' alt='' /> তা হলে এতগুলি না ছাপা কবিতায় ভরা আস্ত একখানা খাতা কোথায় লুকিয়েছিল এত দিন? আর কী ভাবেই বা পাওয়া গেল তা? বাঙালি পাঠকের কাছে সেই উৎস সন্ধানের সূত্র কিছু কম রোমাঞ্চকর নয়। গৌতম মিত্র। পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কলকাতার পথে পথে অমূল্য রতনের খোঁজে ছাই ওড়ানোই ছিল যার একমাত্র কাজ। জীবনানন্দের ডাইরি ও অন্যান্য রচনা উদ্ধারের কাজ যখন পুরোদমে চলেছে, সেই সময় ভূমেন্দ্র গুহর পাশাপাশি গৌতম মিত্রও এই অসাধ্যসাধনে নাম লিখিয়েছিলেন। জীবনানন্দ সংক্রান্ত যেখানে যেটুকু সঙ্কেত বা সূত্র, সেখানেই ছুটে যাওয়া ছিল তার কাজ। এই রকমই একটি সূত্রের নাম অশোকচন্দ্র গুপ্ত। জীবনানন্দ দাশ তার ডাইরিতে বন্ধু হিসেবে বারবার উল্লেখ করেছেন এই মানুষটির। বরিশালের সর্বানন্দ ভবনে থাকাকালীন এই অশোক চন্দ্র গুপ্তের পরিবারের সঙ্গে জীবনানন্দের পরিবারের হৃদ্যতার কথাও তার ডাইরিতে পাওয়া যায়। ১৯৪৬ সালে জীবনানন্দ পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন, তত দিনে অশোক চন্দ্র গুপ্তও সপরিবার কলকাতায়। এই শহরে এসেও তাদের বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ ছিল অটুট। এমনিতে জীবনানন্দ যে খুবই মুখচোরা ও নির্জন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তা আজ সুবিদিত। এ হেন মানুষ যখন বারবার বন্ধু হিসেবে কারও উল্লেখ করেন, তখন তার গুরুত্ব অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়। ২০০১ নাগাদ গৌতমবাবু ক্রমাগত জাতীয় গ্রন্থাগার ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে যাতায়াত করেছিলেন, জীবনানন্দ সংক্রান্ত আরও কিছু সূত্রের আশায়। কারণ জীবনানন্দের ডাইরি বলছিল, বহু অপ্রকাশিত লেখা এখনও আছে কোথাও। কিন্তু কোথায়? বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেই মিলল উত্তর। ব্রহ্মবাদী পত্রিকার একটি সংখ্যায় (যা এক সময় জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ সম্পাদনা করতেন) পাওয়া গেল অশোক চন্দ্র গুপ্তের কন্যাসন্তান লাভের খবর। হয়তো কোনো হদিশ মিললেও মিলতে পারে, এই ভেবেই অশোকচন্দ্রের সেই কন্যাসন্তানের খোঁজে বেরোলেন গৌতমবাবু। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ডোভার রোডের একটি বাড়িতে পাওয়া গেল তাকে। রত্না রায়, যার বয়স তখন ষাট পেরিয়ে গিয়েছে। জীবনানন্দের স্মৃতি তার কাছে স্পষ্ট। যেমন স্পষ্ট তার বাবার সঙ্গে কবির বিরল হৃদ্যতা। সেই সখ্যের ভরসাতেই, জীবনানন্দর মৃত্যুর পর তার গদ্য ও ডাইরিধর্মী অপ্রকাশিত লেখালেখি ভর্তি একটি ট্রাঙ্ক অশোকচন্দ্র গুপ্তের পরিবারের কাছে রেখে গিয়েছিলেন কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ। পরে জীবনান্দের ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশ সেই ট্রাঙ্ক থেকে লেখাগুলো উদ্ধার করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। জীবনানন্দ সংক্রান্ত আরও তথ্য ও স্মৃতির আশায় রত্নাদেবীর বাড়িতে যাতায়াত তৈরি হলো গৌতমবাবুর, পাশাপাশি তৈরি হলো বিশ্বাসযোগ্যতার এক সম্পর্কও। কেবলমাত্র সেই সম্পর্কের খাতিরেই রত্নাদেবী একদিন আড্ডার ছলে এমন এক কথা বললেন, বাংলা সাহিত্যের জগতে যা বিস্ফোরণের চাইতেও বেশি। জীবনানন্দ দাশের হস্তাক্ষরে লিখিত অপ্রকাশিত কবিতা ভর্তি একটি খাতা আছে রত্নাদেবীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। তার বক্তব্য, স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ এই খাতাটি তার পরিবারের হেফাজতে রেখেছিলেন। সেই থেকে সেই ভাবেই আছে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, স্বভাবে নির্জন সেই মানুষটি এক-খাতা কবিতা কেনই বা দিয়েছিলেন বন্ধুর হেফাজতে? তার কাছে তার লেখাই ছিল একমাত্র সম্পদ। সেই সম্পদ নিজের কাছে না রাখার কী কারণ থাকতে পারে? এমন আরও প্রশ্ন নিশ্চয়ই ভিড় করবে। কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর জানার উপায় হয়তো নেই। তবে সেই সম্পদ যে শেষমেশ পাঠককুলের হাতে পৌঁছচ্ছে সেটাই বড় কথা। পৌঁছচ্ছে কারণ শুধুমাত্র ভরসার খাতিরেই সেই খাতা গৌতম মিত্রের হাতে তুলে দিয়েছেন রত্নাদেবী। সেটা ২০০৪। এই মহাভাণ্ডার হস্তান্তরের খবর জানতেন কেবল তারা দু’ জনেই। তার পর ১০ বছর শ্রীমিত্র অপেক্ষা করেছেন স্বত্ব আইনের খাতিরে। আইনি বাধা উঠে যাওয়ার পর খাতাটি নিয়ে তিনি হাজির হন সপ্তর্ষি প্রকাশনের দফতরে। যার ফল? বইমেলায় পাওয়া যাবে গ্রন্থ। নাম ‘অপ্রকাশিত’। কয়েকটা ডাইনোসোর যেন চড়ুইভাতি করে কলরবে ডুবে গেল/ মেছোবাজারের থেকে গ্রে স্ট্রিটে— গঙ্গা— গঙ্গাসাগরের জলে/ ফার্পোর বাড়ি থেকে বাঁক মুছে প্রাগৈতিহাসিক কোলাহলে’ এই তিনটি পঙ্ক্তি পড়ামাত্র আমার চারপাশটা পাল্টে গেল লহমায়। আমি কি জেগেই স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু এমন স্বপ্ন তো সুদূর কল্পনাতেও ছিল না আমার! কারণ আর কিছুই নয়, আমার সামনে এখন খোলা আছে একের পর এক চমকে দেওয়া, থমকে দেওয়া কবিতায় ভর্তি একটি খাতা। এর আগে যার অধিকাংশ কবিতা কোনো দিন কোত্থাও ছাপা হয়নি, আর যার মালিক ও রচয়িতা স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই সকলেরই? আমারও গোড়ায় বিশ্বাস হয়নি। এও কি সম্ভব? যার লেখা পড়বার অধিকার অর্জন করে নিতেই সময় লাগে পাঠকের, তার হাতের লেখায় না-ছাপা এতগুলি কবিতা এখন আমার দু’হাতের মাঝখানে? একে প্রাপ্তি বললেও বোঝানো যায় না কিছুই। তার আনকোরা পাটভাঙা কবিতার আলো নতুন করে এসে পড়ছে আমাদের ছাদে। রাতের আকাশে এই যে অগুনতি তারা দেখতে পাই আমরা, তাদের মধ্যে অনেকেরই কিন্তু মৃত্যু হয়েছে বহু আগে। তবু যে দেখতে পাই, কারণ সে এতই দূরের তারা যে তার আলো আমাদের ছাদে এসে পৌঁছতেই অনেক বছর লেগে যায়। তাই আসলে সে যখন নেই, তখনও তার আলো আছে আমাদের কাছে। তার অতীতের আলো এসে পড়ছে আমার বর্তমানের ছাদে। আলোর লম্বা একটা সুতোয় বাঁধা পড়ছে বহু দূরের দুটো সময়। এই মুহূর্তে ঠিক সেইরকম একটা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমরা সকলেই। ‘পত্রিকা’-র সম্পাদকমশাই আমাকে এই অপ্রকাশিত গুচ্ছ থেকে কয়েকটি কবিতা নির্বাচন করে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। স্বীকার করা জরুরি ও বাহুল্যও যে, আমি কোনো ভাবেই এই দায়িত্বের যোগ্য নই। আমি শেষ সারিতে জায়গা করে নেওয়া একজন পাঠক কেবল, জীবনানন্দের কবিতাই যাকে বেছে নিয়েছে। সুতরাং, প্রক্রিয়াটি বিপরীত। তবে খুচরোর খোঁজে যার দিন কাটে, তার সামনে এক-সিন্দুক গুপ্তধন ঝিকমিকিয়ে উঠলে যা হয়, আমার অবস্থাও এখন ঠিক তাই। কী ভাবে নেব তা হলে এই সব কবিতার পাঠ? এ কথা ঠিকই যে আমরা অনেকেই একেবারে গোড়ায় জীবনানন্দীয় ভাষা-ব্যবহারের মোহের আবর্তে পড়ে যাই। যেমন একই সঙ্গে বিস্ময়ের পর বিস্ময় আসতে থাকে তার কবিতার দৃশ্যকল্পগুলির পিঠে চেপে। কিন্তু ভাষা বা দৃশ্যকল্পের ঘোর কাটতেই আমরা স্পর্শ করতে পারি চিন্তক ও দার্শনিক জীবনানন্দকে। যার কলমে ধরা পড়েছিল মহাসময়ের ইতিহাস। এই কবিতাগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনানন্দকে বারবার পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, তিনি সারাজীবনের লেখালেখি দিয়ে সময়কে, সময়ের পরিক্রমাকে ধরতে চেয়েছেন। ব্যাপ্তিতে, গভীরতায়। কখনও একই সময়বিন্দু’র কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত পৌঁছতে চাওয়া, আবার কখনও বিস্তৃত সময়চেতনার পরিধিকে ছুঁতে চাওয়া। সত্যি বলতে কী, সময়ের বিস্তীর্ণতার যে-বিস্ময়বোধ, তা তো আমরা জীবনানন্দের কবিতা থেকেই অর্জন করেছি, আর সময়চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে ইতিহাসবোধ ও সমাজদর্শন। তার কবিতায় এই সব ক’টিই এমন ভাবে মিলেমিশে থেকেছে বরাবর যে, সেই মিশ্রণ হয়তো শেষমেশ ‘জীবনানন্দীয়’ ভঙ্গি হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। সাধারণত অপ্রকাশিত রচনাকে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রকাশিত রচনার মাঝে ফেলে দেখার একটা চল আছে। আমরা এখন জানি, ১৯৩৮-৩৯ সালে লেখা এই সব কবিতার ঠিক পরপরই জীবনানন্দ লিখবেন ‘মহাপৃথিবী’। সেখানে, আবিষ্কৃত এই খাতা থেকে কয়েকটি লেখা গৃহীতও হবে। আর এর আগেই লিখেছেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতার টানাপড়েনের অনুবীক্ষণে যদি না-ও রাখি এই কবিতাদের, একক ভাবেই এরা তাদের পরিচিতি তৈরি করে নিতে পারে। আমরা দেখব এই কবিতাগুচ্ছেও বারবার তিনি ফিরে গিয়েছেন সময়ের স্রোতের কাছে। পরিচিত আদলেই হয়তো, কিন্তু নতুন দেখায় অবশ্যই। আর সে-দেখার তির্যক আয়োজন, সে-উচ্চারণের ঈষৎ বাঁকা নিশানা কোনো বার ব্যর্থ হয়নি। একেবারে গোড়ায় যে-কটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করলাম, সেখানে সময়ের সুদূরবর্তী দুই বিন্দুকে কী চমৎকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন তিনি! আমরা তো ‘বাঁর নিয়ে’ শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু যে-মুহূর্তে ‘ফার্পোর বাড়ি থেরে বাঁক মুছে’ ব্যবহার করলেন আমি যেন ডাইনোসর-এর অপসৃয়মান বিশালাকায় লেজটুকু দেখতে পেলাম, আর তার পরের শব্দদুটোই ‘প্রাগৈতাহাসিক কোলাহলে’। এই মেছোবাজারের ঘিঞ্জি চৌহদ্দি থেকে এক লহমায় মানবসভ্যতারও আগের কোনো এক বিস্তীর্ণতায় পাড়ি দেওয়া, এও তো একরকম ‘ওয়ার্মহোল’ তত্ত্বই! কিন্তু সময়ের এই যাতায়াতের চাইতেও তাকে বেশি করে ভাবায় সময়ের বিপন্নতা। যখন একটি কবিতার গোড়ায় তিনি লিখছেন, ‘বার বার ডাক আসে রাজপথে নেমে শবের বাহক হতে/কত শব দগ্ধ করা গেল—’ আর সেই কবিতার শেষেই পড়ছি, ‘সব বিদেশির কাছে আমাদের এই এক পরিচয় :/ইহাদের মনন হৃদয় অবিরাম শববাহনের তরে/এরা ক্লান্তিহীন— অবিরাম শববাহনের তরে।’... স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। তিনি তো আমার, আমাদের সময়ের কথা লিখেছেন! যখন রোজ কোনো না কোনো জঙ্গি হামলায় কয়েকশো মানুষ মারা যাচ্ছেন, যখন প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও বোমার আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছেন হাজারো মানুষ, যখন ঘুম থেকে উঠে আমরা রোজই তৈরি হচ্ছি কাঁধে নতুন মৃতদেহ চাপিয়ে ঘুরে বেড়াব বলে। আর ভয় পাচ্ছি এই ভেবে, আজ আমি নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব না তো? তার সময়ে তিনি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। দেশভাগ দেখেছেন। কিন্তু সময়ের শবের উপর দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে মানুষের এই প্রতিনিয়ত ভেতর থেকে ছিন্ন করে যাওয়া যুদ্ধ, তাও কি তিনি কল্পনা করেছিলেন? আজ তো সত্যিই সকলের কাছে আমাদের এই এক পরিচয়। নতুন এই গুচ্ছ হাতে পেয়ে তার পরতে পরতে আমি কেবল আবিষ্কার করেছি আমার নিজের সময়কে, আমার বেঁচে থাকাকে। আরেকটি কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘আমাদের সাহস হারায়ে গেছে বহুদিন পুলিশের ব্যাটনের তলে নুয়ে থেকে/ ফুটবল-গ্রাউন্ডের কাছে বসে শকুন চরানো নীল এশিয়ার দুপুর বেলায়’। কেবল আক্ষরিক অর্থে ভাবলেও প্রথম পঙ্ক্তির অব্যর্থতা আমরা এড়াতে পারি না, নত হয়ে থাকা সময়ের শিরদাঁড়া আরও একবার টের পাই। কিন্তু ‘শকুন চরানো নীল এশিয়ার দুপুর বেলায়’? এই আশ্চর্য বর্ণনা কি কেবলই দৃশ্যকল্পের আয়োজন? উঁঁহু। আঞ্চলিকতার পরিসরে বৃহত্তর পরিস্থিতিকে চিত্রায়িত করাও বটে। শকুন চরানো নীল ভূখণ্ড থেকে আজও তো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। শকুনের ভিড় সময়ের সঙ্গে বেড়েছে কেবল। এই রকম একটা সময়ে শাসকের সামনে, ক্ষমতার সামনে শিরদাঁড়া খুলে মাটিতে পেতে দেওয়াই তো অধিকাংশ মানুষের কাজ। ক্ষমতার রং যখন যেমন, তখন নিজের রং তেমন করে নেওয়াই তো বেশির ভাগ মানুষের ধর্ম। সেই সব মানুষ, যাদের আমরা সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করে এসেছি অনেকদিন, ভাবিনি তারা সেই সম্মানের উপযুক্ত কিনা। কারণ এখানে আরও একটি কবিতায় জীবনানন্দ লিখছেন, ‘দেহের আরাম দিতে গিয়ে মোরা বিদ্বানের জন্ম দিতে পারি নাই’। এই একটিমাত্র পঙ্ক্তিতেই কি তিনি সময়ের শ্রেষ্ঠ বিপন্নতাকে ব্যক্ত করছেন না? তার সময়ের এবং আমার সময়েরও? আবারও, সময়, তার কবিতার প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সময়ের উপরিভাগ নয়। তার অস্থি, তার রক্ত, তার মজ্জা। সময়ভাবনার ত্রিমাত্রিকতায় গড়ে উঠছে কবিতার এক অন্য রকম জগৎ। জীবনানন্দ এই সমস্ত কবিতায় তার পূর্ববর্তী, বর্তমান ও পরবর্তী সময়ের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন একই সঙ্গে। তাই তাদের প্রাসঙ্গিকতা অমলিন। প্রথম কয়েকটি পাঠে যে-কবিতাগুলি আমাকে বেছে নিল, সেগুলির চার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নিরন্তর মৃত্যুস্রোত। সময়ের মোড়কে এক ধাবমান মৃত্যুবোধ। বয়ে চলেছে আশা ছাড়তে নারাজ সভ্যতার নিরাশার দিকে অবধারিত গড়িয়ে চলা। তার নিজস্ব সমসাময়িকতায় সফল হয়েও যে-সব কবিতা চিরকালীনতায় উত্তীর্ণ। অবশ্য জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতাই তো সে রকম। এই কবিতাগুলিকেই বেশি করে নিজের মনে হলো কেন কেউ এ প্রশ্ন করলে বলতে পারি, সমস্ত কাব্যিক তাত্ত্বিকতার বাইরে একটা বড় পরিধি নিয়ে ভাবলে পাঠকের বোধের মাপকাঠি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোন কবিতা তাকে ছুঁয়ে ফেলছে, কোন কবিতার আয়নায় সে নিজেকে, নিজের চারপাশকে দেখতে পাচ্ছে, এই বিষয়গুলি বেশি জরুরি হয়ে ওঠে। অভিঘাত, অতএব, প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এই যে কয়েকটি কবিতা, এদের অভিঘাত আমার কাছে চূড়ান্ত। কারণ যখন তিনি লিখছেন, ‘চারিদিকে উঁচু উঁচু গম্বুজের দ্রাঘিমায় দু’একটা নক্ষত্রের আলো/ খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো এসে ত্রিভঙ্গে দাঁড়াল/ চেয়ে দেখে দেশ তার ভরে গেছে ছিন্ন ভিন্ন মগজের স্তূপে/ ‘নিঃশেষ হ’ল না কিছু’ বলিল সে কয়েকটা লোল মুণ্ডু লুফে/ মোরগের মাথা যেন ছুটিতেছে আজও তার রক্তিম ঝুটিটার পিছু’... তখন প্রতি ছত্রে আমি দেখতে পাচ্ছি কাশ্মীরের জঙ্গি হামলা, পেশোয়ারে স্কুলপড়ুয়াদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু আর অসমে বিহারি ও সাঁওতালদের হত্যা। আমি দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের চোখরাঙানি, রাতারাতি মানুষের বিক্রি হয়ে যাওয়া আর নির্লজ্জতার উজ্জ্বলতম শিখর। আমি দেখতে পাচ্ছি শকুনের ডানায় ছেয়ে যাওয়া একটা আকাশ আর কবরে ঢেকে যাওয়া একটা মাটি। সভ্যতার যে পচন আজ আমরা দেখছি চারপাশে, তিনি একজন দ্রষ্টা হিসেবে তার জীবদ্দশাতেই তা অনুমান করেছিলেন। তাই তার কলম লিখতে পেরেছিল, ‘এর পর কারো আর তিলে তিলে মৃত্যু হবে না ক’/ মৃত্যু বিজ্ঞাপিত হবে— সব মৃত্যু/ সকল শবের চুল পরিপাটি করে আঁচড়ায়ে দেওয়া হবে’। এই উচ্চারণের সামনে আমার সমস্ত বিস্ময় আর স্তব্ধতা মাথা নিচু করে বসে আছে। বিজ্ঞাপিত মৃত্যুর যুগের এক আম নাগরিক হিসেবে আমি এই মহাদার্শনিককে চিরকুর্নিশ জানাই। এর বেশি ব্যাখ্যার যোগ্যতা বা স্পর্ধা কোনোটাই নেই আমার। একজন শিক্ষানবিশ কবিতাপাঠক হিসেবে তার এই কবিতাগুলির বোধ আমাকে সব চাইতে বেশি করে স্পর্শ করেছে, এটুকুই বলতে পারি কেবল। বাকি কবিতাগুলিও ক্রমাগত ভাবাচ্ছে আমাকে। কবিতা সংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনাকে আমি বরাবরই এড়িয়ে চলেছি, সে আমারই অক্ষমতা। আজও কেবল বোধকে অগ্রাধিকার দিলাম, বুদ্ধিকে নয়। আসলে একটাই তো কবিতা। পঙ্ক্তি থেকে পঙ্ক্তিতে বুনে চলা সময়ের মহাকাব্য, যাকে তিনি সংখ্যা দিয়ে ভেঙেছেন মাত্র। এমনটা আমার মনে হয়েছে। কেবল এই কয়েকটি কবিতার একটি গুচ্ছ এখানে রাখা হলো। আরও বেশ কিছু অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের নতুন বই পাওয়া বাবে এ বারের বইমেলায়। যে-ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে আরও সংকলন প্রকাশিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকছে। আজ আমাদের সকলের ছাদে এক মহানক্ষত্রের সুদূরতম আলো এসে পড়েছে। এক অন্তহীন রাতের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা অতীতের সেই আলোয় আরও একবার বর্তমানকে চিনে নিচ্ছি। বাংলা কবিতার সমুদ্রে ভাসমান এক গভীর দ্বীপ আবিষ্কৃত হলো আজ। যার অন্তর্নিহিত ব্যাপ্তি কোনো মহাদেশের চাইতে কম নয়। আমরা সেই উন্মোচনের সাক্ষী থাকলাম, কবিতাকে ভালবেসে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হয় না। পাঠকদের অপেক্ষা আর আবিষ্কারের সফরের প্রথম মাইলফলক পেরিয়ে যাবার দিন আজ। সামনে পড়ে আছে দীর্ঘ পথ, যার আরেক নাম অপ্রকাশিত জীবনানন্দ। একগুচ্ছ জীবনানন্দ
Wednesday, January 28, 2015
অপ্রকাশিত :Natun Barta
উদ্ধারকাহিনি তার মৃত্যুর পরই উদ্ধার হয়েছে তার অধিকাংশ রচনা। সে সব নিয়ে খণ্ডে খণ্ডে গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু দিন হলো।
' alt='' /> তা হলে এতগুলি না ছাপা কবিতায় ভরা আস্ত একখানা খাতা কোথায় লুকিয়েছিল এত দিন? আর কী ভাবেই বা পাওয়া গেল তা? বাঙালি পাঠকের কাছে সেই উৎস সন্ধানের সূত্র কিছু কম রোমাঞ্চকর নয়। গৌতম মিত্র। পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কলকাতার পথে পথে অমূল্য রতনের খোঁজে ছাই ওড়ানোই ছিল যার একমাত্র কাজ। জীবনানন্দের ডাইরি ও অন্যান্য রচনা উদ্ধারের কাজ যখন পুরোদমে চলেছে, সেই সময় ভূমেন্দ্র গুহর পাশাপাশি গৌতম মিত্রও এই অসাধ্যসাধনে নাম লিখিয়েছিলেন। জীবনানন্দ সংক্রান্ত যেখানে যেটুকু সঙ্কেত বা সূত্র, সেখানেই ছুটে যাওয়া ছিল তার কাজ। এই রকমই একটি সূত্রের নাম অশোকচন্দ্র গুপ্ত। জীবনানন্দ দাশ তার ডাইরিতে বন্ধু হিসেবে বারবার উল্লেখ করেছেন এই মানুষটির। বরিশালের সর্বানন্দ ভবনে থাকাকালীন এই অশোক চন্দ্র গুপ্তের পরিবারের সঙ্গে জীবনানন্দের পরিবারের হৃদ্যতার কথাও তার ডাইরিতে পাওয়া যায়। ১৯৪৬ সালে জীবনানন্দ পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন, তত দিনে অশোক চন্দ্র গুপ্তও সপরিবার কলকাতায়। এই শহরে এসেও তাদের বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ ছিল অটুট। এমনিতে জীবনানন্দ যে খুবই মুখচোরা ও নির্জন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তা আজ সুবিদিত। এ হেন মানুষ যখন বারবার বন্ধু হিসেবে কারও উল্লেখ করেন, তখন তার গুরুত্ব অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়। ২০০১ নাগাদ গৌতমবাবু ক্রমাগত জাতীয় গ্রন্থাগার ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে যাতায়াত করেছিলেন, জীবনানন্দ সংক্রান্ত আরও কিছু সূত্রের আশায়। কারণ জীবনানন্দের ডাইরি বলছিল, বহু অপ্রকাশিত লেখা এখনও আছে কোথাও। কিন্তু কোথায়? বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেই মিলল উত্তর। ব্রহ্মবাদী পত্রিকার একটি সংখ্যায় (যা এক সময় জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ সম্পাদনা করতেন) পাওয়া গেল অশোক চন্দ্র গুপ্তের কন্যাসন্তান লাভের খবর। হয়তো কোনো হদিশ মিললেও মিলতে পারে, এই ভেবেই অশোকচন্দ্রের সেই কন্যাসন্তানের খোঁজে বেরোলেন গৌতমবাবু। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ডোভার রোডের একটি বাড়িতে পাওয়া গেল তাকে। রত্না রায়, যার বয়স তখন ষাট পেরিয়ে গিয়েছে। জীবনানন্দের স্মৃতি তার কাছে স্পষ্ট। যেমন স্পষ্ট তার বাবার সঙ্গে কবির বিরল হৃদ্যতা। সেই সখ্যের ভরসাতেই, জীবনানন্দর মৃত্যুর পর তার গদ্য ও ডাইরিধর্মী অপ্রকাশিত লেখালেখি ভর্তি একটি ট্রাঙ্ক অশোকচন্দ্র গুপ্তের পরিবারের কাছে রেখে গিয়েছিলেন কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ। পরে জীবনান্দের ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশ সেই ট্রাঙ্ক থেকে লেখাগুলো উদ্ধার করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। জীবনানন্দ সংক্রান্ত আরও তথ্য ও স্মৃতির আশায় রত্নাদেবীর বাড়িতে যাতায়াত তৈরি হলো গৌতমবাবুর, পাশাপাশি তৈরি হলো বিশ্বাসযোগ্যতার এক সম্পর্কও। কেবলমাত্র সেই সম্পর্কের খাতিরেই রত্নাদেবী একদিন আড্ডার ছলে এমন এক কথা বললেন, বাংলা সাহিত্যের জগতে যা বিস্ফোরণের চাইতেও বেশি। জীবনানন্দ দাশের হস্তাক্ষরে লিখিত অপ্রকাশিত কবিতা ভর্তি একটি খাতা আছে রত্নাদেবীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। তার বক্তব্য, স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ এই খাতাটি তার পরিবারের হেফাজতে রেখেছিলেন। সেই থেকে সেই ভাবেই আছে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, স্বভাবে নির্জন সেই মানুষটি এক-খাতা কবিতা কেনই বা দিয়েছিলেন বন্ধুর হেফাজতে? তার কাছে তার লেখাই ছিল একমাত্র সম্পদ। সেই সম্পদ নিজের কাছে না রাখার কী কারণ থাকতে পারে? এমন আরও প্রশ্ন নিশ্চয়ই ভিড় করবে। কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর জানার উপায় হয়তো নেই। তবে সেই সম্পদ যে শেষমেশ পাঠককুলের হাতে পৌঁছচ্ছে সেটাই বড় কথা। পৌঁছচ্ছে কারণ শুধুমাত্র ভরসার খাতিরেই সেই খাতা গৌতম মিত্রের হাতে তুলে দিয়েছেন রত্নাদেবী। সেটা ২০০৪। এই মহাভাণ্ডার হস্তান্তরের খবর জানতেন কেবল তারা দু’ জনেই। তার পর ১০ বছর শ্রীমিত্র অপেক্ষা করেছেন স্বত্ব আইনের খাতিরে। আইনি বাধা উঠে যাওয়ার পর খাতাটি নিয়ে তিনি হাজির হন সপ্তর্ষি প্রকাশনের দফতরে। যার ফল? বইমেলায় পাওয়া যাবে গ্রন্থ। নাম ‘অপ্রকাশিত’। কয়েকটা ডাইনোসোর যেন চড়ুইভাতি করে কলরবে ডুবে গেল/ মেছোবাজারের থেকে গ্রে স্ট্রিটে— গঙ্গা— গঙ্গাসাগরের জলে/ ফার্পোর বাড়ি থেকে বাঁক মুছে প্রাগৈতিহাসিক কোলাহলে’ এই তিনটি পঙ্ক্তি পড়ামাত্র আমার চারপাশটা পাল্টে গেল লহমায়। আমি কি জেগেই স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু এমন স্বপ্ন তো সুদূর কল্পনাতেও ছিল না আমার! কারণ আর কিছুই নয়, আমার সামনে এখন খোলা আছে একের পর এক চমকে দেওয়া, থমকে দেওয়া কবিতায় ভর্তি একটি খাতা। এর আগে যার অধিকাংশ কবিতা কোনো দিন কোত্থাও ছাপা হয়নি, আর যার মালিক ও রচয়িতা স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই সকলেরই? আমারও গোড়ায় বিশ্বাস হয়নি। এও কি সম্ভব? যার লেখা পড়বার অধিকার অর্জন করে নিতেই সময় লাগে পাঠকের, তার হাতের লেখায় না-ছাপা এতগুলি কবিতা এখন আমার দু’হাতের মাঝখানে? একে প্রাপ্তি বললেও বোঝানো যায় না কিছুই। তার আনকোরা পাটভাঙা কবিতার আলো নতুন করে এসে পড়ছে আমাদের ছাদে। রাতের আকাশে এই যে অগুনতি তারা দেখতে পাই আমরা, তাদের মধ্যে অনেকেরই কিন্তু মৃত্যু হয়েছে বহু আগে। তবু যে দেখতে পাই, কারণ সে এতই দূরের তারা যে তার আলো আমাদের ছাদে এসে পৌঁছতেই অনেক বছর লেগে যায়। তাই আসলে সে যখন নেই, তখনও তার আলো আছে আমাদের কাছে। তার অতীতের আলো এসে পড়ছে আমার বর্তমানের ছাদে। আলোর লম্বা একটা সুতোয় বাঁধা পড়ছে বহু দূরের দুটো সময়। এই মুহূর্তে ঠিক সেইরকম একটা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমরা সকলেই। ‘পত্রিকা’-র সম্পাদকমশাই আমাকে এই অপ্রকাশিত গুচ্ছ থেকে কয়েকটি কবিতা নির্বাচন করে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। স্বীকার করা জরুরি ও বাহুল্যও যে, আমি কোনো ভাবেই এই দায়িত্বের যোগ্য নই। আমি শেষ সারিতে জায়গা করে নেওয়া একজন পাঠক কেবল, জীবনানন্দের কবিতাই যাকে বেছে নিয়েছে। সুতরাং, প্রক্রিয়াটি বিপরীত। তবে খুচরোর খোঁজে যার দিন কাটে, তার সামনে এক-সিন্দুক গুপ্তধন ঝিকমিকিয়ে উঠলে যা হয়, আমার অবস্থাও এখন ঠিক তাই। কী ভাবে নেব তা হলে এই সব কবিতার পাঠ? এ কথা ঠিকই যে আমরা অনেকেই একেবারে গোড়ায় জীবনানন্দীয় ভাষা-ব্যবহারের মোহের আবর্তে পড়ে যাই। যেমন একই সঙ্গে বিস্ময়ের পর বিস্ময় আসতে থাকে তার কবিতার দৃশ্যকল্পগুলির পিঠে চেপে। কিন্তু ভাষা বা দৃশ্যকল্পের ঘোর কাটতেই আমরা স্পর্শ করতে পারি চিন্তক ও দার্শনিক জীবনানন্দকে। যার কলমে ধরা পড়েছিল মহাসময়ের ইতিহাস। এই কবিতাগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনানন্দকে বারবার পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, তিনি সারাজীবনের লেখালেখি দিয়ে সময়কে, সময়ের পরিক্রমাকে ধরতে চেয়েছেন। ব্যাপ্তিতে, গভীরতায়। কখনও একই সময়বিন্দু’র কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত পৌঁছতে চাওয়া, আবার কখনও বিস্তৃত সময়চেতনার পরিধিকে ছুঁতে চাওয়া। সত্যি বলতে কী, সময়ের বিস্তীর্ণতার যে-বিস্ময়বোধ, তা তো আমরা জীবনানন্দের কবিতা থেকেই অর্জন করেছি, আর সময়চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে ইতিহাসবোধ ও সমাজদর্শন। তার কবিতায় এই সব ক’টিই এমন ভাবে মিলেমিশে থেকেছে বরাবর যে, সেই মিশ্রণ হয়তো শেষমেশ ‘জীবনানন্দীয়’ ভঙ্গি হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। সাধারণত অপ্রকাশিত রচনাকে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রকাশিত রচনার মাঝে ফেলে দেখার একটা চল আছে। আমরা এখন জানি, ১৯৩৮-৩৯ সালে লেখা এই সব কবিতার ঠিক পরপরই জীবনানন্দ লিখবেন ‘মহাপৃথিবী’। সেখানে, আবিষ্কৃত এই খাতা থেকে কয়েকটি লেখা গৃহীতও হবে। আর এর আগেই লিখেছেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতার টানাপড়েনের অনুবীক্ষণে যদি না-ও রাখি এই কবিতাদের, একক ভাবেই এরা তাদের পরিচিতি তৈরি করে নিতে পারে। আমরা দেখব এই কবিতাগুচ্ছেও বারবার তিনি ফিরে গিয়েছেন সময়ের স্রোতের কাছে। পরিচিত আদলেই হয়তো, কিন্তু নতুন দেখায় অবশ্যই। আর সে-দেখার তির্যক আয়োজন, সে-উচ্চারণের ঈষৎ বাঁকা নিশানা কোনো বার ব্যর্থ হয়নি। একেবারে গোড়ায় যে-কটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করলাম, সেখানে সময়ের সুদূরবর্তী দুই বিন্দুকে কী চমৎকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন তিনি! আমরা তো ‘বাঁর নিয়ে’ শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু যে-মুহূর্তে ‘ফার্পোর বাড়ি থেরে বাঁক মুছে’ ব্যবহার করলেন আমি যেন ডাইনোসর-এর অপসৃয়মান বিশালাকায় লেজটুকু দেখতে পেলাম, আর তার পরের শব্দদুটোই ‘প্রাগৈতাহাসিক কোলাহলে’। এই মেছোবাজারের ঘিঞ্জি চৌহদ্দি থেকে এক লহমায় মানবসভ্যতারও আগের কোনো এক বিস্তীর্ণতায় পাড়ি দেওয়া, এও তো একরকম ‘ওয়ার্মহোল’ তত্ত্বই! কিন্তু সময়ের এই যাতায়াতের চাইতেও তাকে বেশি করে ভাবায় সময়ের বিপন্নতা। যখন একটি কবিতার গোড়ায় তিনি লিখছেন, ‘বার বার ডাক আসে রাজপথে নেমে শবের বাহক হতে/কত শব দগ্ধ করা গেল—’ আর সেই কবিতার শেষেই পড়ছি, ‘সব বিদেশির কাছে আমাদের এই এক পরিচয় :/ইহাদের মনন হৃদয় অবিরাম শববাহনের তরে/এরা ক্লান্তিহীন— অবিরাম শববাহনের তরে।’... স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। তিনি তো আমার, আমাদের সময়ের কথা লিখেছেন! যখন রোজ কোনো না কোনো জঙ্গি হামলায় কয়েকশো মানুষ মারা যাচ্ছেন, যখন প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও বোমার আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছেন হাজারো মানুষ, যখন ঘুম থেকে উঠে আমরা রোজই তৈরি হচ্ছি কাঁধে নতুন মৃতদেহ চাপিয়ে ঘুরে বেড়াব বলে। আর ভয় পাচ্ছি এই ভেবে, আজ আমি নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব না তো? তার সময়ে তিনি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। দেশভাগ দেখেছেন। কিন্তু সময়ের শবের উপর দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে মানুষের এই প্রতিনিয়ত ভেতর থেকে ছিন্ন করে যাওয়া যুদ্ধ, তাও কি তিনি কল্পনা করেছিলেন? আজ তো সত্যিই সকলের কাছে আমাদের এই এক পরিচয়। নতুন এই গুচ্ছ হাতে পেয়ে তার পরতে পরতে আমি কেবল আবিষ্কার করেছি আমার নিজের সময়কে, আমার বেঁচে থাকাকে। আরেকটি কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘আমাদের সাহস হারায়ে গেছে বহুদিন পুলিশের ব্যাটনের তলে নুয়ে থেকে/ ফুটবল-গ্রাউন্ডের কাছে বসে শকুন চরানো নীল এশিয়ার দুপুর বেলায়’। কেবল আক্ষরিক অর্থে ভাবলেও প্রথম পঙ্ক্তির অব্যর্থতা আমরা এড়াতে পারি না, নত হয়ে থাকা সময়ের শিরদাঁড়া আরও একবার টের পাই। কিন্তু ‘শকুন চরানো নীল এশিয়ার দুপুর বেলায়’? এই আশ্চর্য বর্ণনা কি কেবলই দৃশ্যকল্পের আয়োজন? উঁঁহু। আঞ্চলিকতার পরিসরে বৃহত্তর পরিস্থিতিকে চিত্রায়িত করাও বটে। শকুন চরানো নীল ভূখণ্ড থেকে আজও তো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। শকুনের ভিড় সময়ের সঙ্গে বেড়েছে কেবল। এই রকম একটা সময়ে শাসকের সামনে, ক্ষমতার সামনে শিরদাঁড়া খুলে মাটিতে পেতে দেওয়াই তো অধিকাংশ মানুষের কাজ। ক্ষমতার রং যখন যেমন, তখন নিজের রং তেমন করে নেওয়াই তো বেশির ভাগ মানুষের ধর্ম। সেই সব মানুষ, যাদের আমরা সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করে এসেছি অনেকদিন, ভাবিনি তারা সেই সম্মানের উপযুক্ত কিনা। কারণ এখানে আরও একটি কবিতায় জীবনানন্দ লিখছেন, ‘দেহের আরাম দিতে গিয়ে মোরা বিদ্বানের জন্ম দিতে পারি নাই’। এই একটিমাত্র পঙ্ক্তিতেই কি তিনি সময়ের শ্রেষ্ঠ বিপন্নতাকে ব্যক্ত করছেন না? তার সময়ের এবং আমার সময়েরও? আবারও, সময়, তার কবিতার প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সময়ের উপরিভাগ নয়। তার অস্থি, তার রক্ত, তার মজ্জা। সময়ভাবনার ত্রিমাত্রিকতায় গড়ে উঠছে কবিতার এক অন্য রকম জগৎ। জীবনানন্দ এই সমস্ত কবিতায় তার পূর্ববর্তী, বর্তমান ও পরবর্তী সময়ের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন একই সঙ্গে। তাই তাদের প্রাসঙ্গিকতা অমলিন। প্রথম কয়েকটি পাঠে যে-কবিতাগুলি আমাকে বেছে নিল, সেগুলির চার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নিরন্তর মৃত্যুস্রোত। সময়ের মোড়কে এক ধাবমান মৃত্যুবোধ। বয়ে চলেছে আশা ছাড়তে নারাজ সভ্যতার নিরাশার দিকে অবধারিত গড়িয়ে চলা। তার নিজস্ব সমসাময়িকতায় সফল হয়েও যে-সব কবিতা চিরকালীনতায় উত্তীর্ণ। অবশ্য জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতাই তো সে রকম। এই কবিতাগুলিকেই বেশি করে নিজের মনে হলো কেন কেউ এ প্রশ্ন করলে বলতে পারি, সমস্ত কাব্যিক তাত্ত্বিকতার বাইরে একটা বড় পরিধি নিয়ে ভাবলে পাঠকের বোধের মাপকাঠি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোন কবিতা তাকে ছুঁয়ে ফেলছে, কোন কবিতার আয়নায় সে নিজেকে, নিজের চারপাশকে দেখতে পাচ্ছে, এই বিষয়গুলি বেশি জরুরি হয়ে ওঠে। অভিঘাত, অতএব, প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এই যে কয়েকটি কবিতা, এদের অভিঘাত আমার কাছে চূড়ান্ত। কারণ যখন তিনি লিখছেন, ‘চারিদিকে উঁচু উঁচু গম্বুজের দ্রাঘিমায় দু’একটা নক্ষত্রের আলো/ খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো এসে ত্রিভঙ্গে দাঁড়াল/ চেয়ে দেখে দেশ তার ভরে গেছে ছিন্ন ভিন্ন মগজের স্তূপে/ ‘নিঃশেষ হ’ল না কিছু’ বলিল সে কয়েকটা লোল মুণ্ডু লুফে/ মোরগের মাথা যেন ছুটিতেছে আজও তার রক্তিম ঝুটিটার পিছু’... তখন প্রতি ছত্রে আমি দেখতে পাচ্ছি কাশ্মীরের জঙ্গি হামলা, পেশোয়ারে স্কুলপড়ুয়াদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু আর অসমে বিহারি ও সাঁওতালদের হত্যা। আমি দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের চোখরাঙানি, রাতারাতি মানুষের বিক্রি হয়ে যাওয়া আর নির্লজ্জতার উজ্জ্বলতম শিখর। আমি দেখতে পাচ্ছি শকুনের ডানায় ছেয়ে যাওয়া একটা আকাশ আর কবরে ঢেকে যাওয়া একটা মাটি। সভ্যতার