ref='http://gold.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=adee8319&cb=INSERT_RANDOM_NUMBER_HERE' target='_blank'> আমি তখন পর্যবেক্ষণ করছিলাম জগলুল ভাইয়ের মগজ। ছড়াকার জগলুল হায়দার। তার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম আজিজ মার্কেটে। হঠাৎ করেই উদ্ভট এ গল্পটা শুরু করলেন তিনি। শুধু গল্পটাই উদ্ভট নয়। তার উপস্থাপনের ঢঙও জমজমাট। এই ‘উদ্ভট’ আর ‘জমজমাট’, দুই শব্দের সমন্বয় হলে যেকোনো আড্ডাই উতলা হয়ে উঠে। জগলুল ভাইয়ের সাথে একটি উতলা আড্ডা মানে, পৃথিবীটাকে একবার চক্কর দিয়ে আসা। আড্ডায় গল্প বলার সময় সবচে বেশি কথা বলে তার চোখ। আর চোখের এ কথাগুলোতেই লুকিয়ে থাকে বিশাল এক শব্দবন। সেটা কখনো লাউয়াছড়ার মতো বর্ষাবন। অথবা সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বন। তবে সব বনেই তার সাবলিল চলাফেরা। হেঁটে যান নিশ্চিন্তে। কখনো পায়ের নিচে শুকনো পাতা গুঁড়িয়ে মুড়ি মুড়কির মতো মচমচে শব্দ তুলে। এ শব্দগুলোতেই লুকিয়ে থাকে কথার মিছিল- বুকের ভেতর কথার মিছিল/ হাজার কথার ঢেউ/ সেই কথাটা আমিই জানি/ আর জানে না কেউ।/ কিছু কথা কষ্ট কথা/ কিছু কথায় তাপ/ কিছু কথায় ক্ষোভ আছে তাও/ নেইকো অভিশাপ।/ কিছু কথা আশার কথা/ কিছু কথায় প্রেম/ কিছু কথায় বানাই নানা/ অভিলাষের ফ্রেম।/ এমনি যতো কথার গোলাপ/ পায় না খুঁজে খেই/ তার সুবাসই ছড়িয়ে দিতে/ কলম হাতে নেই।/ কলমটাকেই কামান ভেবে/ খাতায় বসাই দাগ/ লেখাই আমার বাদ-প্রতিবাদ/ রাগ ও অনুরাগ। উতলা আড্ডাটা চলছিল সেই জগলুল ভাইয়ের সাথেই। তিনি দুই হাতের কব্জি একসাথে করে জারে সাজানো মগজগুলোর আকৃতি বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। মগজগুলো যেন আমার চোখের সামনেই ভেসে উঠল। কী সাঙ্ঘাতিক দৃশ্য ওটা! মৃত মানুষের মগজ। দেখতে কেমন হবে, গরুর মগজের মতোই। তবে মানুষের মগজ আরো একটু মোলায়েম হবে। পরিমানেও কম। একবার ক্রসিং দেয়ার সময় ট্রেনে কাটা এক মহিলার মগজ ছিটকে পড়েছিল আমার জানালায়। ভাগ্যিস জানালার কাঁচ আটকানো ছিলো। কাঁচের সাথে লেপ্টে থাকা থকথকে মগজটাকে বেশি সময় দেখার সুযোগ হয়নি। মুহুর্মূহু আতঙ্কিত পরিবেশের ঠেলায় সিট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। অল্প সময়ের জন্য দেখা সেই মহিলার মগজের কথা ভাবতে শুরু করলাম। পরক্ষণেই মনে হলো, জগলুল ভাইযের গল্পের এ মগজগুলো নিশ্চয়ই দুর্ঘটনায় পতিত লোকের থেঁতলানো মগজ নয়। মৃত্যুর পর পরিপাটি কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলি থেকে অক্ষত মগজগুলোই বের করে আনা হয়েছে। সে যেভাবেই আনা হোক। গল্পটা আগে শোনা দরকার। জগলুল ভাই বললেন- তো সেই চার বন্ধু মগজের জারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বিক্রেতা জানালো এখানে বিভিন্ন পেশার লোকের মগজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। আপনার যেটা প্রয়োজন সেটাই নিতে পারেন। তবে ভালো জিনিস চাইলে অবশ্যই টাকাও বেশি গুনতে হবে। একটি মগজের জার দেখিয়ে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ভাই এটার দাম কত? বিক্রেতা জানালেন, এটা দার্শনিকের মগজ। দাম পড়বে প্রতি কেজিতে ২০ টাকা করে। দাম শুনে বেচারা দার্শনিক বন্ধুটার মুখ একটু কালো হয়ে উঠলো। এতো সাধনার পর পৃথিবীর সকল শাস্ত্রের জনক দর্শনশাস্ত্রের ওপর দখল নিয়েছেন, আর তার মগজের দাম নাকি মাত্র ২০ টাকা কেজি! গল্প শুনে আমি একটু অতিরিক্ত রকমের উতলা হয়ে উঠলাম। আমারও দর্শন শাস্ত্রের ওপর সম্মান ও সম্মানোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। তবে উতলা ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ এই ডিগ্রি দুটো আমাকে নাড়া দিতে পারে না। খুব সহযেই এ দুটো অর্জন করে ফেলেছি তো। সহযে কিছু পেয়ে গেলে সেটার মর্ম বোঝা কঠিন। আমি দর্শন শাস্ত্রে দুই দুটি ডিগ্রি অর্জন করলাম ঠিকই। কিন্তু এর নিগূঢ় মর্ম উদ্ধার করতে পারলাম না। অথচ আমার সহপাঠিরা প্রতিদিন একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো ক্লাস করেছে। নোট তৈরি করেছে। পাঠের প্রয়োজনে বন্ধু ও বান্ধব সমেত আলোচনার দল তৈরি করেছে। জুটিতে জুটিতে বিভক্ত হয়ে থেলিসের প্রাচীন পানি তত্ত্ব থেকে শুরু করে সমকালীন দর্শনের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করেই তবে ছেড়েছে। প্রথম দিকে আমিও কৌতুহলী হয়ে তাদের দলের কর্মকা- উদঘাটন করতে গেলাম। দর্শন শাস্ত্র সম্পর্কে সহজ আলোচনায় লিপ্ত হতে চাইলাম। দেখলাম এমনিতে এরা সহজ ভাষাতেই কথা বলে। কিন্তু দর্শনশাস্ত্র নিয়ে বলতে গেলেই কথাগুলো কেমন খটরমটর হয়ে যায়। সে এক অন্যরকম বাংলা ভাষা। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। একটা বুঝতে পারলে দশটা বুঝি না। আরো অনেক কিছুই বুঝতে পারি না। এরা দর্শন শাস্ত্রের রহস্য উদঘাটনের জন্য পারস্পরিক আলোচনার যে দলটি তৈরি করেছে, সেখানে দেখলাম রসায়ন শাস্ত্রের নিগূঢ় চর্চা। প্রেমের রসায়ন। ছেলে মেয়েরা একসাথে চর্চা করছে। প্রায়োগিক রসায়নের চোটে একেকজন প্রাজ্ঞ দার্শনিকও বনে যাচ্ছে। খুব আহ্লাদ করে পড়ার বিষয় হিসেবে দর্শনশাস্ত্র বেছে নিয়েছিলাম। পাঠ্যসূচিটাও ব্যাপক পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বাংলা ভাষায় দর্শন শাস্ত্রের ওপর লেখাপড়া করতে গিয়েই সাধ চুকে গেল। মনে হল পৃথিবীর সবচে কঠিন ভাষাটাই আমাদের এই মাতৃভাষা। তাই সরাসরি আত্মসমর্পণ করে বসলাম। নিগূঢ় রহস্য উদঘাটনের হাল ছেড়ে দিলাম। পরীক্ষার আট-দশ দিন আগে নীলক্ষেত থেকে সিলেবাস দেখে বই কিনে আনতাম। আগের রাত জেগে বইগুলো একবার পড়ে যেতাম। খটরমটর কিছু শব্দ এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি কাগজের স্লিপে লিখে নিতাম। পরীক্ষার হলে গিয়ে সব উগড়ে দিয়ে মাথাটাকে পরিষ্কার করে নিতাম। তারপর শান্তি। এই চরম খটরমটর বাংলা ভাষার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেও কেন জানি দার্শনিকদের জন্য খুব মায়া হয়। এই বেচারাদেরকে সাধারণ সমাজ তেমন মূল্য দিতে চায় না। কেউ কেউ পাগল বলে আখ্যা দেয়। জগলুল ভাইয়ের এই গল্পটাই তো এর বাস্তব উদাহরণ। একজন দার্শনিকের মগজের মূল্য কোন বিবেচনায় কেজি প্রতি মাত্র ২০ টাকা রাখা হলো? নাহ, আমি কোনোভাবেই বিষয়টা সমর্থন করতে পারলাম না। আর জগলুল ভাই-ই বা কেমন অবিবেচক লোক! দার্শনিকদের জন্য অবমাননাকর এমন গল্প বলা কি খুব জরুরি ছিল? আগে তো তার ব্যাপারেও আমার উচ্চতর ধারণা ছিল। তাকেও আমি দার্শনিক হিসেবেই বিবেচনা করতাম। যদিও প্রতিটি মানুষই দার্শনিক। পিথাগোরাসের ভাষায় বললে প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসাকেই দর্শন বলা হয়। সাধারণ সংজ্ঞায় বলা যায় পৃথিবীর সব কিছুই দর্শনের বিষয়। আর এ বিষয়গুলো নিয়েই দর্শন আলোচনা করে। পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষই তার সামনের বিষয় নিয়ে কৌতুহলি হয়ে উঠে, অজানাকে জানতে চায়, শিখতে চায়। এগুলো নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং সবাই দার্শনিক। এমনকি বদ্ধ উন্মাদেরও একটা দর্শন আছে। যার চিন্তার জগত যতদূর সে তত বড় দার্শনিক। তবে সাধারণ চিন্তার জগতে যারা সাধারণের বাইরে তাদেরকেই দার্শনিক বলা হয়। আমি জগলুল ভাইকে সেই সাধারণের বাইরের দার্শনিকই ভাবতাম। তবে কেউ ভুল করে তাকে সক্রেটিস, প্লেটো বা এরিস্টটলের সমত’ল্য ভাববেন না। তিনি আমার কাছে তাদের চেয়েও বেশি। কারণ সক্রেটিস এরিস্টটলের তত্ত্ব ও তথ্য কেবল পড়েছি। এদের চোখের ভাষা পড়ার সুযোগ হয়নি। এদের সাথে একপক্ষীয় আড্ডা হয়েছে। আমি প্রশ্ন করেছি, জবাব পাইনি। কিন্তু জগলুল ভাইয়ের সাথে বহুবার, বহুবার দ্বীপক্ষীয় আড্ডা হয়েছে। জীবন্ত আড্ডা। হাওরের নাঙা চাঁদের নিচে ভাসমান নৌকায়, রাতের কমলাপুর স্টেশনে, ভৈরব মেঘনাঘাটের হাহাকার সন্ধ্যায়, রাজধানীর শাপলা চত্বর, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী, আজিজ মার্কেট, নাহার প্লাজায়। আড্ডার হাজারো বিষয়, হাজারো জিজ্ঞাসা। পৃথিবী, সৃস্টিজগত। দর্শনের প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, আধুনিক যুগ এবং সমকালীন যুগ। চিন্তার আদান প্রদান। আগুন, পানি, আকাশ। তরল, কঠিন, বায়বিয়। সভ্যতা, অসভ্যতা, বর্বরতা। শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, ছড়া। ভাষা, সংস্কৃতি। রাজা, প্রজা, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র। জাতীয়তাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ। আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা। নাহ। জগলুল ভাই সব জান্তা নন। তারপরও কিছু কিছু লোকের অনেক বিষয় জানতে হয়। তিনি এমনই এক লোক। সসীম হয়েও অসীমকে ধারণ করেন। তিনি জানেন, অসীমকে টেক্কা দিতে যাওয়ার আরেক নাম মূর্খতা। এক যায়গায় এসে সব সসীমকেই থেমে যেতে হয় - এক রাতে আমিও/ পার করে যামিও/ ভোরে এসে থামলাম/ আত্মার অন্তরে/ ক্রমাগত নামলাম।/ তারপর রুমিকে/ জিগালাম তুমি কে?/ আর কে বা আমি/ কার কে বা ডামি?/ রুমি কয় বৎস/ মাছ যদি মৎস/ আমি আর তুমিতে/ আসমান ভ’মিতে/ ডিফারেন্স নাই তো-/ তুমি আমি তাই তো/ সব এক এককের/ লিখে দেয়া বর্ণ/ রূপা তামা স্বর্ণ/ যাই তাকে ভাবো না/ মাটি ছাড়া কোথ্থাও/ আর কিছু পাবো না।/ অতঃপর মাটিতে/ হাঁটিতে হাঁটিতে/ খোরাসান-মিরপুর/ আরো কতো ঘাঁটিতে/ মাওলানা রুমিকে/ দেখলাম সেজদায়/ চুমো খেতে ভুমিকে।/ তার পর আরো পথ/ হাঁটলাম আমিও,/ হাঁটলাম হাঁটলাম/ কতো পথ কাটলাম/ মাটি মানে মানুষ তা/ আরো পরে জানলাম/ জানলাম আমিও।/ রুমি বলে কতো কথা/ কতো ভাব কায়দার/ শেষে বলে হায়দার/ ওখানেই থামিও।/ ওখানেই তাকে পাবে/ হ্রৎ কাবা কক্ষে/ ওখানেই সদা তিনি/ মানুষের বক্ষে! সোজাসাপটা কথা। দ্বান্দিকতার ঘোরচাপ নেই। নিজে যা বিশ্বাস করেন। বড় গলায় সেটাই চাওড় করেন। লিখেন, বলেন। লিরিক সাজান। সুর করেন। কখনো কখনো নিজেই গেয়ে শুনান। আর জলসার সাথিরা একেকজন তার কাছে রুমির প্রেমের সাথি। কখনো তিনি নিজেই আইনস্টাইন। কর্মক্ষেত্র মতিঝিলে কাজ শেষ করে ইল্লাল ইশকের জোরে শাপলা চত্বর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যান শাহবাগ এলাকায়- আইনস্টাইনের হাত ধরে রোজ বিকেলের শাপলা চত্বর/ হেঁটে যায় শাহবাগ। ছবির হাট। টিএসসি কিম্বা সরোয়ার্দী।/ রুমির প্রেমের পাখিরা মাঝে মাঝেই মিলিত হয় এখানে। গুমোট/ সন্ধ্যার শরীরে মাখে গোলাপি রঙ। তাবরিজ খোরাসান কিম্বা/ আরো যেখানে যেখানে ছড়ানো ভালোবাসার সুবাস, সব সমবেত/ হয়। প্রতিটি কথাই জরুরি এখানে। আর যে কথার এজেন্ডা প্রেম/ যার ইস্যু মুহাব্বত তার জরুরাত সম্পর্কে ওয়াকেবহাল সার্বভৌম/ বৃক্ষও। বৃক্ষ নিজেও কথা বলে। মেখে দেয় ভাবের ক্লোরোফিল/ সবুজ পাতার রূহ মুবারকে। রুমির দরবেশদের মতো রুহানী হাওয়ায়/ দোলে ওঠে আলোছায়া। নাচে। ভাব-নৃত্য। রোজ নাচের শেষে/ আমি দরবেশদের হাত ধুয়ে চলে আসি। আর আমার চলার পথে/ হাওয়ার নূপুরে বাজে পাতা ও পাখিদের যুগল জিকির- ‘ইল্লাল ইশক/ ইল্লাল ইশক! জগলুল ভাই ইদানীং খাসা কবিতায় ব্যাপক মনযোগী হয়েছেন। ছড়াকার হিসেবেই তার পরিচিতি। সবাই চেনেন ‘ছড়ার হিরো’ বলে। তিনি উত্তরাধুনিক ছড়াকার। যুগের পর যুগ ধরে সাহিত্যে দুই ভাইয়ের মতো পাশাপাশি এগিয়ে চলছে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা। কেউ কেউ অভিযোগ করতে চান উত্তরাধুনিক কবিতার মূল বিষয় হলো দুর্বোধ্যতা। কিন্তু জগলুল হায়দার উত্তরাধুনিকতার পাকাপোক্ত একটি জগত তৈরি করলেও, টর্চ লাইট দিয়ে খুঁজেও আমি কোনো দুর্বোধ্যতা খুঁজে পেলাম না। বরং যেসব বিষয় দুর্বোধ্য হওয়া উচিত, সেগুলোকেও টেনে টুনে বোধগম্য করে তুলেছেন তিনি- সক্রেটিসে অর্ডার দিলে জেনোফোনের দোকানে/ প্লেটো বলে এরিস্টটল নে তো লিচুর ঝোঁকা নে।/ জুলজিতে সাইড মাইরা তাই ধরে সে বোটানি/ তার চেয়ে কি পিথাগোরাস আরো বেশি মোটা নি?/ পাতলা মোটা যা কিছু হোক আর্কিমিডিস ভাসাবে/ টলেমী কি নিচ্ছে তবে বাদামতলি বাসা বে?/ ঘুরছে মাথা ব্রুনোর শুনে কোপার্নিকাস আইসা/ এসব নিয়া গ্যলিলিওরে ধরলো ভীষণ ঠাইসা।/ গ্যালিলিও দুনোমুনো পোপরে দেখে ভয়ার্ত/ এই জাগাতে তাই মেলে না চন্ডীদাসের পয়ার তো।/ চন্ডীদাসের খবর পেয়ে আপেল আনে নিউটনে/ হেমন্তকাল শীতের আমেজ সঙ্গে মেরিল কিউটও নে।/ বহুজাতিক কিরিম থুইয়া দেশিগুলাই মাখাবি/ মেঘনাথের মেঘ এসে কয় ভিনদেশে কেন তাকাবি?/ তাকাবি তয় পণ্যে তো নয়, জ্ঞানগরিমার তালাসে/ এই ইস্যুতে সাপোর্ট দিতে হিউয়েন সাঙও কাল আসে।/ হিউয়েন সাঙয়ের খবর পেয়ে চুপ কি থাকে বতুতা/ সেই খুশিতে শালিক নাচে গায় যে টিয়া ও তুতা।/ তুতার বদল তোতা শুনেই ধমকে বলে চামস্কি/ ভাষা বাহন যোগাযোগের, মানুষ ভাষার চামচ কি?/ নয়রে চামচ সেই কথাটাই বলছে অধম হায়দারে/ শুদ্ধ(?) জিনিস চাপাই’ দেবার তবু কতো কায়দারে।/ শুদ্ধ-শুদ্ধ- অশুদ্ধ এই ধারণাটাই মচকাবে/ নিজের জবান বর্গা দিয়া আর কতো কাল লস খাবে?/ চিরটাকাল সইবে তবু সেই সে লসের গুত্তা কি/ নিজের উপর ঈমান এনে হও না এবার মুত্তাকি।/ নয় তো এ লস পুষবে কি আর মার্ক্স এডামের থিউরিতে/ থাকতে হবে সারা জীবন ফিয়ার এবং ফিউরিতে।/ হেরোডেটাস ভারত আঁকে ভারত কিন্তু চীন না/ এই কথাতে সাপোর্ট জানায় গান্ধী মুজিব জিন্না।/ ইউক্লিডের সরল রেখাই সবচে জটিল এখানে/ ছাপবি যদি এই ব্যাপারে রামানুজের লেখা নে।/ ইসাবেলার ইচ্ছা ভাসে নীল সাগরের পানিতে/ লোভের ভাগে ডাচ হার্মাদ পিছে আসে তা নিতে।/ কলম্বাসে কল্কি টেনে ধরিয়ে দিলো গামাকে/ ম্যাগিলেনও মজলো শেষে পাগলা নেশার তামাকে।/ কোয়ান্টমের কূলে আইসা স্টিং তত্ত খাড়াইলো/ দুঃখ লাগে লেবানিজের নামটা পুরা হারাইলো।/ হ্যাভেল সাবের যন্ত্রে দেখি গ্যালাক্সি বাস ছুটতেছে/ টিকেট কেটে নেবুলারা সেই বাসে সব উঠতেছে।/ আইনস্টাইন চাল্লু আবার তাই তো আলোর গতিতে/ সময়টাকে চাচ্ছে নিতে জার্নি করে অতীতে।/ সেই সময়ের সঙ্গা নিয়া হকিন্স এখন হাঁপাচ্ছে/ এভরিথিংয়ের তত্তে যে তার হুইল চেয়ার লাফাচ্ছে।/ জেরুজালেম রোম কাশি আর শাক্যমুনির গয়াতে/ মানুষ আছে মানুষকে বল মাপবি তোরা কয় হাতে?/ তাই তো মুসা যিশুর পরে মুহাম্মদের মক্কাতে/ বিশ্ব খুঁজে কেন্দ্র নিজের নিজেরই সুরক্ষাতে। আমার মনে হয়, চাইলেও তিনি কঠিন করে কিছু লিখতে পারবেন না, বলতেও পারবেন না। একটি কবিতায় অনেকগুলো কঠিন চিন্তার সমন্বয় করেছেন। তবে সমন্বিত উপস্থাপনটা হয়েছে সহজ। অনেকগুলো দর্শনের কৌনিক আলো টেনেছেন নিজের দিকে। আর এই পুরনো আলোগুলো একসাথে মিলে তৈরি হয়েছে নতুন একটি উজ্জ্বল আলো। নাম জগলুল হায়দার। কিন্তু তার মতো এমন এক উচ্চমার্গীয় ব্যক্তি দার্শনিকের মগজের মূল্য ২০ টাকা কেজি ধরবেন, এটা কেন জানি বিশ্বাসও হতে চাইলো না। তাই গল্পটার দিকে আরো বেশি মনযোগি হলাম। জিজ্ঞেস করলাম কেন এমন ঘটনা ঘটলো? তিনি বললেন, ঘটলো আবার কি, ঘটনা তো মাত্র শুরু। আমি জিজ্ঞেস করলাম এর পর কী হলো? জগলুল ভাই বললেন, এর পর অন্য আরেকটি জারে রাখা মগজ দেখিয়ে চার বন্ধু জিজ্ঞেস করলো ভাই এটা কোন পেশার লোকের মগজ? বিক্রেতা বললো, বৈজ্ঞানিকের। কত করে কেজি? ৫০ টাকা। সর্বনাশ! দার্শনিকের মগজের মূল্য ২০ টাকা। বৈজ্ঞানিকের ৫০ টাকা। গুণি লোকদের এমন অসম্মান! বৈজ্ঞানিক বন্ধুটিও হতাশ হলো। তবে দার্শনিকের চেয়ে মূল্য বেশি হওয়ায় একটু ভাবেও রইলো। এর পর জানতে পারলো ইঞ্জিনিয়ারের মগজ ৬০০ টাকা কেজি। যাহ শালা। বৈজ্ঞানিকের চেয়েও দেখি ইঞ্জিনিয়ারের মূল্য ১২ গুণ বেশি। সব শেষে জানা গেলো অর্থনীতিবিদের মগজের মূল্য ১০০০ টাকা কেজি। শুনে তো অর্থনীতিবিদ খুশিতে ডগমগ। চার বন্ধুর মধ্যে তার মগজের মূল্যই সবচে চড়া। অর্থাৎ পৃথিবীতে যদি অর্থনীতিবিদ না থাকে, তাহলে এইসব দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক আর ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে কিছুই হবে না। এমন একটা ব্যাপার আরকি। অর্থনীতিবিদের পা তো আর মাটিতে পড়ে না। আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো এমন একটা লোক স্টিফেন হকিংসদের মতো তাবড় তাবড় ব্যক্তিদের মুখের ওপর মাতব্বরি করবেন বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলাম না। জগলুল ভাই কোনো নাটক তৈরি করছেন না তো!- নাটক নাটক আচ্ছা নাটক/ চারপাশে আজ নাট্যশালা;/ ধস্ত বিবেক ধমকে বলে/ নাটক তোদের পাঠ্য শালা! পুরো গল্পটা বলতে জগলুল ভাইয়ের সময় লেগেছে বড়জোর দুই-এক মিনিট। কিন্তু এ দুই এক মিনিটের মধ্যেই চিন্তার জগতে ঢেউ খেলে গেছে অনেক। আর এ ঢেউগুলোকেই গুনে গুনে উপস্থাপন করছি এখানে। তাই গল্পের ফাঁকে ঢুকে যাচ্ছে তারচেয়েও বড় গল্প। ঢুকছে জগলুল হায়দারের ছন্দ ও চিন্তার দোলনা- বাইরের আগুন সবাই দেখে/ ভেতরের বারুদ টের পায় না অনেকেই/ যে পারে সে ফুল আর ফিলোসোফির পাঠ/ এক সংগেই নেয়;/ কারো কারো ফুলোলজি আবার ছেঁড়া-ছিঁড়িতেই সীমাবদ্ধ।/ ছিঁড়লেই তাদের মোক্ষ/ তারা সোনার ডিম চায়/ অথচ হাঁসের প্রতিপালন বোঝে না।/ মানুষ, মানুষ তাই!/ শেষমেশ মানুষ যে কি সেটা বোঝা যায় না; বোঝা গেলে সে কি আর মানুষ হতো? ... আশ্চর্য্য এক চীজ মানুষ। মানুষের মন আর আকাশের রঙ বোঝা দায়। কিসে যে মানুষের আনন্দ সেটাও এক রহস্য। মানুষ ভালোবাসে একটু সুখের আশায়। আবার এ সুখের ভাঁজে ভাঁজেই লুকিয়ে থাকে জ্বালা- একটা সুঁই একটা সুতা/ গাঁথলে পরেই মালা হয়;/ একটা দিলে আরেকটা দিল/ বাঁধলে পরেই জ্বালা হয়। আবার সাময়িক যে সুখের সময়। সেটাকেও ঘিরে ধরে জগতের সবচে নিষ্ঠুর বাস্তবতা- বিধি তুমি পকেট দিলা/ পয়সা খালি দিলা না;/ ম্যাসেঞ্জারের চাকরি করি/ ডিউটি পরের বিল আনা! জগলুল হায়দার উচ্চারণ করেছেন দ্রোহের ছন্দ। সময়কে ব্যাঙ্গ করেছেন- লাশ তো এখন গাছের গোটা/ ঝাঁকি দিলেই ঝরছে;/ তোমরা খুঁজো দল পরিচয়/ কিন্তু মানুষ মরছে! তিনি বলবেন তার কথা। আর সময় চলবে সময়ের মতো। সময় কথা শুনুক বা না শুনুক। কবিদের বলে যেতেই হবে- নগর পুড়লে স্বভাবতই/ সংগে পুড়ে দেবালয়;/ ইতিহাসের এই সাজেশন/ পোড়ার দেশে কেবা লয়!? এই তো ছড়াকার জগলুল হায়দার। তার চিন্তা ও দর্শন। আমাদের জগলুল ভাই। একখন্ড পৃথিবী ও বন্ধু। জগলুল ভাইয়ের বড় বড় চোখ দুটিতে সব সময়ই উচ্ছ্বাসের ভাষা। হাত দুটো বুনন করে একেকটা গল্প। এ গল্পটাও তিনি বলছিলেন চোখ নাচিয়ে, হাত নাড়িয়ে। বলতে বলতেই চরম একটা সমাপ্তিও টানলেন। তিনি বললেন- শেষ মেষ বেচারা অসহায় দার্শনিক বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, আসলে ভাই আপনারা মগজের মূল্য নির্ধারণ করেন কিভাবে? বিক্রেতা ঝটপট জবাব দিলেন জীবদ্দশায় যার মগজ যত কম ব্যবহৃত হয়েছে তার মগজের মূল্যই বেশি ধরা হয়। এর পর জগলুল ভাই নিষ্ক্রান্ত হলেন। আমি এক দফা পেট ফাঁটানোর মত হাসি হাসলাম। হাসতে হাসতেই মনে হল জগলুল ভাইয়ের মগজেরও একটা মূল্য নিরুপণ করা প্রয়োজন। উত্তরাধুনিক ছড়া, আর কবিতার ঘুন বাসা বেঁধেছে তার মাথায়। বয়স পঞ্চাশ হলেও সত্যিকারের বয়স সভ্যতার সমান। কাজেই এতো বয়সের এতো ভার সহ্য করতে করতে তার মগজের বেশিরভাগ কোষই অকেজো হয়ে গেছে। ঘুনে খাওয়া এ মগজের দাম চল্লিশ টাকার বেশি উঠার কথা নয়।
Sunday, January 25, 2015
জগলুল হায়দারের মগজ কত টাকা কেজি? :Natun Barta
এখানে মৃত মানুষের মগজ বিক্রি হয়। সাইনবোর্ড দেখে অবাক চার বন্ধু। এক দার্শনিক, এক বিজ্ঞানী, এক ইঞ্জিনিয়ার ও এক অর্থনীতিবিদ। ব্যাপারটার গূঢ় রহস্য উদঘাটনের কৌতুহলে এগিয়ে গেলেন চারজনই। বিক্রেতাও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে জানালেন, সত্যি সত্যিই তিনি মৃত মানুষের মগজ বিক্রি করেন। এর পর জারের ভেতর সংরক্ষণে রাখা মগজগুলো দেখিয়ে দিলেন। চার বন্ধু সন্ধিগ্ধ চোখে থরে থরে সাজানো মগজ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন।
ref='http://gold.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=adee8319&cb=INSERT_RANDOM_NUMBER_HERE' target='_blank'> আমি তখন পর্যবেক্ষণ করছিলাম জগলুল ভাইয়ের মগজ। ছড়াকার জগলুল হায়দার। তার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম আজিজ মার্কেটে। হঠাৎ করেই উদ্ভট এ গল্পটা শুরু করলেন তিনি। শুধু গল্পটাই উদ্ভট নয়। তার উপস্থাপনের ঢঙও জমজমাট। এই ‘উদ্ভট’ আর ‘জমজমাট’, দুই শব্দের সমন্বয় হলে যেকোনো আড্ডাই উতলা হয়ে উঠে। জগলুল ভাইয়ের সাথে একটি উতলা আড্ডা মানে, পৃথিবীটাকে একবার চক্কর দিয়ে আসা। আড্ডায় গল্প বলার সময় সবচে বেশি কথা বলে তার চোখ। আর চোখের এ কথাগুলোতেই লুকিয়ে থাকে বিশাল এক শব্দবন। সেটা কখনো লাউয়াছড়ার মতো বর্ষাবন। অথবা সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বন। তবে সব বনেই তার সাবলিল চলাফেরা। হেঁটে যান নিশ্চিন্তে। কখনো পায়ের নিচে শুকনো পাতা গুঁড়িয়ে মুড়ি মুড়কির মতো মচমচে শব্দ তুলে। এ শব্দগুলোতেই লুকিয়ে থাকে কথার মিছিল- বুকের ভেতর কথার মিছিল/ হাজার কথার ঢেউ/ সেই কথাটা আমিই জানি/ আর জানে না কেউ।/ কিছু কথা কষ্ট কথা/ কিছু কথায় তাপ/ কিছু কথায় ক্ষোভ আছে তাও/ নেইকো অভিশাপ।/ কিছু কথা আশার কথা/ কিছু কথায় প্রেম/ কিছু কথায় বানাই নানা/ অভিলাষের ফ্রেম।/ এমনি যতো কথার গোলাপ/ পায় না খুঁজে খেই/ তার সুবাসই ছড়িয়ে দিতে/ কলম হাতে নেই।/ কলমটাকেই কামান ভেবে/ খাতায় বসাই দাগ/ লেখাই আমার বাদ-প্রতিবাদ/ রাগ ও অনুরাগ। উতলা আড্ডাটা চলছিল সেই জগলুল ভাইয়ের সাথেই। তিনি দুই হাতের কব্জি একসাথে করে জারে সাজানো মগজগুলোর আকৃতি বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। মগজগুলো যেন আমার চোখের সামনেই ভেসে উঠল। কী সাঙ্ঘাতিক দৃশ্য ওটা! মৃত মানুষের মগজ। দেখতে কেমন হবে, গরুর মগজের মতোই। তবে মানুষের মগজ আরো একটু মোলায়েম হবে। পরিমানেও কম। একবার ক্রসিং দেয়ার সময় ট্রেনে কাটা এক মহিলার মগজ ছিটকে পড়েছিল আমার জানালায়। ভাগ্যিস জানালার কাঁচ আটকানো ছিলো। কাঁচের সাথে লেপ্টে থাকা থকথকে মগজটাকে বেশি সময় দেখার সুযোগ হয়নি। মুহুর্মূহু আতঙ্কিত পরিবেশের ঠেলায় সিট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। অল্প সময়ের জন্য দেখা সেই মহিলার মগজের কথা ভাবতে শুরু করলাম। পরক্ষণেই মনে হলো, জগলুল ভাইযের গল্পের এ মগজগুলো নিশ্চয়ই দুর্ঘটনায় পতিত লোকের থেঁতলানো মগজ নয়। মৃত্যুর পর পরিপাটি কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলি থেকে অক্ষত মগজগুলোই বের করে আনা হয়েছে। সে যেভাবেই আনা হোক। গল্পটা আগে শোনা দরকার। জগলুল ভাই বললেন- তো সেই চার বন্ধু মগজের জারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বিক্রেতা জানালো এখানে বিভিন্ন পেশার লোকের মগজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। আপনার যেটা প্রয়োজন সেটাই নিতে পারেন। তবে ভালো জিনিস চাইলে অবশ্যই টাকাও বেশি গুনতে হবে। একটি মগজের জার দেখিয়ে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ভাই এটার দাম কত? বিক্রেতা জানালেন, এটা দার্শনিকের মগজ। দাম পড়বে প্রতি কেজিতে ২০ টাকা করে। দাম শুনে বেচারা দার্শনিক বন্ধুটার মুখ একটু কালো হয়ে উঠলো। এতো সাধনার পর পৃথিবীর সকল শাস্ত্রের জনক দর্শনশাস্ত্রের ওপর দখল নিয়েছেন, আর তার মগজের দাম নাকি মাত্র ২০ টাকা কেজি! গল্প শুনে আমি একটু অতিরিক্ত রকমের উতলা হয়ে উঠলাম। আমারও দর্শন শাস্ত্রের ওপর সম্মান ও সম্মানোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। তবে উতলা ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ এই ডিগ্রি দুটো আমাকে নাড়া দিতে পারে না। খুব সহযেই এ দুটো অর্জন করে ফেলেছি তো। সহযে কিছু পেয়ে গেলে সেটার মর্ম বোঝা কঠিন। আমি দর্শন শাস্ত্রে দুই দুটি ডিগ্রি অর্জন করলাম ঠিকই। কিন্তু এর নিগূঢ় মর্ম উদ্ধার করতে পারলাম না। অথচ আমার সহপাঠিরা প্রতিদিন একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো ক্লাস করেছে। নোট তৈরি করেছে। পাঠের প্রয়োজনে বন্ধু ও বান্ধব সমেত আলোচনার দল তৈরি করেছে। জুটিতে জুটিতে বিভক্ত হয়ে থেলিসের প্রাচীন পানি তত্ত্ব থেকে শুরু করে সমকালীন দর্শনের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করেই তবে ছেড়েছে। প্রথম দিকে আমিও কৌতুহলী হয়ে তাদের দলের কর্মকা- উদঘাটন করতে গেলাম। দর্শন শাস্ত্র সম্পর্কে সহজ আলোচনায় লিপ্ত হতে চাইলাম। দেখলাম এমনিতে এরা সহজ ভাষাতেই কথা বলে। কিন্তু দর্শনশাস্ত্র নিয়ে বলতে গেলেই কথাগুলো কেমন খটরমটর হয়ে যায়। সে এক অন্যরকম বাংলা ভাষা। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। একটা বুঝতে পারলে দশটা বুঝি না। আরো অনেক কিছুই বুঝতে পারি না। এরা দর্শন শাস্ত্রের রহস্য উদঘাটনের জন্য পারস্পরিক আলোচনার যে দলটি তৈরি করেছে, সেখানে দেখলাম রসায়ন শাস্ত্রের নিগূঢ় চর্চা। প্রেমের রসায়ন। ছেলে মেয়েরা একসাথে চর্চা করছে। প্রায়োগিক রসায়নের চোটে একেকজন প্রাজ্ঞ দার্শনিকও বনে যাচ্ছে। খুব আহ্লাদ করে পড়ার বিষয় হিসেবে দর্শনশাস্ত্র বেছে নিয়েছিলাম। পাঠ্যসূচিটাও ব্যাপক পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বাংলা ভাষায় দর্শন শাস্ত্রের ওপর লেখাপড়া করতে গিয়েই সাধ চুকে গেল। মনে হল পৃথিবীর সবচে কঠিন ভাষাটাই আমাদের এই মাতৃভাষা। তাই সরাসরি আত্মসমর্পণ করে বসলাম। নিগূঢ় রহস্য উদঘাটনের হাল ছেড়ে দিলাম। পরীক্ষার আট-দশ দিন আগে নীলক্ষেত থেকে সিলেবাস দেখে বই কিনে আনতাম। আগের রাত জেগে বইগুলো একবার পড়ে যেতাম। খটরমটর কিছু শব্দ এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি কাগজের স্লিপে লিখে নিতাম। পরীক্ষার হলে গিয়ে সব উগড়ে দিয়ে মাথাটাকে পরিষ্কার করে নিতাম। তারপর শান্তি। এই চরম খটরমটর বাংলা ভাষার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেও কেন জানি দার্শনিকদের জন্য খুব মায়া হয়। এই বেচারাদেরকে সাধারণ সমাজ তেমন মূল্য দিতে চায় না। কেউ কেউ পাগল বলে আখ্যা দেয়। জগলুল ভাইয়ের এই গল্পটাই তো এর বাস্তব উদাহরণ। একজন দার্শনিকের মগজের মূল্য কোন বিবেচনায় কেজি প্রতি মাত্র ২০ টাকা রাখা হলো? নাহ, আমি কোনোভাবেই বিষয়টা সমর্থন করতে পারলাম না। আর জগলুল ভাই-ই বা কেমন অবিবেচক লোক! দার্শনিকদের জন্য অবমাননাকর এমন গল্প বলা কি খুব জরুরি ছিল? আগে তো তার ব্যাপারেও আমার উচ্চতর ধারণা ছিল। তাকেও আমি দার্শনিক হিসেবেই বিবেচনা করতাম। যদিও প্রতিটি মানুষই দার্শনিক। পিথাগোরাসের ভাষায় বললে প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসাকেই দর্শন বলা হয়। সাধারণ সংজ্ঞায় বলা যায় পৃথিবীর সব কিছুই দর্শনের বিষয়। আর এ বিষয়গুলো নিয়েই দর্শন আলোচনা করে। পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষই তার সামনের বিষয় নিয়ে কৌতুহলি হয়ে উঠে, অজানাকে জানতে চায়, শিখতে চায়। এগুলো নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং সবাই দার্শনিক। এমনকি বদ্ধ উন্মাদেরও একটা দর্শন আছে। যার চিন্তার জগত যতদূর সে তত বড় দার্শনিক। তবে সাধারণ চিন্তার জগতে যারা সাধারণের বাইরে তাদেরকেই দার্শনিক বলা হয়। আমি জগলুল ভাইকে সেই সাধারণের বাইরের দার্শনিকই ভাবতাম। তবে কেউ ভুল করে তাকে সক্রেটিস, প্লেটো বা এরিস্টটলের সমত’ল্য ভাববেন না। তিনি আমার কাছে তাদের চেয়েও বেশি। কারণ সক্রেটিস এরিস্টটলের তত্ত্ব ও তথ্য কেবল পড়েছি। এদের চোখের ভাষা পড়ার সুযোগ হয়নি। এদের সাথে একপক্ষীয় আড্ডা হয়েছে। আমি প্রশ্ন করেছি, জবাব পাইনি। কিন্তু জগলুল ভাইয়ের সাথে বহুবার, বহুবার দ্বীপক্ষীয় আড্ডা হয়েছে। জীবন্ত আড্ডা। হাওরের নাঙা চাঁদের নিচে ভাসমান নৌকায়, রাতের কমলাপুর স্টেশনে, ভৈরব মেঘনাঘাটের হাহাকার সন্ধ্যায়, রাজধানীর শাপলা চত্বর, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী, আজিজ মার্কেট, নাহার প্লাজায়। আড্ডার হাজারো বিষয়, হাজারো জিজ্ঞাসা। পৃথিবী, সৃস্টিজগত। দর্শনের প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, আধুনিক যুগ এবং সমকালীন যুগ। চিন্তার আদান প্রদান। আগুন, পানি, আকাশ। তরল, কঠিন, বায়বিয়। সভ্যতা, অসভ্যতা, বর্বরতা। শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, ছড়া। ভাষা, সংস্কৃতি। রাজা, প্রজা, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র। জাতীয়তাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ। আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা। নাহ। জগলুল ভাই সব জান্তা নন। তারপরও কিছু কিছু লোকের অনেক বিষয় জানতে হয়। তিনি এমনই এক লোক। সসীম হয়েও অসীমকে ধারণ করেন। তিনি জানেন, অসীমকে টেক্কা দিতে যাওয়ার আরেক নাম মূর্খতা। এক যায়গায় এসে সব সসীমকেই থেমে যেতে হয় - এক রাতে আমিও/ পার করে যামিও/ ভোরে এসে থামলাম/ আত্মার অন্তরে/ ক্রমাগত নামলাম।/ তারপর রুমিকে/ জিগালাম তুমি কে?/ আর কে বা আমি/ কার কে বা ডামি?/ রুমি কয় বৎস/ মাছ যদি মৎস/ আমি আর তুমিতে/ আসমান ভ’মিতে/ ডিফারেন্স নাই তো-/ তুমি আমি তাই তো/ সব এক এককের/ লিখে দেয়া বর্ণ/ রূপা তামা স্বর্ণ/ যাই তাকে ভাবো না/ মাটি ছাড়া কোথ্থাও/ আর কিছু পাবো না।/ অতঃপর মাটিতে/ হাঁটিতে হাঁটিতে/ খোরাসান-মিরপুর/ আরো কতো ঘাঁটিতে/ মাওলানা রুমিকে/ দেখলাম সেজদায়/ চুমো খেতে ভুমিকে।/ তার পর আরো পথ/ হাঁটলাম আমিও,/ হাঁটলাম হাঁটলাম/ কতো পথ কাটলাম/ মাটি মানে মানুষ তা/ আরো পরে জানলাম/ জানলাম আমিও।/ রুমি বলে কতো কথা/ কতো ভাব কায়দার/ শেষে বলে হায়দার/ ওখানেই থামিও।/ ওখানেই তাকে পাবে/ হ্রৎ কাবা কক্ষে/ ওখানেই সদা তিনি/ মানুষের বক্ষে! সোজাসাপটা কথা। দ্বান্দিকতার ঘোরচাপ নেই। নিজে যা বিশ্বাস করেন। বড় গলায় সেটাই চাওড় করেন। লিখেন, বলেন। লিরিক সাজান। সুর করেন। কখনো কখনো নিজেই গেয়ে শুনান। আর জলসার সাথিরা একেকজন তার কাছে রুমির প্রেমের সাথি। কখনো তিনি নিজেই আইনস্টাইন। কর্মক্ষেত্র মতিঝিলে কাজ শেষ করে ইল্লাল ইশকের জোরে শাপলা চত্বর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যান শাহবাগ এলাকায়- আইনস্টাইনের হাত ধরে রোজ বিকেলের শাপলা চত্বর/ হেঁটে যায় শাহবাগ। ছবির হাট। টিএসসি কিম্বা সরোয়ার্দী।/ রুমির প্রেমের পাখিরা মাঝে মাঝেই মিলিত হয় এখানে। গুমোট/ সন্ধ্যার শরীরে মাখে গোলাপি রঙ। তাবরিজ খোরাসান কিম্বা/ আরো যেখানে যেখানে ছড়ানো ভালোবাসার সুবাস, সব সমবেত/ হয়। প্রতিটি কথাই জরুরি এখানে। আর যে কথার এজেন্ডা প্রেম/ যার ইস্যু মুহাব্বত তার জরুরাত সম্পর্কে ওয়াকেবহাল সার্বভৌম/ বৃক্ষও। বৃক্ষ নিজেও কথা বলে। মেখে দেয় ভাবের ক্লোরোফিল/ সবুজ পাতার রূহ মুবারকে। রুমির দরবেশদের মতো রুহানী হাওয়ায়/ দোলে ওঠে আলোছায়া। নাচে। ভাব-নৃত্য। রোজ নাচের শেষে/ আমি দরবেশদের হাত ধুয়ে চলে আসি। আর আমার চলার পথে/ হাওয়ার নূপুরে বাজে পাতা ও পাখিদের যুগল জিকির- ‘ইল্লাল ইশক/ ইল্লাল ইশক! জগলুল ভাই ইদানীং খাসা কবিতায় ব্যাপক মনযোগী হয়েছেন। ছড়াকার হিসেবেই তার পরিচিতি। সবাই চেনেন ‘ছড়ার হিরো’ বলে। তিনি উত্তরাধুনিক ছড়াকার। যুগের পর যুগ ধরে সাহিত্যে দুই ভাইয়ের মতো পাশাপাশি এগিয়ে চলছে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা। কেউ কেউ অভিযোগ করতে চান উত্তরাধুনিক কবিতার মূল বিষয় হলো দুর্বোধ্যতা। কিন্তু জগলুল হায়দার উত্তরাধুনিকতার পাকাপোক্ত একটি জগত তৈরি করলেও, টর্চ লাইট দিয়ে খুঁজেও আমি কোনো দুর্বোধ্যতা খুঁজে পেলাম না। বরং যেসব বিষয় দুর্বোধ্য হওয়া উচিত, সেগুলোকেও টেনে টুনে বোধগম্য করে তুলেছেন তিনি- সক্রেটিসে অর্ডার দিলে জেনোফোনের দোকানে/ প্লেটো বলে এরিস্টটল নে তো লিচুর ঝোঁকা নে।/ জুলজিতে সাইড মাইরা তাই ধরে সে বোটানি/ তার চেয়ে কি পিথাগোরাস আরো বেশি মোটা নি?/ পাতলা মোটা যা কিছু হোক আর্কিমিডিস ভাসাবে/ টলেমী কি নিচ্ছে তবে বাদামতলি বাসা বে?/ ঘুরছে মাথা ব্রুনোর শুনে কোপার্নিকাস আইসা/ এসব নিয়া গ্যলিলিওরে ধরলো ভীষণ ঠাইসা।/ গ্যালিলিও দুনোমুনো পোপরে দেখে ভয়ার্ত/ এই জাগাতে তাই মেলে না চন্ডীদাসের পয়ার তো।/ চন্ডীদাসের খবর পেয়ে আপেল আনে নিউটনে/ হেমন্তকাল শীতের আমেজ সঙ্গে মেরিল কিউটও নে।/ বহুজাতিক কিরিম থুইয়া দেশিগুলাই মাখাবি/ মেঘনাথের মেঘ এসে কয় ভিনদেশে কেন তাকাবি?/ তাকাবি তয় পণ্যে তো নয়, জ্ঞানগরিমার তালাসে/ এই ইস্যুতে সাপোর্ট দিতে হিউয়েন সাঙও কাল আসে।/ হিউয়েন সাঙয়ের খবর পেয়ে চুপ কি থাকে বতুতা/ সেই খুশিতে শালিক নাচে গায় যে টিয়া ও তুতা।/ তুতার বদল তোতা শুনেই ধমকে বলে চামস্কি/ ভাষা বাহন যোগাযোগের, মানুষ ভাষার চামচ কি?/ নয়রে চামচ সেই কথাটাই বলছে অধম হায়দারে/ শুদ্ধ(?) জিনিস চাপাই’ দেবার তবু কতো কায়দারে।/ শুদ্ধ-শুদ্ধ- অশুদ্ধ এই ধারণাটাই মচকাবে/ নিজের জবান বর্গা দিয়া আর কতো কাল লস খাবে?/ চিরটাকাল সইবে তবু সেই সে লসের গুত্তা কি/ নিজের উপর ঈমান এনে হও না এবার মুত্তাকি।/ নয় তো এ লস পুষবে কি আর মার্ক্স এডামের থিউরিতে/ থাকতে হবে সারা জীবন ফিয়ার এবং ফিউরিতে।/ হেরোডেটাস ভারত আঁকে ভারত কিন্তু চীন না/ এই কথাতে সাপোর্ট জানায় গান্ধী মুজিব জিন্না।/ ইউক্লিডের সরল রেখাই সবচে জটিল এখানে/ ছাপবি যদি এই ব্যাপারে রামানুজের লেখা নে।/ ইসাবেলার ইচ্ছা ভাসে নীল সাগরের পানিতে/ লোভের ভাগে ডাচ হার্মাদ পিছে আসে তা নিতে।/ কলম্বাসে কল্কি টেনে ধরিয়ে দিলো গামাকে/ ম্যাগিলেনও মজলো শেষে পাগলা নেশার তামাকে।/ কোয়ান্টমের কূলে আইসা স্টিং তত্ত খাড়াইলো/ দুঃখ লাগে লেবানিজের নামটা পুরা হারাইলো।/ হ্যাভেল সাবের যন্ত্রে দেখি গ্যালাক্সি বাস ছুটতেছে/ টিকেট কেটে নেবুলারা সেই বাসে সব উঠতেছে।/ আইনস্টাইন চাল্লু আবার তাই তো আলোর গতিতে/ সময়টাকে চাচ্ছে নিতে জার্নি করে অতীতে।/ সেই সময়ের সঙ্গা নিয়া হকিন্স এখন হাঁপাচ্ছে/ এভরিথিংয়ের তত্তে যে তার হুইল চেয়ার লাফাচ্ছে।/ জেরুজালেম রোম কাশি আর শাক্যমুনির গয়াতে/ মানুষ আছে মানুষকে বল মাপবি তোরা কয় হাতে?/ তাই তো মুসা যিশুর পরে মুহাম্মদের মক্কাতে/ বিশ্ব খুঁজে কেন্দ্র নিজের নিজেরই সুরক্ষাতে। আমার মনে হয়, চাইলেও তিনি কঠিন করে কিছু লিখতে পারবেন না, বলতেও পারবেন না। একটি কবিতায় অনেকগুলো কঠিন চিন্তার সমন্বয় করেছেন। তবে সমন্বিত উপস্থাপনটা হয়েছে সহজ। অনেকগুলো দর্শনের কৌনিক আলো টেনেছেন নিজের দিকে। আর এই পুরনো আলোগুলো একসাথে মিলে তৈরি হয়েছে নতুন একটি উজ্জ্বল আলো। নাম জগলুল হায়দার। কিন্তু তার মতো এমন এক উচ্চমার্গীয় ব্যক্তি দার্শনিকের মগজের মূল্য ২০ টাকা কেজি ধরবেন, এটা কেন জানি বিশ্বাসও হতে চাইলো না। তাই গল্পটার দিকে আরো বেশি মনযোগি হলাম। জিজ্ঞেস করলাম কেন এমন ঘটনা ঘটলো? তিনি বললেন, ঘটলো আবার কি, ঘটনা তো মাত্র শুরু। আমি জিজ্ঞেস করলাম এর পর কী হলো? জগলুল ভাই বললেন, এর পর অন্য আরেকটি জারে রাখা মগজ দেখিয়ে চার বন্ধু জিজ্ঞেস করলো ভাই এটা কোন পেশার লোকের মগজ? বিক্রেতা বললো, বৈজ্ঞানিকের। কত করে কেজি? ৫০ টাকা। সর্বনাশ! দার্শনিকের মগজের মূল্য ২০ টাকা। বৈজ্ঞানিকের ৫০ টাকা। গুণি লোকদের এমন অসম্মান! বৈজ্ঞানিক বন্ধুটিও হতাশ হলো। তবে দার্শনিকের চেয়ে মূল্য বেশি হওয়ায় একটু ভাবেও রইলো। এর পর জানতে পারলো ইঞ্জিনিয়ারের মগজ ৬০০ টাকা কেজি। যাহ শালা। বৈজ্ঞানিকের চেয়েও দেখি ইঞ্জিনিয়ারের মূল্য ১২ গুণ বেশি। সব শেষে জানা গেলো অর্থনীতিবিদের মগজের মূল্য ১০০০ টাকা কেজি। শুনে তো অর্থনীতিবিদ খুশিতে ডগমগ। চার বন্ধুর মধ্যে তার মগজের মূল্যই সবচে চড়া। অর্থাৎ পৃথিবীতে যদি অর্থনীতিবিদ না থাকে, তাহলে এইসব দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক আর ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে কিছুই হবে না। এমন একটা ব্যাপার আরকি। অর্থনীতিবিদের পা তো আর মাটিতে পড়ে না। আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো এমন একটা লোক স্টিফেন হকিংসদের মতো তাবড় তাবড় ব্যক্তিদের মুখের ওপর মাতব্বরি করবেন বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলাম না। জগলুল ভাই কোনো নাটক তৈরি করছেন না তো!- নাটক নাটক আচ্ছা নাটক/ চারপাশে আজ নাট্যশালা;/ ধস্ত বিবেক ধমকে বলে/ নাটক তোদের পাঠ্য শালা! পুরো গল্পটা বলতে জগলুল ভাইয়ের সময় লেগেছে বড়জোর দুই-এক মিনিট। কিন্তু এ দুই এক মিনিটের মধ্যেই চিন্তার জগতে ঢেউ খেলে গেছে অনেক। আর এ ঢেউগুলোকেই গুনে গুনে উপস্থাপন করছি এখানে। তাই গল্পের ফাঁকে ঢুকে যাচ্ছে তারচেয়েও বড় গল্প। ঢুকছে জগলুল হায়দারের ছন্দ ও চিন্তার দোলনা- বাইরের আগুন সবাই দেখে/ ভেতরের বারুদ টের পায় না অনেকেই/ যে পারে সে ফুল আর ফিলোসোফির পাঠ/ এক সংগেই নেয়;/ কারো কারো ফুলোলজি আবার ছেঁড়া-ছিঁড়িতেই সীমাবদ্ধ।/ ছিঁড়লেই তাদের মোক্ষ/ তারা সোনার ডিম চায়/ অথচ হাঁসের প্রতিপালন বোঝে না।/ মানুষ, মানুষ তাই!/ শেষমেশ মানুষ যে কি সেটা বোঝা যায় না; বোঝা গেলে সে কি আর মানুষ হতো? ... আশ্চর্য্য এক চীজ মানুষ। মানুষের মন আর আকাশের রঙ বোঝা দায়। কিসে যে মানুষের আনন্দ সেটাও এক রহস্য। মানুষ ভালোবাসে একটু সুখের আশায়। আবার এ সুখের ভাঁজে ভাঁজেই লুকিয়ে থাকে জ্বালা- একটা সুঁই একটা সুতা/ গাঁথলে পরেই মালা হয়;/ একটা দিলে আরেকটা দিল/ বাঁধলে পরেই জ্বালা হয়। আবার সাময়িক যে সুখের সময়। সেটাকেও ঘিরে ধরে জগতের সবচে নিষ্ঠুর বাস্তবতা- বিধি তুমি পকেট দিলা/ পয়সা খালি দিলা না;/ ম্যাসেঞ্জারের চাকরি করি/ ডিউটি পরের বিল আনা! জগলুল হায়দার উচ্চারণ করেছেন দ্রোহের ছন্দ। সময়কে ব্যাঙ্গ করেছেন- লাশ তো এখন গাছের গোটা/ ঝাঁকি দিলেই ঝরছে;/ তোমরা খুঁজো দল পরিচয়/ কিন্তু মানুষ মরছে! তিনি বলবেন তার কথা। আর সময় চলবে সময়ের মতো। সময় কথা শুনুক বা না শুনুক। কবিদের বলে যেতেই হবে- নগর পুড়লে স্বভাবতই/ সংগে পুড়ে দেবালয়;/ ইতিহাসের এই সাজেশন/ পোড়ার দেশে কেবা লয়!? এই তো ছড়াকার জগলুল হায়দার। তার চিন্তা ও দর্শন। আমাদের জগলুল ভাই। একখন্ড পৃথিবী ও বন্ধু। জগলুল ভাইয়ের বড় বড় চোখ দুটিতে সব সময়ই উচ্ছ্বাসের ভাষা। হাত দুটো বুনন করে একেকটা গল্প। এ গল্পটাও তিনি বলছিলেন চোখ নাচিয়ে, হাত নাড়িয়ে। বলতে বলতেই চরম একটা সমাপ্তিও টানলেন। তিনি বললেন- শেষ মেষ বেচারা অসহায় দার্শনিক বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, আসলে ভাই আপনারা মগজের মূল্য নির্ধারণ করেন কিভাবে? বিক্রেতা ঝটপট জবাব দিলেন জীবদ্দশায় যার মগজ যত কম ব্যবহৃত হয়েছে তার মগজের মূল্যই বেশি ধরা হয়। এর পর জগলুল ভাই নিষ্ক্রান্ত হলেন। আমি এক দফা পেট ফাঁটানোর মত হাসি হাসলাম। হাসতে হাসতেই মনে হল জগলুল ভাইয়ের মগজেরও একটা মূল্য নিরুপণ করা প্রয়োজন। উত্তরাধুনিক ছড়া, আর কবিতার ঘুন বাসা বেঁধেছে তার মাথায়। বয়স পঞ্চাশ হলেও সত্যিকারের বয়স সভ্যতার সমান। কাজেই এতো বয়সের এতো ভার সহ্য করতে করতে তার মগজের বেশিরভাগ কোষই অকেজো হয়ে গেছে। ঘুনে খাওয়া এ মগজের দাম চল্লিশ টাকার বেশি উঠার কথা নয়।
ref='http://gold.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=adee8319&cb=INSERT_RANDOM_NUMBER_HERE' target='_blank'> আমি তখন পর্যবেক্ষণ করছিলাম জগলুল ভাইয়ের মগজ। ছড়াকার জগলুল হায়দার। তার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম আজিজ মার্কেটে। হঠাৎ করেই উদ্ভট এ গল্পটা শুরু করলেন তিনি। শুধু গল্পটাই উদ্ভট নয়। তার উপস্থাপনের ঢঙও জমজমাট। এই ‘উদ্ভট’ আর ‘জমজমাট’, দুই শব্দের সমন্বয় হলে যেকোনো আড্ডাই উতলা হয়ে উঠে। জগলুল ভাইয়ের সাথে একটি উতলা আড্ডা মানে, পৃথিবীটাকে একবার চক্কর দিয়ে আসা। আড্ডায় গল্প বলার সময় সবচে বেশি কথা বলে তার চোখ। আর চোখের এ কথাগুলোতেই লুকিয়ে থাকে বিশাল এক শব্দবন। সেটা কখনো লাউয়াছড়ার মতো বর্ষাবন। অথবা সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বন। তবে সব বনেই তার সাবলিল চলাফেরা। হেঁটে যান নিশ্চিন্তে। কখনো পায়ের নিচে শুকনো পাতা গুঁড়িয়ে মুড়ি মুড়কির মতো মচমচে শব্দ তুলে। এ শব্দগুলোতেই লুকিয়ে থাকে কথার মিছিল- বুকের ভেতর কথার মিছিল/ হাজার কথার ঢেউ/ সেই কথাটা আমিই জানি/ আর জানে না কেউ।/ কিছু কথা কষ্ট কথা/ কিছু কথায় তাপ/ কিছু কথায় ক্ষোভ আছে তাও/ নেইকো অভিশাপ।/ কিছু কথা আশার কথা/ কিছু কথায় প্রেম/ কিছু কথায় বানাই নানা/ অভিলাষের ফ্রেম।/ এমনি যতো কথার গোলাপ/ পায় না খুঁজে খেই/ তার সুবাসই ছড়িয়ে দিতে/ কলম হাতে নেই।/ কলমটাকেই কামান ভেবে/ খাতায় বসাই দাগ/ লেখাই আমার বাদ-প্রতিবাদ/ রাগ ও অনুরাগ। উতলা আড্ডাটা চলছিল সেই জগলুল ভাইয়ের সাথেই। তিনি দুই হাতের কব্জি একসাথে করে জারে সাজানো মগজগুলোর আকৃতি বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। মগজগুলো যেন আমার চোখের সামনেই ভেসে উঠল। কী সাঙ্ঘাতিক দৃশ্য ওটা! মৃত মানুষের মগজ। দেখতে কেমন হবে, গরুর মগজের মতোই। তবে মানুষের মগজ আরো একটু মোলায়েম হবে। পরিমানেও কম। একবার ক্রসিং দেয়ার সময় ট্রেনে কাটা এক মহিলার মগজ ছিটকে পড়েছিল আমার জানালায়। ভাগ্যিস জানালার কাঁচ আটকানো ছিলো। কাঁচের সাথে লেপ্টে থাকা থকথকে মগজটাকে বেশি সময় দেখার সুযোগ হয়নি। মুহুর্মূহু আতঙ্কিত পরিবেশের ঠেলায় সিট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। অল্প সময়ের জন্য দেখা সেই মহিলার মগজের কথা ভাবতে শুরু করলাম। পরক্ষণেই মনে হলো, জগলুল ভাইযের গল্পের এ মগজগুলো নিশ্চয়ই দুর্ঘটনায় পতিত লোকের থেঁতলানো মগজ নয়। মৃত্যুর পর পরিপাটি কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলি থেকে অক্ষত মগজগুলোই বের করে আনা হয়েছে। সে যেভাবেই আনা হোক। গল্পটা আগে শোনা দরকার। জগলুল ভাই বললেন- তো সেই চার বন্ধু মগজের জারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বিক্রেতা জানালো এখানে বিভিন্ন পেশার লোকের মগজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। আপনার যেটা প্রয়োজন সেটাই নিতে পারেন। তবে ভালো জিনিস চাইলে অবশ্যই টাকাও বেশি গুনতে হবে। একটি মগজের জার দেখিয়ে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ভাই এটার দাম কত? বিক্রেতা জানালেন, এটা দার্শনিকের মগজ। দাম পড়বে প্রতি কেজিতে ২০ টাকা করে। দাম শুনে বেচারা দার্শনিক বন্ধুটার মুখ একটু কালো হয়ে উঠলো। এতো সাধনার পর পৃথিবীর সকল শাস্ত্রের জনক দর্শনশাস্ত্রের ওপর দখল নিয়েছেন, আর তার মগজের দাম নাকি মাত্র ২০ টাকা কেজি! গল্প শুনে আমি একটু অতিরিক্ত রকমের উতলা হয়ে উঠলাম। আমারও দর্শন শাস্ত্রের ওপর সম্মান ও সম্মানোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। তবে উতলা ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ এই ডিগ্রি দুটো আমাকে নাড়া দিতে পারে না। খুব সহযেই এ দুটো অর্জন করে ফেলেছি তো। সহযে কিছু পেয়ে গেলে সেটার মর্ম বোঝা কঠিন। আমি দর্শন শাস্ত্রে দুই দুটি ডিগ্রি অর্জন করলাম ঠিকই। কিন্তু এর নিগূঢ় মর্ম উদ্ধার করতে পারলাম না। অথচ আমার সহপাঠিরা প্রতিদিন একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো ক্লাস করেছে। নোট তৈরি করেছে। পাঠের প্রয়োজনে বন্ধু ও বান্ধব সমেত আলোচনার দল তৈরি করেছে। জুটিতে জুটিতে বিভক্ত হয়ে থেলিসের প্রাচীন পানি তত্ত্ব থেকে শুরু করে সমকালীন দর্শনের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করেই তবে ছেড়েছে। প্রথম দিকে আমিও কৌতুহলী হয়ে তাদের দলের কর্মকা- উদঘাটন করতে গেলাম। দর্শন শাস্ত্র সম্পর্কে সহজ আলোচনায় লিপ্ত হতে চাইলাম। দেখলাম এমনিতে এরা সহজ ভাষাতেই কথা বলে। কিন্তু দর্শনশাস্ত্র নিয়ে বলতে গেলেই কথাগুলো কেমন খটরমটর হয়ে যায়। সে এক অন্যরকম বাংলা ভাষা। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। একটা বুঝতে পারলে দশটা বুঝি না। আরো অনেক কিছুই বুঝতে পারি না। এরা দর্শন শাস্ত্রের রহস্য উদঘাটনের জন্য পারস্পরিক আলোচনার যে দলটি তৈরি করেছে, সেখানে দেখলাম রসায়ন শাস্ত্রের নিগূঢ় চর্চা। প্রেমের রসায়ন। ছেলে মেয়েরা একসাথে চর্চা করছে। প্রায়োগিক রসায়নের চোটে একেকজন প্রাজ্ঞ দার্শনিকও বনে যাচ্ছে। খুব আহ্লাদ করে পড়ার বিষয় হিসেবে দর্শনশাস্ত্র বেছে নিয়েছিলাম। পাঠ্যসূচিটাও ব্যাপক পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বাংলা ভাষায় দর্শন শাস্ত্রের ওপর লেখাপড়া করতে গিয়েই সাধ চুকে গেল। মনে হল পৃথিবীর সবচে কঠিন ভাষাটাই আমাদের এই মাতৃভাষা। তাই সরাসরি আত্মসমর্পণ করে বসলাম। নিগূঢ় রহস্য উদঘাটনের হাল ছেড়ে দিলাম। পরীক্ষার আট-দশ দিন আগে নীলক্ষেত থেকে সিলেবাস দেখে বই কিনে আনতাম। আগের রাত জেগে বইগুলো একবার পড়ে যেতাম। খটরমটর কিছু শব্দ এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি কাগজের স্লিপে লিখে নিতাম। পরীক্ষার হলে গিয়ে সব উগড়ে দিয়ে মাথাটাকে পরিষ্কার করে নিতাম। তারপর শান্তি। এই চরম খটরমটর বাংলা ভাষার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেও কেন জানি দার্শনিকদের জন্য খুব মায়া হয়। এই বেচারাদেরকে সাধারণ সমাজ তেমন মূল্য দিতে চায় না। কেউ কেউ পাগল বলে আখ্যা দেয়। জগলুল ভাইয়ের এই গল্পটাই তো এর বাস্তব উদাহরণ। একজন দার্শনিকের মগজের মূল্য কোন বিবেচনায় কেজি প্রতি মাত্র ২০ টাকা রাখা হলো? নাহ, আমি কোনোভাবেই বিষয়টা সমর্থন করতে পারলাম না। আর জগলুল ভাই-ই বা কেমন অবিবেচক লোক! দার্শনিকদের জন্য অবমাননাকর এমন গল্প বলা কি খুব জরুরি ছিল? আগে তো তার ব্যাপারেও আমার উচ্চতর ধারণা ছিল। তাকেও আমি দার্শনিক হিসেবেই বিবেচনা করতাম। যদিও প্রতিটি মানুষই দার্শনিক। পিথাগোরাসের ভাষায় বললে প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসাকেই দর্শন বলা হয়। সাধারণ সংজ্ঞায় বলা যায় পৃথিবীর সব কিছুই দর্শনের বিষয়। আর এ বিষয়গুলো নিয়েই দর্শন আলোচনা করে। পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষই তার সামনের বিষয় নিয়ে কৌতুহলি হয়ে উঠে, অজানাকে জানতে চায়, শিখতে চায়। এগুলো নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং সবাই দার্শনিক। এমনকি বদ্ধ উন্মাদেরও একটা দর্শন আছে। যার চিন্তার জগত যতদূর সে তত বড় দার্শনিক। তবে সাধারণ চিন্তার জগতে যারা সাধারণের বাইরে তাদেরকেই দার্শনিক বলা হয়। আমি জগলুল ভাইকে সেই সাধারণের বাইরের দার্শনিকই ভাবতাম। তবে কেউ ভুল করে তাকে সক্রেটিস, প্লেটো বা এরিস্টটলের সমত’ল্য ভাববেন না। তিনি আমার কাছে তাদের চেয়েও বেশি। কারণ সক্রেটিস এরিস্টটলের তত্ত্ব ও তথ্য কেবল পড়েছি। এদের চোখের ভাষা পড়ার সুযোগ হয়নি। এদের সাথে একপক্ষীয় আড্ডা হয়েছে। আমি প্রশ্ন করেছি, জবাব পাইনি। কিন্তু জগলুল ভাইয়ের সাথে বহুবার, বহুবার দ্বীপক্ষীয় আড্ডা হয়েছে। জীবন্ত আড্ডা। হাওরের নাঙা চাঁদের নিচে ভাসমান নৌকায়, রাতের কমলাপুর স্টেশনে, ভৈরব মেঘনাঘাটের হাহাকার সন্ধ্যায়, রাজধানীর শাপলা চত্বর, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী, আজিজ মার্কেট, নাহার প্লাজায়। আড্ডার হাজারো বিষয়, হাজারো জিজ্ঞাসা। পৃথিবী, সৃস্টিজগত। দর্শনের প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, আধুনিক যুগ এবং সমকালীন যুগ। চিন্তার আদান প্রদান। আগুন, পানি, আকাশ। তরল, কঠিন, বায়বিয়। সভ্যতা, অসভ্যতা, বর্বরতা। শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, ছড়া। ভাষা, সংস্কৃতি। রাজা, প্রজা, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র। জাতীয়তাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ। আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা। নাহ। জগলুল ভাই সব জান্তা নন। তারপরও কিছু কিছু লোকের অনেক বিষয় জানতে হয়। তিনি এমনই এক লোক। সসীম হয়েও অসীমকে ধারণ করেন। তিনি জানেন, অসীমকে টেক্কা দিতে যাওয়ার আরেক নাম মূর্খতা। এক যায়গায় এসে সব সসীমকেই থেমে যেতে হয় - এক রাতে আমিও/ পার করে যামিও/ ভোরে এসে থামলাম/ আত্মার অন্তরে/ ক্রমাগত নামলাম।/ তারপর রুমিকে/ জিগালাম তুমি কে?/ আর কে বা আমি/ কার কে বা ডামি?/ রুমি কয় বৎস/ মাছ যদি মৎস/ আমি আর তুমিতে/ আসমান ভ’মিতে/ ডিফারেন্স নাই তো-/ তুমি আমি তাই তো/ সব এক এককের/ লিখে দেয়া বর্ণ/ রূপা তামা স্বর্ণ/ যাই তাকে ভাবো না/ মাটি ছাড়া কোথ্থাও/ আর কিছু পাবো না।/ অতঃপর মাটিতে/ হাঁটিতে হাঁটিতে/ খোরাসান-মিরপুর/ আরো কতো ঘাঁটিতে/ মাওলানা রুমিকে/ দেখলাম সেজদায়/ চুমো খেতে ভুমিকে।/ তার পর আরো পথ/ হাঁটলাম আমিও,/ হাঁটলাম হাঁটলাম/ কতো পথ কাটলাম/ মাটি মানে মানুষ তা/ আরো পরে জানলাম/ জানলাম আমিও।/ রুমি বলে কতো কথা/ কতো ভাব কায়দার/ শেষে বলে হায়দার/ ওখানেই থামিও।/ ওখানেই তাকে পাবে/ হ্রৎ কাবা কক্ষে/ ওখানেই সদা তিনি/ মানুষের বক্ষে! সোজাসাপটা কথা। দ্বান্দিকতার ঘোরচাপ নেই। নিজে যা বিশ্বাস করেন। বড় গলায় সেটাই চাওড় করেন। লিখেন, বলেন। লিরিক সাজান। সুর করেন। কখনো কখনো নিজেই গেয়ে শুনান। আর জলসার সাথিরা একেকজন তার কাছে রুমির প্রেমের সাথি। কখনো তিনি নিজেই আইনস্টাইন। কর্মক্ষেত্র মতিঝিলে কাজ শেষ করে ইল্লাল ইশকের জোরে শাপলা চত্বর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যান শাহবাগ এলাকায়- আইনস্টাইনের হাত ধরে রোজ বিকেলের শাপলা চত্বর/ হেঁটে যায় শাহবাগ। ছবির হাট। টিএসসি কিম্বা সরোয়ার্দী।/ রুমির প্রেমের পাখিরা মাঝে মাঝেই মিলিত হয় এখানে। গুমোট/ সন্ধ্যার শরীরে মাখে গোলাপি রঙ। তাবরিজ খোরাসান কিম্বা/ আরো যেখানে যেখানে ছড়ানো ভালোবাসার সুবাস, সব সমবেত/ হয়। প্রতিটি কথাই জরুরি এখানে। আর যে কথার এজেন্ডা প্রেম/ যার ইস্যু মুহাব্বত তার জরুরাত সম্পর্কে ওয়াকেবহাল সার্বভৌম/ বৃক্ষও। বৃক্ষ নিজেও কথা বলে। মেখে দেয় ভাবের ক্লোরোফিল/ সবুজ পাতার রূহ মুবারকে। রুমির দরবেশদের মতো রুহানী হাওয়ায়/ দোলে ওঠে আলোছায়া। নাচে। ভাব-নৃত্য। রোজ নাচের শেষে/ আমি দরবেশদের হাত ধুয়ে চলে আসি। আর আমার চলার পথে/ হাওয়ার নূপুরে বাজে পাতা ও পাখিদের যুগল জিকির- ‘ইল্লাল ইশক/ ইল্লাল ইশক! জগলুল ভাই ইদানীং খাসা কবিতায় ব্যাপক মনযোগী হয়েছেন। ছড়াকার হিসেবেই তার পরিচিতি। সবাই চেনেন ‘ছড়ার হিরো’ বলে। তিনি উত্তরাধুনিক ছড়াকার। যুগের পর যুগ ধরে সাহিত্যে দুই ভাইয়ের মতো পাশাপাশি এগিয়ে চলছে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা। কেউ কেউ অভিযোগ করতে চান উত্তরাধুনিক কবিতার মূল বিষয় হলো দুর্বোধ্যতা। কিন্তু জগলুল হায়দার উত্তরাধুনিকতার পাকাপোক্ত একটি জগত তৈরি করলেও, টর্চ লাইট দিয়ে খুঁজেও আমি কোনো দুর্বোধ্যতা খুঁজে পেলাম না। বরং যেসব বিষয় দুর্বোধ্য হওয়া উচিত, সেগুলোকেও টেনে টুনে বোধগম্য করে তুলেছেন তিনি- সক্রেটিসে অর্ডার দিলে জেনোফোনের দোকানে/ প্লেটো বলে এরিস্টটল নে তো লিচুর ঝোঁকা নে।/ জুলজিতে সাইড মাইরা তাই ধরে সে বোটানি/ তার চেয়ে কি পিথাগোরাস আরো বেশি মোটা নি?/ পাতলা মোটা যা কিছু হোক আর্কিমিডিস ভাসাবে/ টলেমী কি নিচ্ছে তবে বাদামতলি বাসা বে?/ ঘুরছে মাথা ব্রুনোর শুনে কোপার্নিকাস আইসা/ এসব নিয়া গ্যলিলিওরে ধরলো ভীষণ ঠাইসা।/ গ্যালিলিও দুনোমুনো পোপরে দেখে ভয়ার্ত/ এই জাগাতে তাই মেলে না চন্ডীদাসের পয়ার তো।/ চন্ডীদাসের খবর পেয়ে আপেল আনে নিউটনে/ হেমন্তকাল শীতের আমেজ সঙ্গে মেরিল কিউটও নে।/ বহুজাতিক কিরিম থুইয়া দেশিগুলাই মাখাবি/ মেঘনাথের মেঘ এসে কয় ভিনদেশে কেন তাকাবি?/ তাকাবি তয় পণ্যে তো নয়, জ্ঞানগরিমার তালাসে/ এই ইস্যুতে সাপোর্ট দিতে হিউয়েন সাঙও কাল আসে।/ হিউয়েন সাঙয়ের খবর পেয়ে চুপ কি থাকে বতুতা/ সেই খুশিতে শালিক নাচে গায় যে টিয়া ও তুতা।/ তুতার বদল তোতা শুনেই ধমকে বলে চামস্কি/ ভাষা বাহন যোগাযোগের, মানুষ ভাষার চামচ কি?/ নয়রে চামচ সেই কথাটাই বলছে অধম হায়দারে/ শুদ্ধ(?) জিনিস চাপাই’ দেবার তবু কতো কায়দারে।/ শুদ্ধ-শুদ্ধ- অশুদ্ধ এই ধারণাটাই মচকাবে/ নিজের জবান বর্গা দিয়া আর কতো কাল লস খাবে?/ চিরটাকাল সইবে তবু সেই সে লসের গুত্তা কি/ নিজের উপর ঈমান এনে হও না এবার মুত্তাকি।/ নয় তো এ লস পুষবে কি আর মার্ক্স এডামের থিউরিতে/ থাকতে হবে সারা জীবন ফিয়ার এবং ফিউরিতে।/ হেরোডেটাস ভারত আঁকে ভারত কিন্তু চীন না/ এই কথাতে সাপোর্ট জানায় গান্ধী মুজিব জিন্না।/ ইউক্লিডের সরল রেখাই সবচে জটিল এখানে/ ছাপবি যদি এই ব্যাপারে রামানুজের লেখা নে।/ ইসাবেলার ইচ্ছা ভাসে নীল সাগরের পানিতে/ লোভের ভাগে ডাচ হার্মাদ পিছে আসে তা নিতে।/ কলম্বাসে কল্কি টেনে ধরিয়ে দিলো গামাকে/ ম্যাগিলেনও মজলো শেষে পাগলা নেশার তামাকে।/ কোয়ান্টমের কূলে আইসা স্টিং তত্ত খাড়াইলো/ দুঃখ লাগে লেবানিজের নামটা পুরা হারাইলো।/ হ্যাভেল সাবের যন্ত্রে দেখি গ্যালাক্সি বাস ছুটতেছে/ টিকেট কেটে নেবুলারা সেই বাসে সব উঠতেছে।/ আইনস্টাইন চাল্লু আবার তাই তো আলোর গতিতে/ সময়টাকে চাচ্ছে নিতে জার্নি করে অতীতে।/ সেই সময়ের সঙ্গা নিয়া হকিন্স এখন হাঁপাচ্ছে/ এভরিথিংয়ের তত্তে যে তার হুইল চেয়ার লাফাচ্ছে।/ জেরুজালেম রোম কাশি আর শাক্যমুনির গয়াতে/ মানুষ আছে মানুষকে বল মাপবি তোরা কয় হাতে?/ তাই তো মুসা যিশুর পরে মুহাম্মদের মক্কাতে/ বিশ্ব খুঁজে কেন্দ্র নিজের নিজেরই সুরক্ষাতে। আমার মনে হয়, চাইলেও তিনি কঠিন করে কিছু লিখতে পারবেন না, বলতেও পারবেন না। একটি কবিতায় অনেকগুলো কঠিন চিন্তার সমন্বয় করেছেন। তবে সমন্বিত উপস্থাপনটা হয়েছে সহজ। অনেকগুলো দর্শনের কৌনিক আলো টেনেছেন নিজের দিকে। আর এই পুরনো আলোগুলো একসাথে মিলে তৈরি হয়েছে নতুন একটি উজ্জ্বল আলো। নাম জগলুল হায়দার। কিন্তু তার মতো এমন এক উচ্চমার্গীয় ব্যক্তি দার্শনিকের মগজের মূল্য ২০ টাকা কেজি ধরবেন, এটা কেন জানি বিশ্বাসও হতে চাইলো না। তাই গল্পটার দিকে আরো বেশি মনযোগি হলাম। জিজ্ঞেস করলাম কেন এমন ঘটনা ঘটলো? তিনি বললেন, ঘটলো আবার কি, ঘটনা তো মাত্র শুরু। আমি জিজ্ঞেস করলাম এর পর কী হলো? জগলুল ভাই বললেন, এর পর অন্য আরেকটি জারে রাখা মগজ দেখিয়ে চার বন্ধু জিজ্ঞেস করলো ভাই এটা কোন পেশার লোকের মগজ? বিক্রেতা বললো, বৈজ্ঞানিকের। কত করে কেজি? ৫০ টাকা। সর্বনাশ! দার্শনিকের মগজের মূল্য ২০ টাকা। বৈজ্ঞানিকের ৫০ টাকা। গুণি লোকদের এমন অসম্মান! বৈজ্ঞানিক বন্ধুটিও হতাশ হলো। তবে দার্শনিকের চেয়ে মূল্য বেশি হওয়ায় একটু ভাবেও রইলো। এর পর জানতে পারলো ইঞ্জিনিয়ারের মগজ ৬০০ টাকা কেজি। যাহ শালা। বৈজ্ঞানিকের চেয়েও দেখি ইঞ্জিনিয়ারের মূল্য ১২ গুণ বেশি। সব শেষে জানা গেলো অর্থনীতিবিদের মগজের মূল্য ১০০০ টাকা কেজি। শুনে তো অর্থনীতিবিদ খুশিতে ডগমগ। চার বন্ধুর মধ্যে তার মগজের মূল্যই সবচে চড়া। অর্থাৎ পৃথিবীতে যদি অর্থনীতিবিদ না থাকে, তাহলে এইসব দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক আর ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে কিছুই হবে না। এমন একটা ব্যাপার আরকি। অর্থনীতিবিদের পা তো আর মাটিতে পড়ে না। আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো এমন একটা লোক স্টিফেন হকিংসদের মতো তাবড় তাবড় ব্যক্তিদের মুখের ওপর মাতব্বরি করবেন বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলাম না। জগলুল ভাই কোনো নাটক তৈরি করছেন না তো!- নাটক নাটক আচ্ছা নাটক/ চারপাশে আজ নাট্যশালা;/ ধস্ত বিবেক ধমকে বলে/ নাটক তোদের পাঠ্য শালা! পুরো গল্পটা বলতে জগলুল ভাইয়ের সময় লেগেছে বড়জোর দুই-এক মিনিট। কিন্তু এ দুই এক মিনিটের মধ্যেই চিন্তার জগতে ঢেউ খেলে গেছে অনেক। আর এ ঢেউগুলোকেই গুনে গুনে উপস্থাপন করছি এখানে। তাই গল্পের ফাঁকে ঢুকে যাচ্ছে তারচেয়েও বড় গল্প। ঢুকছে জগলুল হায়দারের ছন্দ ও চিন্তার দোলনা- বাইরের আগুন সবাই দেখে/ ভেতরের বারুদ টের পায় না অনেকেই/ যে পারে সে ফুল আর ফিলোসোফির পাঠ/ এক সংগেই নেয়;/ কারো কারো ফুলোলজি আবার ছেঁড়া-ছিঁড়িতেই সীমাবদ্ধ।/ ছিঁড়লেই তাদের মোক্ষ/ তারা সোনার ডিম চায়/ অথচ হাঁসের প্রতিপালন বোঝে না।/ মানুষ, মানুষ তাই!/ শেষমেশ মানুষ যে কি সেটা বোঝা যায় না; বোঝা গেলে সে কি আর মানুষ হতো? ... আশ্চর্য্য এক চীজ মানুষ। মানুষের মন আর আকাশের রঙ বোঝা দায়। কিসে যে মানুষের আনন্দ সেটাও এক রহস্য। মানুষ ভালোবাসে একটু সুখের আশায়। আবার এ সুখের ভাঁজে ভাঁজেই লুকিয়ে থাকে জ্বালা- একটা সুঁই একটা সুতা/ গাঁথলে পরেই মালা হয়;/ একটা দিলে আরেকটা দিল/ বাঁধলে পরেই জ্বালা হয়। আবার সাময়িক যে সুখের সময়। সেটাকেও ঘিরে ধরে জগতের সবচে নিষ্ঠুর বাস্তবতা- বিধি তুমি পকেট দিলা/ পয়সা খালি দিলা না;/ ম্যাসেঞ্জারের চাকরি করি/ ডিউটি পরের বিল আনা! জগলুল হায়দার উচ্চারণ করেছেন দ্রোহের ছন্দ। সময়কে ব্যাঙ্গ করেছেন- লাশ তো এখন গাছের গোটা/ ঝাঁকি দিলেই ঝরছে;/ তোমরা খুঁজো দল পরিচয়/ কিন্তু মানুষ মরছে! তিনি বলবেন তার কথা। আর সময় চলবে সময়ের মতো। সময় কথা শুনুক বা না শুনুক। কবিদের বলে যেতেই হবে- নগর পুড়লে স্বভাবতই/ সংগে পুড়ে দেবালয়;/ ইতিহাসের এই সাজেশন/ পোড়ার দেশে কেবা লয়!? এই তো ছড়াকার জগলুল হায়দার। তার চিন্তা ও দর্শন। আমাদের জগলুল ভাই। একখন্ড পৃথিবী ও বন্ধু। জগলুল ভাইয়ের বড় বড় চোখ দুটিতে সব সময়ই উচ্ছ্বাসের ভাষা। হাত দুটো বুনন করে একেকটা গল্প। এ গল্পটাও তিনি বলছিলেন চোখ নাচিয়ে, হাত নাড়িয়ে। বলতে বলতেই চরম একটা সমাপ্তিও টানলেন। তিনি বললেন- শেষ মেষ বেচারা অসহায় দার্শনিক বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, আসলে ভাই আপনারা মগজের মূল্য নির্ধারণ করেন কিভাবে? বিক্রেতা ঝটপট জবাব দিলেন জীবদ্দশায় যার মগজ যত কম ব্যবহৃত হয়েছে তার মগজের মূল্যই বেশি ধরা হয়। এর পর জগলুল ভাই নিষ্ক্রান্ত হলেন। আমি এক দফা পেট ফাঁটানোর মত হাসি হাসলাম। হাসতে হাসতেই মনে হল জগলুল ভাইয়ের মগজেরও একটা মূল্য নিরুপণ করা প্রয়োজন। উত্তরাধুনিক ছড়া, আর কবিতার ঘুন বাসা বেঁধেছে তার মাথায়। বয়স পঞ্চাশ হলেও সত্যিকারের বয়স সভ্যতার সমান। কাজেই এতো বয়সের এতো ভার সহ্য করতে করতে তার মগজের বেশিরভাগ কোষই অকেজো হয়ে গেছে। ঘুনে খাওয়া এ মগজের দাম চল্লিশ টাকার বেশি উঠার কথা নয়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment