শ্রমবাজার সংকোচনেই অবৈধ সমুদ্রযাত্রা আরটিএনএন ডেস্ক ঢাকা: বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরবের শ্রমবাজার বন্ধ ২০০৯ সাল থেকে। ২০১২ সাল থেকে বন্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারও। দীর্ঘদিন পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও গত তিন বছরে পাঠানো গেছে (সরকারি ব্যবস্থাপনায়) মাত্র সাত হাজার শ্রমিক। শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসার এ সুযোগই নিচ্ছে দালালরা। তাদের প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দিচ
্ছেন বিদেশ গমনেচ্ছুরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈধ পথে প্রচলিত বাজারগুলোয় জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়া ও নতুন বাজারগুলোয় সুবিধা করতে না পারায় অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সমুদ্রপথে মানব পাচারের অন্যতম রুট হয়েছে বঙ্গোপসাগর। মৃত্যুঝুঁকি ও সহিংসতার আশঙ্কা সত্ত্বেও এ পথেই মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন অসংখ্য বাংলাদেশী। অনেক দিন বন্ধ থাকার পর সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির খবরে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অনেকেই। দেশটিতে যেতে নাম নিবন্ধন করেন সাড়ে ১৪ লাখ শ্রমিক। ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রথম দফায় শ্রমিক পাঠানো হয় ৬৫ জন। এ প্রক্রিয়ায় গত তিন বছরে মালয়েশিয়ায় পাঠানো গেছে মাত্র সাত হাজার শ্রমিক। তারা সবাই প্লান্টেশনে কাজ করছেন। তবে মালয়েশিয়া থেকে চাহিদাপত্র না আসায় কয়েক মাস ধরে এ প্রক্রিয়াও বন্ধ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় শ্রমিকরা যেতে না পারায় বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছেন তারা। অনেকে স্টুডেন্ট ভিসার পাশাপাশি ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন। এভাবেও যারা যেতে পারছেন না, সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিচ্ছেন তারা। এ প্রসঙ্গে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনে অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার বলেন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো প্রধান শ্রমবাজারগুলো প্রায় বন্ধ। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। এছাড়া মালয়েশিয়া থেকে সরকারিভাবে শ্রমিকের চাহিদাপত্র তেমন আসছে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েই দালালরা সমুদ্রপথে মানব পাচার করছে। কিছুদিন ধরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া উপকূল থেকে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদ্ধারের খবর আসছে। গত শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে দুটি নৌযান থেকে ৭৪৭ জন বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উদ্ধারের পর এ উপকূলেই আরেকটি নৌকা থেকে ২০০ জনকে উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই থাইল্যান্ডের একটি দ্বীপেও সন্ধান পাওয়া যায় আরো শতাধিক অভিবাসীর। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া উপকূল থেকে অন্তত তিন হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উদ্ধার করা হয়েছে। খাবার নিয়ে মারামারিতে শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার খবরও এসেছে। এছাড়া গত রোববার রাতে বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার উপকূল মেরুল্লাচর এলাকা থেকে মালয়েশিয়াগামী ছয় বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন বলছে, সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিবাসীদের সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রার হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই বঙ্গোপসাগর দিয়ে ২৫ হাজার লোক সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশী। ২০১৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে প্রায় ৫৬ হাজার মানুষ সমুদ্রপথে অবৈধভাবে যাত্রা করেন। এর মধ্যে শুধু বঙ্গোপসাগর দিয়েই গেছেন ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ; যাদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। এভাবে ২০১২ সাল থেকে গত তিন বছরে বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়া গেছেন কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, মূলত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় মানব পাচার হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে চার রাষ্ট্রের সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রগুলো মিলে একটি যৌথ কমিশন গঠন করতে পারে। পাশাপাশি এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে বৈধ পথে অভিবাসনের সুযোগ বাড়াতে হবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যানেও বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য বিদেশী শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার প্রমাণ মেলে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে পাঠানো সম্ভব হতো। ২০১৩ সালে তা কমতে শুরু করে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা প্রায় বন্ধ করে দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভিসা বন্ধ হওয়ার পর ২০১৩ সালে দেশটিতে শ্রমিক রফতানি নেমে আসে ১৪ হাজার ২৪১ জনে। অথচ ২০১২ সালেও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ বাংলাদেশী। ২০১১ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৯। একইভাবে সৌদি আরব বাংলাদেশের কর্মী নেয়া বন্ধ রেখেছে ২০০৯ সাল থেকে। ২০০৮ সালে যেখানে ১ লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জন কর্মী যান, ২০০৯ সালে সেখানে ১৪ হাজার ৬৬৬, ২০১০ সালে ৭ হাজার ৬৯, ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৩৯, ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৩২, ২০১৩ সালে ১২ হাজার ৬৫৪ ও ২০১৪ সালে ১০ হাজার ৬৫৭ জন কর্মী সৌদি আরব যেতে পারেন। এসব কর্মীর বেশির ভাগই আবার গেছেন ব্যক্তিগত ভিসায়। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া। ২০০৭ সালে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ ও ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়া যান। ২০০৯ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয়। এর পর বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বাদ দিয়ে সরকারিভাবে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। খুব একটা সফলতা আসেনি তাতেও। জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, কর্মসংস্থানের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় সাত লাখের বেশি লোক বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। কিন্তু দুই বছর ধরে গড়ে চার লাখের কিছু বেশি শ্রমিক বৈধ পথে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। আর যারা যেতে পারছেন না, তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে পাঠাচ্ছে দালালরা। বহু অভিবাসী মাসের পর মাস নৌকায় করে সমুদ্রে ভেসেছেন, পানি ও খাবারের অভাবে অনেকেই সাগরে মারাও গেছেন। অনেক সময় মানব পাচারকারী এ চক্র মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে, আন্দামান ও ইন্দোনেশিয়ার উপদ্বীপে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এত হুঁশিয়ারি ও সতর্কতার পরও মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন। এতে আমাদের শ্রমবাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পরিস্থিতি উত্তরণে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি চলতি মাসেই আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। মালয়েশিয়ায় জিটুজি (সরকারিভাবে) পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মালয়েশিয়ায় চাহিদা অনুযায়ী লোক পাঠাচ্ছি। চলতি মাসের শেষ দিকে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আমাদের বৈঠক আছে। তারা যাতে দ্রুত বেশি সংখ্যক শ্রমিক নেয়, সে বিষয়টি বৈঠকে তুলে ধরব।’ সূত্র: বণিকবার্তা মন্তব্য
No comments:
Post a Comment