যে পচন আজ আমরা দেখছি চারপাশে, তিনি একজন দ্রষ্টা হিসেবে তার জীবদ্দশাতেই তা অনুমান করেছিলেন। তাই তার কলম লিখতে পেরেছিল, ‘এর পর কারো আর তিলে তিলে মৃত্যু হবে না ক’/ মৃত্যু বিজ্ঞাপিত হবে— সব মৃত্যু/ সকল শবের চুল পরিপাটি করে আঁচড়ায়ে দেওয়া হবে’। এই উচ্চারণের সামনে আমার সমস্ত বিস্ময় আর স্তব্ধতা মাথা নিচু করে বসে আছে। বিজ্ঞাপিত মৃত্যুর যুগের এক আম নাগরিক হিসেবে আমি এই মহাদার্শনিককে চিরকুর্নিশ জানাই। এর বেশি ব্যাখ্যার যোগ্যতা বা স্পর্ধা কোনোটাই নেই আমার। একজন শিক্ষানবিশ কবিতাপাঠক হিসেবে তার এই কবিতাগুলির বোধ আমাকে সব চাইতে বেশি করে স্পর্শ করেছে, এটুকুই বলতে পারি কেবল। বাকি কবিতাগুলিও ক্রমাগত ভাবাচ্ছে আমাকে। কবিতা সংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনাকে আমি বরাবরই এড়িয়ে চলেছি, সে আমারই অক্ষমতা। আজও কেবল বোধকে অগ্রাধিকার দিলাম, বুদ্ধিকে নয়। আসলে একটাই তো কবিতা। পঙ্ক্তি থেকে পঙ্ক্তিতে বুনে চলা সময়ের মহাকাব্য, যাকে তিনি সংখ্যা দিয়ে ভেঙেছেন মাত্র। এমনটা আমার মনে হয়েছে। কেবল এই কয়েকটি কবিতার একটি গুচ্ছ এখানে রাখা হলো। আরও বেশ কিছু অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের নতুন বই পাওয়া বাবে এ বারের বইমেলায়। যে-ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে আরও সংকলন প্রকাশিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকছে। আজ আমাদের সকলের ছাদে এক মহানক্ষত্রের সুদূরতম আলো এসে পড়েছে। এক অন্তহীন রাতের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা অতীতের সেই আলোয় আরও একবার বর্তমানকে চিনে নিচ্ছি। বাংলা কবিতার সমুদ্রে ভাসমান এক গভীর দ্বীপ আবিষ্কৃত হলো আজ। যার অন্তর্নিহিত ব্যাপ্তি কোনো মহাদেশের চাইতে কম নয়। আমরা সেই উন্মোচনের সাক্ষী থাকলাম, কবিতাকে ভালবেসে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হয় না। পাঠকদের অপেক্ষা আর আবিষ্কারের সফরের প্রথম মাইলফলক পেরিয়ে যাবার দিন আজ। সামনে পড়ে আছে দীর্ঘ পথ, যার আরেক নাম অপ্রকাশিত জীবনানন্দ। একগুচ্ছ জীবনানন্দ
' alt='' /> তা হলে এতগুলি না ছাপা কবিতায় ভরা আস্ত একখানা খাতা কোথায় লুকিয়েছিল এত দিন? আর কী ভাবেই বা পাওয়া গেল তা? বাঙালি পাঠকের কাছে সেই উৎস সন্ধানের সূত্র কিছু কম রোমাঞ্চকর নয়। গৌতম মিত্র। পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কলকাতার পথে পথে অমূল্য রতনের খোঁজে ছাই ওড়ানোই ছিল যার একমাত্র কাজ। জীবনানন্দের ডাইরি ও অন্যান্য রচনা উদ্ধারের কাজ যখন পুরোদমে চলেছে, সেই সময় ভূমেন্দ্র গুহর পাশাপাশি গৌতম মিত্রও এই অসাধ্যসাধনে নাম লিখিয়েছিলেন। জীবনানন্দ সংক্রান্ত যেখানে যেটুকু সঙ্কেত বা সূত্র, সেখানেই ছুটে যাওয়া ছিল তার কাজ। এই রকমই একটি সূত্রের নাম অশোকচন্দ্র গুপ্ত। জীবনানন্দ দাশ তার ডাইরিতে বন্ধু হিসেবে বারবার উল্লেখ করেছেন এই মানুষটির। বরিশালের সর্বানন্দ ভবনে থাকাকালীন এই অশোক চন্দ্র গুপ্তের পরিবারের সঙ্গে জীবনানন্দের পরিবারের হৃদ্যতার কথাও তার ডাইরিতে পাওয়া যায়। ১৯৪৬ সালে জীবনানন্দ পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন, তত দিনে অশোক চন্দ্র গুপ্তও সপরিবার কলকাতায়। এই শহরে এসেও তাদের বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ ছিল অটুট। এমনিতে জীবনানন্দ যে খুবই মুখচোরা ও নির্জন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তা আজ সুবিদিত। এ হেন মানুষ যখন বারবার বন্ধু হিসেবে কারও উল্লেখ করেন, তখন তার গুরুত্ব অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়। ২০০১ নাগাদ গৌতমবাবু ক্রমাগত জাতীয় গ্রন্থাগার ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে যাতায়াত করেছিলেন, জীবনানন্দ সংক্রান্ত আরও কিছু সূত্রের আশায়। কারণ জীবনানন্দের ডাইরি বলছিল, বহু অপ্রকাশিত লেখা এখনও আছে কোথাও। কিন্তু কোথায়? বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেই মিলল উত্তর। ব্রহ্মবাদী পত্রিকার একটি সংখ্যায় (যা এক সময় জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ সম্পাদনা করতেন) পাওয়া গেল অশোক চন্দ্র গুপ্তের কন্যাসন্তান লাভের খবর। হয়তো কোনো হদিশ মিললেও মিলতে পারে, এই ভেবেই অশোকচন্দ্রের সেই কন্যাসন্তানের খোঁজে বেরোলেন গৌতমবাবু। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ডোভার রোডের একটি বাড়িতে পাওয়া গেল তাকে। রত্না রায়, যার বয়স তখন ষাট পেরিয়ে গিয়েছে। জীবনানন্দের স্মৃতি তার কাছে স্পষ্ট। যেমন স্পষ্ট তার বাবার সঙ্গে কবির বিরল হৃদ্যতা। সেই সখ্যের ভরসাতেই, জীবনানন্দর মৃত্যুর পর তার গদ্য ও ডাইরিধর্মী অপ্রকাশিত লেখালেখি ভর্তি একটি ট্রাঙ্ক অশোকচন্দ্র গুপ্তের পরিবারের কাছে রেখে গিয়েছিলেন কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ। পরে জীবনান্দের ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশ সেই ট্রাঙ্ক থেকে লেখাগুলো উদ্ধার করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। জীবনানন্দ সংক্রান্ত আরও তথ্য ও স্মৃতির আশায় রত্নাদেবীর বাড়িতে যাতায়াত তৈরি হলো গৌতমবাবুর, পাশাপাশি তৈরি হলো বিশ্বাসযোগ্যতার এক সম্পর্কও। কেবলমাত্র সেই সম্পর্কের খাতিরেই রত্নাদেবী একদিন আড্ডার ছলে এমন এক কথা বললেন, বাংলা সাহিত্যের জগতে যা বিস্ফোরণের চাইতেও বেশি। জীবনানন্দ দাশের হস্তাক্ষরে লিখিত অপ্রকাশিত কবিতা ভর্তি একটি খাতা আছে রত্নাদেবীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। তার বক্তব্য, স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ এই খাতাটি তার পরিবারের হেফাজতে রেখেছিলেন। সেই থেকে সেই ভাবেই আছে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, স্বভাবে নির্জন সেই মানুষটি এক-খাতা কবিতা কেনই বা দিয়েছিলেন বন্ধুর হেফাজতে? তার কাছে তার লেখাই ছিল একমাত্র সম্পদ। সেই সম্পদ নিজের কাছে না রাখার কী কারণ থাকতে পারে? এমন আরও প্রশ্ন নিশ্চয়ই ভিড় করবে। কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর জানার উপায় হয়তো নেই। তবে সেই সম্পদ যে শেষমেশ পাঠককুলের হাতে পৌঁছচ্ছে সেটাই বড় কথা। পৌঁছচ্ছে কারণ শুধুমাত্র ভরসার খাতিরেই সেই খাতা গৌতম মিত্রের হাতে তুলে দিয়েছেন রত্নাদেবী। সেটা ২০০৪। এই মহাভাণ্ডার হস্তান্তরের খবর জানতেন কেবল তারা দু’ জনেই। তার পর ১০ বছর শ্রীমিত্র অপেক্ষা করেছেন স্বত্ব আইনের খাতিরে। আইনি বাধা উঠে যাওয়ার পর খাতাটি নিয়ে তিনি হাজির হন সপ্তর্ষি প্রকাশনের দফতরে। যার ফল? বইমেলায় পাওয়া যাবে গ্রন্থ। নাম ‘অপ্রকাশিত’। কয়েকটা ডাইনোসোর যেন চড়ুইভাতি করে কলরবে ডুবে গেল/ মেছোবাজারের থেকে গ্রে স্ট্রিটে— গঙ্গা— গঙ্গাসাগরের জলে/ ফার্পোর বাড়ি থেকে বাঁক মুছে প্রাগৈতিহাসিক কোলাহলে’ এই তিনটি পঙ্ক্তি পড়ামাত্র আমার চারপাশটা পাল্টে গেল লহমায়। আমি কি জেগেই স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু এমন স্বপ্ন তো সুদূর কল্পনাতেও ছিল না আমার! কারণ আর কিছুই নয়, আমার সামনে এখন খোলা আছে একের পর এক চমকে দেওয়া, থমকে দেওয়া কবিতায় ভর্তি একটি খাতা। এর আগে যার অধিকাংশ কবিতা কোনো দিন কোত্থাও ছাপা হয়নি, আর যার মালিক ও রচয়িতা স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই সকলেরই? আমারও গোড়ায় বিশ্বাস হয়নি। এও কি সম্ভব? যার লেখা পড়বার অধিকার অর্জন করে নিতেই সময় লাগে পাঠকের, তার হাতের লেখায় না-ছাপা এতগুলি কবিতা এখন আমার দু’হাতের মাঝখানে? একে প্রাপ্তি বললেও বোঝানো যায় না কিছুই। তার আনকোরা পাটভাঙা কবিতার আলো নতুন করে এসে পড়ছে আমাদের ছাদে। রাতের আকাশে এই যে অগুনতি তারা দেখতে পাই আমরা, তাদের মধ্যে অনেকেরই কিন্তু মৃত্যু হয়েছে বহু আগে। তবু যে দেখতে পাই, কারণ সে এতই দূরের তারা যে তার আলো আমাদের ছাদে এসে পৌঁছতেই অনেক বছর লেগে যায়। তাই আসলে সে যখন নেই, তখনও তার আলো আছে আমাদের কাছে। তার অতীতের আলো এসে পড়ছে আমার বর্তমানের ছাদে। আলোর লম্বা একটা সুতোয় বাঁধা পড়ছে বহু দূরের দুটো সময়। এই মুহূর্তে ঠিক সেইরকম একটা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমরা সকলেই। ‘পত্রিকা’-র সম্পাদকমশাই আমাকে এই অপ্রকাশিত গুচ্ছ থেকে কয়েকটি কবিতা নির্বাচন করে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। স্বীকার করা জরুরি ও বাহুল্যও যে, আমি কোনো ভাবেই এই দায়িত্বের যোগ্য নই। আমি শেষ সারিতে জায়গা করে নেওয়া একজন পাঠক কেবল, জীবনানন্দের কবিতাই যাকে বেছে নিয়েছে। সুতরাং, প্রক্রিয়াটি বিপরীত। তবে খুচরোর খোঁজে যার দিন কাটে, তার সামনে এক-সিন্দুক গুপ্তধন ঝিকমিকিয়ে উঠলে যা হয়, আমার অবস্থাও এখন ঠিক তাই। কী ভাবে নেব তা হলে এই সব কবিতার পাঠ? এ কথা ঠিকই যে আমরা অনেকেই একেবারে গোড়ায় জীবনানন্দীয় ভাষা-ব্যবহারের মোহের আবর্তে পড়ে যাই। যেমন একই সঙ্গে বিস্ময়ের পর বিস্ময় আসতে থাকে তার কবিতার দৃশ্যকল্পগুলির পিঠে চেপে। কিন্তু ভাষা বা দৃশ্যকল্পের ঘোর কাটতেই আমরা স্পর্শ করতে পারি চিন্তক ও দার্শনিক জীবনানন্দকে। যার কলমে ধরা পড়েছিল মহাসময়ের ইতিহাস। এই কবিতাগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনানন্দকে বারবার পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, তিনি সারাজীবনের লেখালেখি দিয়ে সময়কে, সময়ের পরিক্রমাকে ধরতে চেয়েছেন। ব্যাপ্তিতে, গভীরতায়। কখনও একই সময়বিন্দু’র কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত পৌঁছতে চাওয়া, আবার কখনও বিস্তৃত সময়চেতনার পরিধিকে ছুঁতে চাওয়া। সত্যি বলতে কী, সময়ের বিস্তীর্ণতার যে-বিস্ময়বোধ, তা তো আমরা জীবনানন্দের কবিতা থেকেই অর্জন করেছি, আর সময়চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে ইতিহাসবোধ ও সমাজদর্শন। তার কবিতায় এই সব ক’টিই এমন ভাবে মিলেমিশে থেকেছে বরাবর যে, সেই মিশ্রণ হয়তো শেষমেশ ‘জীবনানন্দীয়’ ভঙ্গি হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। সাধারণত অপ্রকাশিত রচনাকে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রকাশিত রচনার মাঝে ফেলে দেখার একটা চল আছে। আমরা এখন জানি, ১৯৩৮-৩৯ সালে লেখা এই সব কবিতার ঠিক পরপরই জীবনানন্দ লিখবেন ‘মহাপৃথিবী’। সেখানে, আবিষ্কৃত এই খাতা থেকে কয়েকটি লেখা গৃহীতও হবে। আর এর আগেই লিখেছেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতার টানাপড়েনের অনুবীক্ষণে যদি না-ও রাখি এই কবিতাদের, একক ভাবেই এরা তাদের পরিচিতি তৈরি করে নিতে পারে। আমরা দেখব এই কবিতাগুচ্ছেও বারবার তিনি ফিরে গিয়েছেন সময়ের স্রোতের কাছে। পরিচিত আদলেই হয়তো, কিন্তু নতুন দেখায় অবশ্যই। আর সে-দেখার তির্যক আয়োজন, সে-উচ্চারণের ঈষৎ বাঁকা নিশানা কোনো বার ব্যর্থ হয়নি। একেবারে গোড়ায় যে-কটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করলাম, সেখানে সময়ের সুদূরবর্তী দুই বিন্দুকে কী চমৎকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন তিনি! আমরা তো ‘বাঁর নিয়ে’ শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু যে-মুহূর্তে ‘ফার্পোর বাড়ি থেরে বাঁক মুছে’ ব্যবহার করলেন আমি যেন ডাইনোসর-এর অপসৃয়মান বিশালাকায় লেজটুকু দেখতে পেলাম, আর তার পরের শব্দদুটোই ‘প্রাগৈতাহাসিক কোলাহলে’। এই মেছোবাজারের ঘিঞ্জি চৌহদ্দি থেকে এক লহমায় মানবসভ্যতারও আগের কোনো এক বিস্তীর্ণতায় পাড়ি দেওয়া, এও তো একরকম ‘ওয়ার্মহোল’ তত্ত্বই! কিন্তু সময়ের এই যাতায়াতের চাইতেও তাকে বেশি করে ভাবায় সময়ের বিপন্নতা। যখন একটি কবিতার গোড়ায় তিনি লিখছেন, ‘বার বার ডাক আসে রাজপথে নেমে শবের বাহক হতে/কত শব দগ্ধ করা গেল—’ আর সেই কবিতার শেষেই পড়ছি, ‘সব বিদেশির কাছে আমাদের এই এক পরিচয় :/ইহাদের মনন হৃদয় অবিরাম শববাহনের তরে/এরা ক্লান্তিহীন— অবিরাম শববাহনের তরে।’... স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। তিনি তো আমার, আমাদের সময়ের কথা লিখেছেন! যখন রোজ কোনো না কোনো জঙ্গি হামলায় কয়েকশো মানুষ মারা যাচ্ছেন, যখন প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও বোমার আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছেন হাজারো মানুষ, যখন ঘুম থেকে উঠে আমরা রোজই তৈরি হচ্ছি কাঁধে নতুন মৃতদেহ চাপিয়ে ঘুরে বেড়াব বলে। আর ভয় পাচ্ছি এই ভেবে, আজ আমি নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব না তো? তার সময়ে তিনি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। দেশভাগ দেখেছেন। কিন্তু সময়ের শবের উপর দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে মানুষের এই প্রতিনিয়ত ভেতর থেকে ছিন্ন করে যাওয়া যুদ্ধ, তাও কি তিনি কল্পনা করেছিলেন? আজ তো সত্যিই সকলের কাছে আমাদের এই এক পরিচয়। নতুন এই গুচ্ছ হাতে পেয়ে তার পরতে পরতে আমি কেবল আবিষ্কার করেছি আমার নিজের সময়কে, আমার বেঁচে থাকাকে। আরেকটি কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘আমাদের সাহস হারায়ে গেছে বহুদিন পুলিশের ব্যাটনের তলে নুয়ে থেকে/ ফুটবল-গ্রাউন্ডের কাছে বসে শকুন চরানো নীল এশিয়ার দুপুর বেলায়’। কেবল আক্ষরিক অর্থে ভাবলেও প্রথম পঙ্ক্তির অব্যর্থতা আমরা এড়াতে পারি না, নত হয়ে থাকা সময়ের শিরদাঁড়া আরও একবার টের পাই। কিন্তু ‘শকুন চরানো নীল এশিয়ার দুপুর বেলায়’? এই আশ্চর্য বর্ণনা কি কেবলই দৃশ্যকল্পের আয়োজন? উঁঁহু। আঞ্চলিকতার পরিসরে বৃহত্তর পরিস্থিতিকে চিত্রায়িত করাও বটে। শকুন চরানো নীল ভূখণ্ড থেকে আজও তো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। শকুনের ভিড় সময়ের সঙ্গে বেড়েছে কেবল। এই রকম একটা সময়ে শাসকের সামনে, ক্ষমতার সামনে শিরদাঁড়া খুলে মাটিতে পেতে দেওয়াই তো অধিকাংশ মানুষের কাজ। ক্ষমতার রং যখন যেমন, তখন নিজের রং তেমন করে নেওয়াই তো বেশির ভাগ মানুষের ধর্ম। সেই সব মানুষ, যাদের আমরা সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করে এসেছি অনেকদিন, ভাবিনি তারা সেই সম্মানের উপযুক্ত কিনা। কারণ এখানে আরও একটি কবিতায় জীবনানন্দ লিখছেন, ‘দেহের আরাম দিতে গিয়ে মোরা বিদ্বানের জন্ম দিতে পারি নাই’। এই একটিমাত্র পঙ্ক্তিতেই কি তিনি সময়ের শ্রেষ্ঠ বিপন্নতাকে ব্যক্ত করছেন না? তার সময়ের এবং আমার সময়েরও? আবারও, সময়, তার কবিতার প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সময়ের উপরিভাগ নয়। তার অস্থি, তার রক্ত, তার মজ্জা। সময়ভাবনার ত্রিমাত্রিকতায় গড়ে উঠছে কবিতার এক অন্য রকম জগৎ। জীবনানন্দ এই সমস্ত কবিতায় তার পূর্ববর্তী, বর্তমান ও পরবর্তী সময়ের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন একই সঙ্গে। তাই তাদের প্রাসঙ্গিকতা অমলিন। প্রথম কয়েকটি পাঠে যে-কবিতাগুলি আমাকে বেছে নিল, সেগুলির চার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নিরন্তর মৃত্যুস্রোত। সময়ের মোড়কে এক ধাবমান মৃত্যুবোধ। বয়ে চলেছে আশা ছাড়তে নারাজ সভ্যতার নিরাশার দিকে অবধারিত গড়িয়ে চলা। তার নিজস্ব সমসাময়িকতায় সফল হয়েও যে-সব কবিতা চিরকালীনতায় উত্তীর্ণ। অবশ্য জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতাই তো সে রকম। এই কবিতাগুলিকেই বেশি করে নিজের মনে হলো কেন কেউ এ প্রশ্ন করলে বলতে পারি, সমস্ত কাব্যিক তাত্ত্বিকতার বাইরে একটা বড় পরিধি নিয়ে ভাবলে পাঠকের বোধের মাপকাঠি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোন কবিতা তাকে ছুঁয়ে ফেলছে, কোন কবিতার আয়নায় সে নিজেকে, নিজের চারপাশকে দেখতে পাচ্ছে, এই বিষয়গুলি বেশি জরুরি হয়ে ওঠে। অভিঘাত, অতএব, প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এই যে কয়েকটি কবিতা, এদের অভিঘাত আমার কাছে চূড়ান্ত। কারণ যখন তিনি লিখছেন, ‘চারিদিকে উঁচু উঁচু গম্বুজের দ্রাঘিমায় দু’একটা নক্ষত্রের আলো/ খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো এসে ত্রিভঙ্গে দাঁড়াল/ চেয়ে দেখে দেশ তার ভরে গেছে ছিন্ন ভিন্ন মগজের স্তূপে/ ‘নিঃশেষ হ’ল না কিছু’ বলিল সে কয়েকটা লোল মুণ্ডু লুফে/ মোরগের মাথা যেন ছুটিতেছে আজও তার রক্তিম ঝুটিটার পিছু’... তখন প্রতি ছত্রে আমি দেখতে পাচ্ছি কাশ্মীরের জঙ্গি হামলা, পেশোয়ারে স্কুলপড়ুয়াদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু আর অসমে বিহারি ও সাঁওতালদের হত্যা। আমি দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের চোখরাঙানি, রাতারাতি মানুষের বিক্রি হয়ে যাওয়া আর নির্লজ্জতার উজ্জ্বলতম শিখর। আমি দেখতে পাচ্ছি শকুনের ডানায় ছেয়ে যাওয়া একটা আকাশ আর কবরে ঢেকে যাওয়া একটা মাটি। সভ্যতার যে পচন আজ আমরা দেখছি চারপাশে, তিনি একজন দ্রষ্টা হিসেবে তার জীবদ্দশাতেই তা অনুমান করেছিলেন। তাই তার কলম লিখতে পেরেছিল, ‘এর পর কারো আর তিলে তিলে মৃত্যু হবে না ক’/ মৃত্যু বিজ্ঞাপিত হবে— সব মৃত্যু/ সকল শবের চুল পরিপাটি করে আঁচড়ায়ে দেওয়া হবে’। এই উচ্চারণের সামনে আমার সমস্ত বিস্ময় আর স্তব্ধতা মাথা নিচু করে বসে আছে। বিজ্ঞাপিত মৃত্যুর যুগের এক আম নাগরিক হিসেবে আমি এই মহাদার্শনিককে চিরকুর্নিশ জানাই। এর বেশি ব্যাখ্যার যোগ্যতা বা স্পর্ধা কোনোটাই নেই আমার। একজন শিক্ষানবিশ কবিতাপাঠক হিসেবে তার এই কবিতাগুলির বোধ আমাকে সব চাইতে বেশি করে স্পর্শ করেছে, এটুকুই বলতে পারি কেবল। বাকি কবিতাগুলিও ক্রমাগত ভাবাচ্ছে আমাকে। কবিতা সংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনাকে আমি বরাবরই এড়িয়ে চলেছি, সে আমারই অক্ষমতা। আজও কেবল বোধকে অগ্রাধিকার দিলাম, বুদ্ধিকে নয়। আসলে একটাই তো কবিতা। পঙ্ক্তি থেকে পঙ্ক্তিতে বুনে চলা সময়ের মহাকাব্য, যাকে তিনি সংখ্যা দিয়ে ভেঙেছেন মাত্র। এমনটা আমার মনে হয়েছে। কেবল এই কয়েকটি কবিতার একটি গুচ্ছ এখানে রাখা হলো। আরও বেশ কিছু অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের নতুন বই পাওয়া বাবে এ বারের বইমেলায়। যে-ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে আরও সংকলন প্রকাশিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকছে। আজ আমাদের সকলের ছাদে এক মহানক্ষত্রের সুদূরতম আলো এসে পড়েছে। এক অন্তহীন রাতের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা অতীতের সেই আলোয় আরও একবার বর্তমানকে চিনে নিচ্ছি। বাংলা কবিতার সমুদ্রে ভাসমান এক গভীর দ্বীপ আবিষ্কৃত হলো আজ। যার অন্তর্নিহিত ব্যাপ্তি কোনো মহাদেশের চাইতে কম নয়। আমরা সেই উন্মোচনের সাক্ষী থাকলাম, কবিতাকে ভালবেসে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হয় না। পাঠকদের অপেক্ষা আর আবিষ্কারের সফরের প্রথম মাইলফলক পেরিয়ে যাবার দিন আজ। সামনে পড়ে আছে দীর্ঘ পথ, যার আরেক নাম অপ্রকাশিত জীবনানন্দ। একগুচ্ছ জীবনানন্দ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment