Wednesday, May 13, 2015

লেখক যখন বিয়ের কনে :নতুন বার্তা

আমার বিয়ে হয়েছিল বেশ নাটুকে ঢঙে। তাতে খানিকটা রহস্য-রোমাঞ্চের মিশেলও ছিল। অবশ্য, ষাট-সত্তরের দশকে এমন বিয়ে তেমন কিছু বিরল ঘটনা নয়। তখন আমি সদ্য কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে। ওই বয়সে যেমন হয়, যুক্তির থেকে আবেগের তাড়নাই বেশি। আর, সেই ষাট-সত্তরের দশকে আমরা বোধহয় একটু অপরিণতমস্তিষ্কও ছিলাম, হৃদয়টাকে অকারণে একটু বেশি গুরুত্ব দিতাম। প্রেম মানেই তখন ছিল এক ধরনের কমিটমেন্ট, ডেবিট-ক্রেডিট কষা নয়। সেই জোলো আবেগের জ
োয়ারে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ একদিন মনে হল, আঠারো বছর বয়স হয়েছে, এখন আমি প্রাপ্তবয়স্ক। সুতরাং, এখন আমার পাড়াতুতো প্রেমিকটিকে বিয়ে করে ফেলতেই পারি। বাড়ি থেকে এ বিয়ে দেওয়ার কণামাত্র সম্ভাবনা নেই, অতএব কাজটি সারতে হবে অতি গোপনে। কী করা যায়? কী ভাবে করা যায়? অং বং চং মন্ত্র পড়ে বিয়ে করার প্রতি আমার কোনো কালেই তেমন একটা মোহ ছিল না। সম্প্রদান, পাণিগ্রহণ সম্পর্কে খানিক ভাসা-ভাসা ধারণা ছিল বটে, তবে, সে-ধারণাও মোটামুটি বিরূপই। আস্ত একটা মেয়েকে কারও কাছে দান করা হচ্ছে, ভাবা যায়! তা ছাড়া, যুগটাও তখন ছিল নিয়ম ভাঙার। বড়দের অগ্রাহ্য করার। অতএব, চুপিচুপি রেজিষ্ট্রি করাই স্থির হল। সেইমত নোটিসও পড়ে গেল রেজিষ্ট্রি অফিসে। নোটিসটা অবশ্য রেজিষ্ট্রারকে পটিয়ে-পাটিয়ে ব্যাকডেটে করা হয়েছিল। বিয়ের দিন বিনুনি দুলিয়ে, চটি ফটর-ফটর করতে করতে, অতি সাধারণ শাড়ি পরে, বইপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হ্যাঁ, অবশ্যই কলেজ যাওয়ার নাম করে। প্রেমিকপ্রবর বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছিলেন। আমি পৌঁছতেই ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেজিষ্ট্রি অফিস। সেখানে এক জগঝম্প ব্যাপার চলছে। আমার এক পাতানো দাদাকে আগে থেকেই বলা ছিল, পাছে সাক্ষী কম পড়ে, সেই আশঙ্কায় দাদাটি কলেজ থেকে ঝেঁটিয়ে তার সহপাঠীদের তুলে এনেছে। তারা একটা সই করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করার জন্য রীতিমত ডনবৈঠক দিচ্ছে অফিসের বাইরে। বিয়ের আগে আমি তাদের কখনও দেখিনি। বিয়ের পরেও আর কোনওদিন তাদের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়নি। তবে, মনে রাখতে হবে, তারাই ছিল সেদিন কন্যাপক্ষের প্রতিনিধি। সইসাবুদ করে বিয়ে তো হয়ে গেল, এবার ভোজনপর্ব। সকলের পকেট কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটা ফান্ড মতো তৈরি করা হল। তাই নিয়ে ছোট্ ছোট্ ছোট্ পাশের রেস্টুরেন্টে। আহার বলতে একটা করে মোগলাই। মিষ্টিমুখ বলতে এক কাপ চা। ব্যস। খানা খতম। এর পর বাড়িতে জানাজানি, প্রাথমিক ভাবে বাবার অর্ধচন্দ্রদান-এসব প্রসঙ্গ উহ্যই থাক। শুধু বলতে পারি, তখনও আমি সেভাবে সাহিত্যের সংস্পর্শে আসিনি। লিখতাম বটে অল্পস্বল্প, তবে সেসব নেহাতই বালখিল্য ব্যাপার। ক্লাস সিক্সে প্রেমের গল্প লিখে স্কুলবাসে যেতে যেতে সহপাঠিনীদের পড়ে শোনালাম, তারা দারুণ রোমাঞ্চিত হল। একটা ভীষণ দুঃখের গল্প লিখে ভাইবোনদের চেপে ধরে শোনালাম, তারা ফোঁপাতে লাগল। দু’টাকা দামের বাঁধানো খাতায় লেখা সেই সব গল্প-কবিতাকে আর যাই হোক, সাহিত্যপদবাচ্য বলা যায় না। সুতরাং, লেখকদের বিয়ের প্রসঙ্গে আমার বিবাহ সংক্রান্ত কাহিনী নিতান্তই গৌণ। এ বিয়েটাকে বড়জোর একটা এঁচোড়ে পাকা মেয়ের ডেঁপোমিই বলা যায়, তার বেশি কিছু নয়। সত্যিকারের লেখকদের বিয়ে কেমন হয়? একটা স্পেশাল বিয়ের কথা বলি। দিনটা পনেরোই জানুয়ারি, সাল দু হাজার এক। সন্ধেবেলা। দক্ষিণ কলকাতার সিংহিবাড়ির পুষ্পতোরণের সামনে চলছে রই রই কাণ্ড। ভিড় জমিয়েছেন খবরের কাগজের সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহকের দল। টিভি ক্যামেরাও সদলবলে হাজির। সকলেই ছটফট করছেন সিংহিবাড়ির অন্দরে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু, আজ ওই বাড়িতে প্রচারমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সাংবাদিককুল ক্রমশ অধৈর্য, হতাশ, বিমর্ষ ও উত্তেজিত। রাগ-রাগ গলায় দাবিও পেশ করছেন অনেকে। ভেতরে তাঁদের ঢুকতে দিতেই হবে। জনাকয়েক অত্যুৎসাহী সাংবাদিক ছুটলেন সিংহিবাড়ির লাগোয়া এক নির্মীয়মান বহুতলে। যদি সেখান থেকে কোনও ভাবে ভেতরের অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করা যায়। হা হতোস্মি! সে উপায়ও নেই। দুখানা কেঁদো ল্যাব্রাডর লেলিয়ে দেওয়া হল তাঁদের দিকে। মুক্তকচ্ছ হয়ে পালিয়ে বাঁচলেন সাংবাদিকরা। হ্যাঁ, এক লেখকেরই বিয়ে তখন চলছিল সিংহিবাড়িতে। হেঁজিপেজি লেখক নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক ঝুম্পা লাহিড়ী (লেখিকা নয়, লেখকের লিঙ্গভেদে আমি বিশ্বাস করি না), সদ্য পুলিৎজার এবং হেমিংওয়ে পুরস্কার প্রাপ্তির সুবাদে যিনি কিনা এখন খবরের শিরোনামে। বর গুণী মানুষ হলেও তুলনায় সাদামাটা। গ্রিক-স্প্যানিশ-আমেরিকান, টাইম পত্রিকার লাতিন সংস্করণের উপ-সম্পাদক তথা ঝুম্পার ‘স্টেডি বয়ফ্রেণ্ড’ আলবার্তো ভুরভুলিয়াস। নামী লেখকের বিয়ে বলেই কি সাংবাদিককুলের এত আগ্রহ ছিল সেদিন? হয়তো মুখ্য কারণ সেটাই ছিল। তবে, গৌণ কারণও ছিল কিছু কিছু। কনের জন্ম ইংল্যাণ্ডে, শিক্ষাদীক্ষা আমেরিকায়, সংসার পাতবেন নিউ ইয়র্কে, অথচ তিনি বিয়েটা করতে এসেছেন কলকাতায়, তাঁর দীর্ঘকাল প্রবাসী বাবা-মার দেশে— এটাও তো খবর। ঝুম্পা তাঁর সাহেব বরকে বিয়ে করছেন সম্পূর্ণ হিন্দুশাস্ত্র মতে, নিখাদ বাঙালি প্রথায়। বিয়ের আগে আইবুড়ো ভাত হয়েছে, বিয়ের দিন সকাল থেকে উপোসও করেছেন বর-কনে, ভোরবেলা দধিমঙ্গল হয়েছে, গায়েহলুদ, মালাবদল, হোমযজ্ঞ, সম্প্রদান, সপ্তপদী- কিছুই বাদ পড়েনি। সম্প্রদানের সময়ে কন্যার কাকা জামাতার জানু স্পর্শ করে বলেছেন, ‘অর্চয়িষ্যামো ভবন্তম্’ (আমি আপনাকে অর্চনা করছি)। ধূতি-পাঞ্জাবি-টোপর শোভিত সাহেব বর অনুমতি দিয়েছেন, ‘ওম্ অর্চয়’। এর পরই শাস্ত্রমতো ভাবী জামাতার হাতে ‘সবস্ত্রা সালংকারা এবং পণযৌতুক’ সহ কন্যাকে অর্পণ করার মন্ত্র পড়েছেন সম্প্রদাতা। বলেছেন, ‘সহোভৌ চরতাং ধর্মমিতি বাচানুভাষ্য চ’ (তোমরা দুজনে একত্র হয়ে ধর্মাচরণ করো)। পাণিগ্রহণের কালে আলবার্তো ভুরভুলিয়াস বলেছেন, ‘মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু মম চিত্তমনু চিত্তং তেহস্তু’ (আমার ব্রতে তুমি তোমার হৃদয় ধারণ করো; তোমার চিত্ত আমার চিত্তের অনুগামী হোক)। ঝুম্পার বিয়েতে স্ত্রী-আচারও পালিত হয়েছে নিয়ম মতোই, যেমন আর পাঁচটা বাঙালির বিয়েতে হয়। এমনকী, নাপিতের খেউড়ও বাদ যায়নি। পিঁড়ি উঁচুতে তুলে, বর বড় না কনে বড়-র প্রতিযোগিতায় জিতে রীতিমত উল্লসিত হয়েছেন লাল বেনারসী-সজ্জিতা ঝুম্পা। আদ্যন্ত বিদেশি হাওয়ায় লালিত-পালিত, ইংরিজি ভাষায় সাহিত্য রচনার সুবাদে বিখ্যাত, বাঙালি লেখকের দেশজ সংস্কৃতির ওপরে এই টান সংবাদপত্রকে তো আকৃষ্ট করবেই। ক’জন লেখকই বা বিয়ে করার স্বাভাবিক বয়সে এমন বিরল খ্যাতির অধিকারী হন? একটি মাত্র গল্পগ্রন্থ লিখে এত নামডাকই বা হয় ক’জনের? সাহেব বরকে বিয়ে করতে ঝুম্পা লাহিড়ীর এই যে কলকাতায় আগমন, এর পিছনে কতটা পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতি টান, কতটাই বা পাশ্চাত্যের মানুষদের প্রাচ্য রীতিনীতি দেখানোর লেখক-সুলভ খেয়াল, তা বুঝে ওঠা কঠিন। তাঁর মতো সেলিব্রিটি বর-সমেত কলকাতায় গাঁটছড়া বাঁধতে এলে সংবাদমাধ্যম যে পতঙ্গের মতো ধেয়ে যাবে, এ কথা জেনেও কেন যে তিনি বিয়ের আসরে স্থানীয় সাংবাদিকদের অচ্ছ্যুৎ করে রাখলেন! হিন্দু বিয়ে যে একান্তভাবেই পুরুষতান্ত্রিক, সংস্কৃত মন্ত্রের অনেকগুলিই যে নারীর পক্ষে অবমাননাকর, এ তথ্যও আধুনিক মনস্ক ঝুম্পার অজ্ঞাত কি না, তা নিয়েও তর্ক উঠতে পারে। তবে, একটা বিষয় স্বতঃসিদ্ধ। লেখকদের বিয়ে নিয়ে পাঠকের মনে, বিশেষত সাহিত্যানুরাগী মহলে, কৌতূহল একটু থাকবেই। যাঁদের কলমের আঁচড়ে নরনারীর জীবনের সুখদুঃখের মুহূর্তগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে, দেশ-সমাজ-সংসারের ভাঙাগড়া নতুন মাত্রা পায়, তাঁরা কীভাবে নিজেদের ঘর বসাচ্ছেন, তা জানতে পাঠকের আগ্রহ জাগতেই পারে। আর, লেখক যদি নারী হন, সেক্ষেত্রে আগ্রহটা আর একটু বেশিই হবে। বিয়ের ধরনধারন সম্পর্কে তাঁদের চিন্তাভাবনা কী রকম, জানার ইচ্ছে তো হতেই পারে। অবশ্য, তার মানে এই নয়, নারী-লেখকদের বিয়েতে ঝুম্পা লাহিড়ীর বিয়ের মতো কোনও না কোনও বিশেষত্ব থাকবেই। কিংবা চমকদার কোনও ঘটনা ঘটবেই। যেমন ধরা যাক আশাপূর্ণা দেবীর কথা। এই মহীয়সী সাহিত্যিকের বিয়ে হয়েছিল মাত্র পনেরো বছর বয়সে। আর পাঁচটা বিয়ের মতোই সম্বন্ধ করে। যথারীতি শাস্ত্রমতে। আশাপূর্ণার বিয়ের আগে থেকেই লেখালিখির অভ্যাস ছিল, পাত্রপক্ষ জানতেনও সে কথা, বিয়ের পরেও তাঁর সাহিত্যসাধনায় কোনও দিনই এতটুকু ব্যাঘাত ঘটেনি। লেখালিখিতে তাঁকে সব চেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। শুনেছি, বিয়ের পর যখন বরপক্ষের গাড়িতে মেয়ের সব জিনিসপত্র উঠছে, তখন তার মধ্যে দেখা গেল, রয়েছে একটা বেশ ভারী বাক্স। কী আছে ওতে? না, মেয়ে পড়তে খুব ভালবাসে, তাই বই...। শুনে শ্বশুরমশাই বুঝি একটু বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, অমনি পাশ থেকে এক ভরাট কণ্ঠস্বর— না, ওটাও যাবে। কণ্ঠস্বরটি স্বয়ং আশাপূর্ণার স্বামীর। আর একটি ঘটনাও ঘটেছিল আশাপূর্ণার বিয়েতে। বিয়ের দিন হঠাৎই কী ভাবে যেন তাঁর জন্যে কেনা দামি বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নাটা ভেঙে যায়। পরদিন ফের অঘটন। শাঁখা পরানোর সময়ে পুট করে ভেঙে গেল হাতের শাঁখাটা। পর পর দু-দুটো অলুক্ষণে কাণ্ড, আশাপূর্ণার মার তো মুখ শুকিয়ে আমসি। কিন্তু, আশ্চর্য, পনেরো বছরের কনেটি সেদিন এতটুকু বিচলিত হননি। ওই বয়স থেকেই তাঁর মনে কুসংস্কারের কোনও স্থান ছিল না। পাক্কা চুয়ান্ন বছর পরিপূর্ণ সুখী দাম্পত্য-জীবন যাপন করেছেন আশাপূর্ণা দেবী। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য গল্প-উপন্যাসে সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে। প্রথানুগ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও প্রেমহীন, নারীর অধিকারহীন একপেশে, আচারসর্বস্ব বিবাহানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে কলম ধরতে একবারের জন্যেও তাঁর হাত কাঁপেনি। উল্লেখ্য, ঝুম্পা লাহিড়ীর গবেষণার বিষয় ছিলেন আশাপূর্ণা।    

No comments:

Post a Comment