নারী দিবস: সফলতা, না ব্যর্থতা? শামীম হোসাইন টাইম নিউজ বিডি, ০৮ মার্চ, ২০১৫ ০৯:২৭:২৫ আজ ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৮৫৭ সালের এদিন নারীরা ন্যায্য অধিকারের জন্য আন্দোলন করে। এতে নির্যাতনেরও শিকার হয় তারা। সেই দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর বিশ্ব জুড়ে পালন করা হয় নারী দিবস। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুঁচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে আটঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেফতার হন বহু নারী। কারাগারে নির্যাতিত হন অনেকেই। তিন বছর পরে ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’। ১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমাকের্র কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পর থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। এর দু'বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নারী সমাজ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করবে। কিন্তু তারা কি পেয়েছে তাদের মৌলিক অধিকার? তারা কি পেয়েছে একটি শোষণ মুক্ত সমাজ যেখানে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। ৮ মার্চ সারা বিশ্বে যখন নারী দিবস পালন করা হচ্ছে, অন্যদিকে হয়তো কোন নারী সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে পদক্ষেপে নিলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আবার যারা বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে তা প্রকল্প ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে সবাই মিলে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া নারীর অধিকার আদায়ে একজন নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপশি পরিবারেরও বেশ কিছু ভূমিকা রয়েছে। নারীর নিজেরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। নারীর নিজেরও কিছু দায়িত্ব থাকবে। স্বেচ্ছাচারী হয়ে পুরুষের প্রতি বিরূপ আচরণ করবে তা নয়। সর্বোপরি কথা হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়কে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সহনশীল হতে হবে। তবে আশার বানী হলো আজ নারীদের যে চিরাচরিত প্রথা 'বুক ফাটেতো মুখ ফোটে না’ সেই আদিকালের এই প্রবাদ বাক্যটি বর্তমান যুগে একেবারেই বেমানান। এখন নারীদের ‘মুখ ফোটে কারো বুক ফাটে না’। নারী দিবসের একশত তিন বছরে চারিপাশে নারীদের অবস্থারও একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে অনেক নারী তার বিয়ে বিষয়ে মতামত প্রদান করতে পারতেন না। সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করতে পারতেন না। অনেকেই পরিবার থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করলেও তাদের সে আয় স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী খরচ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন সে অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি বেশি হলেও এখনও পুরুষের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুফল কতটা পেয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু একটা বিষয় বিতর্ক নেই যে বাংলাদেশে নারীরা অনেক এগিয়েছে। এখন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, সচিব, বিচারপতি, ডিসি, এসপি এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কর্মরত আছে। লাখ লাখ নারী শ্রমিক গার্মেন্ট খাতসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। কিন্তু তারপরও এ দেশে এখনো নারীর মাথামুড়ে প্রকাশ্যে প্রহার করা হচ্ছে, এখনো যৌতুকের বলি হচ্ছেন অসংখ্য নারী, নানাভাবে নারী অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিশ্ব নারী দিবসের প্রাক্কালে এটাই প্রত্যাশা। এখনো যেসব নারী সমাজের নিচুস্তরে অবস্থান করছে, তাদের ওপরে তুলে আনার উদ্যোগ নেয়া হোক। তবে ধর্মের আগুনে পুড়ে না নারী কারন নারীরা ফুল। নারীরা স্বপ্ন। নারী আলোকিত মানুষের ঠিকানা। মা ছাড়া সংসার অচল। মেয়ে ছাড়া ঘর মরুভূমি। আমার মা জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মা আমার আবেগ ভালোবাসা ও মাথা গুজার ঠাঁই। বোন সে তো ফুলের সুবাস। রাঙা পাপড়ি। জীবনসঙ্গিনী বউ সে তো বন্ধুত্ব-প্রেমের ভরা গাঙের ঢেউ। নারীর প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালোবাসার এই আকুতি ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন বলছে, তোমাদের আছে জীবন সঙ্গিনী, পরস্পর সুখ শান্তি ও আরামের জন্য। তিনিই তোমাদের অন্তরে সৃষ্টি করেন প্রেম ভালোবাসা অপার মায়া। সুরা রুম : ২১ কোরআন আরও বলছে তোমারা একে অপরের অংশ। আল ইমরান : ১৯৫ নবীজি সা. বারবার বলেছেন, সন্তান হৃদয়ের ফুল। সন্তানের সুবাস জান্নাতের সুবাস। কাজেই নারীর প্রতি অবহেলা নয়। নারীর প্রতি সম্মান মর্যাদা আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য। নারী সমাজের পরিপূরক ও সহযোগী। সুখি সমৃদ্ধ আলোকিত সমাজ নিমার্ণ করতে হলে অবশ্যই সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার সুপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইনসাফ ভিত্তিক নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, প্রাপ্তি নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নত অগ্রসর ও সমৃদ্ধ হতে পারবে না। সমাজ থেকে বৈরি আচরণ ও প্রান্তিক মনোভাবের শেকড় থেকে কেটে দিতে হবে। নারী-পুরুষ পরস্পর মুখোমুখি বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। উভয়কে হাটতে হবে হাতে হাত রেখে। বন্ধুত্বের সেতু রচনা করে। তবে নারীকে যারা পুরুষের মুখোমুখি বসাতে চায় কিংবা ধর্মের বাধন ছেড়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে শেখায় তাদের দাবি হলো, নারীর প্রধান শত্রু-ধর্ম ও পুরুষ। এই দাবি বাজার মিডিয়ায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদেরও। কারণ নারীকে ধর্মের আঙিনা আর স্বামীর সংসার ছাড়া করতে পারলে পুজিবাদি দুনিয়া নারীদের অন্ধকারের কাচামাল হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। ইসলাম ধর্মের মুখোমুখি বসিয়ে নারী স্বাধীনতার শ্লোগান দেওয়ানো যাবে। মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি দেখিয়ে নারীবাদের চিৎকার করা যাবে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যে ধর্মের আদেশ-উপদেশ এবং বিধিবিধান নারীর মর্যাদা অধিকার ও সম্মান রক্ষা করেছে। সনাতন হিন্দুধর্মে নারীর পৈতৃক সম্পত্তি পাওয়ার ধারনা ছিল না। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকেও চিতায় আগুনে পুড়ে মরার প্রথা চালু ছিল। বৃটিশ ঐতিহাসিক জেমস টেলর ‘কোম্পানী আমলে ঢাকা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৮ সালের মধ্যে ঢাকা জেলায় একশত পঁচানব্বই জন বিধবা স্বেচ্ছায় তাদের স্বামীর সঙ্গে চিতায় আরোহন করেন। পৃথিবীতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের উদাহারণ ভারত। ভারতের আইন রচয়িতা মনু নারী সম্পর্কে মনু স্মৃতির অধ্যায়ে বলেছেন, শৈশবে নারী তার পিতার অধিনে থাকবে। যৌবনে স্বামীর অধিনে, এবং বিধবা হওয়ার পর থাকবে পুত্রের অধিনে। কোনো সময় সে স্বাধীন থাকবে না। (মনু স্মৃতি ৫, ১৪৫) প্রচীন হিন্দু আইনে বলা হয়েছে, রোগ মহামারী মৃত্যু নরক অগ্নি বিষ ইত্যাদি নারী অপেক্ষা উত্তম। ইহুদি ধর্মে তো ছেলে না থাকলে মেয়েরা বাবার সম্পত্তির অধিকারী হবে। তার মানে যার ভাই আছে সে বাবার সম্পদ পাবে না। অহিংস ধর্ম খ্যাত বৌদ্ধ ধর্মেও অবহেলিত নারী। গৌতমবুদ্ধ বিয়ে প্রথা বিরোধী। সংসার ত্যাগ ও সন্ন্যাস তার ধর্ম। বিভিন্ন মত ও ধর্মে নারীর অবহেলার হাজারও উপমা-উদারণ আছে। ইসলাম নারীকে মর্যার সিংহাসনে বসিয়েছে। নিশ্চিত করেছে নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থিক অধিকার। কোরআন বলছে, সম্পত্তিতে যেমন পুরুষের অংশ আছে, তেমনি আছে নারীর অধিকার। নিসা : ৭ সুস্থ্য ও নিরাপদ জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কোরআন বলছে, তোমরা তাদের সঙ্গে উত্তম জীবন যাপন করো। সুরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা তাদের প্রতি উদারতা করতে ভুলে যেও না। অধিকার ও প্রাপ্তির সমান নিদের্শে কোরআন বলছে, পুরুষ যেমন কাজ করবে; তেমন ফল পাবে। নারী যেমন কাজ করবে তেমনি ফল পাবে । সুরা নিসা : ৩২ আজকের নারী দিবসের অঙ্গিকার হোক ইনসাফ ভিত্তিক নারীর মর্যাদা অধিকার ও ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠা করার। সমাজের কোথাও অবহেলিত না হোক নারী। বিমানবালা থেকে ঘরের নারীও ফিরে পাক তার নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা। এসএইচ/জেডআই
No comments:
Post a Comment