Sunday, November 23, 2014

প্যারীচাঁদ মিত্র স্মরণে :Natun Barta

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস 'আলালের ঘরের দুলাল'-এর লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র। তার ছদ্মনাম 'টেকচাঁদ ঠাকুর'। জন্ম কলকাতায়, ১৮১৪ সালের ২২ জুলাই। পিতার নাম রামনারায়ণ মিত্র। প্রথম জীবনে রামনারায়ণ হুগলি জেলা থেকে কলকাতা এসেছিলেন। তৎকালে ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে সখ্যতা তার ভাগ্য ফিরিয়েছিল। প্যারীচাঁদ মিত্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিমণ্ডলে। তিনি একজন পণ্ডিত ও মুনশির কাছে যথাক্রমে বাংলা ও ফারসি শিখেছিলে
ন। পাশাপাশি তিনি শিখেছিলেন ইংরেজি ভাষাও। তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন ১৮২৭ সালে। সেখানে হেনরি ডিরোজিও নামের একজন অসাধারণ শিক্ষকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এ-কলেজেই তিনি তার শিক্ষাজীবন শেষ করেন। ১৮৩৬ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে। পরে তিনি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে পদোন্নতি পান এবং আরো পরে প্রতিষ্ঠানটির সেক্রেটারি বা সচিব হন। পাবলিক লাইব্রেরির কাজের পাশাপাশি প্যারীচাঁদ বিভিন্ন ব্যবসার সাথেও জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোম্পানি লিমিটেড, পোর্ট ক্যানিং গ্র্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি এবং হাওড়া ডকিং কোম্পানির মতো বিনিয়োগ কোম্পানির অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন। ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। প্যারীচাঁদ ছিলেন সমাজহিতৈষী ও সংস্কৃতিসেবী। বাঙালি সমাজের কল্যাণে তিনি বহু সংগঠন গড়ে তোলেন। জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ডেভিড হেয়ার মেমোরিয়াল সোসাইটি, রেস ক্লাব, এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি, বেথুন সোসাইটির সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, জেল ও কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রের পরিদর্শক, কলকাতা হাইকোর্টের গ্র্যান্ড জুরি, বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এ ছাড়া, তিনি 'পশু-ক্লেশনিবারণীসভারও' সদস্যছিলেন। ১৮৮৩সালের ২৩শে নভেম্বর আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলেও, পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা ও বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী ছিলেন রাধানাথ শিকদার। পৃথিবীর প্রত্যেক সাহিত্যই নিজ নিজ গতি এবং স্বকীয়তা বজায় রেখে আপন গৌরবময় পথে অগ্রসরমান। ভাষা এবং বিষয়বস্তু এ দু’টির উপর নির্ভর করেই মূলত সৃষ্টি হয় সাহিত্য। সুতরাং এ দুটিই সাহিত্যের ধারক ও বাহক। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে গদ্যের চর্চা ছিলনা বললেই চলে। তখন পর্যন্ত মানুষ কথা বলতো কাব্যের ভাষায়। ইতোপূর্বে রামমোহন, বিদ্যাসাগরসহ কয়েকজন খ্যাতিমান লেখক বাংলা গদ্যে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করলেও সেগুলো সংস্কৃত এবং ইংরেজিঘেষা উচ্চমার্গের সাধু ভঙ্গিতে রচিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝা ও আয়ত্ত করা ছিল অসম্ভব। প্যারীচাঁদ মিত্রই প্রথম এর বিরূদ্ধে অবস্থান নিলেন। তিনি লেখ্য ও কথ্যরীতির মিলন ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অবলম্বনে সর্বজনবোধগম্য নবতর গদ্যরীতির সূচনা করলেন। তাই বাংলা গদ্যের অবয়ব নির্মাণ এবং বিবর্তনের ইতিহাসে প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত ১৮০০ সালের পর বাংলা সাহিত্যে শুরু হয় গদ্যের চর্চা। ১৮০০ সাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যকে আধুনিক বলা হয়। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ওই কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান উইলিয়াম কেরী ১৮০১ সালে ‘কথোপকথন’ এবং ১৮০২ সালে ‘ইতিহাসমালা’ রচনা করেন বাংলা গদ্যে। শিক্ষাঙ্গনে পড়াবার উপযোগী বাংলা গদ্য পুস্তকের অভাব বোধ থেকে রচিত এ গ্রন্থের মধ্য দিয়েই সূচিত হয় সাহিত্যাঙ্গনে বাংলা গদ্য চর্চার পথ। এর পর রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং আরও কয়েকজন লেখকের নাম বাংলা সাহিত্যের এ ধারায় উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে তাদের সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা সবাই বাংলা গদ্যের সাধুভঙ্গি ও সংস্কৃত অনুসারী রীতির সাধনা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে ক্রমে ওই রীতি আরও বিকাশ ও স্থিতিশীলতা পেয়ে তা বিদ্যাসাগরীয় রীতি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এই বিদ্যাসাগরীয় রীতির বিরূদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ করেন প্যারীচাঁদ মিত্র। প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর ছিলেন স্বাধীনচেতা ও মুক্ত মনের অধিকারী। সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তি জীবনে সর্বত্রই প্যারীচাঁদ মিত্র অবিসংবাদিত খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। জ্ঞানানুশীলনে তাঁর যেমন ছিল অদম্য স্পৃহা তেমনি ছিল অক্লান্ত পরিশ্রমের ক্ষমতা ও অনুসন্ধিৎসা। এই অধ্যবসায়, শ্রমশীলতা ও চিন্তাশীলতা অবশ্য যুগেরই সাধারণ লক্ষণ। বাংলা সাহিত্যের সেই ক্রান্তিকালের প্রথমাংশের যুগপুরুষ রাজা রামমোহন রায়। শেষাংশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর মধ্যবর্তী কাল ছিল ইয়ংবেঙ্গলদের চাঞ্চল্যে মুখর। প্যারীচাঁদ মিত্রের শিল্পী মানস গঠিত হয়েছে রাজা রামমোহন রায়ের ব্যক্তিত্বের আলোকে ইয়ংবেঙ্গলদের সংগে। আর তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমকালে। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বাংলা গদ্যের যে সাধুরীতির উদ্ভব ঘটেছিল তা কেবল লিখিত রূপেই ব্যবহৃত হতো। এ দেশের কোন অঞ্চলের নিজস্ব কথ্যরীতি তাতে গ্রহণযোগ্য ছিলনা বলে বিশেষ চর্চা ব্যতীত তা আয়ত্ত করাও সম্ভব ছিলনা। প্যারীচাঁদ মিত্রই প্রথম উপলব্ধি করলেন, বিদ্যাসাগরীয় ভাষা বড় বেশী সংস্কৃতঘেষা। ক্লাসিক বর্মেচর্মে আবৃত হওয়ার জন্যে ভাষায় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেনা। তার মতে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগবঞ্চিত, বিশেষত সে কালের অন্তপুরবাসিনী এই ভাষারীতি হৃদয়ঙ্গম করতে পারত না। তাছাড়া বিদ্যাসাগরীয় সাধুরীতির মধ্যে মহৎ ও কোমল ভাব প্রকাশের যথেষ্ট উপযোগিতা এবং শ্র“তি মাধুর্য ও ধ্বণিময়তা থাকলেও তাকে জীবনের লঘুতর বৈশিষ্ট প্রকাশের বাহন হিসেবে গ্রহণ করা ছিল অসম্ভব। বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান নির্ণয় করতে গেলে তাকে অতি উচ্চস্থান না দেয়ার কোন সুযোগ তিনি রাখেননি। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও বাংলা গদ্যের একজন প্রধান সংস্কারক। তাঁর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছিল অন্য ভাষা ও সাহিত্যের কাছে ঋণী। নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্যের চিন্তা না করে জ্ঞানী গুণী লেখকেরা সকলেই এ ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল হয়ে ডুবে ছিলেন সাহিত্য চর্চায়। অন্য ভাষা ও সাহিত্যের উপর নির্ভর করে ভিনদেশী সংস্কৃতির আলোকে সাহিত্য চর্চার এই রীতির বিরূদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে লেখ্য ও কথ্যরীতির সংমিশ্রণে তৎকালীন কলকাতা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অবলম্বনে একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র ভাষা রীতির সূচনা করে প্যারীচাঁদ মিত্র এ দু’টি বিপদ থেকে মুক্ত করেন বাংলা সাহিত্যকে। যে ভাষা ও সাহিত্য বাঙালির বোধগম্য এবং সকল বাঙালি যে ভাষা ব্যবহার করে, তিনিই প্রথম গ্রন্থ প্রণয়নে সে ভাষা ব্যবহার করেন এবং তিনিই প্রথম ইংরেজি ও সংস্কৃতের ভাণ্ডারে পূর্বসূরী লেখকদের উচ্ছিষ্টাবশেষের অনুসন্ধান না করে স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার হতে রচনার উপদান সংগ্রহ করেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ভাষাও যেমন সংস্কৃতের ছায়ামাত্র ছিল, তেমনি বিষয়বস্তুও সংস্কৃতের এবং কদাচিৎ ইংরেজির ছায়ামাত্র ছিল। সে সময় সংস্কৃত বা ইংরেজি গ্রন্থের সারসংকলন বা অনুবাদ ছাড়া বাংলা সাহিত্য আর কিছুই প্রসব করতো না । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিরাট প্রতিভাশালী লেখক ছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তারও ‘শকুন্তলা’ ও ‘সীতার বনবাস’ সংস্কৃত হতে,‘ভ্রান্ত বিলাস’ ইংরেজি থেকে এবং ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ হিন্দি থেকে সংগৃহিত। অক্ষয় কুমার দত্তের একমাত্র অবলম্বন ছিল ইংরেজি। আর সকলে তাদের অনুসারী ছিলেন। সেকালের বাঙালি লেখকেরা গতানুগতির বাইরে হস্থপ্রসারণ করতেন না। জগতের অনন্ত ভাঙ্গার আপনাদের অধিকার অনিবার না করে সকলেই সংস্কৃত ও ইংরেজির ভাণ্ডার চুরির সন্ধানে বেড়াতেন। একটি জাতির সাহিত্যের পক্ষে এর চেয়ে বড় বিপদ আর কি হতে পারে? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয় কুমার দত্ত যা করেছেন তা কেবল সময়ের প্রয়োজন মত। সুতরাং তারা এ ক্ষেত্রে প্রশংসা পাওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সকল বাঙালি লেখক দল বেধে সেই একই পথের পথিক হওয়াটাই ছিল সাহিত্যের জন্যে বিপজ্জনক। এখানেই ব্যতিক্রম প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনি সংস্কৃত এবং ইংরেজ লেখকদের অনুসরণ বা অনুকরণ না করে স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার হতে রচনার উপাদান আহরণ করে সে কালের কলকাতা অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্যের বাহন হিসেবে গ্রহণ করে নিজস্ব চিন্তা চেতনার আলোকে বিষয়বস্তু নির্বাচনের মাধ্যমে রচনা করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’। এতে উভয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো, অর্থাৎ দু’টি বিপদ থেকে বাংলা সাহিত্যকে তিনি উদ্ধার করতে সক্ষম হলেন। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে (গদ্য) সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শিল্পনৈপূণ্য প্রদর্শনপূর্বক তিনিই হয়ে উঠলেন প্রথম সার্থক গদ্যশিল্পী এবং স্বকীয় সত্ত্বায় ভাস্বর। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট কোন গ্রন্থ তৎপরে কেউ প্রণয়ন করে থাকতে পারে, কিংবা ভবিষ্যতেও করতে পারেন। কিন্তু এই গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য যা পেয়েছে আর কোন বাঙালির রচিত গ্রন্থের দ্বারা তেমন কিছু পায়নি, ভবিষ্যতেও এমন আর কিছু পাবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়েই বাংলা গদ্য সাহিত্যে সূচিত হলো নতুন পথ, সাহিত্যাঙ্গনে গুঞ্জণ উঠলো আলালী ভাষার। আলালী ভাষা সম্পর্কে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষপাতহীন একটি মন্তব্য এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ ‘আমি এমন বলিতেছিনা যে আলালের ঘরের দুলালের ভাষা আদর্শ ভাষা। উহাতে গাম্ভীর্যের এবং বিশুদ্ধির অভাব আছে এবং ঊহাতে অতি উন্নত ভাবসকল,সকল সময়ে পরিস্ফুট করা যায় কিনা সন্দেহ । কিন্তু, উহাতেই প্রথম এ বাংলাদেশে প্রচারিত হইল যে, যে বাংলা সর্বজনমধ্যে কথিত এবং প্রচলিত তাহাতে গ্রন্থ রচনা সুন্দরও হয় এবং যে সর্বজন হৃদয় গ্রাহিতা সংস্কৃতানুযায়ী ভাষার পক্ষে দুর্লভ এ ভাষার তাহা সহজ গুণ।’ আলালী ভাষারীতি বাংলা গদ্যের বাহন হিসেবে টিকতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে যে আদর্শ গদ্যরীতির উদ্ভব ঘটেছিল তার পিছনে এ রীতির অবদান অনস্বীকার্য। এখানেই প্যারীচাঁদ মিত্রের সার্থকতা এবং বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্যের যথার্থতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন হিন্দু কলেজের লেখক গোষ্ঠীর প্রধান এবং হিন্দু কলেজের ছাত্র হিসেবে ইয়ংবেঙ্গলের পরামর্শদাতা ডিরোজিওর আদর্শ ও প্রত্যক্ষ প্রভাবে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ। শিক্ষা, সংস্কৃতি,সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থেকে প্যারীচাঁদ মিত্র তৎকালীন কলকাতার সুধীজনের কাছে স্থান করে নিয়েছিলেন একজন মর্যাদাবান ও বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে। সাহিত্য ক্ষেত্রেও প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সাহিত্যরস যোগান দেয়ার উদ্দেশ্যে শিক্ষাচ্ছলে অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের জন্যে রাধানাথ শিকদারের সহযোগিতায় তিনি ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন ক্ষুদ্রাকৃতির ‘মাসিক পত্রিকা’। ওই পত্রিকার শীর্ষে ছাপা থাকতো সম্পাদকীয় মন্তব্য। যাতে লেখা থাকতোঃ ‘এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষত স্ত্রীলোকের জন্য ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরাও পড়িতে চান, পড়িবেন, কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই।’ তা সত্ত্বেও চলতি ভাষা শিক্ষার্থীদের কাছে এই পত্রিকার আবেদন ছিল অনেক বেশি। কারণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কথ্য ভাষার রীতিতে বাক্য রচনা। এছাড়া সাধু ও কথ্য ভাষার মিশ্র ক্রিয়াপদ এবং তদ্ভব ও ফারসি শব্দের প্রচুর ব্যবহার। প্যারীচাঁদ মিত্রের সাহিত্যিক জীবন শুরুর রচনাগুলো এই পত্রিকার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। বাংলা গদ্যে কথ্যরীতির বর্তমান যে গৌরবজনক স্থান, মূলত এই মাসিক পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্যারীচাঁদ মিত্রের হাতেই রচিত হয়েছিল তার ভিত্তি । উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দু মধ্যবিত্ত জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে বিত্ত ও বিদ্যা যখন সমাজ শাসনের অধিকার অর্জন করলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই শুধুমাত্র বিত্তের অধিকারীরা উচ্ছৃঙ্খলতার চক্রাবর্তে নিমজ্জিত হলো। এই উচ্ছৃঙ্খল দলটিই বাংলা সাহিত্যে ইয়ংবেঙ্গল নামে পরিচিত। এই ইয়ংবেঙ্গলের মন্ত্রদাতা ডিরোজিওর আদর্শস্নাত হয়েও প্যারীচাঁদ মিত্র তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার সমালোচনা করতে ছাড়েননি। প্যারীচাঁদ মিত্র সমসাময়িক কালের সমাজের বাস্তব চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার উপন্যাসগুলোতে। উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণে ত্র“টি থাকা সত্ত্বেও সমাজের খণ্ডচিত্রগুলো তাতে তিনি সুনিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন। তার রচিত উপন্যাসের চরিত্রগুলো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহজেই। তার রচিত গ্রন্থগুলো নিয়ে আলোচনা করলে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। সাহিত্যকর্মী হিসেবে প্যারীচাঁদ মিত্রের খ্যাতির উৎস্য হচ্ছে তার অবিস্মরণীয় রচনা ‘আলালের ঘরের দুলাল’(১৮৫৮)। এছাড়াও তিনি ইংরেজি ভাষায় রচনা করেন The Zemindar and Ryots. এই গ্রন্থটি তখনকার সময়ে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। কারণ এটি রচিত হয়েছিলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।প্যারীচাঁদ মিত্র তার সাহিত্যিক জীবনে ১৯টি গ্রন্থ রচনা করেন যার মধ্যে ১১টি বাংলা। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ক’টি হচ্ছে ‘রামারঞ্জিকা’(১৮৬০) স্ত্রীশিক্ষামূলক গ্রন্থ। ‘কৃষিপাঠ’(১৮৬১), ‘যৎকিঞ্চিত’(১৮৬৫), ‘ডেবিড হেয়ারের জীবনচরিত’(১৮৭৮) প্রভৃতি প্রবন্ধ গ্রন্থ। ‘অভেদী’(১৮৭১) ‘আধ্যাত্মিকা’(১৮৮০) ইত্যাদি নীতিবিষয়ক এবং সংলাপ প্রধান গল্পমূলক রচনা। ‘গীতাঙ্কুর’(৩য় সংস্করণ, ১৮৭০) ভ্রমণবিষয়ক গানের বই। ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা’(১৮৭৮)এবং ‘বামাতোষিণী’(১৮৮১) ইত্যাদি। বাংলা গদ্যে উপন্যাসের বিকাশ ধারায় প্যারীচাঁদ মিত্র এক উল্লেখযোগ্য নাম। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের স্ফুটনোম্মুখ যুগে প্যারীচাঁদ মিত্র পুরোপুুরি না হলেও অন্ততঃ অংশত জীবনের সাথে শিল্পের সংযোগ ঘটাতে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ভাষা ব্যবহারে কথ্যরীতির অনুসরণ তাকে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতা এনে দেয়। তার প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’(১৮৫৮) বাংলা গদ্যে সাড়া জাগানো প্রথম গ্রন্থ। আলালের ঘরের দুলাল : গ্রন্থটি সম্পূর্ণ সামাজিক পটভূমিকায় রচিত। নব্য শিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলদের কার্যকলাপ ও পরিণতি গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্যারীচাঁদ মিত্র এই নবলব্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করলেন যে, ধর্ম ও নীতিহীনতাই উচ্ছৃঙ্খলতার মূল কারণ। সুতরাং জীবনযাত্রা প্রণালীর মধ্যেই রয়েছে এ থেকে মুক্তির পথ। এ কথা প্রতিপন্ন করার জন্যেই তিনি আলালের ঘরের দুলালের কাহিনী নির্মাণ করেন। আবাল্য অতি আদরের ধনীর পুত্র মতিলাল কখনও ধর্ম ও নীতির শিক্ষা পায়নি, উপরন্ত অসৎ সঙ্গে সে অবনতির শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মতিলালেরই অনুজ রামলাল আদর্শ চরিত্র। বরদাবাবুর একান্ত স্নেহছায়ায় বড় হয়ে সে তার সকল নির্দেশ মান্য করে সর্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। মতিলালের চৈতন্যেদয় এবং আদর্শ জীবনের প্রতি আকর্ষণে সমাপ্তি। গ্রন্থের এই দুই প্রধান ঘটনাস্রোত বিচিত্র খণ্ড ক্ষুদ্র ঘটনায় পল্লবিত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মূল ঘটনা অপেক্ষা এ বিচিত্র খণ্ড ক্ষুদ্র পল্লবিত ঘটনাই গ্রন্থটির আশ্চর্য সফলতার কারণ। বস্তুতঃ বরদাবাবুর মত মূর্তিমান নীতিপাঠ, বেনী বাবুর মত সজ্জন অথবা আদর্শ যুবক রামলাল এরা কেউই আলালের মত মূল আকর্ষণীয় নয়। এদের মধ্যে সুশিক্ষা থাকতে পারে কিন্তু উপন্যাসের যা প্রধানতম উপকরণ জীবনের স্পর্শ স্বাদ, তা এই চরিত্রগুলোতে কোথাও নেই। আলালের অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দিয়েছে মতিলাল স্বয়ং এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ হলধর গদাধর ইত্যাদি। ধরিবাজ মুৎসুদ্দি বাহোরাম, শিক্ষক বক্রেশ্বর বাবু ও সর্বোপরি একটি অপরূপ সৃষ্টি ঠকচাচা। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘উহার মধ্যে কূটকৌশল ও স্তোকবাক্যে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতার এমন চমৎকার সমন্বয় হইয়াছে যে, পরবর্তী উন্নত শ্রেনীর উপন্যাসেও ঠিক এইরূপ চরিত্র মিলেনা।’ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সম্পর্কেই প্যারীচাঁদ মিত্রের তীক্ষè ও বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল। প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ড চিত্রের চিত্রকর। তাঁর শিল্পীসত্ত্বা কখনো বৃহৎ ঘটনাকে কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ করে জীবনের জটিলতা সৃষ্টি করেনি। যার কারণে তিনি জীবনের গভীর রূপ পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি। বস্তুতঃ বৃহৎ বর্ণনা অপেক্ষা এইসব সামান্য ঘটনা নির্ভরতা প্যারীচাঁদ মিত্রের একটা কৌশলমাত্র। অবশ্য কেবল বাস্তব চিত্রাঙ্কন বা জীবন পর্যবেক্ষণই উচ্চাঙ্গের উপন্যাসের একমাত্র গুণ নয়। বাস্তব উপাদানগুলোকে এরূপভাবে সাজাতে হবে যেন তাদের কার্যকারণ পরম্পরার মধ্যদিয়ে জীবনের জটিলতা ও মহত্ত সম্বন্ধে একটা গভীর ও ব্যাপক ধারণা পাঠকের সামনে ফুটে উঠে। মানব হৃদয়ের গভীর সনাতন ভাবগুলো যেন তাদের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে অতি তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর বাহ্য ঘটনার উপরেও একটা অচিন্তিত পূর্ব গৌরব মুকুট পরিয়ে দিতে পারে। আলালের ঘরের দুলাল এ কৃতিত্বে স্ববিশ্বে উজ্জ্বল নয়। বস্তুত প্যারীচাঁদ মিত্র তার পরবর্তী বঙ্কিমের মত মানবতার অন্তর্গূঢ় রূপের আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। কিন্তু মানুষের বিষয়গত চেতনার খণ্ড চিত্র ‘আলালের ঘরের দুলালে’ আছে। মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়ঃ উপন্যাসিক শিল্প বিচারে প্যারীচাঁদ মিত্রের দ্বিতীয় গ্রন্থ মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায় যদিও প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’(১৮৫৮) এর সমতুল্য হতে পারেনি। তবুও তৎকালীন সমাজ জীবন চিত্রায়নের নিরিখে এটিকেও একেবারে নগণ্য বলা যায় না। উনিশ শতকের নাগরিক জীবনের ভাঙ্গাগড়ার দিনে সমাজ জীবনে যে অবক্ষয় নেমে এসেছিল ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ গ্রন্থে প্যারীচাঁদ মিত্র সেই সমাজকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে সমাজ জীবনে মদেরও অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তার প্রতিক্রিয়া যে বড় সুখের ছিলনা সে পরিচয়ই প্যারীচাঁদ মিত্র তার এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। সমাজ চিত্র, চরিত্র চিত্রন এবং ভাষা ব্যবহারে এ গ্রন্থে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে প্যারীচাঁদ মিত্রের যথার্থ প্রতিভার স্বাক্ষর সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ গ্রন্থে কোন একক কাহিনী পূর্ণাঙ্গ রূপে ফুটে না উঠলেও নাগরিক জীবনের ক্লেদান্ত দিকের একটা জীবন্ত প্রতিচিত্র ফুটে উঠেছে। মদ্যপান এবং মদ্যাসক্তি শিক্ষিত মানসেও কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে লেখক সেই পরিচয়ই দিয়েছেন। অন্যদিকে সমাজপতিদের দুমুখো নীতি সমাজ জীবনকে কেমন করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, সে পরিচয়ও এ গ্রন্থে দেখানো হয়েছে। ভবানীবাবু কলেজে পড়াশুনা করতেন কিন্তু ‘অল্প বয়সে পিতৃহীন হওয়াতে কতগুলো বেলেল্ল ছোঁড়ার সংগে সহবাসে কপচাতে না শিখিতে মদ আরম্ভ করলেন’ এবং ‘বাটিতে এমনি শোর শরাবাত হইতে লাগিল যে, পাড়ার নেড়িকুকুর এবং চৌকিদার ভেগে গেল। সন্ধ্যার পর কার সাধ্য সেদিক দিয়া পথ চলে।’ এখানে এটা পরিস্ফুট যে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও বিত্তশালী জমিদার ভবানীবাবুর আত্মসংযমের অভাবে এবং যথেষ্ট পরিমানে ধর্মবুদ্ধি ও নৈতিকজ্ঞান না থাকায়, অপরিমিত মদ্যপানের দরুণ অকালে পরিবার পরিজনকে নিঃসম্বল অবস্থায় ফেলে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হয়েছে। প্যারীচাঁদ মিত্রের এই বর্ণনাকে অনেকে অতিরঞ্জিত বলে অভিহিত করলেও মুলতঃ সমাজে যা ঘটেছিল প্যারীচাঁদ মিত্র তা-ই গ্রন্থে উপস্থিত করেছেন। প্রকাশ্যে মদমত্ত বাবু শ্রেণীর বর্ণনার পাশাপাশি প্যারীচাঁদ মিত্র সমাজপতিদের গোপনে মদ খাওয়া এবং প্রকাশ্যে সাধুতার ভান করার চিত্রটিও অতি মনোমুগ্ধকরভাবে তুলে ধরেছেন। এই শ্রেনীর প্রতিনিধি গোস্বামী নিজেই স্বীকার করেছেন ‘আমি কোশাকুশি গঙ্গায় টেনে ফেলেছি কিন্তু স্থান বিশেষে বুঝে চলি। খরদহ প্রভৃতি স্থানে গেলে তিলক করি ও কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি, আবার তেমন জায়গায় গিয়া রক্ত চন্দনের ফোটা করি ও দুর্গা দুর্গা জপি। কোন কোন স্থানে নাস্তিকতা প্রকাশ করি। আমি সকলকে তুষ্ট রাখি আমার কুহক কেউ বুঝিতে পারেনা।’ এই গোস্বামীই প্রেমচাঁদের ভাষায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি আর এই বুদ্ধিমানদের হাতে পড়ে তৎকালীন সমাজের কি অবস্থা হয়েছিল গ্রন্থের শেষ দিকে প্যারীচাঁদ মিত্র তার মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন একটা রূপক কথার মাধ্যমে । ‘যে গরুটা পালাই পালাই ডাক ছাড়ছে ইহার নাম জাতি, এ অনেক চোট খাইতেছে আর টিকতে পারেনা। তাহার লেজ ধরে যিনি টানছেন উহার নাম হিন্দুগিরি। জাতি গেলে তার গুমর যাইবে, এজন্য টানাটানি করিতেছেন। আর ঐযে এক কন্যা একবার নামছেন ও উঠছেন উহার নাম ধর্ম। বঙ্গ দেশে এত অধর্ম যে, তিনি আর তিষ্টিয়া থাকিতে পারেন না।’ এই রূপক বর্ণনার মধ্যেই আমরা তৎকালীন বঙ্গ সমাজ বিশেষতঃ কলকাতার হিন্দু সমাজের প্রকৃত রূপ বুঝে নিতে পারি। তৎকালীন সমাজপতিদের গায়ে নামাবলী, আর হাতে থাকতো হরিনামের মালা। কিন্তু অন্তর ছিল নানা প্রকার কুটিলতায় পঙ্কিল, এমনি অবস্থায় সমাজ হয়েছিল অনাচারে ভরপুর। নকশা জাতীয় কোন গ্রন্থে আমরা কোন পূর্ণাঙ্গ জীবন না পেলেও এ গ্রন্থে প্যারীচাঁদ মিত্রের হাতে বেশ কয়েকটি চরিত্র জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। এর মধ্যে ভবানী বাবু, প্রেমচাঁদ, গোস্বামী, হেমচন্দ্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ভবানী বাবু বদ্ধ মাতাল। মদের নেশা করে বিষয় আশয় সমস্ত খোয়ায় এবং শেষ পর্যন্ত কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে সুযোগ্য ডাক্তারের সেবায় সে ভাল হয়ে উঠে। ডাক্তারের সহায়তায় কর্ম যোগাড় করে সুখের পথে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু মদ ছাড়া কিছুই ভাল লাগেনা। সব ফাঁক ফাঁক মনে হয়। এই ভেবে সে আবার মদ ধরে এবং পরিণামে অচিরেই কালের করালগ্রাসে পতিত হয়। জীবনবাদী ভবানীবাবু ভোগের মাধ্যমেই জীবনকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ এই বাক্যের নিদর্শন আমরা দেখতে পাই জয়হরি চরিত্রে। সামান্য লেখাপড়া শেখার ফলেই তার মনে আত্মম্ভরিতা জাগ্রত হয় এবং সে উচ্চ কর্মের আশায় কলিকাতা চলে আসে। এখানে এসে সে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয় কিন্তু তবুও তার মজ্জাগত আত্মঅহংকার বোধ যাবার নয়, তার কথাবার্তায় তা সপ্রকাশিত। বেকার জয়হরির মুখে আত্মঅহংকার বোধক উক্তিই তাকে অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয়। প্রেমচাঁদ ও গোস্বামীর মধ্যে আমরা দেখতে পাই উক্ত সমাজপতির প্রতিচ্ছবি। তারা প্রবৃত্তির মদ মাংসে আসক্ত, কিন্তু সমাজের ভয়ে খাঁটি বৈষ্ণবের ভান করে লোকের শ্রদ্ধা পেতে লালায়িত। তাদের নীতি হচেছ গোপনে গোপনে সকল প্রকার অপকর্মের আসর জমানো, আর প্রকাশ্যে সাধু সেজে হরিনাম কীর্তন করা। জাতি মারার পরামর্শ সভায় ব্যক্ত অভিমতে এদের স্বরূপ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত। প্যারীচাঁদ মিত্রের এ গ্রন্থে দু‘টি প্রতিবাদী চরিত্র বিদ্যমান যারা কোন অন্যায়কে কোন ক্রমেই প্রশ্রয় দিতে স্বীকৃত নয়। এর একজন হেমচন্দ্র অপরজন রামাপ্রসাদ। গোস্বামীদের ভণ্ডনীতির বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে হেমচন্দ্র এবং রামাপ্রসাদ টুটি টিপে ভজহরি এবং রামানন্দের অশ্লীল কর্মের প্রতিশোধ নেয়। অল্পপরিসরে এদু‘টি চরিত্র প্যারীচাঁদ মিত্রের অনন্য সৃষ্টি। চরিত্র সৃষ্টি এবং সমাজ চিত্রনে এ গ্রন্থে প্যারীচাঁদ মিত্রের সীমাবদ্ধতা ধরা পড়লেও ভাষা ব্যবহারের চারুত্বে তার সে ত্র“টি অনেকখানি মলিন হয়ে গেছে। যে বিশিষ্ট ভাষা ব্যবহারের ফলে প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা সাহিত্যে অক্ষয় সম্মান পাওয়ার অধিকারী সেই আলালী ভাষার প্রয়োগ নৈপূণ্য আমরা এই গ্রন্থে দেখতে পাই। এ গ্রন্থে গদ্যের ভিত্তিভূমি সাধুভাষা হলেও দেখা যায় সরল ও সর্বজনবোধ্য শব্দ নির্বাচনের দিকে প্যারীচাঁদ মিত্রের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। এ গ্রন্থের ভাষা অনেক বেশি মার্র্জিত এবং ভদ্র সমাজের উপযোগী। পরিশেষে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভাষা ব্যবহারের দিক দিয়ে এ গ্রন্থ আলালী ভাষা থেকে অনেক উচুঁ স্তরের। এছাড়া প্যারীচাঁদ মিত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনাবলী হচ্ছে তার আধ্যাত্মিক উপন্যাসগুলো। এগুলো তার ব্যক্তি জীবন ও আধ্যাত্মিক চেতনার গভীরে উত্তরোত্তর উৎক্রমনের কাহিনী। এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য পুরোপুুরিই আধ্যাত্মিক। পারিবারিক স্বাস্থ্য রক্ষা, শিশু ও স্ত্রী শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়েও তিনি উপন্যাস লিখেছেন। তবে তৎকালীন জীবনের চিত্র হিসেবে আলালের ঘরের দুলালের ঐতিহাসিক মূল্য থাকলেও এ গ্রন্থে ভাষারীতির যে বৈশিষ্ট্য প্রদর্শিত হয়েছে তার জন্যেই বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের বিশেষ গুরুত্ব বিদ্যমান। আর এই আলালের ঘরের দুলালের ভাষা ‘আলালী ভাষা’ নামে পরিচিত। এই ভাষাকে বিদ্যাসাগরী ভাষারীতির বন্ধন মুক্তির অগ্রদূত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। পরিশেষে বলা যায় প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর বাংলা গদ্যের অবয়ব নির্মাণ এবং বিবর্তনের ইতিহাসে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম। তার রচিত উপন্যাসে জীবনের সামগ্রিক ও গভীর রূপ পরিস্ফুট না হলেও জীবনের খণ্ড চিত্র অঙ্কনে প্যারীচাঁদ মিত্রের পারদর্শিতা ছিল অপরিসীম। তাই তিনি ছিলেন খণ্ড চিত্র অঙ্কনের নিঁখুত ও সার্থক শিল্পী। শেষ করবো তার জীবনের একটি মজার ঘটনা দিয়ে। বাস্তব জীবনে রম্য লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র বেশ রসিক হিসেবে সর্বজন পরিচিত ছিলেন।তার রসবোধের নমুনা এমন,একবার এক এলাকার অন্যতম ধনী দেব নারায়ন দে'র বাড়িতে একটা বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিল। লেখা হচ্ছিল দেনাপাওনা ও খরচাপাতির ফর্দ। সেখানে উপস্তিত ছিলেন রসিক লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র। খরচের ফর্দ দেখে প্যারীচাঁদ মিত্র বললেন-' একি মিস্টান্নের জন্য এতো কম টাকা? ব্রাম্মনকেও তো তেমন দেয়া হচ্ছেনা। এসব খরচ কিছু বাড়িয়ে দিন।' দেবনারায়ন বললেন-' প্যারীচাঁদ বাবু,আপনি শুধু খরচ বাড়াতে বলছেন। টাকাটা কে দেবে শুনি?' প্যারীচাঁদ মিত্রের তড়িৎ জবাব-'কেন, আপনি দেবেন। আপনার নামের আগে দে, নামের পরেও দে। দিতে আপনাকে হবেই। সংগৃহীত

No comments:

Post a Comment