নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে পাশ্চাত্যে সাহিত্যের ভাষা এবং প্রকাশনার ভাষা ক্রমশ এক বিন্দুতে মিশে যেতে থাকে। প্রকাশকরা তখন ক্রমাগত তাদের প্রকাশ-করা কয়েকটি বাছাই বইকে ‘মাস্টারপিস’ আখ্যা দিতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগে তখন ‘লিটারারি’ বা সাহিত্যানুগ শব্দের মতো ‘মাস্টারপিস’ শব্দটিও বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা দর্শকে পরিণত হলাম, দেখলাম সাহিত্য প্রকাশনা বিষয়টি উপন্যাসের আনুষ্ঠানিক
প্রকাশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, উপন্যাস মাধ্যমটি ‘মার্কেট অ্যাক্টিভিজ্ম’ বা বাজারের সক্রিয়তায় রাহুগ্রস্ত। ঔপন্যাসিককে এত দিন যে ভাবে বিচার করা হতো, তার সাহিত্য কর্মের মূল্যায়ন এবং সম্মান করা হতো, আগ্রাসী এজেন্ট ও প্রকাশকেরা সেই মানচিত্র ভেঙে দিতে থাকেন। সাংস্কৃতিক পুঁজির চেয়ে জাগতিক পুরস্কারই তাদের কাছে আশাপ্রদ হয়ে ওঠে। লেখকদের অবদানও কম নয়। অ্যান্ড্রু ওয়াইলি যে ভাবে সালমান রুশদির উপন্যাস ‘দ্য স্যাটার্নিক ভার্সেস’ কেনেন, রুশদি তার সাবেক এজেন্টকে ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, তা প্রকাশনা-বাজারের অতিসক্রিয়তার উদাহরণ। লন্ডনে অনেক এজেন্টের সাক্ষাৎকার নিয়ে বিক্রম শেঠ যে ভাবে তার উপন্যাস ‘আ স্যুটেব্ল বয়’-এর জন্য জাইলস গর্ডনকে বেছে নিলেন, সেটিও আর এক মোক্ষম উদাহরণ। ‘দি ইনফরমেশন’ উপন্যাস প্রকাশের জন্য মার্টিন অ্যামিস যে ভাবে নতুন এজেন্ট ও প্রকাশককে বেছে নিলেন, হারপার কলিন্স প্রকাশনার তৎকালীন সম্পাদক পঙ্কজ মিশ্র অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসকে আবিষ্কার করা সত্ত্বেও ডেভিড গডউইনের মতো এজেন্ট ভারতে উড়ে এসে লেখিকার থেকে সেই উপন্যাসের প্রকাশ-স্বত্ব কিনে নিলেন, সে সবই এই নতুন বাজারি সক্রিয়তার অবদান। এই উদাহরণগুলি মনে করিয়ে দেয় যে, বাজারের অতিসক্রিয়তার সঙ্গে ‘নতুন সাহিত্য’ আবিষ্কার কী ভাবে সংযুক্ত! অরুন্ধতীর উপন্যাস নিয়ে পঙ্কজের উত্তেজনা প্রাথমিক ভাবে সাহিত্যবোধ থেকে শুরু হয়, কিন্তু ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি সক্রিয় প্রকাশনা বাজারেরই উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। গত দু’দশক ধরে এই সব উদাহরণ যে ভাবে আমাদের সাহিত্যপাঠের অভ্যাস গড়ে তুলছে, তার প্রতিক্রিয়ায় আজ সাহিত্যিক সক্রিয়তা বা ‘লিটারারি অ্যাক্টিভিজ্ম’-এর অবস্থান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। সাহিত্যিক বা সাহিত্যানুগ সক্রিয়তা কী? ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার পর আজকের দুনিয়ায় প্রকাশনা সংস্থা ও বড় বড় বইয়ের দোকানের ‘চেন’গুলি, এমনকী বই জিনিসটি, যা কিছু ছিল বাজারি সক্রিয়তার প্রতীক, আজ অন্তিম দশায়। গত দুই দশক ধরে অত্যন্ত সক্রিয় এক বাজারি বয়ান আর অতি-পুরাতন সাহিত্য মূল্যায়ন ক্রমে মিলেমিশে একাকার। তবু এখনও আমরা সাহিত্যের কথা বলি, এই পরিবেশেই আমাদের পড়া এবং লেখার অভ্যাস চালিয়ে যেতে হয়। বলিষ্ঠ সমালোচনার নতুন প্রতর্ক আজও অনুপস্থিত। তা হলে সাহিত্যের সক্রিয়তা আমাদের দৃষ্টি কোন দিকে টানতে চায়? কী তার উদ্দেশ্য? সে কি শুধুই অতিসক্রিয় বাজারের প্রাথমিক সাফল্য ও ইদানীংকার ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া? লেখালিখি এবং প্রকাশনা জগতে নতুন দৃষ্টির উন্মেষ? উদাহরণ, ভারতে ডেভিড গডউইনের আসা আর নবীন কিশোরের জার্মানি যাত্রার তফাৎ। গডউইনের প্রয়াস লেখক ও এজেন্টের জয়ধ্বনিতে পর্যবসিত হয়। আর কলকাতার ‘সিগাল’ প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার নবীন কিশোর জার্মানি গিয়ে সুরকাম্পের পেট্রা হার্ডটের থেকে টমাস বার্নার্ডের মতো লেখকদের বিশ্বাস অর্জন করে কম অর্থমূল্যে তাদের রচনার স্বত্ব কেনেন। এজেন্ট ও লেখককে নিয়ে উন্মাদনা নয়, বরং বিশ্বাসের জয়ধ্বনিই কি এ ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে ওঠে না? সাহিত্যিক সক্রিয়তা বা লিটারারি অ্যাক্টিভিজম কী সাহিত্যিকের সাবেক পৃষ্ঠপোষণার এক নতুন প্রয়াস? যাদের লেখা তুলে ধরা হবে, সেই লেখকরা এই নতুন পরিস্থিতিতে কী ভাবে মানিয়ে নেবেন? নতুন সাহিত্যের উন্মেষেই বা কেমন হবে সাহিত্যের সক্রিয়তা? বাজারের অতিসক্রিয়তা থেকে সৃষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে কী ভাবেই বা ঘটবে তার মিলন কিংবা বিচ্ছেদ? দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমটি দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্প লেখক জোয়ি উইকম্বের সাহিত্যিক উত্থানে তার স্বদেশীয় সমালোচক ডেরেক অ্যাট্রিজের ভূমিকা। অ্যাট্রিজের সমালোচনা উইকম্বের সাহিত্যকৃতির পুনর্মূল্যায়নের জন্য যে ভাবে সওয়াল করেছে, তার ফলেই গত পাঁচ বছর ধরে লেখিকাকে নিয়ে পাঠকমহলে ফের নতুন আগ্রহের সঞ্চার। অথচ এই আগ্রহ শুধুই নতুন সাহিত্যের প্রকরণ নয়। উইকম্বকে নিয়ে অ্যাট্রিজের আলোচনা কোনও জাতীয়তাবাদী (দক্ষিণ আফ্রিকার) বা উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রকল্পেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। উইকম্ব এবং আট্রিজ দু’জনেই যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা। তবু উইকম্বকে নিয়ে অ্যাট্রিজের আলোচনা নিছক ‘লিটারেচার অব মাইগ্রেশন’সর্বস্ব নয়। উইকম্ব যে ভাবে দীর্ঘকালীন বিভ্রম, শৈল্পিক সম্ভ্রান্তি, দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্যের ইতিহাস, দেশছাড়া হওয়া এবং অ্যাট্রিজের চিন্তাভাবনার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, সেই চলমান চিন্তাধারায় রয়েছে ‘লিটারারি’ শব্দটিও। উইকম্বকে অ্যাট্রিজ এমন ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্যের ইতিহাসে চলমান ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে দেন। এই চলিষ্ণুতাই সাহিত্যানুগ সক্রিয়তার বয়ান, উইকম্বের উদাহরণ সেটিই সামনে নিয়ে আসে। দ্বিতীয় উদাহরণে নিজের কথা বলতে কিঞ্চিৎ বাধ্য। ২০০৮ সালে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের পিটার ডি ম্যাকডোনাল্ডের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলাম, পরের বছর কবিতার অধ্যাপক হিসেবে যেন কবি, নিবন্ধকার ও সমালোচক অরবিন্দকৃষ্ণ মেহরোত্রাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। মেহরোত্রার কথা একটি কারণেই ভেবেছিলাম। আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক ভারতীয় লেখকের ছকবাঁধা পরিচয়ে তাকে বাঁধা যায় না। তার সমালোচনা বরং চলতি ধারণার ওলটপালট ঘটায়! ম্যাকডোনাল্ডও আমার সঙ্গে একমত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে বেঞ্জামিন জেপেনায়া যখন ওই ‘প্রোফেসর অব পোয়েট্রি’ পদে সেমাস হিনির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন, হাসির উদ্রেক হয়েছিল। কিন্তু অরবিন্দকৃষ্ণ মেহরোত্রার মনোনয়ন হাসির জন্য নয়। আমরা একটা ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলাম। হারজিতটাও বড় কথা নয়। জয়ের ধারণা নিছক প্রান্তিক। সেই প্রান্তিকতায় দাঁড়ানোর প্রবল অভিঘাতে অরবিন্দকৃষ্ণ মেহরোত্রার মতো কসমোপলিটান লেখককে ফের পেশ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সাহিত্যমূলক বা সাহিত্যানুগ শব্দগুলির মতো তাই সাহিত্যানুগ সক্রিয়তাতেও এক আশ্চর্য বিষাদ আছে। বাজারের সক্রিয়তায় মুক্ত বাজারের পারম্পর্যহীনতা ও তাৎক্ষণিক অভিঘাত আছে। সাহিত্যানুগ সক্রিয়তা সে রকম নয়, তার মূল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। শুধু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাঙালি পড়ুয়ার কাছে সাহিত্যের সক্রিয়তা নিয়ে আসতে পারে অন্য মাত্রা। চল্লিশ বছর আগেও কোনো জার্মান, উর্দু, ফরাসি বা বাঙালি লেখক ইংরেজি ভাষার এই রমরমা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারতেন না। বিশ্বায়ন, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বিশ্বায়িত দুনিয়া তৈরিতে মার্কিন প্রভাব থেকেই আজকের ইংরেজি-প্রাধান্য। কিন্তু বিশ্বায়ন শুধু ইংরেজি ভাষার জয়জয়কার নয়। সে নতুন কিছু প্রতর্কেরও জন্ম দেয়, যার মাধ্যমে আমরা অনায়াসে আজ সাহিত্যের কথা ভাবি: উপন্যাসের কেন্দ্রিকতা; কবিতার প্রান্তগামিতা; আধুনিকতা ও সাহিত্যের ইতিহাসের পরিবর্তে পরিচিতি ও সংস্কৃতির ফারাক দিয়ে ভাবা; এমনকী অজ্ঞাতসারে বাজারকে সাহিত্যের একমাত্র প্রকরণ ভাবা। এই নতুন, প্রভাবশালী ছকের বাইরে কী ভাবে বেরিয়ে আসা যায়? ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার লেখক, পাঠক, প্রকাশকদেরও এ নিয়ে চিন্তার সময় এসে গিয়েছে। ‘আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি’ ধরনের আত্মপরিচিতি বা জাতীয়তার ছকে উত্তরটি ভাবলে নিশ্চয় চলবে না। সে সব বিশ্বায়ন নামক মুদ্রারই অন্য পিঠ। বাঙালিকে আবার সাহিত্যের পক্ষে বা বিপক্ষে তর্ক করতে হবে, ‘বাঙালি মানে’ গোছের কোনো স্থির, নিশ্চল ধারণায় আটকে থাকলে হবে না। এখানেই অন্তঃশীল ভঙ্গিতে চলতে পারে আন্তর্জাতিক কথোপকথন। তারই অন্য নাম সাহিত্যিক সক্রিয়তা।
No comments:
Post a Comment