আরব বিশ্ব-ওবামা সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ মো: কামরুজ্জামান বাবলু টাইম নিউজ বিডি, ১৪ মে, ২০১৫ ০১:৫৬:৫৩ ছয় উপসাগরীয় দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দুই দিনের সম্মেলন থেকে কী অর্জন হতে যাচ্ছে এই মুহুর্তে বিশ্ববাসীর সতর্ক দৃষ্টি সেদিকেই। বুধবার (১৩ মে ২০১৫) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের অদূরে ক্যাম্প ডেভিড অবকাশ কেন্দ্রে এই সম্মেলন শুরু হয়। গত এপ্রিলে জাতিসংঘের নিরাপ
ত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র জার্মানকে সাথে নিয়ে ইরানের সাথে একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষর করে। আর এরই পটভূমিতে পাঁচ উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার এই সম্মেলন ডাকা হলো। ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইরানকে তার পারমানবিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা এবং এর বিনিময়ে দেশটির ওপর দীর্ঘদিন ধরে আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়া। তবে, ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তির ব্যাপারে ওবামা প্রশাসনের কাছে উপসাগরীয় দেশগুলো আসলে কী চায় তা নিয়ে আলোচনার পূর্বে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরী। আর তা হলো-কেন ওবামা উপসাগরীয় নেতাদের সম্মেলনের দাওয়াত দিলেন? আর এক্ষেত্রে ভেন্যু হিসেবে কেন ক্যাম্প ডেভিডকে বেছে নিলেন? এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্ররা বর্তমানে এই অঞ্চলে মার্কিন নীতির ব্যাপারে যে অসন্তুষ্ট সে ব্যাপারে ওবামা প্রশাসন খুবই সতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে, ইরানের পরমানু কর্মসূচি এবং সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং ইয়েমেন সংকটে আমেরিকার কৌশলী অবস্থানে দীর্ঘদিনের উপসাগরীয় মিত্ররা খুবই অসুখী। পাশাপাশি ফিলিস্তিন এবং আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না আরব মিত্ররা। ধারণা করা হচ্ছে ওবামা তার উপসাগরীয় মিত্রদের কাছে ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির ব্যাপারে খোলামেলা ব্যাখ্যা দিবেন। একই সাথে এই চুক্তির ফলে উপসাগরীয় মিত্রদের জাতীয় নিরাপত্তা যাতে কোনভাবে ক্ষুণ্ন না হয় সে বিষয়ে আশ্বস্ত করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে, বিষয়টি বেশ জটিল কারণ ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত এই ঐতিহাসিক চুক্তিকে বারাক ওবামার মেয়াদের একটি মাইলফলক অর্জন হিসেবেই দেখা হচ্ছে। আগামী বছরে (২০১৬) শেষ হতে যাওয়া নিজ শাসনের ক্রান্তিলগ্নে এসে এমন একটি অর্জনকে নিশ্চয়ই কালিমালিপ্ত হতে দিবেন না বারাক ওবামা। উপসাগরীয় দেশগুলোর মতে, ইরাক এবং ইয়েমেন-উভয় দেশের চলমান পরিস্থিতিতে নাটের গুরু ইরান। এদের অভিযোগ, ইরাক ও ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধ এবং অস্থিতিশীলতাকে উস্কে দিচ্ছে ইরান। সেখানে ইরান তার মিত্রদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে যা গোটা অঞ্চলকে অশান্ত করে তুলেছে। যাই হোক, ক্যাম্প ডেভিডকে সম্মেলনের স্থান হিসেবে বাছাই করা আরব বিশ্বের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ওয়াশিংটন থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এই অবকাশ কেন্দ্রটি সামষ্টিক আরব মনতস্ত্বের ওপর বিশেষ প্রভাব রাখে। ক্যাম্প ডেভিড অবকাশ কেন্দ্রটি স্থায়ীভাবেই যেন “শান্তি আলোচনা” এবং “সমঝোতা”-র সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। এখানেই ১৯৭৮ সালে মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল যার ফল ছিল এক বছরের মাথায় ১৯৭৯ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর যা ঐতিহাসিক “ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি” হিসেবে খ্যাত। এই ক্যাম্প ডেভিডেই আবার ২০০০ সালে ফিলিস্তিন ইসরাইলের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সমঝোতা ভেস্তে যায় এবং নানা কারণে কোন শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানো সম্ভব হয়নি। তাই পাঁচ উপসাগরীয় রাষ্ট্র ও আমেরিকার মধ্যে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের এজেন্ডার ওপরই অনেক কিছুই নির্ভর করছে। এই সম্মেলনে মিত্র দেশগুলোর মধ্যে ভবিষ্যত পরিকল্পনায় কোন কৌশলগত সমঝোতা হয় কীনা তা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক কৌতুহল। তাছাড়া, উপসাগরীয় নেতারা বেশ কিছু প্রশ্ন ও দাবি নিয়েই ওয়াশিংটনে এসেছেন যা ওবামা প্রশাসনের কাছ থেকে আদায় করার চেষ্টা করবেন তারা। কৌশলগত সম্পর্ক ইরানের সাথে: আশা করা হচ্ছে যে আরব নেতারা প্রথমেই যে বিষয়টি ওবামার সামনে উত্থাপন করবেন তা হলো-ইরানের সাথে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে পারমানবিক সক্ষমতার বিষয়টি এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে। তবে, এর অর্থ এটা নয় যে ইরান ও আরব দেশগুলো পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (the Gulf Cooperation Council-GCC) নেতারা অত্র অঞ্চলের অস্থিতিশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নিজেদের অবস্থান অবশ্যই সুসংহত রাখার চেষ্টা করবেন। আর এক্ষেত্রে ইরানকে তার পারমানবিক কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেয়া হলে শান্তিপূর্ণ পারমানবিক প্রযুক্তি উপসাগরীয় দেশগুলোর হাতেও থাকতে হবে। এছাড়া, উপসাগরীয় নেতারা আমেরিকার কাছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি চাইবেন। বর্তমানে উপসাগরীয় দেশগুলোকে তার উত্তরের ইরাক এবং দক্ষিনের ইয়েমেন সীমান্ত এলাকায় অনাকাঙ্খিত নিরাপত্তা ঝুঁকি ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এরমধ্যে ২০০৩ সালে ইরাকে আমেরিকার অনুপ্রবেশের পর থেকেই পরিস্থিতি অবনতির দিকে গড়ায় এবং সেখানে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে। বর্তমানে দেশটির একটি বড় অংশই ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড দ্য লিভান্ট (আইএসআইএল)-এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অপরদিকে, ইয়েমেনেও ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মানসুর হাদিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই গৃহযুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। আর এ পরিস্থিতিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ভেবে সৌদি আরব তার অন্যান্য অনুগত মিত্রদের নিয়ে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যৌথ বিমান হামলা চালায়। দেশটির পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ এবং হুথিদের দুর্বল করে দিয়ে সবাইকে একটি সমঝোতার টেবিলে বসানোর জন্যই সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওই হামলা করা হয়। উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করে ইরাক এবং ইয়েমেন-উভয় দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্যই মূলত ইরান দায়ী। ইরান তার মিত্রদের সমর্থন করতে গিয়ে ইরাক ও ইয়েমেনে অস্থিতিশীলতাকে উস্কে দিচ্ছে যা প্রকারান্তরে গোটা অঞ্চলকেই অশান্ত করে তুলছে। এ পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় নেতারা অবশ্যই ওবামার সাথে সম্মেলনে তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি তুলে ধরবেন এবং অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে ওবামার পদক্ষেপ কামনা করবেন। এছাড়া আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুর সমাধানের বিষয়টিও সম্মেলনের এজেন্ডাতে গুরুত্বের সাথে আলোচিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১১ সালে হঠাৎ করেই সৃষ্ট হওয়া আরব বসন্তের লাগাম টেনে ধরতে আরব নেতারা ওবামার সহযোগিতা চাইবেন। এই আরব বসন্তই সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশরসহ অত্র অঞ্চলকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। কমাতে হবে আমেরিকা নির্ভরতা: গত ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি একটি রোড ম্যাপ তৈরি করেন। সেখানে এই অঞ্চলে কোন ধরনের ঝুঁকি রয়েছে তা তুলে ধরা হয়। ওই রোডম্যাপে বলা হয়, সহিংসতা ও নিপীড়নের নানা ঘটনায় মানুষের মধ্যে হতাশা জন্মলাভ করলেও আরব বিশ্বের যুবশক্তি এখনও একটি স্থিতিশীল, মজবুত ও সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা ক্রমাগত এমনই একটি মধ্যপ্রাচ্যের স্বপ্ন দেখে যেখানে মানবিক মর্যাদাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হবে এবং সুন্দর ও সত্যই হবে ন্যায়বিচারের মূল মানদন্ড। কাতারের আমীর জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সাথে এক আলোচনায় বলেন, অবিচার এবং অস্থিতিশীলতার মূল কারণ খুজেঁ বের করতে হবে। তিনি বলেন, আরব রাষ্ট্রগুলোকে তার সমস্যা সমাধানে পুরোপুরি আমেরিকা নির্ভর হওয়া উচিত নয়। এর পরিবর্তে এসব রাষ্ট্রকে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে যাতে নিজ জনগোষ্ঠীর সেবায় একযোগে কাজ করতে পারে তারা। তিনি বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে মুক্তির আশায় কাজ করছেন এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন তাদের জন্য স্ব স্ব রাষ্ট্রকেই কাজ করতে হবে। নিজেদেরকে পুরোপুরি সক্ষম করে তোলার পরই কেবল আমেরিকার সহযোগিতা কামনা করা উচিত বলেও মত দেন কাতারের আমীর। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে ইয়েমেনে গৃহিত পদক্ষেপ এবং তরুণ সৌদি আমিরদের মধ্যে রাজমুকুটের মালিকানায় পৌছার ক্ষেত্রে নানা নাটকীয় ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বারাক ওবামার কাছে প্রকৃত প্রস্তাবে যে শক্ত বার্তাটি পৌঁছে গেছে তা হলো-“আমরা আমাদের আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে সক্ষম”। তাই এ অঞ্চলে আমেরিকার ভূমিকা হবে “সমর্থক” হিসেবে, “ত্রানকর্তা” হিসেবে নয়। (বি. দ্র. গত ১২ মে ২০১৫ আলজাজিরা ওয়েব সাইটে “What Gulf countries expect from Obama”-শীরোনামে প্রকাশিত বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনের আলোকে এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। আলজাজিরা সেন্টার ফর স্টাডিজ-এর গালফ স্টাডিজ ইউনিটের গবেষক জামাল আবদুল্লাহর লেখা মূল প্রতিবেদনটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন: http://www.aljazeera.com/news/2015/05/150512062229232.html)
No comments:
Post a Comment