দুই জেলায় দুই বছর ধরে নিখোঁজ তিন শতাধিক মানুষ নিউজ ডেস্ক আরটিএনএন ঢাকা: সারা দেশে আলোচনার তুঙ্গে এখন মানবপাচার। ভালো কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে কতো মানুষকে দালাল চক্র অজানার উদ্দেশে ঘরছাড়া করেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। কতো মানুষ গভীর সাগরে কিংবা ভিন দেশের বনে বাদাড়ে নির্যাতনে-অনাহারে জীবন বলি দিয়েছে কেউ জানে না। দুখী-অভাবী, ভাগ্যবিড়ম্বিত বাংলার মানুষগুলোর জীবন দেশের প্রশাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস
্থার ব্যর্থতায় এভাবেই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। তেমনি এক ট্রাজেডির গল্প সিরাজগঞ্জের নিখোঁজ তিন শতাধিক মানুষকে নিয়ে। অপর জেলা সাতক্ষীরায় নিখোঁজ ১৬ যুবক। দুই বছর তাদের হদিস নেই। জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ থেকেই পাড়ি জমিয়েছিলেন চার হাজার জন। সংসারে সচ্ছলতার স্বপ্ন নিয়ে সাগরে ভাসা। গন্তব্য থাইল্যাল্ড বা মালয়েশিয়া। পথটি বৈধ না অবৈধ ওই আইনের মারপ্যাঁচ বোঝেন না তারা। গ্রাম-বাংলার সাধারণ, অভাবী ও প্রান্তিক মানুষ। কেউ ঋণগ্রস্ত, কেউ নদীভাঙনের শিকার, কেউ বেকার। কারো ছিল ছোট্ট মুদি দোকান, কারো পেশা দিনমজুরি, কেউবা সদ্য বিবাহিত। এর পরই হাহাকার আর অসহায়ত্ব। তারা ভাসমান না মৃত উত্তর জানা নেই কারো। সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন— দালালের প্রলোভনে সাগর পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন প্রায় ৪ হাজার। বয়সে তরুণ। অধিকাংশই বেকার। একটি বেসরকারি সংস্থার দাবি, জেলার তিন শতাধিক যুবক এখন নিখোঁজ। কিন্তু মানব পাচারকারী চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। পরিবারগুলোয় শোকের মাতম চলছে। সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের জারিলা পোড়াবাড়ী গ্রামের তারা সেখ। তিনি জানান, তার ছেলে মো. ইলিয়াস ২০১৪ সালের ৭ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ। একই গ্রামের আসাব উদ্দিনের ছেলে মালেক ছয় মাস ধরে নিখোঁজ। সারুটিয়া কলেজপাড়ার শাহআলম নিখোঁজ এক বছর। দালালদের দুই দফায় ৭০ হাজার টাকাও দেন, জানায় তার পরিবার। একই গ্রামের হিরন নিখোঁজ প্রায় নয় মাস। ডিগ্রিরচরের আহমেদ শরিফ নিখোঁজ ২০১৪ সালে। একই এলাকার এরশাদ, রাজা, সাখাওয়াত, আব্দুল্লাহও নিখোঁজ। বেলকুচির ক্ষিদ্রমাটিয়ার শুকুর আলী ও হাবিবুল্লার একই দশা। কামারখন্দের চৌবাড়ী দক্ষিণপাড়ার লিটন সরকার ও আইব আলীও নিখোঁজ। স্ত্রী হালিমা ছয় মাসের কন্যাসন্তান নিয়ে দিশেহারা। স্বামী ইলিয়াস ফিরবেন কিনা জানেন না। প্রতিদিনই টেলিভিশন আর খবরের কাগজে খোঁজ নিচ্ছেন। গোটা জেলার সব উপজেলায় নিখোঁজের তালিকা বাড়ছে। স্থানীয়দের তথ্যমতে, শুরু হয়েছিল বিনা টাকায় থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়া যাত্রার প্রলোভন। কেউ কেউ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকাও দেন। সাগরে ভাসার পর পরিস্থিতি বদলে যায়, জানান ভুক্তভোগীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী জানান, তিনি ১৩ মাস বন্দি ছিলেন। পাচারকারী চক্রটি শুরুতে ৮-১০ জনকে বিদেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখায়। মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। বলা হয়, শুধু ঢাকা পর্যন্ত যাওয়ার ভাড়া থাকলেই হবে। এর পর সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে কক্সবাজার। পরে নৌকা বা ট্রলারযোগে সাগরে ভাসা। তার পরই চলে পরিবারের সঙ্গে দালাল চক্রের দরকষাকষি। টাকার অঙ্ক নিয়ে ফয়সালা। এ টাকা পেতে প্রতিদিনই তাদের ওপর চালানো হয়েছে নির্যাতন। ফলে সন্তান, ভাই ও স্বামীকে বাঁচাতে পরিবারগুলো ধারদেনা, ঋণ, ঘরবাড়িসহ শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, দালালরা চেনা। তারা স্থানীয় ও প্রভাশালী। ফলে অনেকে অভিযোগ করার সাহস রাখেন না। সরেজমিনে অনুসন্ধান ও নিখোঁজ পরিবারগুলোর কাছ থেকে যেসব মানব পাচারকারী দালালদের নাম উঠে এসেছে, তারা হলেন— কামারখন্দের বড়ধুল গ্রামের আব্দুল মজিদ, চালা শাহবাজপুরের পল্লীচিকিৎসক সানোয়ার, বেলকুচির কল্যাণপুর গ্রামের ফয়সাল, মৌপুর গ্রামের জুলমাত আলী ও দেলুয়া গ্রামের তালেব। তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। সিরাজগঞ্জের বেসরকারি সংস্থা ডেভেলপমেন্ট ফর ডিজঅ্যাডভানটেজড পিপলের (ডিডিপি) নির্বাহী পরিচালক কাজী সোহেল রানা জানান, পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে জেলার প্রায় ৪ হাজার মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে। এর মধ্যে ৩ শতাধিক নিখোঁজ। সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার এসএম এমরান হোসেন জানান, কেউ বিদেশে যাওয়ার নামে প্রতারিত হলে বা নিখোঁজ থাকলে জানালে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্তরা তথ্য না জানালে অপরাধীদের ধরা কঠিন। সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানিয়েছেন— দুই বছরেও সন্ধান মেলেনি মালয়েশিয়াগামী ১৬ যুবকের। সবার বাড়ি কলারোয়ার বসন্তপুর গ্রামে। ওই পরিবারগুলোয় চলছে শোকের মাতম। দুই বছর আগে দালালের খপ্পরে পড়ে সাহেদ আলী, সাইফুল, আরিফসহ ১৬ জন নিখোঁজ হন। অভিভাবকদের তথ্যানুযায়ী, উপজেলার কাজীরহাট গ্রামের রউফ ও শুভঙ্করকাটি গ্রামের আজিজ মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেখান। মাথাপিছু কয়েক লাখ টাকাও নিয়েছে। তাদের মালয়েশিয়ায় নেয়ার কথা ছিল। পরিবারের সঙ্গে কারো এখন যোগাযোগ নেই। নিখোঁজ আজমলের বাবা সিরাজুল ইসলাম জানান, শেষ সম্বল জমি বিক্রির ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। ছেলের আর কোনো খোঁজ নেই। আরশাদ আলী জানান, তার ছেলে, ছোট ভাই, ভাইপোসহ নিখোঁজ চারজন। দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা মুক্তিপণ দাবি করে। থানা পুলিশও তাদের খোঁজার নামে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছে। মন্তব্য
No comments:
Post a Comment