যুক্তির যুগ। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করলে পরিবেশের ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় হবে। ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হবে। তিন. সারা দেশে বিদ্যুতের জোয়ার এলে, এরকম ছোটখাটো দু’চারটে ক্ষতি মানুষ ভুলে যাবেই। চার. যে প্রক্রিয়ায় আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি, একই প্রক্রিয়ায় উন্নয়নবিরোধী সব তৎপরতা থামিয়ে দেয়া যাবে। এরকম ভাবনা যে শুধু শেখ হাসিনা ভাবছেন তা নয়। তার আগে পৃথিবীতে অনেক শক্ত শাসক ভেবেছেন। বাংলাদেশেই তার নমুনা আছে। লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছিলেন একই যুক্তি ও বিশ্বাসে। পাহাড়িদের দুর্দশা যা-ই হোক না কেন, জলবিদ্যুতের উন্নয়ন তা ভুলিয়ে দেবে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উন্নয়নতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে যে বিদ্যুৎ এসেছে, তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে এই প্রকল্প। আর্থিকভাবে, পরিবেশগতভাবে প্রতিবেশভাবে এই ক্ষতি অপূরণীয়। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাহাড়ি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে, জলমগ্নতায় তাদের জীবন বদলে গেছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পকে তারা নিজেদের জীবনহানির সমতুল্য ভেবে দশকের পর দশক সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে। সেই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে বছরের পর বছর ধরে সামরিকীকরণ প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে অস্ত্র, বারুদ, ক্যান্টনমেন্ট আর সামরিক খাতে। এক দেশের মধ্যে দুই দেশ হয়েছে। এক দেশের মানুষ পরস্পরকে শত্রু ভেবে যুদ্ধ ও প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে বহু বছর। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ, প্রকৃতি, জনমানুষের জীবন বিবেচনায় সবচেয়ে ক্ষতিকর উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আইয়ুব খানের নাম কী পাকিস্তান কী বাংলাদেশ কোথাও আর সম্মানের সঙ্গে, সাফল্যের সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু আইয়ুব শাহীঘটিত এই দুর্যোগ এখনও মানুষের পিছু ছাড়েনি। কাজেই উন্নয়ন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। যেনতেন প্রকারে, শক্তি প্রয়োগের নীতিতে, জনমানুষের ভাবনার বিপরীতে উন্নয়ন অনেক সময় বড় বিপদই ডেকে আনে। সাম্প্রতিক সুন্দরবনের বিপর্যয় সেই কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ২. সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে দৃশ্যমান যেসব ক্ষতি দেখা যাচ্ছে- এক. সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন খাল, ছোট নদীতে এ তেল ছড়িয়ে পড়েছে। শ্বাসমূলীয় বনের উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হবে। দুই. বনের গাছ, উদ্ভিদ, জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তিন. সুন্দরবনের শ্যালা, পশুর, বলেশ্বর নদীর পানি দূষিত হয়েছে। ফলে মাছ, শুশুক, ডলফিনের জীবন বিপন্ন হয়েছে। চার. সুন্দরবনের নদীর পানি নষ্ট হওয়াতে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট অধিবাসী যারা এই নদীর ওপর প্রাণ ও জীবিকার কারণে নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাবার পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। নদী সংলগ্ন জনগণের ঘরে পালিত হাঁস, মুরগি এই পানিতে বিচরণ করত সেসব প্রাণীর প্রাণ সংহার হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠছে। পাঁচ. সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল উদ্ধার কাজে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়িয়ে পড়ায় বনের নির্জনতা বিপন্ন হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সব বন্যপ্রাণীর জীবন হুমকির মধ্যে পড়ছে। ছয়. অবৈজ্ঞানিক উপায়ে অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে ৩০ টাকা লিটার দরে এই তেল কেনার লোভ দেখিয়ে যেভাবে স্থানীয় জনমানুষকে ব্যবহার করা হচ্ছে, দ্রুতই তারা স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সাত. জোয়ার-ভাটার নদীতে ইতোমধ্যে মাছশূন্যতা দেখা দিয়েছে। ফার্নেস অয়েল যেভাবে বিস্তৃত এলাকাকে ছুঁয়েছে তাতে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের অপ্রাকৃতিক মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ৩. এ তেল কেন পরিবহন করা হচ্ছে? কোথা থেকে এ তেল কোথায় যাচ্ছে? কার স্বার্থে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এ রকম বাণিজ্যিক জলযান চলার অনুমতি দেয়া হয়েছে? কারা এসব জলযানের মালিক? এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা আর্থিকভাবে কতটুকু লাভবান হচ্ছে? সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে কেন এই নতুন জলরুট ব্যবহৃত হচ্ছে? এক. এ তেল পরিবহন করা হচ্ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে। মংলা বন্দর থেকে এ তেল আনা হচ্ছিল। রেন্টাল, কুইক রেন্টালের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাহিদা মেটাতে এ জ্বালানি পরিবহন করছিল প্রায় ৫০ বছর বয়সী ব্যবহার অনুপোযোগী অয়েল ট্যাংকার। দুই. এসব জলযানের মালিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এবং তাদের ঘনিষ্ঠজন। নানা প্রভাব খাটিয়ে, টাকার বিনিময়ে এ জলরুটটি চালু করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে মংলা-বেতবুনিয়া-ঘষিয়াঘাটি নৌরুট বন্ধ। বিকল্প পথ হিসেবে বনের মধ্য দিয়ে নৌরুট চালু করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বনবিভাগ আপত্তি দিলেও তা ধোপে টেকেনি। তিন. এভাবে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের উদ্দেশ্য হচ্ছে আখেরে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও মালামাল সরবরাহের সংক্ষিপ্ত ও সাশ্রয়ী নৌরুট প্রতিষ্ঠিত করা। চার. যেকোনো মূল্যে, পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে নীতি সরকার নিয়েছে তার বাস্তবায়ন করতেই এ জলরুটকে স্থায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ৪. সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও শিক্ষা ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের জলাভূমি বিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও বিশেষ শ্রেণির ডলফিনের জন্য বিখ্যাত এ সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মানুষ, জলযান, যত বেশি চলাচল করবে সুন্দরবনের ভেতরে বাস করা সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য তা বিপজ্জনক হবে, এ চিন্তায় ইউনেস্কো, জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা ও ব্যক্তিÑ প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনকে রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছে বেশ ক’বছর ধরেই। সরকার তাতে গা লাগায়নি। বরং গায়ের জোরেই সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। সরকার এ কাজ করতে আত্মঘাতী দায়মুক্তির আইন বানিয়েছে। মানুষের সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এ দায়মুক্তির আইনের মেয়াদ বছরের পর বছর বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো এ দায়মুক্তির অস্বাভাবিক, কালো আইন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ নামে পরিচিত। এ জনঅহিতকর, অগণতান্ত্রিক, স্বৈরমুখী কালো আইনের ৯, ১০, ১৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে- বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৪ নং আইন) আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ ৯। এই আইনের অধীন কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্য, গৃহীত কোন ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ ১০। এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্যের জন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। এই আইনের অধীন গৃহীত কাজের হেফাজত ১৪। এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই। ৫. যে ভারতকে তুষ্ট করতে সরকার উন্নয়নের কথা বলে সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে সে ভারতের জনগণ সুন্দরবনের নিকটে নিজ দেশে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, ভারতের আদালত সুন্দরবন সুরক্ষায় কতটুকু তৎপর তার নমুনা মেলবে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিচের সংবাদটি পড়লে- কেমন আছে ম্যানগ্রোভ, উপগ্রহ-চিত্র চায় আদালত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ নষ্ট হতে বসেছে, এই আশঙ্কা করে জাতীয় পরিবেশ আদালতের কলকাতা বেঞ্চই সেপ্টেম্বরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের বর্তমান চেহারা কী রকম, নদী বা খাঁড়িতে দূষিত ডিজেল ব্যবহার করা হয় কি না, সেখানে বেআইনি ইটভাটা চলে কি না অথবা সুন্দরবন এলাকায় অবৈধ হোটেল বা রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হয়েছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে রাজ্যের অবস্থান জানতে চেয়েছে পরিবেশ আদালত। ওই আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় এবং পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন নির্দেশ দিয়েছে, সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে উপগ্রহ-মানচিত্র অবশ্যই থাকতে হবে। সুন্দরবনের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তকে আদালত-বান্ধব নিযুক্ত করা হয়েছে। সুভাষবাবু জানান, ম্যানগ্রোভের পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে আগেই রিপোর্ট তলব করা হয়েছিল। কিন্তু বন দফতর এখনও কোনও রিপোর্টই পরিবেশ আদালতে জমা দিতে পারেনি। এ দিন ম্যানগ্রোভ মামলার শুনানি ছিল। পরিবেশ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের আইনজীবী বিকাশকুমার গুপ্তকে নির্দেশ দেন, ২১ জানুয়ারি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সংক্রান্ত উপগ্রহ-চিত্র আদালতে জমা দিতে হবে। -আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ৬. সুন্দরবন ধ্বংস করার মতো রিস্ক নিয়ে সরকার এগুতে চাইল কেন? বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে সরকার সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইল কেন? এক. সুন্দরবনকে খুব পরিকল্পিত উপায়ে টার্গেট করেছে সরকার। কারণ সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে সরকারের মাথায় আছে বড় বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ফুলবাড়ী কয়লাখনি নির্মাণ সরকারের টার্গেট। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে নৌরুট চালু করে এ প্রকল্পগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে চায় সরকার। দুই. রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। শক্তির জোরে সকল স্থানীয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে দমিয়ে সরকার ভারতকে খুশি করতে চায়। ভারতের বিনিয়োগমহল এ প্রকল্পে খুশি। ফলে বাংলাদেশে যেভাবেই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুন না কেন, ভারতের শর্তহীন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সরকারের মনস্তত্ত্ব কাজ করছে, ভারতীয় সমর্থন বজায় থাকলে তাদের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিন্ত এবং বাধাহীন। সুতরাং যেকোনো মূল্যে ভারতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। এমনকি তাতে সুন্দরবন ধ্বংস হলেও কিছু যায় আসে না। তিন. এসব প্রকল্প দৃশ্যমান। কিন্তু পেছনে আছে এশিয়া এনার্জির প্রস্তাবিত ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের উন্মুক্ত খনন। ফুলবাড়ীর কয়লা দ্রুত সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে পরিবহন করার জন্যই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বজায় রাখার প্রক্রিয়া চলছে। মংলা বন্দরকে সচল-সক্রিয় করে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সহজ, সাশ্রয়ী মূল্যে কয়লা ও উন্নয়ন প্রকল্পের সব সামগ্রী পরিবহনের জন্যই সরকার জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, দেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিষেধ, নিবেদন, পরামর্শ উপেক্ষা করেছে। চার. সরকারের যারা বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শ জোগান দেয় তারা বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক। তারা ভাবেন যেকোনো মূল্যে উন্নয়ন হলে, উন্নয়নের জোয়ারে প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস বা বিনষ্টের দুঃখ মানুষ ভুলে যাবে। বড় বড় ফ্লাইওভার, বড় বড় রেল-সড়ক সেতু, বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এমন উন্নয়ন চেহারা আনবে যার তাৎক্ষণিক সুবিধা পেয়ে জনমানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। মানুষ অর্থনীতির সুবিধা পেলে পরিবেশ ধ্বংসে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা বিবেচনায় নেবে না। পাঁচ. সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতে বিস্তৃত। সুন্দরবনের তুলনামূলক বড় অংশটি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ফার্নেস অয়েলের তেলে সুন্দরবনকে ডুবিয়ে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মালামাল পরিবহন চালিয়ে, সুন্দরবনকে ঘিরে নানারকম উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ক্রমশ বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশ বিনষ্ট করলে, ভারতীয় অংশের সুন্দরবনকে বড় করে তোলা যাবে। উন্নয়নের তেলে সুন্দরবনকে ডুবিয়ে সে প্রচেষ্টাই হয়ত চলছে! সৌজন্যে: সাপ্তাহিক
Wednesday, December 17, 2014
উন্নয়নের বলি সুন্দরবন! :Natun Barta
সুন্দরবন বন থাকুক আর না থাকুক, উন্নয়ন চলবেই। সেই উন্নয়ন জোয়ারে তাবৎ বাধা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সরকার সুন্দরবনকে বিপদাপন্ন করেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। দেশের মধ্য থেকে অনেক রকম বাধা এসেছে বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে বাধা পাত্তা দেননি। তার যুক্তি- এক. উন্নয়ন করতে গেলে জলা, বনের কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করতেই হবে। উন্নয়নের সুফল এই ক্ষতি পুষিয়ে দেবে। দুই. এখন উন্নত প্র
যুক্তির যুগ। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করলে পরিবেশের ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় হবে। ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হবে। তিন. সারা দেশে বিদ্যুতের জোয়ার এলে, এরকম ছোটখাটো দু’চারটে ক্ষতি মানুষ ভুলে যাবেই। চার. যে প্রক্রিয়ায় আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি, একই প্রক্রিয়ায় উন্নয়নবিরোধী সব তৎপরতা থামিয়ে দেয়া যাবে। এরকম ভাবনা যে শুধু শেখ হাসিনা ভাবছেন তা নয়। তার আগে পৃথিবীতে অনেক শক্ত শাসক ভেবেছেন। বাংলাদেশেই তার নমুনা আছে। লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছিলেন একই যুক্তি ও বিশ্বাসে। পাহাড়িদের দুর্দশা যা-ই হোক না কেন, জলবিদ্যুতের উন্নয়ন তা ভুলিয়ে দেবে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উন্নয়নতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে যে বিদ্যুৎ এসেছে, তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে এই প্রকল্প। আর্থিকভাবে, পরিবেশগতভাবে প্রতিবেশভাবে এই ক্ষতি অপূরণীয়। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাহাড়ি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে, জলমগ্নতায় তাদের জীবন বদলে গেছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পকে তারা নিজেদের জীবনহানির সমতুল্য ভেবে দশকের পর দশক সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে। সেই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে বছরের পর বছর ধরে সামরিকীকরণ প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে অস্ত্র, বারুদ, ক্যান্টনমেন্ট আর সামরিক খাতে। এক দেশের মধ্যে দুই দেশ হয়েছে। এক দেশের মানুষ পরস্পরকে শত্রু ভেবে যুদ্ধ ও প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে বহু বছর। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ, প্রকৃতি, জনমানুষের জীবন বিবেচনায় সবচেয়ে ক্ষতিকর উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আইয়ুব খানের নাম কী পাকিস্তান কী বাংলাদেশ কোথাও আর সম্মানের সঙ্গে, সাফল্যের সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু আইয়ুব শাহীঘটিত এই দুর্যোগ এখনও মানুষের পিছু ছাড়েনি। কাজেই উন্নয়ন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। যেনতেন প্রকারে, শক্তি প্রয়োগের নীতিতে, জনমানুষের ভাবনার বিপরীতে উন্নয়ন অনেক সময় বড় বিপদই ডেকে আনে। সাম্প্রতিক সুন্দরবনের বিপর্যয় সেই কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ২. সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে দৃশ্যমান যেসব ক্ষতি দেখা যাচ্ছে- এক. সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন খাল, ছোট নদীতে এ তেল ছড়িয়ে পড়েছে। শ্বাসমূলীয় বনের উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হবে। দুই. বনের গাছ, উদ্ভিদ, জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তিন. সুন্দরবনের শ্যালা, পশুর, বলেশ্বর নদীর পানি দূষিত হয়েছে। ফলে মাছ, শুশুক, ডলফিনের জীবন বিপন্ন হয়েছে। চার. সুন্দরবনের নদীর পানি নষ্ট হওয়াতে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট অধিবাসী যারা এই নদীর ওপর প্রাণ ও জীবিকার কারণে নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাবার পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। নদী সংলগ্ন জনগণের ঘরে পালিত হাঁস, মুরগি এই পানিতে বিচরণ করত সেসব প্রাণীর প্রাণ সংহার হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠছে। পাঁচ. সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল উদ্ধার কাজে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়িয়ে পড়ায় বনের নির্জনতা বিপন্ন হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সব বন্যপ্রাণীর জীবন হুমকির মধ্যে পড়ছে। ছয়. অবৈজ্ঞানিক উপায়ে অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে ৩০ টাকা লিটার দরে এই তেল কেনার লোভ দেখিয়ে যেভাবে স্থানীয় জনমানুষকে ব্যবহার করা হচ্ছে, দ্রুতই তারা স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সাত. জোয়ার-ভাটার নদীতে ইতোমধ্যে মাছশূন্যতা দেখা দিয়েছে। ফার্নেস অয়েল যেভাবে বিস্তৃত এলাকাকে ছুঁয়েছে তাতে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের অপ্রাকৃতিক মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ৩. এ তেল কেন পরিবহন করা হচ্ছে? কোথা থেকে এ তেল কোথায় যাচ্ছে? কার স্বার্থে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এ রকম বাণিজ্যিক জলযান চলার অনুমতি দেয়া হয়েছে? কারা এসব জলযানের মালিক? এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা আর্থিকভাবে কতটুকু লাভবান হচ্ছে? সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে কেন এই নতুন জলরুট ব্যবহৃত হচ্ছে? এক. এ তেল পরিবহন করা হচ্ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে। মংলা বন্দর থেকে এ তেল আনা হচ্ছিল। রেন্টাল, কুইক রেন্টালের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাহিদা মেটাতে এ জ্বালানি পরিবহন করছিল প্রায় ৫০ বছর বয়সী ব্যবহার অনুপোযোগী অয়েল ট্যাংকার। দুই. এসব জলযানের মালিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এবং তাদের ঘনিষ্ঠজন। নানা প্রভাব খাটিয়ে, টাকার বিনিময়ে এ জলরুটটি চালু করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে মংলা-বেতবুনিয়া-ঘষিয়াঘাটি নৌরুট বন্ধ। বিকল্প পথ হিসেবে বনের মধ্য দিয়ে নৌরুট চালু করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বনবিভাগ আপত্তি দিলেও তা ধোপে টেকেনি। তিন. এভাবে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের উদ্দেশ্য হচ্ছে আখেরে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও মালামাল সরবরাহের সংক্ষিপ্ত ও সাশ্রয়ী নৌরুট প্রতিষ্ঠিত করা। চার. যেকোনো মূল্যে, পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে নীতি সরকার নিয়েছে তার বাস্তবায়ন করতেই এ জলরুটকে স্থায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ৪. সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও শিক্ষা ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের জলাভূমি বিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও বিশেষ শ্রেণির ডলফিনের জন্য বিখ্যাত এ সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মানুষ, জলযান, যত বেশি চলাচল করবে সুন্দরবনের ভেতরে বাস করা সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য তা বিপজ্জনক হবে, এ চিন্তায় ইউনেস্কো, জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা ও ব্যক্তিÑ প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনকে রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছে বেশ ক’বছর ধরেই। সরকার তাতে গা লাগায়নি। বরং গায়ের জোরেই সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। সরকার এ কাজ করতে আত্মঘাতী দায়মুক্তির আইন বানিয়েছে। মানুষের সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এ দায়মুক্তির আইনের মেয়াদ বছরের পর বছর বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো এ দায়মুক্তির অস্বাভাবিক, কালো আইন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ নামে পরিচিত। এ জনঅহিতকর, অগণতান্ত্রিক, স্বৈরমুখী কালো আইনের ৯, ১০, ১৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে- বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৪ নং আইন) আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ ৯। এই আইনের অধীন কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্য, গৃহীত কোন ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ ১০। এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্যের জন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। এই আইনের অধীন গৃহীত কাজের হেফাজত ১৪। এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই। ৫. যে ভারতকে তুষ্ট করতে সরকার উন্নয়নের কথা বলে সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে সে ভারতের জনগণ সুন্দরবনের নিকটে নিজ দেশে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, ভারতের আদালত সুন্দরবন সুরক্ষায় কতটুকু তৎপর তার নমুনা মেলবে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিচের সংবাদটি পড়লে- কেমন আছে ম্যানগ্রোভ, উপগ্রহ-চিত্র চায় আদালত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ নষ্ট হতে বসেছে, এই আশঙ্কা করে জাতীয় পরিবেশ আদালতের কলকাতা বেঞ্চই সেপ্টেম্বরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের বর্তমান চেহারা কী রকম, নদী বা খাঁড়িতে দূষিত ডিজেল ব্যবহার করা হয় কি না, সেখানে বেআইনি ইটভাটা চলে কি না অথবা সুন্দরবন এলাকায় অবৈধ হোটেল বা রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হয়েছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে রাজ্যের অবস্থান জানতে চেয়েছে পরিবেশ আদালত। ওই আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় এবং পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন নির্দেশ দিয়েছে, সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে উপগ্রহ-মানচিত্র অবশ্যই থাকতে হবে। সুন্দরবনের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তকে আদালত-বান্ধব নিযুক্ত করা হয়েছে। সুভাষবাবু জানান, ম্যানগ্রোভের পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে আগেই রিপোর্ট তলব করা হয়েছিল। কিন্তু বন দফতর এখনও কোনও রিপোর্টই পরিবেশ আদালতে জমা দিতে পারেনি। এ দিন ম্যানগ্রোভ মামলার শুনানি ছিল। পরিবেশ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের আইনজীবী বিকাশকুমার গুপ্তকে নির্দেশ দেন, ২১ জানুয়ারি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সংক্রান্ত উপগ্রহ-চিত্র আদালতে জমা দিতে হবে। -আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ৬. সুন্দরবন ধ্বংস করার মতো রিস্ক নিয়ে সরকার এগুতে চাইল কেন? বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে সরকার সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইল কেন? এক. সুন্দরবনকে খুব পরিকল্পিত উপায়ে টার্গেট করেছে সরকার। কারণ সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে সরকারের মাথায় আছে বড় বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ফুলবাড়ী কয়লাখনি নির্মাণ সরকারের টার্গেট। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে নৌরুট চালু করে এ প্রকল্পগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে চায় সরকার। দুই. রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। শক্তির জোরে সকল স্থানীয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে দমিয়ে সরকার ভারতকে খুশি করতে চায়। ভারতের বিনিয়োগমহল এ প্রকল্পে খুশি। ফলে বাংলাদেশে যেভাবেই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুন না কেন, ভারতের শর্তহীন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সরকারের মনস্তত্ত্ব কাজ করছে, ভারতীয় সমর্থন বজায় থাকলে তাদের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিন্ত এবং বাধাহীন। সুতরাং যেকোনো মূল্যে ভারতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। এমনকি তাতে সুন্দরবন ধ্বংস হলেও কিছু যায় আসে না। তিন. এসব প্রকল্প দৃশ্যমান। কিন্তু পেছনে আছে এশিয়া এনার্জির প্রস্তাবিত ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের উন্মুক্ত খনন। ফুলবাড়ীর কয়লা দ্রুত সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে পরিবহন করার জন্যই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বজায় রাখার প্রক্রিয়া চলছে। মংলা বন্দরকে সচল-সক্রিয় করে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সহজ, সাশ্রয়ী মূল্যে কয়লা ও উন্নয়ন প্রকল্পের সব সামগ্রী পরিবহনের জন্যই সরকার জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, দেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিষেধ, নিবেদন, পরামর্শ উপেক্ষা করেছে। চার. সরকারের যারা বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শ জোগান দেয় তারা বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক। তারা ভাবেন যেকোনো মূল্যে উন্নয়ন হলে, উন্নয়নের জোয়ারে প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস বা বিনষ্টের দুঃখ মানুষ ভুলে যাবে। বড় বড় ফ্লাইওভার, বড় বড় রেল-সড়ক সেতু, বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এমন উন্নয়ন চেহারা আনবে যার তাৎক্ষণিক সুবিধা পেয়ে জনমানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। মানুষ অর্থনীতির সুবিধা পেলে পরিবেশ ধ্বংসে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা বিবেচনায় নেবে না। পাঁচ. সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতে বিস্তৃত। সুন্দরবনের তুলনামূলক বড় অংশটি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ফার্নেস অয়েলের তেলে সুন্দরবনকে ডুবিয়ে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মালামাল পরিবহন চালিয়ে, সুন্দরবনকে ঘিরে নানারকম উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ক্রমশ বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশ বিনষ্ট করলে, ভারতীয় অংশের সুন্দরবনকে বড় করে তোলা যাবে। উন্নয়নের তেলে সুন্দরবনকে ডুবিয়ে সে প্রচেষ্টাই হয়ত চলছে! সৌজন্যে: সাপ্তাহিক
যুক্তির যুগ। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করলে পরিবেশের ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় হবে। ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হবে। তিন. সারা দেশে বিদ্যুতের জোয়ার এলে, এরকম ছোটখাটো দু’চারটে ক্ষতি মানুষ ভুলে যাবেই। চার. যে প্রক্রিয়ায় আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি, একই প্রক্রিয়ায় উন্নয়নবিরোধী সব তৎপরতা থামিয়ে দেয়া যাবে। এরকম ভাবনা যে শুধু শেখ হাসিনা ভাবছেন তা নয়। তার আগে পৃথিবীতে অনেক শক্ত শাসক ভেবেছেন। বাংলাদেশেই তার নমুনা আছে। লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছিলেন একই যুক্তি ও বিশ্বাসে। পাহাড়িদের দুর্দশা যা-ই হোক না কেন, জলবিদ্যুতের উন্নয়ন তা ভুলিয়ে দেবে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উন্নয়নতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে যে বিদ্যুৎ এসেছে, তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে এই প্রকল্প। আর্থিকভাবে, পরিবেশগতভাবে প্রতিবেশভাবে এই ক্ষতি অপূরণীয়। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাহাড়ি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে, জলমগ্নতায় তাদের জীবন বদলে গেছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পকে তারা নিজেদের জীবনহানির সমতুল্য ভেবে দশকের পর দশক সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে। সেই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে বছরের পর বছর ধরে সামরিকীকরণ প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে অস্ত্র, বারুদ, ক্যান্টনমেন্ট আর সামরিক খাতে। এক দেশের মধ্যে দুই দেশ হয়েছে। এক দেশের মানুষ পরস্পরকে শত্রু ভেবে যুদ্ধ ও প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে বহু বছর। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ, প্রকৃতি, জনমানুষের জীবন বিবেচনায় সবচেয়ে ক্ষতিকর উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আইয়ুব খানের নাম কী পাকিস্তান কী বাংলাদেশ কোথাও আর সম্মানের সঙ্গে, সাফল্যের সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু আইয়ুব শাহীঘটিত এই দুর্যোগ এখনও মানুষের পিছু ছাড়েনি। কাজেই উন্নয়ন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। যেনতেন প্রকারে, শক্তি প্রয়োগের নীতিতে, জনমানুষের ভাবনার বিপরীতে উন্নয়ন অনেক সময় বড় বিপদই ডেকে আনে। সাম্প্রতিক সুন্দরবনের বিপর্যয় সেই কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ২. সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে দৃশ্যমান যেসব ক্ষতি দেখা যাচ্ছে- এক. সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন খাল, ছোট নদীতে এ তেল ছড়িয়ে পড়েছে। শ্বাসমূলীয় বনের উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হবে। দুই. বনের গাছ, উদ্ভিদ, জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তিন. সুন্দরবনের শ্যালা, পশুর, বলেশ্বর নদীর পানি দূষিত হয়েছে। ফলে মাছ, শুশুক, ডলফিনের জীবন বিপন্ন হয়েছে। চার. সুন্দরবনের নদীর পানি নষ্ট হওয়াতে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট অধিবাসী যারা এই নদীর ওপর প্রাণ ও জীবিকার কারণে নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাবার পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। নদী সংলগ্ন জনগণের ঘরে পালিত হাঁস, মুরগি এই পানিতে বিচরণ করত সেসব প্রাণীর প্রাণ সংহার হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠছে। পাঁচ. সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল উদ্ধার কাজে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়িয়ে পড়ায় বনের নির্জনতা বিপন্ন হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সব বন্যপ্রাণীর জীবন হুমকির মধ্যে পড়ছে। ছয়. অবৈজ্ঞানিক উপায়ে অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে ৩০ টাকা লিটার দরে এই তেল কেনার লোভ দেখিয়ে যেভাবে স্থানীয় জনমানুষকে ব্যবহার করা হচ্ছে, দ্রুতই তারা স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সাত. জোয়ার-ভাটার নদীতে ইতোমধ্যে মাছশূন্যতা দেখা দিয়েছে। ফার্নেস অয়েল যেভাবে বিস্তৃত এলাকাকে ছুঁয়েছে তাতে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের অপ্রাকৃতিক মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ৩. এ তেল কেন পরিবহন করা হচ্ছে? কোথা থেকে এ তেল কোথায় যাচ্ছে? কার স্বার্থে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এ রকম বাণিজ্যিক জলযান চলার অনুমতি দেয়া হয়েছে? কারা এসব জলযানের মালিক? এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা আর্থিকভাবে কতটুকু লাভবান হচ্ছে? সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে কেন এই নতুন জলরুট ব্যবহৃত হচ্ছে? এক. এ তেল পরিবহন করা হচ্ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে। মংলা বন্দর থেকে এ তেল আনা হচ্ছিল। রেন্টাল, কুইক রেন্টালের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাহিদা মেটাতে এ জ্বালানি পরিবহন করছিল প্রায় ৫০ বছর বয়সী ব্যবহার অনুপোযোগী অয়েল ট্যাংকার। দুই. এসব জলযানের মালিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এবং তাদের ঘনিষ্ঠজন। নানা প্রভাব খাটিয়ে, টাকার বিনিময়ে এ জলরুটটি চালু করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে মংলা-বেতবুনিয়া-ঘষিয়াঘাটি নৌরুট বন্ধ। বিকল্প পথ হিসেবে বনের মধ্য দিয়ে নৌরুট চালু করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বনবিভাগ আপত্তি দিলেও তা ধোপে টেকেনি। তিন. এভাবে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের উদ্দেশ্য হচ্ছে আখেরে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও মালামাল সরবরাহের সংক্ষিপ্ত ও সাশ্রয়ী নৌরুট প্রতিষ্ঠিত করা। চার. যেকোনো মূল্যে, পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে নীতি সরকার নিয়েছে তার বাস্তবায়ন করতেই এ জলরুটকে স্থায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ৪. সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও শিক্ষা ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের জলাভূমি বিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও বিশেষ শ্রেণির ডলফিনের জন্য বিখ্যাত এ সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মানুষ, জলযান, যত বেশি চলাচল করবে সুন্দরবনের ভেতরে বাস করা সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য তা বিপজ্জনক হবে, এ চিন্তায় ইউনেস্কো, জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা ও ব্যক্তিÑ প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনকে রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছে বেশ ক’বছর ধরেই। সরকার তাতে গা লাগায়নি। বরং গায়ের জোরেই সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। সরকার এ কাজ করতে আত্মঘাতী দায়মুক্তির আইন বানিয়েছে। মানুষের সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এ দায়মুক্তির আইনের মেয়াদ বছরের পর বছর বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো এ দায়মুক্তির অস্বাভাবিক, কালো আইন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ নামে পরিচিত। এ জনঅহিতকর, অগণতান্ত্রিক, স্বৈরমুখী কালো আইনের ৯, ১০, ১৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে- বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৪ নং আইন) আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ ৯। এই আইনের অধীন কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্য, গৃহীত কোন ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ ১০। এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্যের জন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। এই আইনের অধীন গৃহীত কাজের হেফাজত ১৪। এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই। ৫. যে ভারতকে তুষ্ট করতে সরকার উন্নয়নের কথা বলে সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে সে ভারতের জনগণ সুন্দরবনের নিকটে নিজ দেশে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, ভারতের আদালত সুন্দরবন সুরক্ষায় কতটুকু তৎপর তার নমুনা মেলবে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিচের সংবাদটি পড়লে- কেমন আছে ম্যানগ্রোভ, উপগ্রহ-চিত্র চায় আদালত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ নষ্ট হতে বসেছে, এই আশঙ্কা করে জাতীয় পরিবেশ আদালতের কলকাতা বেঞ্চই সেপ্টেম্বরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের বর্তমান চেহারা কী রকম, নদী বা খাঁড়িতে দূষিত ডিজেল ব্যবহার করা হয় কি না, সেখানে বেআইনি ইটভাটা চলে কি না অথবা সুন্দরবন এলাকায় অবৈধ হোটেল বা রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হয়েছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে রাজ্যের অবস্থান জানতে চেয়েছে পরিবেশ আদালত। ওই আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় এবং পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন নির্দেশ দিয়েছে, সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে উপগ্রহ-মানচিত্র অবশ্যই থাকতে হবে। সুন্দরবনের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তকে আদালত-বান্ধব নিযুক্ত করা হয়েছে। সুভাষবাবু জানান, ম্যানগ্রোভের পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে আগেই রিপোর্ট তলব করা হয়েছিল। কিন্তু বন দফতর এখনও কোনও রিপোর্টই পরিবেশ আদালতে জমা দিতে পারেনি। এ দিন ম্যানগ্রোভ মামলার শুনানি ছিল। পরিবেশ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের আইনজীবী বিকাশকুমার গুপ্তকে নির্দেশ দেন, ২১ জানুয়ারি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সংক্রান্ত উপগ্রহ-চিত্র আদালতে জমা দিতে হবে। -আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ৬. সুন্দরবন ধ্বংস করার মতো রিস্ক নিয়ে সরকার এগুতে চাইল কেন? বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে সরকার সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইল কেন? এক. সুন্দরবনকে খুব পরিকল্পিত উপায়ে টার্গেট করেছে সরকার। কারণ সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে সরকারের মাথায় আছে বড় বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ফুলবাড়ী কয়লাখনি নির্মাণ সরকারের টার্গেট। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে নৌরুট চালু করে এ প্রকল্পগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে চায় সরকার। দুই. রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। শক্তির জোরে সকল স্থানীয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে দমিয়ে সরকার ভারতকে খুশি করতে চায়। ভারতের বিনিয়োগমহল এ প্রকল্পে খুশি। ফলে বাংলাদেশে যেভাবেই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুন না কেন, ভারতের শর্তহীন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সরকারের মনস্তত্ত্ব কাজ করছে, ভারতীয় সমর্থন বজায় থাকলে তাদের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিন্ত এবং বাধাহীন। সুতরাং যেকোনো মূল্যে ভারতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। এমনকি তাতে সুন্দরবন ধ্বংস হলেও কিছু যায় আসে না। তিন. এসব প্রকল্প দৃশ্যমান। কিন্তু পেছনে আছে এশিয়া এনার্জির প্রস্তাবিত ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের উন্মুক্ত খনন। ফুলবাড়ীর কয়লা দ্রুত সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে পরিবহন করার জন্যই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বজায় রাখার প্রক্রিয়া চলছে। মংলা বন্দরকে সচল-সক্রিয় করে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সহজ, সাশ্রয়ী মূল্যে কয়লা ও উন্নয়ন প্রকল্পের সব সামগ্রী পরিবহনের জন্যই সরকার জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, দেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিষেধ, নিবেদন, পরামর্শ উপেক্ষা করেছে। চার. সরকারের যারা বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শ জোগান দেয় তারা বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক। তারা ভাবেন যেকোনো মূল্যে উন্নয়ন হলে, উন্নয়নের জোয়ারে প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস বা বিনষ্টের দুঃখ মানুষ ভুলে যাবে। বড় বড় ফ্লাইওভার, বড় বড় রেল-সড়ক সেতু, বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এমন উন্নয়ন চেহারা আনবে যার তাৎক্ষণিক সুবিধা পেয়ে জনমানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। মানুষ অর্থনীতির সুবিধা পেলে পরিবেশ ধ্বংসে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা বিবেচনায় নেবে না। পাঁচ. সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতে বিস্তৃত। সুন্দরবনের তুলনামূলক বড় অংশটি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ফার্নেস অয়েলের তেলে সুন্দরবনকে ডুবিয়ে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মালামাল পরিবহন চালিয়ে, সুন্দরবনকে ঘিরে নানারকম উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ক্রমশ বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশ বিনষ্ট করলে, ভারতীয় অংশের সুন্দরবনকে বড় করে তোলা যাবে। উন্নয়নের তেলে সুন্দরবনকে ডুবিয়ে সে প্রচেষ্টাই হয়ত চলছে! সৌজন্যে: সাপ্তাহিক
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment