কৃতজ্ঞতার সামান্য অংশও যদি থাকে তাহলে তা দিয়ে আবদুল কাদিরের জন্যে শ্রদ্ধার মিনার নির্মাণ করে দেখানো উচিত। নিঃসন্দেহে তিনি ‘নজরুল-রচনাবলী’ সম্পাদনায় সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের দাবীদার; ‘নজরুল-রচনা-সম্ভার’ সম্পাদনও তাঁর অনন্যকীর্তি; কিন্তু এই চাপাওষ্ঠের মানুষটি ‘গোলাম মোস্তফা কাব্য-গ্রন্থাবলী’ ‘লুৎফর রহমান রচনাবলী’ ‘আবুল হোসেন রচনাবলী’ ‘ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক স্মারক বক্তৃতামালা’ ‘রোকেয়া রচনাবলী’ ‘সনেট শতক’ ও ‘বাঙলা সনেট’ সম্পাদনা করে যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন তার কোন তুলনা নেই। স্পষ্টবাদিতার কারণে এবং চাতুর্য ব্যবহারের দুর্বলতার কারণে হয়ত তিনি জনপ্রিয়তা অর্জনে এবং বহু হৃদয় জয়ে ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু বাঙলী মুসলিম মনীষীকৃত সাহিত্য-সৃষ্টি-রক্ষাকারী, উন্নতশির প্রহরী হিসেবে তিনি যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আশা করি বাঙলী সাহিত্য ও কাব্যপ্রেমীরা তা পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত বিস্মৃত হবেন না। কবি হিসেবে তিনি বড় না ছোট তা নিয়ে বির্তক থাকবে চিরকাল; কিন্তু বাঙালী মুসলিম সাহিত্য প্রহরায় তাঁর অন্তহীন প্রেম ও সাধনা তাঁর ঈর্ষাপরায়ণ বন্ধুদের উত্তরসূরীরা ভুলে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন বলে মনে করি। বাঙালী মুসলিম সাহিত্য ইতিহাস রচনায় আমি মনে করি আবদুল করীম সাহিত্যবিশারদ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, নাজিরুল ইসলাম মুহম্মদ সুফিয়ান প্রমুখদের মতো তাঁর নামও অমরতার স্তরে উন্নীত হবে। বলা বাহুল্য আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালী হিন্দু সাহিত্যিকদের তুলনায় বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান সামান্য নয়Ñ যদিও পরিমাণে তা স্বল্প কিন্তু গুণগত মানে তা উপেক্ষা করার মত নয়। এ-ব্যাপারে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের এ-সম্পর্কিত বক্তব্যটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে পারি। ইংরেজ আমলের মুসলিম বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে এনামুল হক, মীর মোশাররফ হোসেন, মৌলভী মুহম্মদ মহীউদ্দীন, কায়কোবাদ, দাদ আলী, শেখ আবদুর রহীম, রিয়াজুদ্দীন মাশহাদী, মোজাম্মেল হক, মুনশী মুহম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ, ডাক্তার আবুল হোসেন, মৌলভী মেয়রাজউদ্দীন আহমদ, তাসলীমউদ্দীন আহমদ, মুন্সি মুহম্মদ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ, মৌলভী আব্বাস আলী, কবি আবু মালি মোহাম্মদ হামিদ আলী, কবি আবদুল হামিদ খান ইউসুফজায়ী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, নওশের আলী খান ইউসুফজায়ী, মওলানা মুহম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মেহেরুল্লাহ প্রমুখের নাম উল্লেখ করে বলেছেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ইঁহাদের দান সম্বন্ধে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসুদনকে বাদ দিলে সেই যুগের অন্যান্য সাহিত্যিকদের তুলনায় ইঁহাদের দান উৎকৃষ্ট বই নিকৃষ্ট নহে। এই বক্তব্যে উচ্ছ্বাস আছে নি:সন্দেহে, কিন্তু তা অপরিমাণ মিথ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন নয়। আবদুল কাদির এ-বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলেন না। তাঁর ঐতিহাসিক চেতনা তাঁকে এ-দিকে পিঠ ফেরাতে নিষেধ করেছে। তিনিও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, এনামুল হকের মত মুসলিম লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের উদ্বোধন যুগকে শ্রদ্ধা জানাতে কসুর করেন নি; রত্নগর্ভা বাংলা ভাষাকে চিনতে ভুল করেন নি। মুসলিম সাহিত্য মাতৃকোষে যে ‘রতœরাজি’ আছে তা তাঁরা বারেকের জন্যেও বিস্মৃত হন নি। এখানে এ-কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের অবদান সামান্য নয়। তাদের অনুবাদ সাহিত্যও মৌলিক সাহিত্যের গুণ-শোভিত এবং আসল-নকল ভেদ চূর্ণকারী। এ-ক্ষেত্রে আবদুল কাদিরের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পণ্ডিত অধ্যাপকের চেয়ে কম নয়। তাঁর রচিত অসংখ্য প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হলেই আমরা তা জানতে পারব। তবে তিনি যে কেবল কবি ও ছান্দসিক নন একজন উঁচুমানের সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও গবেষকও তাঁকে সম্পূর্ণভাবে জানলে সে বিষয়ে সন্দেহ করতে দ্বিধা করবেন। তাঁর ইতিহাস জ্ঞানও সামান্য ছিল না এবং তাঁর সাহিত্যবোধকে শানিত করতে সে জ্ঞান তাঁকে অশেষ সাহায্য করেছে যে তাতে আমাদের সন্দেহ প্রায় শূন্যস্পর্শী। তবে তাঁর গ্রন্থ-সম্পাদনা দেখে মনে হয় তাঁর সাহিত্য কর্মক্ষেত্র, বিশেষ করে, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক মুসলিম রেনেসাঁস কেন্দ্রিক কালের। ইসমাঈল হোসেন সিরাজী বেগম রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন, ডাক্তার লুৎফর রহমান, আবুল হুসেন, গোলাম মোস্তফা ও নজরুল ইসলাম সবাই এই সময়ের উপহার। যদিও উদার এবং বিশ্বজনীন সাহিত্যনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন এবং আধুনিকতায় তবু তাঁর ঐতিহ্যপ্রীতি এবং মুসলিম সমাজ-প্রীতি তাঁর বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছে। তিনি শ্মশ্র“ধারী মুসলিম ছিলেন না; কিন্তু তাঁর জীবনাচরণে তিনি যে ইসলাম-প্রেমী ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, তাঁর সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের অল্প ঘনিষ্ঠ এবং স্বল্প ঘনিষ্ঠ পরিচিত জীবনে, তিনি চিন্তায় উদার হলেও এবং নাস্তিক্যবাদী সাইয়েদুর রহমানের নাস্তিক্যবাদ প্রচার সভায় অংশগ্রহণ করলেও, তিনি মুসলিম সামাজিক প্রথাগুলো বয়কট করতে কুন্ঠিত ছিলেন এবং তাঁর শ্বশুর কমরেড মুজফফর আহমদ পাক্কা কমিউনিষ্ট হিসাবে মৃত্যুবরণ করার পরে তিনি তাঁর নিজের বাসায় মিলাদ পড়ে কুলখানি পড়ার ব্যবস্থা করে প্রমাণ করেছেন তিনি ঐতিহ্য-বিচ্যুত হওয়ার পক্ষপাতী নন। তিনি র্যাডিকাল হিউম্যানিজমে বিশ্বাসী ছিলেন বলে দাবী করলেও তিনি বলতে দ্বিধা করতেন না, তাঁর মধ্যে অতি মুসলিমদের কিছু অন্ধসংস্কার বেঁচে আছে। এখানে র্যাডিকাল হিউম্যানিজম বা নবমানবতাবাদ সম্বন্ধে সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রণীত ‘রাজনীতির অভিধান’ থেকে বিষয়টির স্বল্প ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঐ গ্রন্থের সংকলক ও সম্পাদক বলছেন ‘মানবেন্দ্র রায় কর্তৃক প্রবর্তিত বাক্যটি থিসিসে বিবৃত একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন। এটি ‘নবমানবতাবাদ’ নামেও প্রচারিত হয়। …‘নবমানবতাবাদ’ দর্শনে মানবতাই সব কিছুর একমাত্র মানদন্ড। আধ্যাত্মিক মানবতাবাদে মানুষকে ঐশি সত্তায় বিমূর্ত কল্পনায় বিশ্বাতীত মহত্ত্ব দান করা হয়। বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদে প্রাকৃতিক বিবর্তনের অংশ হিসাবে জৈব দৃষ্টিতে মানুষ বিবেচিত। নবমানবতাবাদ দর্শন সম্পূর্ণ রূপে মানুষের জ্ঞান ও গবেষণার উপর প্রতিষ্ঠিত। তার প্রেক্ষাপট একাধারে বস্তুবাদী ও গতিসম্পন্ন। সর্বার্থে-বিজ্ঞানভিত্তিক এই দর্শন মানুষের সৎ, শুভ ও সৃজনশীল জৈবধর্মে আস্থাবান। এ-যাবৎকালীন আধ্যাত্মিক ও অতীন্দ্রিয় মানবতা থেকে পার্থক্যের চিহ্ন হিসাবে ‘নব’ কথাটি যুক্ত হয়েছে এই অর্থে যে এতে মানুষকে নতুনভাবে দেখা হয়েছে। যে দেখার পিছনে আছে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের মনোভঙ্গি। … নবমানবতাবাদ দর্শন ঐতিহাসিক বিবর্তনে লব্ধ অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত। এই দর্শনের মর্ম হল যুক্তি, নৈতিকতা ও স্বাধীনতা। মানুষ মূলত যুক্তিবাদী জীব হলেও অনেক সময় তাঁর অপরিশীলিত মনে আদিম প্রবৃত্তি ফুটে ওঠে। সেজন্য চাই মানব মনের যথোচিত কর্ষণ। মানুষে মানুষে সম্বন্দ ও সামাজিক বিধি- ব্যবস্থায় যুক্তির সুষ্ঠ প্রয়োগ থেকেই নীতিনিষ্ঠা গড়ে ওঠে।’ কিন্তু আমার ধারণা আবদুল কাদির এই বৈজ্ঞানিক র্যাডিকেলিজমকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেন নি। তিনি যেমন ইসলামকে তেমনি ইসলামী সূফীবাদ তথা আধ্যাত্মিকতাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করতেন বলে বিশ্বাস করা যায়। তাঁর লেখা, লেখক এবং বিষয় নির্বাচন খুঁটিয়ে দেখলেই বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে। একজন সাধারণ ধারণার আধুনিক লেখককে মধ্যযুগের মুসলিম লিখিত পুঁথিসাহিত্য বা বিংশশতাব্দীর মুসলিম সাহিত্য বা ইসলাম ধর্ম বা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশী কৌতূহলী হওয়া স্বাভাবিক নয়, একমাত্র গবেষণাকর্মী ছাড়া। আবদুল কাদির গভীর মনোযোগ, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দিয়ে ইসলাম ধর্ম ও ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ‘দিলরুবা’ গ্রন্থে তিনি যে রসুল সা. এর উপর কবিতা লিখেছেন সেটা তাঁর ইসলাম প্রীতিরই উজ্জ্বল প্রমাণ। অবশ্য ধর্ম-প্রীতি ও ইসলাম প্রীতিতে তিনি গভীরতর সমর্পিত সত্তা ছিলেন না। কেননা তিনি নজরুল ইসলামের মত কখন অটল বিশ্বাসে স্থিরদৃঢ় এ-ধরনের কথা বলেন নি- ‘আল্লাহ লা-শরিক, একমেবাদ্বিতীয়ম। কে সেখানে দ্বিতীয় আছে যে আমার বিচার করবে? কাজেই কারও নিন্দাবাদ বা বিচারকে আমি ভয় করি না। আল্লাহ আমার প্রভূ, রসূলের আমি উম্মত, আল কোরান আমার পথ-প্রদর্শক। এ-ছাড়া আমার কেহ-প্রভু নাই, শাফায়াতদাতা নাই, মুর্শিদ নাই।’আমার-লীগ-কংগ্রেস:নজরুল- রচনাবলী, ৫খন্ড, দ্বিতীয়ার্ধ। কিন্তু তাঁর নজরুলপ্রিয়তা, নজরুলানুরাগ, নজরুল প্রচারনিষ্ঠা ও নজরুল-চর্চা প্রমাণ করে স্ব-সামাজিক দায়িত্ব চেতনা যা ছিল সমকালীন মুসলিম সমাজের জন্যে একান্ত প্রয়োজন, তা তিনি অবিচলিত অদোদুল্যমান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আবদুল কাদির যত ছিলেন কাব্যপ্রেমী তত ছিলেন কাব্য-ছন্দ-প্রেমী। তাঁর ছন্দ ও কাব্য প্রায় অভিন্ন ছিল। নিজের কবিতায় সেই ছন্দ খুব বেশী উল্লাস-উজ্জ্বল না হলেও তাঁর ছন্দ-ব্যাকরণপাণ্ডিত্য অস্বীকার করার উপায় নেই এবং তাঁর ছন্দ:সমীক্ষণ গ্রন্থে তিনি তার উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছেন। ছন্দ তাঁর মাথায় এমনভাবে বসতি স্থাপন করেছিল যে মাঝে মাঝে তাঁকে ছন্দপ্রেমগ্রস্ত বলে মনে হত। এবং গোলাম মোস্তফার ‘কাব্যগ্রন্থাবলী’র ভূমিকাতে যেমন তেমনি তাঁর ‘সনেট শতক’ ও ‘বাঙলা সনেট’ নামক কাব্য-সংকলন বা সনেট-সংকলনের ভূমিকায় সনেটের ছন্দ ও কবিতার ছন্দ নিয়ে, যা সমুচিত বলে মনে হয়, আলোচনা করেছেন, যা একই সঙ্গে জ্ঞানপ্রদ ও আনন্দপ্রদ। যদিও তাঁকে কখনও কখনও ছন্দগ্রস্ত বলে মনে হয় তবে এ-কথা সত্যি হিন্দু মুসলমান কবি সাহিত্যিক মিলে এ-পর্যন্ত কেউ এ-ধরণের গুণসমন্বিত ভূমিকা প্রবন্ধ লেখায় কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন বলে আমার জনা নেই। তাঁর লেখা আবুল হুসেনের রচনাবলীর ভূমিকাকে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা বলে আমি মনে করি। বাঙালী মুসলিম সমাজের রাজনীতি আজ পর্যন্ত যে ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে এই ভূমিকায় প্রকাশিত আবদুল কাদিরের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে বিবেচিত হবে বলে আমার ধারণা। বলেছি আবদুল কাদির শুধু ‘নজরুল রচনাবলী’ নয় ‘রোকেয়া’ ‘আবুল হোসেন’ ‘লুৎফর রহমান’ ‘গোলাম মোস্তফা’ রচনাবলী ও কাব্যগ্রন্থেরও সম্পাদক। তিনি আরও সম্পাদক ১৯৭৩-এ প্রকাশিত ‘সনেট শতক’ ও ১৯৭৪-এ প্রকাশিত ‘বাঙলা সনেট’। এবং তাঁর বিশেষ পরিকল্পনায় বাঙালী মুসলিমদের কাব্য সংকলন ‘কাব্য মালঞ্চ’ যেটি উপেক্ষিত বাঙালী মুসলিমদের বাংলা সাহিত্যে অবদান নিয়ে আমাদের একটি নতুন ভাবনা উপহার দেয়। কিন্তু যেটা তাকে সম্পাদক হিসাবে অমরত্বের সিংহাসনে বসিয়েছে সেটা ‘নজরুল রচনাবলী’ যদিও আমার ব্যক্তিগত ধারণা, প্রবন্ধ লেখায় যিনি অতি নিষ্ঠাবান ছিলেন ‘নজরুল রচনাবলী’র ভূমিকা লেখায় তিনি সেই নিষ্ঠাকে নিংড়ে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয়ত ‘গ্রন্থ পরিচয়’ দিতে গিয়ে তিনি তাঁর অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করছেন ভূমিকা লেখায় অতিরিক্ত বক্তব্য বলে মনে করাতে তিনি এটাকে নি®প্রয়োজন বলে ভেবেছেন। আর একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি নজরুল জীবনী লেখার দায়িত্ব তিনি হয়ত সম্পূর্ণ করতে পারতেন; কিন্তু ‘নজরুল রচনাবলী’ সম্পাদনা করতে গিয়ে তাঁর পক্ষে সে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় নি। তবু অনেকে জানেন তিনিই প্রথম দৈনিক কৃষকে নজরুল জন্মবার্ষিকীতে নজরুল জীবনী লেখার সূচনা করেছিলেন। তিনি ‘নজরুল রচনাবলী’র ৫ম খণ্ডের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বয়সোচিত শারীরিক অক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘১৩৯১ সনের ১৮ জ্যৈষ্ঠ আমার বয়স ৭৮ বৎসর পূর্ণ হয়ে ৭৯ বৎসর শুরু হবে। বর্তমানে আমি বহু ব্যধিগ্রস্ত জরাজীর্ণ ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধ। প্রায় সতের বছর আগে আমার ডান চোখের ছানি কাটা হয়েছিল; কিন্তু সেই চোখ এখনও কাজে লাগছে না। ১৯৮২ খ্রীস্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর আমার বাম চোখের ছানি কাটা হয়েছে। এই অবস্থায় আমার পক্ষে নজরুল ইসলামের অবলুপ্তিমুখীন রচনাবলী সংগ্রহের চেষ্টা করা আর সম্ভবপর নয়।’ ১৩৯১-এ লেখা ভূমিকা [১৯৮৪ ইংরেজী সন] লেখার পরে আর বেশী দিন তিনি বাঁচেন নি। নি:শেষিত এই প্রদীপের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না নজরুল জীবনী রচনার। তবু এই মেধাবী কবি সম্পাদনা কর্মে যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং কাব্য ও সাহিত্যের ইতিহাসে যে অবদান রেখেছেন, বাংলাদেশের মানুষ তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। নজরুল-চর্চায় তাঁর অবদানের কথা লিখতে গিয়ে তাঁর সম্পাদিত ‘মাহে-নও’ পত্রিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। পত্রিকাটি সরকারী পত্রিকা ছিল। কিন্তু সরকারী অফিসে বসেও এক নিমেষেও তিনি ‘বিদ্রোহী’ নজরুলের কথা বিস্মৃত হন নি, যা কোন সরকারের পক্ষে ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ সত্ত্বেও তিনি প্রতি বছর ‘নজরুলের জন্য একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশকে জাতীয় দায়িত্ব বলে ভেবেছেন। এই পত্রিকায় তিনি বহু বছর ধরে নজরুল সম্বদ্ধে নিজে যেমন লিখেছেন এবং অন্যদেরও নজরুলের উপর লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন। অনেক সময় মনে হতো ‘মাহে-নও’ যেন নজরুল পরিচিতি দানের একটি মুখপত্র। কারণ কবি হিসেবে নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে তাঁর কোন সন্দেহ ছিল না। এবং কবি হিসেবে নজরুলের যে স্বীকৃতি বাংলাদেশের সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে পাওয়া উচিত ছিল কৃপণহৃদয়, বৃটিশ-ভীত ও বৃটিশ-ভক্ত বাংলাদেশীরা নজরুল ইসলামকে সে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তরুণ বয়সে তিনি যে নজরুলকে ভলোবেসেছিলেন তাঁর ৭৮ বছর বয়সের জীবনে [১৯শে ডিসেম্বর ১৯৮৪ তে তিনি মৃত্যুবরণ করেন] তাঁর সে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পরিবর্তন ঘটেনি। এবং নজরুলের কাব্য ও সংগীতসমৃদ্ধ সাহিত্য মূল্যায়নে তাঁর পরিমাপের পাল্লা অবনমনের দিকে ঝোঁকে নি। উপসংহারে তাঁর আর একটি অসাধারণ গুণের কথা আমি উল্লেখ করব যেটা আমি সম্পাদক গোলাম মোস্তফার মধ্যেও দেখেছি। তবে এ-ব্যাপারে আবদুল কাদিরকে আমাকে গোলাম মোস্তফার চেয়ে এক ধাপ উপরের মনে হয়েছে। তিনি লেখকের মুখ দেখে লেখার বিচার করতেন না। তিনি লেখার বিচার করতেন লেখা পড়ে। সে লেখা কোন ভাগ্যবানের না হতভাগ্যের, কোন স্বীকৃত লেখকের না বর্জিত লেখকের সে দিকে দৃকপাত করতেন না। অসাধারণ স্মৃতিধর এই সম্পাদক, ভাষাবিদ, ছান্দসিক, সংস্কারবিদ ও ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক জ্ঞানে টইটম্বুর এই সম্পাদক খুঁটিয়ে পড়ে লেখার মান বিচার করতেন এবং সে লেখা মুদ্রণযোগ্য কি না তা নির্ণয় করতেন। এর জন্যে অনেক খ্যাতিমান লেখকের লেখা যেমন তাঁর বাস্কেট বক্সে স্থান পেত তেমনি একেবারে অখ্যাত লেখকের লেখা তাঁর হাতে শুদ্ধ হয়ে মুদ্রণ তালিকায় ঠাঁই পেত। সাহিত্যের মান বিচারে শত্র“-মিত্র তাঁর কাছে সমতুল্য ছিল। তাঁর সত্য-সন্ধ প্রকৃতির কাছে সাহিত্য ছিল অগ্রগণ্য। এ-ক্ষেত্রে নিবিচার নয় শুদ্ধ বিচার, সমদর্শীর সাম্যবাদী বিচার, ছিল তাঁর কাছে শ্রদ্ধেয়। তাঁর ধাত্রীপনায় সাফ হয়ে কত যে অখ্যাত কবি-সাহিত্যিক বিখ্যাত হয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। এবং এ থেকে এ-দেশের বর্তমানে বিখ্যাত কোন কবি বাদ যাবেন না, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিচারে তাঁর ঔদার্যের ও মানবিকতার কোন অভাব ছিল না; কিন্তু সাহিত্য-বিচারে তিনি ছিলেন নির্মম। এবং এ-ব্যাপারে তাঁর বন্ধুরাও রেহাই পাই নি। আজ এই কঠোর সম্পাদকের অভাব বাংলাদেশে প্রচন্ডভাবে দৃষ্ট হওয়ায় সাহিত্যের নন্দনকাননে দুরাচার দৈত্যেরা নির্বিকারভাবে ভ্রমণ করার স্পর্ধা পাচ্ছে যেসব লেখকরা সাহিত্যের প্রতি আজও সশ্রদ্ধ তাঁরা তাই নিষ্কুন্ঠ চিত্তে আবদুল কাদিরকে হাজার হাজার সালাম জানাবেন বলে আমার বিশ্বাস। এবং সম চরিত্রের আর একজন আবদুল কাদিরকে পেতে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করবেন। (আজ প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, ছান্দসিক ও সম্পাদক আবদুল কাদিরের মৃত্যুবার্ষিকী। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আড়াইসিধা গ্রামে ১ জুন, ১৯০৬ সালে। ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে পাঁচটি লেটারসহ ম্যাট্রিক ও ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএসসি পাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় বিখ্যাত সওগাত পত্রিকায় সম্পাদনা বিভাগে চাকরি নেন। ১৯৩০ সালে কলকাতার একটি প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৫-এ কমরেড মুজাফফর আহমদের কন্যা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। বাংলা ১৩৩৭-এ জয়তী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা ছাড়াও একই বছর নবশক্তির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৯৩৮-এ যোগ দেন যুগান্তর পত্রিকায়। ১৯৪২-এ কবি নজরুল সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে সরকারের প্রচার সংস্থায় বাংলা অনুবাদক পদে যোগ দেন। ১৯৪৬-এ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও অর্ধসাপ্তাহিক পয়গাম পত্রিকায় চাকরি করেন। ১৯৫২ থেকে ’৬৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপত্র মাসিক মাহেনও পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশন অফিসার ছিলেন ১৯৭০ পর্যন্ত। মুসলিম সাহিত্য সমাজ (১৯২৬)-এর নেতৃত্বে ঢাকায় যে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন সূচিত হয়, তিনি তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং সাহিত্য সমাজের মুখপত্র বার্ষিক শিখা (১৯২৭) পত্রিকার প্রকাশক ও লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ-কবিতা : দিলরুবা (১৯৩৩), উত্তর বসন্ত (১৯৬৭)। প্রবন্ধ : বাংলা কাব্যের ইতিহাস : মুসলিম সাধনার ধারা (১৯৪৪), কবি নজরুল (১৯৭০), মওলানা মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন (১৯৭৯), কাজী আবদুল ওদুদ (১৯৭৬), ড. মুহম্মদ এনামুল হক বক্তৃতামালা (১৩৯০), ছন্দ সমীক্ষণ (১৯৭৯), লোকায়ত সাহিত্য (১৯৮৫, মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমী প্রকাশিত)। সম্পাদনা করেছেন বিখ্যাত কাব্য সঙ্কলন কাব্য মালঞ্চং, মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প, নজরুল রচনাবলী (প্রথম খণ্ড-পঞ্চম খণ্ড), রোকেয়া রচনাবলী, শিরাজী রচনাবলী, লুৎফর রহমান রচনাবলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী, আবুল হুসেন রচনাবলী, কাব্যবীথি ইত্যাদি। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, মুক্তধারা পুরস্কার প্রভৃতি লাভ করেন।)
Saturday, December 20, 2014
কবি-সম্পাদক আবদুল কাদির :Natun Barta
শুধু উপার্জন করা; সম্পদের পাহাড় গড়াই বড় ব্যাপার নয় সম্পদ রক্ষা করাও বড় ব্যাপার। বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে সেই কৃতিত্ব যাঁদের প্রাপ্য কবি-সম্পাদক-গবেষক-সমালোচক আবদুল কাদির তাঁদেরই একজন। এমন নিষ্ঠাবান সাহিত্যপ্রেমী একাধিক দেখেছি বলে আমার মনে হয় না। বিশেষ করে বাঙালী মুসলিম সাহিত্য ও সাহিত্যিককে যে গভীর প্রেম ও শ্রদ্ধা দিয়ে কালের ধ্বংস ও ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা তিনি করেছেন জাতির মধ্যে
কৃতজ্ঞতার সামান্য অংশও যদি থাকে তাহলে তা দিয়ে আবদুল কাদিরের জন্যে শ্রদ্ধার মিনার নির্মাণ করে দেখানো উচিত। নিঃসন্দেহে তিনি ‘নজরুল-রচনাবলী’ সম্পাদনায় সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের দাবীদার; ‘নজরুল-রচনা-সম্ভার’ সম্পাদনও তাঁর অনন্যকীর্তি; কিন্তু এই চাপাওষ্ঠের মানুষটি ‘গোলাম মোস্তফা কাব্য-গ্রন্থাবলী’ ‘লুৎফর রহমান রচনাবলী’ ‘আবুল হোসেন রচনাবলী’ ‘ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক স্মারক বক্তৃতামালা’ ‘রোকেয়া রচনাবলী’ ‘সনেট শতক’ ও ‘বাঙলা সনেট’ সম্পাদনা করে যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন তার কোন তুলনা নেই। স্পষ্টবাদিতার কারণে এবং চাতুর্য ব্যবহারের দুর্বলতার কারণে হয়ত তিনি জনপ্রিয়তা অর্জনে এবং বহু হৃদয় জয়ে ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু বাঙলী মুসলিম মনীষীকৃত সাহিত্য-সৃষ্টি-রক্ষাকারী, উন্নতশির প্রহরী হিসেবে তিনি যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আশা করি বাঙলী সাহিত্য ও কাব্যপ্রেমীরা তা পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত বিস্মৃত হবেন না। কবি হিসেবে তিনি বড় না ছোট তা নিয়ে বির্তক থাকবে চিরকাল; কিন্তু বাঙালী মুসলিম সাহিত্য প্রহরায় তাঁর অন্তহীন প্রেম ও সাধনা তাঁর ঈর্ষাপরায়ণ বন্ধুদের উত্তরসূরীরা ভুলে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন বলে মনে করি। বাঙালী মুসলিম সাহিত্য ইতিহাস রচনায় আমি মনে করি আবদুল করীম সাহিত্যবিশারদ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, নাজিরুল ইসলাম মুহম্মদ সুফিয়ান প্রমুখদের মতো তাঁর নামও অমরতার স্তরে উন্নীত হবে। বলা বাহুল্য আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালী হিন্দু সাহিত্যিকদের তুলনায় বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান সামান্য নয়Ñ যদিও পরিমাণে তা স্বল্প কিন্তু গুণগত মানে তা উপেক্ষা করার মত নয়। এ-ব্যাপারে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের এ-সম্পর্কিত বক্তব্যটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে পারি। ইংরেজ আমলের মুসলিম বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে এনামুল হক, মীর মোশাররফ হোসেন, মৌলভী মুহম্মদ মহীউদ্দীন, কায়কোবাদ, দাদ আলী, শেখ আবদুর রহীম, রিয়াজুদ্দীন মাশহাদী, মোজাম্মেল হক, মুনশী মুহম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ, ডাক্তার আবুল হোসেন, মৌলভী মেয়রাজউদ্দীন আহমদ, তাসলীমউদ্দীন আহমদ, মুন্সি মুহম্মদ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ, মৌলভী আব্বাস আলী, কবি আবু মালি মোহাম্মদ হামিদ আলী, কবি আবদুল হামিদ খান ইউসুফজায়ী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, নওশের আলী খান ইউসুফজায়ী, মওলানা মুহম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মেহেরুল্লাহ প্রমুখের নাম উল্লেখ করে বলেছেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ইঁহাদের দান সম্বন্ধে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসুদনকে বাদ দিলে সেই যুগের অন্যান্য সাহিত্যিকদের তুলনায় ইঁহাদের দান উৎকৃষ্ট বই নিকৃষ্ট নহে। এই বক্তব্যে উচ্ছ্বাস আছে নি:সন্দেহে, কিন্তু তা অপরিমাণ মিথ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন নয়। আবদুল কাদির এ-বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলেন না। তাঁর ঐতিহাসিক চেতনা তাঁকে এ-দিকে পিঠ ফেরাতে নিষেধ করেছে। তিনিও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, এনামুল হকের মত মুসলিম লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের উদ্বোধন যুগকে শ্রদ্ধা জানাতে কসুর করেন নি; রত্নগর্ভা বাংলা ভাষাকে চিনতে ভুল করেন নি। মুসলিম সাহিত্য মাতৃকোষে যে ‘রতœরাজি’ আছে তা তাঁরা বারেকের জন্যেও বিস্মৃত হন নি। এখানে এ-কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের অবদান সামান্য নয়। তাদের অনুবাদ সাহিত্যও মৌলিক সাহিত্যের গুণ-শোভিত এবং আসল-নকল ভেদ চূর্ণকারী। এ-ক্ষেত্রে আবদুল কাদিরের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পণ্ডিত অধ্যাপকের চেয়ে কম নয়। তাঁর রচিত অসংখ্য প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হলেই আমরা তা জানতে পারব। তবে তিনি যে কেবল কবি ও ছান্দসিক নন একজন উঁচুমানের সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও গবেষকও তাঁকে সম্পূর্ণভাবে জানলে সে বিষয়ে সন্দেহ করতে দ্বিধা করবেন। তাঁর ইতিহাস জ্ঞানও সামান্য ছিল না এবং তাঁর সাহিত্যবোধকে শানিত করতে সে জ্ঞান তাঁকে অশেষ সাহায্য করেছে যে তাতে আমাদের সন্দেহ প্রায় শূন্যস্পর্শী। তবে তাঁর গ্রন্থ-সম্পাদনা দেখে মনে হয় তাঁর সাহিত্য কর্মক্ষেত্র, বিশেষ করে, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক মুসলিম রেনেসাঁস কেন্দ্রিক কালের। ইসমাঈল হোসেন সিরাজী বেগম রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন, ডাক্তার লুৎফর রহমান, আবুল হুসেন, গোলাম মোস্তফা ও নজরুল ইসলাম সবাই এই সময়ের উপহার। যদিও উদার এবং বিশ্বজনীন সাহিত্যনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন এবং আধুনিকতায় তবু তাঁর ঐতিহ্যপ্রীতি এবং মুসলিম সমাজ-প্রীতি তাঁর বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছে। তিনি শ্মশ্র“ধারী মুসলিম ছিলেন না; কিন্তু তাঁর জীবনাচরণে তিনি যে ইসলাম-প্রেমী ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, তাঁর সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের অল্প ঘনিষ্ঠ এবং স্বল্প ঘনিষ্ঠ পরিচিত জীবনে, তিনি চিন্তায় উদার হলেও এবং নাস্তিক্যবাদী সাইয়েদুর রহমানের নাস্তিক্যবাদ প্রচার সভায় অংশগ্রহণ করলেও, তিনি মুসলিম সামাজিক প্রথাগুলো বয়কট করতে কুন্ঠিত ছিলেন এবং তাঁর শ্বশুর কমরেড মুজফফর আহমদ পাক্কা কমিউনিষ্ট হিসাবে মৃত্যুবরণ করার পরে তিনি তাঁর নিজের বাসায় মিলাদ পড়ে কুলখানি পড়ার ব্যবস্থা করে প্রমাণ করেছেন তিনি ঐতিহ্য-বিচ্যুত হওয়ার পক্ষপাতী নন। তিনি র্যাডিকাল হিউম্যানিজমে বিশ্বাসী ছিলেন বলে দাবী করলেও তিনি বলতে দ্বিধা করতেন না, তাঁর মধ্যে অতি মুসলিমদের কিছু অন্ধসংস্কার বেঁচে আছে। এখানে র্যাডিকাল হিউম্যানিজম বা নবমানবতাবাদ সম্বন্ধে সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রণীত ‘রাজনীতির অভিধান’ থেকে বিষয়টির স্বল্প ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঐ গ্রন্থের সংকলক ও সম্পাদক বলছেন ‘মানবেন্দ্র রায় কর্তৃক প্রবর্তিত বাক্যটি থিসিসে বিবৃত একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন। এটি ‘নবমানবতাবাদ’ নামেও প্রচারিত হয়। …‘নবমানবতাবাদ’ দর্শনে মানবতাই সব কিছুর একমাত্র মানদন্ড। আধ্যাত্মিক মানবতাবাদে মানুষকে ঐশি সত্তায় বিমূর্ত কল্পনায় বিশ্বাতীত মহত্ত্ব দান করা হয়। বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদে প্রাকৃতিক বিবর্তনের অংশ হিসাবে জৈব দৃষ্টিতে মানুষ বিবেচিত। নবমানবতাবাদ দর্শন সম্পূর্ণ রূপে মানুষের জ্ঞান ও গবেষণার উপর প্রতিষ্ঠিত। তার প্রেক্ষাপট একাধারে বস্তুবাদী ও গতিসম্পন্ন। সর্বার্থে-বিজ্ঞানভিত্তিক এই দর্শন মানুষের সৎ, শুভ ও সৃজনশীল জৈবধর্মে আস্থাবান। এ-যাবৎকালীন আধ্যাত্মিক ও অতীন্দ্রিয় মানবতা থেকে পার্থক্যের চিহ্ন হিসাবে ‘নব’ কথাটি যুক্ত হয়েছে এই অর্থে যে এতে মানুষকে নতুনভাবে দেখা হয়েছে। যে দেখার পিছনে আছে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের মনোভঙ্গি। … নবমানবতাবাদ দর্শন ঐতিহাসিক বিবর্তনে লব্ধ অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত। এই দর্শনের মর্ম হল যুক্তি, নৈতিকতা ও স্বাধীনতা। মানুষ মূলত যুক্তিবাদী জীব হলেও অনেক সময় তাঁর অপরিশীলিত মনে আদিম প্রবৃত্তি ফুটে ওঠে। সেজন্য চাই মানব মনের যথোচিত কর্ষণ। মানুষে মানুষে সম্বন্দ ও সামাজিক বিধি- ব্যবস্থায় যুক্তির সুষ্ঠ প্রয়োগ থেকেই নীতিনিষ্ঠা গড়ে ওঠে।’ কিন্তু আমার ধারণা আবদুল কাদির এই বৈজ্ঞানিক র্যাডিকেলিজমকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেন নি। তিনি যেমন ইসলামকে তেমনি ইসলামী সূফীবাদ তথা আধ্যাত্মিকতাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করতেন বলে বিশ্বাস করা যায়। তাঁর লেখা, লেখক এবং বিষয় নির্বাচন খুঁটিয়ে দেখলেই বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে। একজন সাধারণ ধারণার আধুনিক লেখককে মধ্যযুগের মুসলিম লিখিত পুঁথিসাহিত্য বা বিংশশতাব্দীর মুসলিম সাহিত্য বা ইসলাম ধর্ম বা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশী কৌতূহলী হওয়া স্বাভাবিক নয়, একমাত্র গবেষণাকর্মী ছাড়া। আবদুল কাদির গভীর মনোযোগ, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দিয়ে ইসলাম ধর্ম ও ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ‘দিলরুবা’ গ্রন্থে তিনি যে রসুল সা. এর উপর কবিতা লিখেছেন সেটা তাঁর ইসলাম প্রীতিরই উজ্জ্বল প্রমাণ। অবশ্য ধর্ম-প্রীতি ও ইসলাম প্রীতিতে তিনি গভীরতর সমর্পিত সত্তা ছিলেন না। কেননা তিনি নজরুল ইসলামের মত কখন অটল বিশ্বাসে স্থিরদৃঢ় এ-ধরনের কথা বলেন নি- ‘আল্লাহ লা-শরিক, একমেবাদ্বিতীয়ম। কে সেখানে দ্বিতীয় আছে যে আমার বিচার করবে? কাজেই কারও নিন্দাবাদ বা বিচারকে আমি ভয় করি না। আল্লাহ আমার প্রভূ, রসূলের আমি উম্মত, আল কোরান আমার পথ-প্রদর্শক। এ-ছাড়া আমার কেহ-প্রভু নাই, শাফায়াতদাতা নাই, মুর্শিদ নাই।’আমার-লীগ-কংগ্রেস:নজরুল- রচনাবলী, ৫খন্ড, দ্বিতীয়ার্ধ। কিন্তু তাঁর নজরুলপ্রিয়তা, নজরুলানুরাগ, নজরুল প্রচারনিষ্ঠা ও নজরুল-চর্চা প্রমাণ করে স্ব-সামাজিক দায়িত্ব চেতনা যা ছিল সমকালীন মুসলিম সমাজের জন্যে একান্ত প্রয়োজন, তা তিনি অবিচলিত অদোদুল্যমান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আবদুল কাদির যত ছিলেন কাব্যপ্রেমী তত ছিলেন কাব্য-ছন্দ-প্রেমী। তাঁর ছন্দ ও কাব্য প্রায় অভিন্ন ছিল। নিজের কবিতায় সেই ছন্দ খুব বেশী উল্লাস-উজ্জ্বল না হলেও তাঁর ছন্দ-ব্যাকরণপাণ্ডিত্য অস্বীকার করার উপায় নেই এবং তাঁর ছন্দ:সমীক্ষণ গ্রন্থে তিনি তার উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছেন। ছন্দ তাঁর মাথায় এমনভাবে বসতি স্থাপন করেছিল যে মাঝে মাঝে তাঁকে ছন্দপ্রেমগ্রস্ত বলে মনে হত। এবং গোলাম মোস্তফার ‘কাব্যগ্রন্থাবলী’র ভূমিকাতে যেমন তেমনি তাঁর ‘সনেট শতক’ ও ‘বাঙলা সনেট’ নামক কাব্য-সংকলন বা সনেট-সংকলনের ভূমিকায় সনেটের ছন্দ ও কবিতার ছন্দ নিয়ে, যা সমুচিত বলে মনে হয়, আলোচনা করেছেন, যা একই সঙ্গে জ্ঞানপ্রদ ও আনন্দপ্রদ। যদিও তাঁকে কখনও কখনও ছন্দগ্রস্ত বলে মনে হয় তবে এ-কথা সত্যি হিন্দু মুসলমান কবি সাহিত্যিক মিলে এ-পর্যন্ত কেউ এ-ধরণের গুণসমন্বিত ভূমিকা প্রবন্ধ লেখায় কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন বলে আমার জনা নেই। তাঁর লেখা আবুল হুসেনের রচনাবলীর ভূমিকাকে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা বলে আমি মনে করি। বাঙালী মুসলিম সমাজের রাজনীতি আজ পর্যন্ত যে ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে এই ভূমিকায় প্রকাশিত আবদুল কাদিরের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে বিবেচিত হবে বলে আমার ধারণা। বলেছি আবদুল কাদির শুধু ‘নজরুল রচনাবলী’ নয় ‘রোকেয়া’ ‘আবুল হোসেন’ ‘লুৎফর রহমান’ ‘গোলাম মোস্তফা’ রচনাবলী ও কাব্যগ্রন্থেরও সম্পাদক। তিনি আরও সম্পাদক ১৯৭৩-এ প্রকাশিত ‘সনেট শতক’ ও ১৯৭৪-এ প্রকাশিত ‘বাঙলা সনেট’। এবং তাঁর বিশেষ পরিকল্পনায় বাঙালী মুসলিমদের কাব্য সংকলন ‘কাব্য মালঞ্চ’ যেটি উপেক্ষিত বাঙালী মুসলিমদের বাংলা সাহিত্যে অবদান নিয়ে আমাদের একটি নতুন ভাবনা উপহার দেয়। কিন্তু যেটা তাকে সম্পাদক হিসাবে অমরত্বের সিংহাসনে বসিয়েছে সেটা ‘নজরুল রচনাবলী’ যদিও আমার ব্যক্তিগত ধারণা, প্রবন্ধ লেখায় যিনি অতি নিষ্ঠাবান ছিলেন ‘নজরুল রচনাবলী’র ভূমিকা লেখায় তিনি সেই নিষ্ঠাকে নিংড়ে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয়ত ‘গ্রন্থ পরিচয়’ দিতে গিয়ে তিনি তাঁর অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করছেন ভূমিকা লেখায় অতিরিক্ত বক্তব্য বলে মনে করাতে তিনি এটাকে নি®প্রয়োজন বলে ভেবেছেন। আর একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি নজরুল জীবনী লেখার দায়িত্ব তিনি হয়ত সম্পূর্ণ করতে পারতেন; কিন্তু ‘নজরুল রচনাবলী’ সম্পাদনা করতে গিয়ে তাঁর পক্ষে সে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় নি। তবু অনেকে জানেন তিনিই প্রথম দৈনিক কৃষকে নজরুল জন্মবার্ষিকীতে নজরুল জীবনী লেখার সূচনা করেছিলেন। তিনি ‘নজরুল রচনাবলী’র ৫ম খণ্ডের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বয়সোচিত শারীরিক অক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘১৩৯১ সনের ১৮ জ্যৈষ্ঠ আমার বয়স ৭৮ বৎসর পূর্ণ হয়ে ৭৯ বৎসর শুরু হবে। বর্তমানে আমি বহু ব্যধিগ্রস্ত জরাজীর্ণ ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধ। প্রায় সতের বছর আগে আমার ডান চোখের ছানি কাটা হয়েছিল; কিন্তু সেই চোখ এখনও কাজে লাগছে না। ১৯৮২ খ্রীস্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর আমার বাম চোখের ছানি কাটা হয়েছে। এই অবস্থায় আমার পক্ষে নজরুল ইসলামের অবলুপ্তিমুখীন রচনাবলী সংগ্রহের চেষ্টা করা আর সম্ভবপর নয়।’ ১৩৯১-এ লেখা ভূমিকা [১৯৮৪ ইংরেজী সন] লেখার পরে আর বেশী দিন তিনি বাঁচেন নি। নি:শেষিত এই প্রদীপের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না নজরুল জীবনী রচনার। তবু এই মেধাবী কবি সম্পাদনা কর্মে যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং কাব্য ও সাহিত্যের ইতিহাসে যে অবদান রেখেছেন, বাংলাদেশের মানুষ তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। নজরুল-চর্চায় তাঁর অবদানের কথা লিখতে গিয়ে তাঁর সম্পাদিত ‘মাহে-নও’ পত্রিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। পত্রিকাটি সরকারী পত্রিকা ছিল। কিন্তু সরকারী অফিসে বসেও এক নিমেষেও তিনি ‘বিদ্রোহী’ নজরুলের কথা বিস্মৃত হন নি, যা কোন সরকারের পক্ষে ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ সত্ত্বেও তিনি প্রতি বছর ‘নজরুলের জন্য একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশকে জাতীয় দায়িত্ব বলে ভেবেছেন। এই পত্রিকায় তিনি বহু বছর ধরে নজরুল সম্বদ্ধে নিজে যেমন লিখেছেন এবং অন্যদেরও নজরুলের উপর লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন। অনেক সময় মনে হতো ‘মাহে-নও’ যেন নজরুল পরিচিতি দানের একটি মুখপত্র। কারণ কবি হিসেবে নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে তাঁর কোন সন্দেহ ছিল না। এবং কবি হিসেবে নজরুলের যে স্বীকৃতি বাংলাদেশের সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে পাওয়া উচিত ছিল কৃপণহৃদয়, বৃটিশ-ভীত ও বৃটিশ-ভক্ত বাংলাদেশীরা নজরুল ইসলামকে সে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তরুণ বয়সে তিনি যে নজরুলকে ভলোবেসেছিলেন তাঁর ৭৮ বছর বয়সের জীবনে [১৯শে ডিসেম্বর ১৯৮৪ তে তিনি মৃত্যুবরণ করেন] তাঁর সে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পরিবর্তন ঘটেনি। এবং নজরুলের কাব্য ও সংগীতসমৃদ্ধ সাহিত্য মূল্যায়নে তাঁর পরিমাপের পাল্লা অবনমনের দিকে ঝোঁকে নি। উপসংহারে তাঁর আর একটি অসাধারণ গুণের কথা আমি উল্লেখ করব যেটা আমি সম্পাদক গোলাম মোস্তফার মধ্যেও দেখেছি। তবে এ-ব্যাপারে আবদুল কাদিরকে আমাকে গোলাম মোস্তফার চেয়ে এক ধাপ উপরের মনে হয়েছে। তিনি লেখকের মুখ দেখে লেখার বিচার করতেন না। তিনি লেখার বিচার করতেন লেখা পড়ে। সে লেখা কোন ভাগ্যবানের না হতভাগ্যের, কোন স্বীকৃত লেখকের না বর্জিত লেখকের সে দিকে দৃকপাত করতেন না। অসাধারণ স্মৃতিধর এই সম্পাদক, ভাষাবিদ, ছান্দসিক, সংস্কারবিদ ও ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক জ্ঞানে টইটম্বুর এই সম্পাদক খুঁটিয়ে পড়ে লেখার মান বিচার করতেন এবং সে লেখা মুদ্রণযোগ্য কি না তা নির্ণয় করতেন। এর জন্যে অনেক খ্যাতিমান লেখকের লেখা যেমন তাঁর বাস্কেট বক্সে স্থান পেত তেমনি একেবারে অখ্যাত লেখকের লেখা তাঁর হাতে শুদ্ধ হয়ে মুদ্রণ তালিকায় ঠাঁই পেত। সাহিত্যের মান বিচারে শত্র“-মিত্র তাঁর কাছে সমতুল্য ছিল। তাঁর সত্য-সন্ধ প্রকৃতির কাছে সাহিত্য ছিল অগ্রগণ্য। এ-ক্ষেত্রে নিবিচার নয় শুদ্ধ বিচার, সমদর্শীর সাম্যবাদী বিচার, ছিল তাঁর কাছে শ্রদ্ধেয়। তাঁর ধাত্রীপনায় সাফ হয়ে কত যে অখ্যাত কবি-সাহিত্যিক বিখ্যাত হয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। এবং এ থেকে এ-দেশের বর্তমানে বিখ্যাত কোন কবি বাদ যাবেন না, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিচারে তাঁর ঔদার্যের ও মানবিকতার কোন অভাব ছিল না; কিন্তু সাহিত্য-বিচারে তিনি ছিলেন নির্মম। এবং এ-ব্যাপারে তাঁর বন্ধুরাও রেহাই পাই নি। আজ এই কঠোর সম্পাদকের অভাব বাংলাদেশে প্রচন্ডভাবে দৃষ্ট হওয়ায় সাহিত্যের নন্দনকাননে দুরাচার দৈত্যেরা নির্বিকারভাবে ভ্রমণ করার স্পর্ধা পাচ্ছে যেসব লেখকরা সাহিত্যের প্রতি আজও সশ্রদ্ধ তাঁরা তাই নিষ্কুন্ঠ চিত্তে আবদুল কাদিরকে হাজার হাজার সালাম জানাবেন বলে আমার বিশ্বাস। এবং সম চরিত্রের আর একজন আবদুল কাদিরকে পেতে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করবেন। (আজ প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, ছান্দসিক ও সম্পাদক আবদুল কাদিরের মৃত্যুবার্ষিকী। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আড়াইসিধা গ্রামে ১ জুন, ১৯০৬ সালে। ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে পাঁচটি লেটারসহ ম্যাট্রিক ও ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএসসি পাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় বিখ্যাত সওগাত পত্রিকায় সম্পাদনা বিভাগে চাকরি নেন। ১৯৩০ সালে কলকাতার একটি প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৫-এ কমরেড মুজাফফর আহমদের কন্যা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। বাংলা ১৩৩৭-এ জয়তী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা ছাড়াও একই বছর নবশক্তির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৯৩৮-এ যোগ দেন যুগান্তর পত্রিকায়। ১৯৪২-এ কবি নজরুল সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে সরকারের প্রচার সংস্থায় বাংলা অনুবাদক পদে যোগ দেন। ১৯৪৬-এ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও অর্ধসাপ্তাহিক পয়গাম পত্রিকায় চাকরি করেন। ১৯৫২ থেকে ’৬৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপত্র মাসিক মাহেনও পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশন অফিসার ছিলেন ১৯৭০ পর্যন্ত। মুসলিম সাহিত্য সমাজ (১৯২৬)-এর নেতৃত্বে ঢাকায় যে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন সূচিত হয়, তিনি তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং সাহিত্য সমাজের মুখপত্র বার্ষিক শিখা (১৯২৭) পত্রিকার প্রকাশক ও লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ-কবিতা : দিলরুবা (১৯৩৩), উত্তর বসন্ত (১৯৬৭)। প্রবন্ধ : বাংলা কাব্যের ইতিহাস : মুসলিম সাধনার ধারা (১৯৪৪), কবি নজরুল (১৯৭০), মওলানা মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন (১৯৭৯), কাজী আবদুল ওদুদ (১৯৭৬), ড. মুহম্মদ এনামুল হক বক্তৃতামালা (১৩৯০), ছন্দ সমীক্ষণ (১৯৭৯), লোকায়ত সাহিত্য (১৯৮৫, মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমী প্রকাশিত)। সম্পাদনা করেছেন বিখ্যাত কাব্য সঙ্কলন কাব্য মালঞ্চং, মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প, নজরুল রচনাবলী (প্রথম খণ্ড-পঞ্চম খণ্ড), রোকেয়া রচনাবলী, শিরাজী রচনাবলী, লুৎফর রহমান রচনাবলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী, আবুল হুসেন রচনাবলী, কাব্যবীথি ইত্যাদি। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, মুক্তধারা পুরস্কার প্রভৃতি লাভ করেন।)
কৃতজ্ঞতার সামান্য অংশও যদি থাকে তাহলে তা দিয়ে আবদুল কাদিরের জন্যে শ্রদ্ধার মিনার নির্মাণ করে দেখানো উচিত। নিঃসন্দেহে তিনি ‘নজরুল-রচনাবলী’ সম্পাদনায় সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের দাবীদার; ‘নজরুল-রচনা-সম্ভার’ সম্পাদনও তাঁর অনন্যকীর্তি; কিন্তু এই চাপাওষ্ঠের মানুষটি ‘গোলাম মোস্তফা কাব্য-গ্রন্থাবলী’ ‘লুৎফর রহমান রচনাবলী’ ‘আবুল হোসেন রচনাবলী’ ‘ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক স্মারক বক্তৃতামালা’ ‘রোকেয়া রচনাবলী’ ‘সনেট শতক’ ও ‘বাঙলা সনেট’ সম্পাদনা করে যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন তার কোন তুলনা নেই। স্পষ্টবাদিতার কারণে এবং চাতুর্য ব্যবহারের দুর্বলতার কারণে হয়ত তিনি জনপ্রিয়তা অর্জনে এবং বহু হৃদয় জয়ে ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু বাঙলী মুসলিম মনীষীকৃত সাহিত্য-সৃষ্টি-রক্ষাকারী, উন্নতশির প্রহরী হিসেবে তিনি যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আশা করি বাঙলী সাহিত্য ও কাব্যপ্রেমীরা তা পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত বিস্মৃত হবেন না। কবি হিসেবে তিনি বড় না ছোট তা নিয়ে বির্তক থাকবে চিরকাল; কিন্তু বাঙালী মুসলিম সাহিত্য প্রহরায় তাঁর অন্তহীন প্রেম ও সাধনা তাঁর ঈর্ষাপরায়ণ বন্ধুদের উত্তরসূরীরা ভুলে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন বলে মনে করি। বাঙালী মুসলিম সাহিত্য ইতিহাস রচনায় আমি মনে করি আবদুল করীম সাহিত্যবিশারদ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, নাজিরুল ইসলাম মুহম্মদ সুফিয়ান প্রমুখদের মতো তাঁর নামও অমরতার স্তরে উন্নীত হবে। বলা বাহুল্য আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালী হিন্দু সাহিত্যিকদের তুলনায় বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান সামান্য নয়Ñ যদিও পরিমাণে তা স্বল্প কিন্তু গুণগত মানে তা উপেক্ষা করার মত নয়। এ-ব্যাপারে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের এ-সম্পর্কিত বক্তব্যটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে পারি। ইংরেজ আমলের মুসলিম বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে এনামুল হক, মীর মোশাররফ হোসেন, মৌলভী মুহম্মদ মহীউদ্দীন, কায়কোবাদ, দাদ আলী, শেখ আবদুর রহীম, রিয়াজুদ্দীন মাশহাদী, মোজাম্মেল হক, মুনশী মুহম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ, ডাক্তার আবুল হোসেন, মৌলভী মেয়রাজউদ্দীন আহমদ, তাসলীমউদ্দীন আহমদ, মুন্সি মুহম্মদ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ, মৌলভী আব্বাস আলী, কবি আবু মালি মোহাম্মদ হামিদ আলী, কবি আবদুল হামিদ খান ইউসুফজায়ী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, নওশের আলী খান ইউসুফজায়ী, মওলানা মুহম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মেহেরুল্লাহ প্রমুখের নাম উল্লেখ করে বলেছেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ইঁহাদের দান সম্বন্ধে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসুদনকে বাদ দিলে সেই যুগের অন্যান্য সাহিত্যিকদের তুলনায় ইঁহাদের দান উৎকৃষ্ট বই নিকৃষ্ট নহে। এই বক্তব্যে উচ্ছ্বাস আছে নি:সন্দেহে, কিন্তু তা অপরিমাণ মিথ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন নয়। আবদুল কাদির এ-বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলেন না। তাঁর ঐতিহাসিক চেতনা তাঁকে এ-দিকে পিঠ ফেরাতে নিষেধ করেছে। তিনিও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, এনামুল হকের মত মুসলিম লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের উদ্বোধন যুগকে শ্রদ্ধা জানাতে কসুর করেন নি; রত্নগর্ভা বাংলা ভাষাকে চিনতে ভুল করেন নি। মুসলিম সাহিত্য মাতৃকোষে যে ‘রতœরাজি’ আছে তা তাঁরা বারেকের জন্যেও বিস্মৃত হন নি। এখানে এ-কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের অবদান সামান্য নয়। তাদের অনুবাদ সাহিত্যও মৌলিক সাহিত্যের গুণ-শোভিত এবং আসল-নকল ভেদ চূর্ণকারী। এ-ক্ষেত্রে আবদুল কাদিরের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পণ্ডিত অধ্যাপকের চেয়ে কম নয়। তাঁর রচিত অসংখ্য প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হলেই আমরা তা জানতে পারব। তবে তিনি যে কেবল কবি ও ছান্দসিক নন একজন উঁচুমানের সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও গবেষকও তাঁকে সম্পূর্ণভাবে জানলে সে বিষয়ে সন্দেহ করতে দ্বিধা করবেন। তাঁর ইতিহাস জ্ঞানও সামান্য ছিল না এবং তাঁর সাহিত্যবোধকে শানিত করতে সে জ্ঞান তাঁকে অশেষ সাহায্য করেছে যে তাতে আমাদের সন্দেহ প্রায় শূন্যস্পর্শী। তবে তাঁর গ্রন্থ-সম্পাদনা দেখে মনে হয় তাঁর সাহিত্য কর্মক্ষেত্র, বিশেষ করে, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক মুসলিম রেনেসাঁস কেন্দ্রিক কালের। ইসমাঈল হোসেন সিরাজী বেগম রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন, ডাক্তার লুৎফর রহমান, আবুল হুসেন, গোলাম মোস্তফা ও নজরুল ইসলাম সবাই এই সময়ের উপহার। যদিও উদার এবং বিশ্বজনীন সাহিত্যনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন এবং আধুনিকতায় তবু তাঁর ঐতিহ্যপ্রীতি এবং মুসলিম সমাজ-প্রীতি তাঁর বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছে। তিনি শ্মশ্র“ধারী মুসলিম ছিলেন না; কিন্তু তাঁর জীবনাচরণে তিনি যে ইসলাম-প্রেমী ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, তাঁর সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের অল্প ঘনিষ্ঠ এবং স্বল্প ঘনিষ্ঠ পরিচিত জীবনে, তিনি চিন্তায় উদার হলেও এবং নাস্তিক্যবাদী সাইয়েদুর রহমানের নাস্তিক্যবাদ প্রচার সভায় অংশগ্রহণ করলেও, তিনি মুসলিম সামাজিক প্রথাগুলো বয়কট করতে কুন্ঠিত ছিলেন এবং তাঁর শ্বশুর কমরেড মুজফফর আহমদ পাক্কা কমিউনিষ্ট হিসাবে মৃত্যুবরণ করার পরে তিনি তাঁর নিজের বাসায় মিলাদ পড়ে কুলখানি পড়ার ব্যবস্থা করে প্রমাণ করেছেন তিনি ঐতিহ্য-বিচ্যুত হওয়ার পক্ষপাতী নন। তিনি র্যাডিকাল হিউম্যানিজমে বিশ্বাসী ছিলেন বলে দাবী করলেও তিনি বলতে দ্বিধা করতেন না, তাঁর মধ্যে অতি মুসলিমদের কিছু অন্ধসংস্কার বেঁচে আছে। এখানে র্যাডিকাল হিউম্যানিজম বা নবমানবতাবাদ সম্বন্ধে সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রণীত ‘রাজনীতির অভিধান’ থেকে বিষয়টির স্বল্প ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঐ গ্রন্থের সংকলক ও সম্পাদক বলছেন ‘মানবেন্দ্র রায় কর্তৃক প্রবর্তিত বাক্যটি থিসিসে বিবৃত একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন। এটি ‘নবমানবতাবাদ’ নামেও প্রচারিত হয়। …‘নবমানবতাবাদ’ দর্শনে মানবতাই সব কিছুর একমাত্র মানদন্ড। আধ্যাত্মিক মানবতাবাদে মানুষকে ঐশি সত্তায় বিমূর্ত কল্পনায় বিশ্বাতীত মহত্ত্ব দান করা হয়। বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদে প্রাকৃতিক বিবর্তনের অংশ হিসাবে জৈব দৃষ্টিতে মানুষ বিবেচিত। নবমানবতাবাদ দর্শন সম্পূর্ণ রূপে মানুষের জ্ঞান ও গবেষণার উপর প্রতিষ্ঠিত। তার প্রেক্ষাপট একাধারে বস্তুবাদী ও গতিসম্পন্ন। সর্বার্থে-বিজ্ঞানভিত্তিক এই দর্শন মানুষের সৎ, শুভ ও সৃজনশীল জৈবধর্মে আস্থাবান। এ-যাবৎকালীন আধ্যাত্মিক ও অতীন্দ্রিয় মানবতা থেকে পার্থক্যের চিহ্ন হিসাবে ‘নব’ কথাটি যুক্ত হয়েছে এই অর্থে যে এতে মানুষকে নতুনভাবে দেখা হয়েছে। যে দেখার পিছনে আছে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের মনোভঙ্গি। … নবমানবতাবাদ দর্শন ঐতিহাসিক বিবর্তনে লব্ধ অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত। এই দর্শনের মর্ম হল যুক্তি, নৈতিকতা ও স্বাধীনতা। মানুষ মূলত যুক্তিবাদী জীব হলেও অনেক সময় তাঁর অপরিশীলিত মনে আদিম প্রবৃত্তি ফুটে ওঠে। সেজন্য চাই মানব মনের যথোচিত কর্ষণ। মানুষে মানুষে সম্বন্দ ও সামাজিক বিধি- ব্যবস্থায় যুক্তির সুষ্ঠ প্রয়োগ থেকেই নীতিনিষ্ঠা গড়ে ওঠে।’ কিন্তু আমার ধারণা আবদুল কাদির এই বৈজ্ঞানিক র্যাডিকেলিজমকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেন নি। তিনি যেমন ইসলামকে তেমনি ইসলামী সূফীবাদ তথা আধ্যাত্মিকতাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করতেন বলে বিশ্বাস করা যায়। তাঁর লেখা, লেখক এবং বিষয় নির্বাচন খুঁটিয়ে দেখলেই বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে। একজন সাধারণ ধারণার আধুনিক লেখককে মধ্যযুগের মুসলিম লিখিত পুঁথিসাহিত্য বা বিংশশতাব্দীর মুসলিম সাহিত্য বা ইসলাম ধর্ম বা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশী কৌতূহলী হওয়া স্বাভাবিক নয়, একমাত্র গবেষণাকর্মী ছাড়া। আবদুল কাদির গভীর মনোযোগ, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দিয়ে ইসলাম ধর্ম ও ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ‘দিলরুবা’ গ্রন্থে তিনি যে রসুল সা. এর উপর কবিতা লিখেছেন সেটা তাঁর ইসলাম প্রীতিরই উজ্জ্বল প্রমাণ। অবশ্য ধর্ম-প্রীতি ও ইসলাম প্রীতিতে তিনি গভীরতর সমর্পিত সত্তা ছিলেন না। কেননা তিনি নজরুল ইসলামের মত কখন অটল বিশ্বাসে স্থিরদৃঢ় এ-ধরনের কথা বলেন নি- ‘আল্লাহ লা-শরিক, একমেবাদ্বিতীয়ম। কে সেখানে দ্বিতীয় আছে যে আমার বিচার করবে? কাজেই কারও নিন্দাবাদ বা বিচারকে আমি ভয় করি না। আল্লাহ আমার প্রভূ, রসূলের আমি উম্মত, আল কোরান আমার পথ-প্রদর্শক। এ-ছাড়া আমার কেহ-প্রভু নাই, শাফায়াতদাতা নাই, মুর্শিদ নাই।’আমার-লীগ-কংগ্রেস:নজরুল- রচনাবলী, ৫খন্ড, দ্বিতীয়ার্ধ। কিন্তু তাঁর নজরুলপ্রিয়তা, নজরুলানুরাগ, নজরুল প্রচারনিষ্ঠা ও নজরুল-চর্চা প্রমাণ করে স্ব-সামাজিক দায়িত্ব চেতনা যা ছিল সমকালীন মুসলিম সমাজের জন্যে একান্ত প্রয়োজন, তা তিনি অবিচলিত অদোদুল্যমান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আবদুল কাদির যত ছিলেন কাব্যপ্রেমী তত ছিলেন কাব্য-ছন্দ-প্রেমী। তাঁর ছন্দ ও কাব্য প্রায় অভিন্ন ছিল। নিজের কবিতায় সেই ছন্দ খুব বেশী উল্লাস-উজ্জ্বল না হলেও তাঁর ছন্দ-ব্যাকরণপাণ্ডিত্য অস্বীকার করার উপায় নেই এবং তাঁর ছন্দ:সমীক্ষণ গ্রন্থে তিনি তার উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছেন। ছন্দ তাঁর মাথায় এমনভাবে বসতি স্থাপন করেছিল যে মাঝে মাঝে তাঁকে ছন্দপ্রেমগ্রস্ত বলে মনে হত। এবং গোলাম মোস্তফার ‘কাব্যগ্রন্থাবলী’র ভূমিকাতে যেমন তেমনি তাঁর ‘সনেট শতক’ ও ‘বাঙলা সনেট’ নামক কাব্য-সংকলন বা সনেট-সংকলনের ভূমিকায় সনেটের ছন্দ ও কবিতার ছন্দ নিয়ে, যা সমুচিত বলে মনে হয়, আলোচনা করেছেন, যা একই সঙ্গে জ্ঞানপ্রদ ও আনন্দপ্রদ। যদিও তাঁকে কখনও কখনও ছন্দগ্রস্ত বলে মনে হয় তবে এ-কথা সত্যি হিন্দু মুসলমান কবি সাহিত্যিক মিলে এ-পর্যন্ত কেউ এ-ধরণের গুণসমন্বিত ভূমিকা প্রবন্ধ লেখায় কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন বলে আমার জনা নেই। তাঁর লেখা আবুল হুসেনের রচনাবলীর ভূমিকাকে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা বলে আমি মনে করি। বাঙালী মুসলিম সমাজের রাজনীতি আজ পর্যন্ত যে ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে এই ভূমিকায় প্রকাশিত আবদুল কাদিরের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে বিবেচিত হবে বলে আমার ধারণা। বলেছি আবদুল কাদির শুধু ‘নজরুল রচনাবলী’ নয় ‘রোকেয়া’ ‘আবুল হোসেন’ ‘লুৎফর রহমান’ ‘গোলাম মোস্তফা’ রচনাবলী ও কাব্যগ্রন্থেরও সম্পাদক। তিনি আরও সম্পাদক ১৯৭৩-এ প্রকাশিত ‘সনেট শতক’ ও ১৯৭৪-এ প্রকাশিত ‘বাঙলা সনেট’। এবং তাঁর বিশেষ পরিকল্পনায় বাঙালী মুসলিমদের কাব্য সংকলন ‘কাব্য মালঞ্চ’ যেটি উপেক্ষিত বাঙালী মুসলিমদের বাংলা সাহিত্যে অবদান নিয়ে আমাদের একটি নতুন ভাবনা উপহার দেয়। কিন্তু যেটা তাকে সম্পাদক হিসাবে অমরত্বের সিংহাসনে বসিয়েছে সেটা ‘নজরুল রচনাবলী’ যদিও আমার ব্যক্তিগত ধারণা, প্রবন্ধ লেখায় যিনি অতি নিষ্ঠাবান ছিলেন ‘নজরুল রচনাবলী’র ভূমিকা লেখায় তিনি সেই নিষ্ঠাকে নিংড়ে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয়ত ‘গ্রন্থ পরিচয়’ দিতে গিয়ে তিনি তাঁর অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করছেন ভূমিকা লেখায় অতিরিক্ত বক্তব্য বলে মনে করাতে তিনি এটাকে নি®প্রয়োজন বলে ভেবেছেন। আর একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি নজরুল জীবনী লেখার দায়িত্ব তিনি হয়ত সম্পূর্ণ করতে পারতেন; কিন্তু ‘নজরুল রচনাবলী’ সম্পাদনা করতে গিয়ে তাঁর পক্ষে সে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় নি। তবু অনেকে জানেন তিনিই প্রথম দৈনিক কৃষকে নজরুল জন্মবার্ষিকীতে নজরুল জীবনী লেখার সূচনা করেছিলেন। তিনি ‘নজরুল রচনাবলী’র ৫ম খণ্ডের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বয়সোচিত শারীরিক অক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘১৩৯১ সনের ১৮ জ্যৈষ্ঠ আমার বয়স ৭৮ বৎসর পূর্ণ হয়ে ৭৯ বৎসর শুরু হবে। বর্তমানে আমি বহু ব্যধিগ্রস্ত জরাজীর্ণ ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধ। প্রায় সতের বছর আগে আমার ডান চোখের ছানি কাটা হয়েছিল; কিন্তু সেই চোখ এখনও কাজে লাগছে না। ১৯৮২ খ্রীস্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর আমার বাম চোখের ছানি কাটা হয়েছে। এই অবস্থায় আমার পক্ষে নজরুল ইসলামের অবলুপ্তিমুখীন রচনাবলী সংগ্রহের চেষ্টা করা আর সম্ভবপর নয়।’ ১৩৯১-এ লেখা ভূমিকা [১৯৮৪ ইংরেজী সন] লেখার পরে আর বেশী দিন তিনি বাঁচেন নি। নি:শেষিত এই প্রদীপের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না নজরুল জীবনী রচনার। তবু এই মেধাবী কবি সম্পাদনা কর্মে যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং কাব্য ও সাহিত্যের ইতিহাসে যে অবদান রেখেছেন, বাংলাদেশের মানুষ তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। নজরুল-চর্চায় তাঁর অবদানের কথা লিখতে গিয়ে তাঁর সম্পাদিত ‘মাহে-নও’ পত্রিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। পত্রিকাটি সরকারী পত্রিকা ছিল। কিন্তু সরকারী অফিসে বসেও এক নিমেষেও তিনি ‘বিদ্রোহী’ নজরুলের কথা বিস্মৃত হন নি, যা কোন সরকারের পক্ষে ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ সত্ত্বেও তিনি প্রতি বছর ‘নজরুলের জন্য একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশকে জাতীয় দায়িত্ব বলে ভেবেছেন। এই পত্রিকায় তিনি বহু বছর ধরে নজরুল সম্বদ্ধে নিজে যেমন লিখেছেন এবং অন্যদেরও নজরুলের উপর লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন। অনেক সময় মনে হতো ‘মাহে-নও’ যেন নজরুল পরিচিতি দানের একটি মুখপত্র। কারণ কবি হিসেবে নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে তাঁর কোন সন্দেহ ছিল না। এবং কবি হিসেবে নজরুলের যে স্বীকৃতি বাংলাদেশের সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে পাওয়া উচিত ছিল কৃপণহৃদয়, বৃটিশ-ভীত ও বৃটিশ-ভক্ত বাংলাদেশীরা নজরুল ইসলামকে সে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তরুণ বয়সে তিনি যে নজরুলকে ভলোবেসেছিলেন তাঁর ৭৮ বছর বয়সের জীবনে [১৯শে ডিসেম্বর ১৯৮৪ তে তিনি মৃত্যুবরণ করেন] তাঁর সে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পরিবর্তন ঘটেনি। এবং নজরুলের কাব্য ও সংগীতসমৃদ্ধ সাহিত্য মূল্যায়নে তাঁর পরিমাপের পাল্লা অবনমনের দিকে ঝোঁকে নি। উপসংহারে তাঁর আর একটি অসাধারণ গুণের কথা আমি উল্লেখ করব যেটা আমি সম্পাদক গোলাম মোস্তফার মধ্যেও দেখেছি। তবে এ-ব্যাপারে আবদুল কাদিরকে আমাকে গোলাম মোস্তফার চেয়ে এক ধাপ উপরের মনে হয়েছে। তিনি লেখকের মুখ দেখে লেখার বিচার করতেন না। তিনি লেখার বিচার করতেন লেখা পড়ে। সে লেখা কোন ভাগ্যবানের না হতভাগ্যের, কোন স্বীকৃত লেখকের না বর্জিত লেখকের সে দিকে দৃকপাত করতেন না। অসাধারণ স্মৃতিধর এই সম্পাদক, ভাষাবিদ, ছান্দসিক, সংস্কারবিদ ও ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক জ্ঞানে টইটম্বুর এই সম্পাদক খুঁটিয়ে পড়ে লেখার মান বিচার করতেন এবং সে লেখা মুদ্রণযোগ্য কি না তা নির্ণয় করতেন। এর জন্যে অনেক খ্যাতিমান লেখকের লেখা যেমন তাঁর বাস্কেট বক্সে স্থান পেত তেমনি একেবারে অখ্যাত লেখকের লেখা তাঁর হাতে শুদ্ধ হয়ে মুদ্রণ তালিকায় ঠাঁই পেত। সাহিত্যের মান বিচারে শত্র“-মিত্র তাঁর কাছে সমতুল্য ছিল। তাঁর সত্য-সন্ধ প্রকৃতির কাছে সাহিত্য ছিল অগ্রগণ্য। এ-ক্ষেত্রে নিবিচার নয় শুদ্ধ বিচার, সমদর্শীর সাম্যবাদী বিচার, ছিল তাঁর কাছে শ্রদ্ধেয়। তাঁর ধাত্রীপনায় সাফ হয়ে কত যে অখ্যাত কবি-সাহিত্যিক বিখ্যাত হয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। এবং এ থেকে এ-দেশের বর্তমানে বিখ্যাত কোন কবি বাদ যাবেন না, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিচারে তাঁর ঔদার্যের ও মানবিকতার কোন অভাব ছিল না; কিন্তু সাহিত্য-বিচারে তিনি ছিলেন নির্মম। এবং এ-ব্যাপারে তাঁর বন্ধুরাও রেহাই পাই নি। আজ এই কঠোর সম্পাদকের অভাব বাংলাদেশে প্রচন্ডভাবে দৃষ্ট হওয়ায় সাহিত্যের নন্দনকাননে দুরাচার দৈত্যেরা নির্বিকারভাবে ভ্রমণ করার স্পর্ধা পাচ্ছে যেসব লেখকরা সাহিত্যের প্রতি আজও সশ্রদ্ধ তাঁরা তাই নিষ্কুন্ঠ চিত্তে আবদুল কাদিরকে হাজার হাজার সালাম জানাবেন বলে আমার বিশ্বাস। এবং সম চরিত্রের আর একজন আবদুল কাদিরকে পেতে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করবেন। (আজ প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, ছান্দসিক ও সম্পাদক আবদুল কাদিরের মৃত্যুবার্ষিকী। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আড়াইসিধা গ্রামে ১ জুন, ১৯০৬ সালে। ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে পাঁচটি লেটারসহ ম্যাট্রিক ও ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএসসি পাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় বিখ্যাত সওগাত পত্রিকায় সম্পাদনা বিভাগে চাকরি নেন। ১৯৩০ সালে কলকাতার একটি প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৫-এ কমরেড মুজাফফর আহমদের কন্যা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। বাংলা ১৩৩৭-এ জয়তী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা ছাড়াও একই বছর নবশক্তির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৯৩৮-এ যোগ দেন যুগান্তর পত্রিকায়। ১৯৪২-এ কবি নজরুল সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে সরকারের প্রচার সংস্থায় বাংলা অনুবাদক পদে যোগ দেন। ১৯৪৬-এ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও অর্ধসাপ্তাহিক পয়গাম পত্রিকায় চাকরি করেন। ১৯৫২ থেকে ’৬৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপত্র মাসিক মাহেনও পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশন অফিসার ছিলেন ১৯৭০ পর্যন্ত। মুসলিম সাহিত্য সমাজ (১৯২৬)-এর নেতৃত্বে ঢাকায় যে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন সূচিত হয়, তিনি তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং সাহিত্য সমাজের মুখপত্র বার্ষিক শিখা (১৯২৭) পত্রিকার প্রকাশক ও লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ-কবিতা : দিলরুবা (১৯৩৩), উত্তর বসন্ত (১৯৬৭)। প্রবন্ধ : বাংলা কাব্যের ইতিহাস : মুসলিম সাধনার ধারা (১৯৪৪), কবি নজরুল (১৯৭০), মওলানা মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন (১৯৭৯), কাজী আবদুল ওদুদ (১৯৭৬), ড. মুহম্মদ এনামুল হক বক্তৃতামালা (১৩৯০), ছন্দ সমীক্ষণ (১৯৭৯), লোকায়ত সাহিত্য (১৯৮৫, মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমী প্রকাশিত)। সম্পাদনা করেছেন বিখ্যাত কাব্য সঙ্কলন কাব্য মালঞ্চং, মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প, নজরুল রচনাবলী (প্রথম খণ্ড-পঞ্চম খণ্ড), রোকেয়া রচনাবলী, শিরাজী রচনাবলী, লুৎফর রহমান রচনাবলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী, আবুল হুসেন রচনাবলী, কাব্যবীথি ইত্যাদি। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, মুক্তধারা পুরস্কার প্রভৃতি লাভ করেন।)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment