রকারি বাহিনীর যুদ্ধের গুলিগোলায় নিহত মানুষদের শবের জন্য৷ কাঠের বাক্স মানে আত্মঘাতী বোমারুদের লাশের ছিন্ন দেহাংশ৷ ২০০৫ সালের কথা৷ তখন মালিক আবদুল হাকিম আফগান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবক৷ সেই সময় ঝারি জেলাতে গৃহযুদ্ধে মারা যান তালেবান বাহিনীর এক নামজাদা কম্যান্ডার৷ আবদুল হাকিমের ঘরদোরও সেই জেলাতেই৷ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ডাক পড়ে তার৷ তিনি কি মৃতদেহটি সরকারি সেন্টার থেকে বের করে মৃতের আত্মীয়দের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন? আবদুল হাকিম জানান তিনি চেষ্টা করবেন৷ জেলার পুলিশ প্রধান সে দিন তাকে একটি প্রশ্নই করেছিলেন- তিনি কেন সরকারি পক্ষের হয়ে এই কাজ করার কোনো আগ্রহ দেখাননি৷ আবদুল হাকিম জানিয়েছিলেন যে, তিনি নিজেও ভাবেননি যে এই কাজ তাকে কোনো দিন করতে হবে৷ সরকার শেষ পর্যন্ত দেহটি হাকিমের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়৷ তবে একটি শর্তে- তালেবানদেরও সরকারি পক্ষের মৃতদেহ ফিরিয়ে দিতে হবে৷ সে দিন থেকে শুরু৷ ধূসর মৃত্যু উপত্যকায় মানবিক সম্ভ্রমের শেষ বোধটুকু জিইয়ে রাখার জন্য এক নিরন্তর লড়াইয়ের৷ মালিক আবদুল হাকিম গত দশ বছর ধরে গৃহযুদ্ধে নিহত মানুষদের নামগোত্রহীন মৃতদেহগুলিকে পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের প্রিয়জনদের কাছে৷ মৃত মানুষটির পরিচয় যা-ই হোক না কেন৷ তালেবান উগ্রপন্থী, পুলিশ কিংবা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ কোনো শিশু বা বৃদ্ধ৷ মৃতের শেষ প্রাপ্যটুকু নিশ্চিত করতে পারাই তার একমাত্র লক্ষ্য৷ হাকিম বলেন, 'মানুষটি কোন পক্ষের সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ যেকোনো মানুষেরই সসম্মানে ইসলামি ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সমাধিস্থ হওয়ার অধিকার আছে'৷ নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর হিসেব অনুসারে গত এক বছরে ৩১৩টি দেহ বহন করেছেন কান্দাহার শহরের এই অক্লান্ত বুড়ো মানুষটি৷ কখনও মনে হয় না এ অনন্ত বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে? আবদুল হাকিম সেই বিরল মানুষদের মধ্যে এক জন, যিনি চান যে, তার এই চাকরিটি এই মুহূর্তে, এখনই চলে যাক- 'প্রতি বার যখন একটা মৃতদেহ দেখি, ভাবি, ইনশাল্লাহ, এটাই যেন শেষ মৃতদেহ হয়৷ যেন শান্তি ফিরে আসে, যেন আমাকে আর এই কাজ করতে না হয়৷' আর বিপদ? যে শহরের প্রতিটি কোণে আচম্বিত মৃত্যু ওঁত পেতে থাকে, দক্ষিণ আফগানিস্থানের যেখানে কোন মহল্লা কোন পক্ষের আওতায় না জেনে ঢুকে পড়লেই বন্দুকবাজদের নিশ্চিত নিশানায়, কিংবা যেকোনো সময়ে ল্যান্ডমাইনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, সেখানে? আবদুল হাকিম কখনও কাছছাড়া করেন না দুই পক্ষের অনুমতিপত্র৷ তালেবানের দেওয়া অনুমতিপত্রটিতে লেখা আছে, 'আমি এই অঞ্চলের সব মুজাহিদিনদের জানাচ্ছি, আমাদের শহিদদের বহন করার ব্যাপারে পত্রবাহক আমাদের সাহায্য করছেন৷ যদি তার সঙ্গে কোনো সমস্যা হয়, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন'৷ তলায় স্বাক্ষর- জবর আগা, ঝারি জেলায় তালেবানদের প্রতিনিধি৷ যেকোনো খণ্ডযুদ্ধ শেষ হলেই খোঁজ পড়ে আবদুল হাকিমের৷ প্রথম ফোন আসে তালেবানের কাছ থেকে৷ মৃতদেহ খুঁজে দিতে হবে৷ আবদুল হাকিম তার ট্যাক্সিটি নিয়ে পৌঁছান কান্দাহার শহরে মিরওয়াইস হাসপাতালের মর্গে৷ সেখানেই রাখা থাকে নিহত মানুষদের দেহ৷ তালেবান বা পুলিশ বা মার্কিন কোনো সেনা৷ মৃত্যুর পরে সবাই প্রতিবেশী৷ পুলিশ বা সেনা বা অন্য কোনো মানুষের ক্ষেত্রে মৃতদেহ বের করে আনতে পরিবারের সদস্যদের সই লাগে৷ তালেবান সদস্য হলে আবদুল হাকিমের সইই যথেষ্ট৷ ফোন আসে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকেও৷ অনেক মৃত মানুষেরই বাড়িঘর শহর থেকে বহু দূরে৷ মৃত্যুসংবাদ পৌঁছতেই লেগে যায় বহু দিন৷ কেউ আসে না তাদের দেহটিকে সনাক্ত করতে৷ মর্গে দু'মাসের মতো পড়ে থাকে সেই দেহগুলি৷ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চেষ্টা করে তাদের পরিজনদের তত্ত্বতালাশ করে দেহগুলি পৌঁছে দেওয়ার৷ আবদুল হাকিম ফোন লাগান দক্ষিণ আফগানিস্থানের গ্রামেগঞ্জে৷ কার ঘরের ছেলেবুড়ো নিখোঁজ? কোথাও কি সম্প্রতি কোনো আত্মঘাতী হামলা ঘটেছে? খোঁজ পাওয়া গেলে হাকিমের ট্যাক্সি চেপে শেষ বারের মতো ঘরে ফেরে সেই সব নিহত মানুষ৷ আর খোঁজ পাওয়া না গেলে? হাকিমের নিজের ছোট এক ফালি জমি আছে৷ সেখানে নিজেই ব্যবস্থা করে সমাধিস্থ করেন দেহগুলি৷ মৃতদেহকে স্নান করান, সাদা কাফনে ঢাকেন, মোল্লাদের ডেকে আনা হয়, তারা সালাত আল-জানাজা পড়েন৷ আবদুল হাকিমের কবরখানায় সসম্ভ্রম আশ্রয় মেলে নিরাশ্রয় দেহের৷ প্রত্যেকটি দেহের ছবিও তুলে রাখা থাকে৷ পরে যদি কখনও হঠাৎ মানুষটির খোঁজ পড়ে৷ ৩০০ মাইল দূরের পাকতিয়া প্রভিন্স থেকে জনৈক ব্যক্তি তার নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধানে এসে পড়েছিলেন আবদুল হাকিমের কাছে৷ মোবাইলের অস্পষ্ট ছবি দেখে চিনতে পারেন৷ হাকিম তাকে নিয়ে যান তার মৃত ভাইয়ের কবরের কাছে৷ দু'জনে মিলে এক সঙ্গে মৃত মানুষটির শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন৷ কিন্তু কারও বাড়িতে মৃতদেহ পৌঁছে দেওয়ার পরে আবদুল হাকিম শেষযাত্রার জন্য আর অপেক্ষা করেন না৷ দ্রুত ফিরে আসতে চান৷ যদি পুরনো ক্ষত থেকে... আবদুল হাকিমের জামাই ট্রাক চালাতেন৷ পাঁচ বছর আগে তার সঙ্গে কান্দাহারের উত্তরে খাকরেজ জেলায় গিয়েছিল হাকিমের দুই ছেলে৷ কেউই আর ঘরে ফেরেনি৷ এলাকাটি হাকিমের চেনা৷ কিছু দিন আগেই তিনি দুই তালেবান সদস্যের দেহ পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন৷ অগত্যা বিপন্ন হাকিম তালেবান বাহিনীর কম্যান্ডারের শরণাপন্ন হন৷ দিন কাটে৷ সাহায্য মেলে না৷ অতঃপর হাকিম তালেবান বাহিনীর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে পৌঁছান পাকিস্তানের কোয়েটায়৷ তালেবানের তরফ থেকে একটি চিঠি মেলে৷ স্থানীয় আর এক কম্যাণ্ডারকে লেখা৷ আদেশ- সে যেন হাকিমকে তার ছেলেদের কাছে পৌঁছে দেয়৷ খাকরেজ-এ জনমানবশূন্য হাইওয়েতে হাকিম দেখা পান কম্যান্ডারের৷ সেখান থেকে প্রায় এক ঘণ্টা গাড়িতে৷ কম্যান্ডার গাড়িটাকে থামতে বলে৷ হাকিমকে বলে- 'গন্ধ শুঁকে খুঁজে নাও তোমার ছেলেদের'৷ তালেবান কনভয় বেরিয়ে যায়৷ তীব্র দহনবেলায় তৃণহীন প্রান্তরে তখন একলা আবদুল হাকিম৷ এক ঘণ্টা খোঁজার পর একটি অগভীর কবর মেলে৷ হাত দিয়ে মাটি খোঁড়েন হাকিম৷ প্রায় দু'ঘণ্টা৷ তার ছেলেদের লাশ৷ মুখ চেনা যাচ্ছে না৷ হাকিম আর বাড়ি ফেরেন না৷ সোজা পারিবারিক সমাধিস্থলে গিয়ে ছেলেদের সমাধিস্থ করেন৷ তার স্ত্রী এখনও তাকে দোষ দেন যে, তিনি শেষ বারের মতো মৃত সন্তানের মুখ দেখতে দিলেন না৷ আমি-আপনি এই কাহিনির মুখ্য চরিত্র হলে পরবর্তী পরিণতি কী হতো জানি না৷ কিন্তু আবদুল হাকিমের কথা জানি৷ তিনি কাজে ফেরেন৷ স্বেচ্ছায়৷ আবার মৃত তালেবান সদস্যদের দেহ তুলে নেন ট্যাক্সির পিছনে৷ ফিরিয়ে দিতে থাকেন মা-বাবা-সন্তান-আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কাছে৷ 'আমাকেই যদি নিজের ছেলেদের শব ফিরে পেতে এত কষ্ট করতে হয়, ভাবুন সাধারণ মানুষদের কী অবস্থা! তাই আমি নিজেকে বলি, যা করছি আমাকে তা করে যেতেই হবে, নিরুপায় মানুষদের জন্য৷' বলতে বলতে কান্না চাপেন মালিক আবদুল হাকিম৷
Monday, June 22, 2015
গন্ধ শুঁকে খুঁজে নাও তোমার ছেলেদের... :নতুন বার্তা
রকারি বাহিনীর যুদ্ধের গুলিগোলায় নিহত মানুষদের শবের জন্য৷ কাঠের বাক্স মানে আত্মঘাতী বোমারুদের লাশের ছিন্ন দেহাংশ৷ ২০০৫ সালের কথা৷ তখন মালিক আবদুল হাকিম আফগান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবক৷ সেই সময় ঝারি জেলাতে গৃহযুদ্ধে মারা যান তালেবান বাহিনীর এক নামজাদা কম্যান্ডার৷ আবদুল হাকিমের ঘরদোরও সেই জেলাতেই৷ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ডাক পড়ে তার৷ তিনি কি মৃতদেহটি সরকারি সেন্টার থেকে বের করে মৃতের আত্মীয়দের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন? আবদুল হাকিম জানান তিনি চেষ্টা করবেন৷ জেলার পুলিশ প্রধান সে দিন তাকে একটি প্রশ্নই করেছিলেন- তিনি কেন সরকারি পক্ষের হয়ে এই কাজ করার কোনো আগ্রহ দেখাননি৷ আবদুল হাকিম জানিয়েছিলেন যে, তিনি নিজেও ভাবেননি যে এই কাজ তাকে কোনো দিন করতে হবে৷ সরকার শেষ পর্যন্ত দেহটি হাকিমের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়৷ তবে একটি শর্তে- তালেবানদেরও সরকারি পক্ষের মৃতদেহ ফিরিয়ে দিতে হবে৷ সে দিন থেকে শুরু৷ ধূসর মৃত্যু উপত্যকায় মানবিক সম্ভ্রমের শেষ বোধটুকু জিইয়ে রাখার জন্য এক নিরন্তর লড়াইয়ের৷ মালিক আবদুল হাকিম গত দশ বছর ধরে গৃহযুদ্ধে নিহত মানুষদের নামগোত্রহীন মৃতদেহগুলিকে পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের প্রিয়জনদের কাছে৷ মৃত মানুষটির পরিচয় যা-ই হোক না কেন৷ তালেবান উগ্রপন্থী, পুলিশ কিংবা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ কোনো শিশু বা বৃদ্ধ৷ মৃতের শেষ প্রাপ্যটুকু নিশ্চিত করতে পারাই তার একমাত্র লক্ষ্য৷ হাকিম বলেন, 'মানুষটি কোন পক্ষের সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ যেকোনো মানুষেরই সসম্মানে ইসলামি ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সমাধিস্থ হওয়ার অধিকার আছে'৷ নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর হিসেব অনুসারে গত এক বছরে ৩১৩টি দেহ বহন করেছেন কান্দাহার শহরের এই অক্লান্ত বুড়ো মানুষটি৷ কখনও মনে হয় না এ অনন্ত বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে? আবদুল হাকিম সেই বিরল মানুষদের মধ্যে এক জন, যিনি চান যে, তার এই চাকরিটি এই মুহূর্তে, এখনই চলে যাক- 'প্রতি বার যখন একটা মৃতদেহ দেখি, ভাবি, ইনশাল্লাহ, এটাই যেন শেষ মৃতদেহ হয়৷ যেন শান্তি ফিরে আসে, যেন আমাকে আর এই কাজ করতে না হয়৷' আর বিপদ? যে শহরের প্রতিটি কোণে আচম্বিত মৃত্যু ওঁত পেতে থাকে, দক্ষিণ আফগানিস্থানের যেখানে কোন মহল্লা কোন পক্ষের আওতায় না জেনে ঢুকে পড়লেই বন্দুকবাজদের নিশ্চিত নিশানায়, কিংবা যেকোনো সময়ে ল্যান্ডমাইনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, সেখানে? আবদুল হাকিম কখনও কাছছাড়া করেন না দুই পক্ষের অনুমতিপত্র৷ তালেবানের দেওয়া অনুমতিপত্রটিতে লেখা আছে, 'আমি এই অঞ্চলের সব মুজাহিদিনদের জানাচ্ছি, আমাদের শহিদদের বহন করার ব্যাপারে পত্রবাহক আমাদের সাহায্য করছেন৷ যদি তার সঙ্গে কোনো সমস্যা হয়, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন'৷ তলায় স্বাক্ষর- জবর আগা, ঝারি জেলায় তালেবানদের প্রতিনিধি৷ যেকোনো খণ্ডযুদ্ধ শেষ হলেই খোঁজ পড়ে আবদুল হাকিমের৷ প্রথম ফোন আসে তালেবানের কাছ থেকে৷ মৃতদেহ খুঁজে দিতে হবে৷ আবদুল হাকিম তার ট্যাক্সিটি নিয়ে পৌঁছান কান্দাহার শহরে মিরওয়াইস হাসপাতালের মর্গে৷ সেখানেই রাখা থাকে নিহত মানুষদের দেহ৷ তালেবান বা পুলিশ বা মার্কিন কোনো সেনা৷ মৃত্যুর পরে সবাই প্রতিবেশী৷ পুলিশ বা সেনা বা অন্য কোনো মানুষের ক্ষেত্রে মৃতদেহ বের করে আনতে পরিবারের সদস্যদের সই লাগে৷ তালেবান সদস্য হলে আবদুল হাকিমের সইই যথেষ্ট৷ ফোন আসে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকেও৷ অনেক মৃত মানুষেরই বাড়িঘর শহর থেকে বহু দূরে৷ মৃত্যুসংবাদ পৌঁছতেই লেগে যায় বহু দিন৷ কেউ আসে না তাদের দেহটিকে সনাক্ত করতে৷ মর্গে দু'মাসের মতো পড়ে থাকে সেই দেহগুলি৷ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চেষ্টা করে তাদের পরিজনদের তত্ত্বতালাশ করে দেহগুলি পৌঁছে দেওয়ার৷ আবদুল হাকিম ফোন লাগান দক্ষিণ আফগানিস্থানের গ্রামেগঞ্জে৷ কার ঘরের ছেলেবুড়ো নিখোঁজ? কোথাও কি সম্প্রতি কোনো আত্মঘাতী হামলা ঘটেছে? খোঁজ পাওয়া গেলে হাকিমের ট্যাক্সি চেপে শেষ বারের মতো ঘরে ফেরে সেই সব নিহত মানুষ৷ আর খোঁজ পাওয়া না গেলে? হাকিমের নিজের ছোট এক ফালি জমি আছে৷ সেখানে নিজেই ব্যবস্থা করে সমাধিস্থ করেন দেহগুলি৷ মৃতদেহকে স্নান করান, সাদা কাফনে ঢাকেন, মোল্লাদের ডেকে আনা হয়, তারা সালাত আল-জানাজা পড়েন৷ আবদুল হাকিমের কবরখানায় সসম্ভ্রম আশ্রয় মেলে নিরাশ্রয় দেহের৷ প্রত্যেকটি দেহের ছবিও তুলে রাখা থাকে৷ পরে যদি কখনও হঠাৎ মানুষটির খোঁজ পড়ে৷ ৩০০ মাইল দূরের পাকতিয়া প্রভিন্স থেকে জনৈক ব্যক্তি তার নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধানে এসে পড়েছিলেন আবদুল হাকিমের কাছে৷ মোবাইলের অস্পষ্ট ছবি দেখে চিনতে পারেন৷ হাকিম তাকে নিয়ে যান তার মৃত ভাইয়ের কবরের কাছে৷ দু'জনে মিলে এক সঙ্গে মৃত মানুষটির শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন৷ কিন্তু কারও বাড়িতে মৃতদেহ পৌঁছে দেওয়ার পরে আবদুল হাকিম শেষযাত্রার জন্য আর অপেক্ষা করেন না৷ দ্রুত ফিরে আসতে চান৷ যদি পুরনো ক্ষত থেকে... আবদুল হাকিমের জামাই ট্রাক চালাতেন৷ পাঁচ বছর আগে তার সঙ্গে কান্দাহারের উত্তরে খাকরেজ জেলায় গিয়েছিল হাকিমের দুই ছেলে৷ কেউই আর ঘরে ফেরেনি৷ এলাকাটি হাকিমের চেনা৷ কিছু দিন আগেই তিনি দুই তালেবান সদস্যের দেহ পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন৷ অগত্যা বিপন্ন হাকিম তালেবান বাহিনীর কম্যান্ডারের শরণাপন্ন হন৷ দিন কাটে৷ সাহায্য মেলে না৷ অতঃপর হাকিম তালেবান বাহিনীর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে পৌঁছান পাকিস্তানের কোয়েটায়৷ তালেবানের তরফ থেকে একটি চিঠি মেলে৷ স্থানীয় আর এক কম্যাণ্ডারকে লেখা৷ আদেশ- সে যেন হাকিমকে তার ছেলেদের কাছে পৌঁছে দেয়৷ খাকরেজ-এ জনমানবশূন্য হাইওয়েতে হাকিম দেখা পান কম্যান্ডারের৷ সেখান থেকে প্রায় এক ঘণ্টা গাড়িতে৷ কম্যান্ডার গাড়িটাকে থামতে বলে৷ হাকিমকে বলে- 'গন্ধ শুঁকে খুঁজে নাও তোমার ছেলেদের'৷ তালেবান কনভয় বেরিয়ে যায়৷ তীব্র দহনবেলায় তৃণহীন প্রান্তরে তখন একলা আবদুল হাকিম৷ এক ঘণ্টা খোঁজার পর একটি অগভীর কবর মেলে৷ হাত দিয়ে মাটি খোঁড়েন হাকিম৷ প্রায় দু'ঘণ্টা৷ তার ছেলেদের লাশ৷ মুখ চেনা যাচ্ছে না৷ হাকিম আর বাড়ি ফেরেন না৷ সোজা পারিবারিক সমাধিস্থলে গিয়ে ছেলেদের সমাধিস্থ করেন৷ তার স্ত্রী এখনও তাকে দোষ দেন যে, তিনি শেষ বারের মতো মৃত সন্তানের মুখ দেখতে দিলেন না৷ আমি-আপনি এই কাহিনির মুখ্য চরিত্র হলে পরবর্তী পরিণতি কী হতো জানি না৷ কিন্তু আবদুল হাকিমের কথা জানি৷ তিনি কাজে ফেরেন৷ স্বেচ্ছায়৷ আবার মৃত তালেবান সদস্যদের দেহ তুলে নেন ট্যাক্সির পিছনে৷ ফিরিয়ে দিতে থাকেন মা-বাবা-সন্তান-আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কাছে৷ 'আমাকেই যদি নিজের ছেলেদের শব ফিরে পেতে এত কষ্ট করতে হয়, ভাবুন সাধারণ মানুষদের কী অবস্থা! তাই আমি নিজেকে বলি, যা করছি আমাকে তা করে যেতেই হবে, নিরুপায় মানুষদের জন্য৷' বলতে বলতে কান্না চাপেন মালিক আবদুল হাকিম৷
Labels:
নতুন বার্তা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment