আওয়ামী লীগে কোন্দল বাড়ছে স্টাফ রিপোর্টার টাইম নিউজ বিডি, ১৫ জুন, ২০১৫ ১৭:০৩:৩০ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিরোধী দল সক্রিয় না থাকায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত নানা সুযোগসুবিধা বাগিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে দলটির মধ্যে খুনোখুনি ও কোন্দল বাড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আরও বলছেন, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ
্বের দেশে পাওয়া না- পাওয়া থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ, অন্তর্কলহ থাকবে,এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে এটা আওয়ামী লীগের মধ্যে এটা মাত্রাতিরিক্ত। কারণ আওয়ামী লীগের এখন কোনো দলগত প্রতিপক্ষ নেই। দলটির কোনো কোনো নেতার সময় ব্যয় হয় ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে। ফলে তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। কারণ রাজনৈতিক শক্তির ধারা কখনো নিষ্ক্রিয় থাকে না। তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজবাহ্ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘আমাদের দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, কোন্দল নাই।’ সত্যিকারের বিরোধী দল না থাকায় তাঁদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন তিনি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট তথ্যমতে, গত ছয় বছরে (২০০৯-১৪) সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অন্তত ১৭২ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও চরমপন্থীদের হাতে খুন হয়েছেন আরও ৭৪ জন। ২০০৯ থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেও দলটি এই ২৪৬ নেতা-কর্মীকে রক্ষা করতে পারেনি। এসব হত্যার পাশাপাশি দলীয় কোন্দলে সৃষ্ট সংঘর্ষে ছয় বছরে আহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৬৯১। এঁদের প্রায় সবাই সরকারি দলের নেতা-কর্মী। এই সময়ে নিজেদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১১১টি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ২৫ জন নেতা খুন হয়েছেন। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, জেলা সম্মেলনগুলোতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সংঘর্ষ হয়েছে ৩০টিরও বেশি। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া আর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মানসিকতা এসব ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধের কারণেও হানাহানি ঘটছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দেশের বিভিন্ন সাংগঠনিক প্রায় সব জেলায় নানা ধরনের কোন্দল রয়েছে। মূলত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়েই বেশির ভাগ কোন্দল। সর্বশেষ ২ জুন মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আতিক মাতবর এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য ইব্রাহিম শিকদারের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী আরশাদ মাতবর (৩৬) ও মুদি ব্যবসায়ী শাহজাহান দরানী (৪০) নিহত হন। গত ৩১ মে রোববার রাজধানীতে এক মতবিনিময় সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের সামনেই দ্বন্দ্বে জড়ান ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হক ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ সাবিনা আক্তার তুহিন। একে অপরকে হুমকি-ধমকিও দেন। মিরপুরে বিএনপির নেতা এস এ খালেক দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। ফলে সেখানে এখন সরকার দলীয়দের মধ্যে একচেটিয়া আধিপত্য। কুমিল্লা সদর দক্ষিণে মুজিবুল হক, আফজল খান ও আ ক ম বাহাউদ্দিনের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। জানা গেছে, এটি আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে। সেখানে নেতাদের দ্বন্দ্বের জের ধরে গত ২৯ মে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সাংসদ বাহাউদ্দিনের ভাতিজা নিহত হয়েছেন। সেখানে বিএনপির কোনো কর্মকাণ্ড নেই। অধিকাংশ নেতা ঢাকায় থাকেন। গত ১০ মে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন। সাতগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াদুদ মিয়া ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইব্রাহীম ইবুর সঙ্গে চলা দীর্ঘদিনের বিরোধের জেরে এ সংঘর্ষ হয়। ২ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ও ময়মনসিংহ পৌর মেয়র একরামুল হকের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। ফরিদপুর জেলায় আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলমের (ভোলা মাস্টার) দ্বন্দ্বে ফরিদপুর জেলার নেতা-কর্মীরা রয়েছেন দুই মেরুতে। গত কয়েক বছরে উভয় পক্ষের কর্মী সমর্থকেরা আগাম ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষের প্রস্তুতি নেয় কয়েকবার। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন মেজর (অব.) আবদুল হালিম। অন্যদিকে সদর আসনে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। ফরিদপুরের বিএনপির শীর্ষ নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ নিষ্ক্রিয়। সেখানে বিএনপির কোনো কার্যক্রমই নেই। যশোর-৩ আসনের সাবেক সাংসদ আলী রেজা রাজু, খালেদুর রহমান (টিটো) ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব রয়েছে। গত বছরের ১৮ জুন দলীয় প্রতিপক্ষের গুলি ও বোমায় আহত সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে আলমগীর এ ঘটনার জন্য টিটো গ্রুপকে দায়ী করেন। বর্তমানে চিত্র পাল্টেছে। এখন নতুন গ্রুপ যশোরের নবনির্বাচিত সভাপতি শহিদুল ইসলাম (মিলন) ও যশোর-৩ আসনের সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদ। এই গ্রুপের সঙ্গে এখন শাহীন গ্রুপের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর নিজ দলের প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও ফুলগাজী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে খুন হন চীন শাখা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদুল আলম, রাঙমাটির রাজস্থলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মংক্য মারমা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে এমন খুনের ঘটনা ঘটছে। এসব অন্তঃকলহের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়ে তাঁদের দলীয় ফোরামে আলোচনা হয় না। পত্র-পত্রিকায় যেটা প্রকাশিত হচ্ছে সেটা দেখে অনেক সময় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের ঢাকায় অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগে তাঁদের প্রভাব না থাকায় কোন্দল কমে না। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন মধ্যম সারির নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের কথা থেকে বোঝা যায়, তাঁদের প্রতিদিনের কাজ, নিজ ও আশপাশের এলাকায় কোথাও দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি, কোথায় টিআর, কাবিখা, প্রতিবন্ধী, ওএমএস ডিলার নিয়োগ, গভীর নলকূপ অপারেটর নিয়োগ হচ্ছে কি না এ সবের খবর নেওয়া। যেহেতু বিরোধী দলের কোনো আন্দোলন নেই। ফলে ভাগ-বাঁটোয়ারার হিসাব নিকেশ নিয়ে সময় কাটে তাঁদের। আর একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একাধিক ভাগীদার থাকলে অন্তর্কলহ ও সংঘর্ষ হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, অনেকে অনেক ধরনের কথা বলতে পারেন। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে সত্যিকারের বিরোধী দল না থাকা। তাঁর মতে, দল ক্ষমতায় থাকলে থানা-পুলিশ ওই দলের কর্মীরা অপরাধ করলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এটাই বাস্তবতা। বিরোধী দল থাকলে চাপের মুখে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়, এলাকাতে ভারসাম্য তৈরি হয়। কিন্তু সব এলাকায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা কারাগারে ও মামলার ভয়ে আত্মগোপনে থাকায় তাঁদের নেতা-কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, এসব কথা তাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বলতে ভয় পান। গণমাধ্যমই তাঁদের ভরসা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানূর রহমান শেলী বলেন, ‘বিরোধী দলের প্রতিরোধ প্রবল না থাকলে ক্ষমতাসীন দল প্রভাব-প্রতিপত্তি ঘটাবে, এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগও এর বাইরে নয়।’ তিনি বলেন, ‘বিরোধী দল আছে। কিন্তু সত্যিকারের বিরোধী দল না থাকায় একটি দেশে যে যে রাজনৈতিক সমস্যা হওয়ার কথা, এখন আমরা সেটাই দেখতে পাচ্ছি।’ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পরাজিত হয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ক্যাম্পাসগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ছাত্রলীগ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রদল ও অন্য বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, ক্যাম্পাস কিংবা হলগুলোয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমেদ এ ব্যাপারে বলেন, ‘বিরোধী দলের ওপর মামলা-হামলা হচ্ছে। তাদের আন্দোলনের কোনো জায়গা দেওয়া হচ্ছে না। সমালোচনা না হলে সরকারি দলের অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রলুব্ধ হয়। ফলে সরকারি দলের মধ্যে অন্তর্বিরোধ হতে বাধ্য।’ তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ‘দলীয় কোন্দল সত্যিকারের বিরোধী দল থাকা, না থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত না। আওয়ামী লীগের কোন্দল অতীতের তুলনায় বাড়েনি। বড় দল হওয়ায় অনেকে বঞ্চিত হতে পারেন, সেটা নিয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু কোন্দল নেই।’সূত্র:প্রথম আলো এসএইচ
No comments:
Post a Comment