মানবপাচার প্রতিরোধে সরকার ব্যর্থ: সুজন নিজস্ব প্রতিবেদক আরটিএনএন ঢাকা: চলতি বছরের তিন মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে কমপক্ষে ২৫,০০০ মানুষ দেশ ত্যাগ করেছে। বিগত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু সরকার এই মানবপাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘মানবপাচার বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ তথ্য দেন। তারা বলেন,
দেশত্যাগী মানুষের মধ্যে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মিয়ানমারের নাগরিক। বাকিরা সবাই বাংলাদেশি। যারা পাচার হচ্ছে, তাদের অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। কেউ কেউ মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। সমুদ্র পথে অবৈধভাবে মানবপাচার বন্ধ করতে না পারলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো খারাপ হতে পারে। বৈধ অভিবাসন হুমকির মধ্যে পড়বে। মানবপাচার বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি সুজনের বৈঠক থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি স্টিনা লুংডেল, সুজনের নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, ড. হামিদা হোসেন, সৈয়দ আবুল মকুসদ, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, সুমাইয়া ইসলাম প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে একটি নগ্ন ধরনের নব্য দাসপ্রথার আবির্ভাব ঘটছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং মালয়েশিয়ার একদল মানুষ এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। মানবপাচার, জিম্মিকরণ, জবরদস্তিমূলক কারারুদ্ধকরণ, এমনকি হত্যা তাদের অপকর্মের অংশ।’ মানবপাচারের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ ক্রমাগতভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা হ্রাস। মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি বড় উৎস হলো মানসম্মত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ। এছাড়া বিনিয়োগের স্থবিরতার কারণে গ্রামে অন্য কোনো বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। তাই জীবন-জীবিকার সন্ধানে মানুষ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।’ বদিউল আলম বলেন, সরকারিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ নানা ধরনের কার্যক্রম প্রান্ত্রিক পর্যায়ের মানুষের কাছে যথাযথভাবে না পৌঁছানোও মানবপাচারের অন্যতম একটি কারণ। সমাজে ন্যায়পরায়নতার অভাব থাকলে এবং বৈষম্য বিরাজ করলে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে ধনীরা আরো ধনী হয়। দরিদ্রদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত এমন অবস্থায় বিরাজ করছে আমাদের দেশে, যে কারণে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন-জীবিকার সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এছাড়া পাচারকারী/দালালদের খপ্পরে পড়ে এবং সচেতনতার অভাবে অনেকে মানবপাচারের শিকার হন।’ মানবপাচার বন্ধে করণীয় সম্পর্কে সুজন সম্পাদক বলেন, ‘মানবপাচার একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। পাচারকারীদের এই আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তবে পাচারকারীদের শাস্তি দিলেই হবে না, পাচারের কারণ অনুসন্ধান করে এর প্রতিকারের ব্যবস্থাও নিতে হবে।’ তিনি বলেন, একই সঙ্গে জরুরি রাষ্ট্রীয় সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। মানবপাচার বন্ধ করতে হলে সরকারের নীতি-কাঠামোতে কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। একটি নতুন সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা সামাজিক চুক্তি করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের একটি অংশ সরাসরি দরিদ্রদের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও জরুরি বলে মত দেন বদিউল আলম মজুমদার। এম হাফিজ উদ্দীন খান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার হয়ে আসছে। কিন্তু সরকার আমাদের নাগরিকদের পাচার হওয়া বন্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেনি। তাই মানবপাচার বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।’ স্টিনা লুংডেল বলেন, ‘দু-তিন হাজার ডলার ব্যয় করে এদেশের মানুষ সমুদ্র পথে বিদেশ যাচ্ছে। কিন্তু যারা আদৌ দেশের বাইরে যেতে চায় না, তাদেরও সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। কারণ তাদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ইউএনএইচসিআর’র তথ্য মতে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ২৫,০০০ ব্যক্তি অবৈধভাবে দেশত্যাগ করে। এই সংখ্যা ২০১৩ এবং ২০১৪ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই ২৫,০০০ উদ্বাস্তুর প্রায় ৪০-৬০ শতাংশ মিয়ানমারের, আর বাকি প্রায় সকল যাত্রীই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে গিয়েছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘যারা পাচার হচ্ছে তাদের অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। কেউ কেউ মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। এই সমগ্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার আইন প্রণয়নকারী সংস্থা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা।’ স্টিনা লুংডেল বলেন, ‘এদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এতবড় অপকর্ম সম্ভব নয়। এ অপকর্ম তথা মানবপাচার বা অবৈধ অভিবাসন রোধে আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে।’ গোল টেবিল বৈঠকে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘মানবপাচার শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয় নয়। এর সঙ্গে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড যুক্ত। তাই এটি বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে, বিশেষ করে জাতিসংঘের উদ্যোগে ভূমিকা নিতে হবে।’ তিনি বলেন, এছাড়া আমাদের নাগরিকরা কী কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পথে গমন করছে এবং এটি বন্ধে কী করণীয় তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া দরকার।’ আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এবং বৈধভাবে অভিবাসন কমে যাওয়ায় মানবপাচার বাড়ছে। সরকারি উদ্যোগে বিদেশ নেয়ার কার্যক্রম ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, সরকার এটি নিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। সঠিক তদারকির মাধ্যমে বেসরকারি রিক্রটিং এজেন্সিগুলোকে অভিবাসী প্রেরণের কাজ করতে দেয়া উচিত।’ ড. সি আর আবরার বলেন, ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্যের পরিমাণ কমলেও এখনো বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এ বৈষম্যের কারণে মানবপাচার বাড়ছে।’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বসবাস করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।’ ড. হামিদা হোসেন বলেন, ‘অতিরিক্ত লোভের কারণে, দালালদের খপ্পরে পড়ে এবং ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মানবপাচারের শিকার হচ্ছে। তাই এটি বন্ধে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে, বিশেষ করে সংসদে আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার, যাতে সম্পূর্ণভাবে এটি বন্ধ করা যায়।’ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মানবপাচার বন্ধে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের যৌথ উদ্যোগ ও সহযোগিতা দরকার। প্রয়োজনে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে।’ এছাড়া পাচারকারী এবং যেসব সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান তিনি। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বন্যা বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের জনগণ সাগর পাড়ি দিচ্ছে। কারণ রাষ্ট্র তাদের মৌলিক অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি বলেন, সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারা পাচারের সঙ্গে জড়িত তা খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। মন্তব্য
No comments:
Post a Comment