Tuesday, December 23, 2014

নিজের জীবন, প্রাণের জীবন:Time News

নিজের জীবন, প্রাণের জীবন মাকসুদুল আলম টাইম নিউজ বিডি, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০৬:৫৭:১৬ পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্যের উন্মোচক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার এই লেখায় মাকসুদুল আলম তাঁর শিক্ষা ও গবেষণার পটভূমি তুলে ধরেছেন, বলেছেন বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথাও। প্রাণময় এই জগৎ নিয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল মূলত ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে। বাব
া সেখানে একখণ্ড জমি কিনেছিলেন। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বাবার কেনা ওই জমিতে একটি ঘর তৈরি করার পর প্রায়ই সেখানে যেতাম। ঘরের আশপাশ ও মাঠ থেকে নানা জাতের গাছ ও লতাগুল্ম এনে জড়ো করতাম। একটার সঙ্গে আরেকটার মিল-অমিল খুঁজে দেখতাম। বৃক্ষের অপার সৌন্দর্য আর রহস্য আমাকে মুগ্ধ করত। প্রাণের জীবনরহস্য (জেনোম সিকোয়েন্সি) উন্মোচনের প্রতি আমার আগ্রহের সূচনা ঘটে ঢ্যাঁড়স থেকে। একবার ব্যাপক বন্যা হলো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বাবা জমিতে ঢ্যাঁড়সের বীজ লাগালেন। কয়েক মাস পরে দেখি, সেখানে বিশাল আকৃতির ঢ্যাঁড়স হয়েছে। এত বড় ঢ্যাঁড়স আগে কখনো দেখিনি। অবাক হয়ে ভাবলাম, বন্যার আগেও তো বাবা ঢ্যাঁড়সের চারা রোপণ করেছিলেন। তখন তো এত বড় ঢ্যাঁড়স জন্মায়নি! এবার এত বড় ঢ্যাঁড়স কীভাবে হলো? প্রাণের এই গভীর রহস্যময় আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তুলল। মনে হলো, নিশ্চয়ই মাটি, পানি, বীজ সব মিলিয়ে এখানে এমন কোনো একটা ব্যাপার ঘটেছে, যা ফসলের চেহারা ও আকৃতিতে প্রভাব ফেলেছে। কী করলে সারা বছর ওসব জায়গায় একই রকম ফসল পাওয়া সম্ভব, সে ব্যাপারে কৌতূহল জেগে উঠল। আমি তা অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম। আমার বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেই সময়কার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের কর্মকর্তা। মা লিরিয়ান আহমেদ শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজ করতেন। আমার জন্ম বৃহত্তর ফরিদপুরে, ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বাবা শহীদ হয়ে গেলেন। চার ছেলে আর চার মেয়ের বড় পরিবারের ভারটি এসে পড়ল মায়ের কাঁধে। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের সবার পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। উচ্চমাধ্যমিকের পর একটি বৃত্তি নিয়ে আমি চলে যাই সোভিয়েত ইউনিয়নে। মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করি। এরপর আবারও পিএইচডি। এবার জার্মানির বিখ্যাত ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট থেকে, প্রাণরসায়নে। মস্কোয় থাকার সময় আমি সুযোগ পেয়েছিলাম তখনকার প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ভ্লাদিমির পেত্রোভিচ মুলাচেভের সংস্পর্শে আসার। প্রাণরসায়নের বিভিন্ন শাখায় পেত্রোভিচের অবদান অসামান্য। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি, কীভাবে প্রকৃতির অজানা রহস্য সম্পর্কে ভাবতে হয়, এ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হয়। জার্মানিতে কাজ করার সুযোগ পাই প্রাণরসায়নের অপর দুই দিকপাল ডিয়েটার ওয়েস্টারহেল্ট ও জেরাল্ড হেজেলবাউয়ের সঙ্গে। ডিয়েটার আমাকে শেখান, কীভাবে অজানা বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। হেজেলবাউ ও লিন্ডা রন্ডালের কাছে আমি ঋণী, প্রকৃতির অভূতপূর্ব বিষয়গুলো চমৎকারভাবে প্রকাশের পদ্ধতি শেখার জন্য। জার্মানির পর আমি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বাইপ্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারে যোগ দিই সহযোগী পরিচালক হিসেবে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গবেষণার জন্য আমাদের গবেষণা দলকে এক মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। এখানে কাজ করার সময় ২০০০ সালে আমি ও আমার আরেক সহকর্মী রেন্ডি লারসেন প্রাচীন জীবাণুতে মায়োগে­বিন-জাতীয় এক নতুন ধরনের প্রোটিন আবিষ্কার করি। মাংসপেশিতে বিদ্যমান মায়োগে­বিন ও রক্তের হিমোগ্লোবিন জীবদেহে অক্সিজেন পরিবহন করতে ও মজুত রাখতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিবর্তনের ধারায় মায়োগে­বিন ও হিমোগ্লোবিনের সৃষ্টি কীভাবে সম্ভব হয়েছে, আমাদের আবিষ্কৃত নতুন প্রোটিন তার রহস্য ভেদ করে। এই আবিষ্কারের পর আমি পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। সে উদ্দেশ্যে কয়েকবার বাংলাদেশেও আসি। এ কাজ আমি বিনা পারিশ্রমিকেই করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমার দরকার ছিল শুধু লোকবল ও গবেষণার ন্যূনতম আর্থিক সহায়তা। এ প্রস্তাবে সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি। এর মধ্যেই মালয়েশিয়া সরকার তাদের প্রধান ফসল রাবারের জীবন-নকশা উন্মোচনের দায়িত্ব দেয় আমাকে। ভারত, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া এ নিয়ে তাদের গবেষণা শুরু করে দিয়েছিল। রাবারের জীবন-নকশা উন্মোচন করার জন্য আমাদের তাই সময়ের সঙ্গে দৌড়াতে হয়। পাঁচ মাসের মাথায় রাবার জিনের ২০০ কোটি ভিত্তি-যুগলের নকশা আমরা উন্মোচিত করি। এরপর পাট নিয়ে আমার আফসোস আরও বেড়ে যায়। পাট তো নিছক একটি উদ্ভিদ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ২০০৮ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আহমেদ শামসুল ইসলাম, প্রাণরসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা ডেটাসফটের মাহবুব জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁরা খুবই উৎসাহ নিয়ে সাড়া দেন। এ কাজ কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে আমরা সবাই মিলে পরিকল্পনা করি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই ও ইউনিভার্সিটি সেইনস মালয়েশিয়ার সঙ্গেও কথা হয়। তারা বলল, কাজটা সম্ভব, তবে অর্থের প্রয়োজন হবে প্রচুর। প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাও লাগবে। প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিতে লাগলাম। শুরুতে অনেকে আশ্বাস দিলেও বাস্তব কাজ শুরু হওয়ার পর কাউকে পাওয়া গেল না। ২০০৮ সালের জুনে আমরা নিজেরাই তহবিল সংগ্রহের কাজে নেমে পড়লাম। পুরো কাজটি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং ডেটাসফটের কর্মীদের নিয়ে ‘স্বপ্নযাত্রা’ নামে একটি উদ্যোগ নিলাম। প্রবাসী জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসিনা খান ও জেবা সিরাজ, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী মোহাম্মদ আজাদসহ আমরা ৭০ জনের একটি দল গঠন করি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ ও ডেটাসফট। কাজ শুরু করার পর অনেকের দুয়ারে ধরনা দিয়েও তহবিল সংগ্রহ করা যাচ্ছিল না। কেউই এগিয়ে আসছিলেন না। আমরা তখন নিজেদের অর্থায়নেই কাজ শুরু করলাম। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে অবস্থিত আমার সাবেক কর্মস্থল জেনোম রিসার্চ সেন্টার ও মালয়েশিয়ার ইউএসএম প্রাথমিকভাবে কিছু কারিগরি সহায়তা দিল। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আমরা পাটের জিনবিষয়ক গবেষণাতথ্য জোগাড় করতে শুরু করলাম। বিপুল পরিমাণে তথ্য হাতে চলে আসার পর সেসব সুবিন্যস্ত ও ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন দেখা দিল। সুপার কম্পিউটার ছাড়া তা করা সম্ভবপর ছিল না। এর জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল আরও প্রচুর অর্থ। অর্থ প্রয়োজন ছিল মাঠপর্যায়ের গবেষণার জন্যও। কারও কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা না পেয়ে আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। নিজেদের অর্থ দিয়েই প্রাথমিক কাজটা শুরু করলাম। ভাবলাম, কাজটা শুরু করেছি, আর বন্ধ করা যাবে না। আরও বেশ কয়েকটি দেশ পাট নিয়ে গবেষণা করছিল। আমরা কাজ বন্ধ করলেও তারা তো থেমে থাকবে না। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়লাম। আমাদের ‘স্বপ্নযাত্রা’র অনেককেই ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। একবার ভাবলাম, আমাদের গবেষণা তহবিলের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিই। ২০০৯ সালের নভেম্বরে আমি মালয়েশিয়ায় গিয়েছি। সেখান থেকে শুনতে পেলাম পত্রিকায় আমাদের গবেষণা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বেরিয়েছে। সেই প্রতিবেদনটিই পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দিল। ঠিক পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী আমাকে মালয়েশিয়ায় ফোন করলেন। বললেন, ‘আপনার ওপরে লেখাটি পড়েছি। আপনি দেশে আসেন। আমরা আপনাদের সব সহযোগিতা দেব।’ তাঁর আশ্বাস পেয়ে দেশে ফিরে এলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রীকে পুরো বিষয়টি সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললাম। তিনিও আমাদের গবেষণাটি চালিয়ে যেতে বললেন। জানালেন, এর জন্য সম্পূর্ণ সহযোগিতা সরকার করবে। আমরা লুপ্ত মনোবল ফিরে পেলাম। আবারও পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হলো। আমাদের প্রকল্পের সঙ্গে যেসব তরুণ বিজ্ঞানী যুক্ত ছিলেন, তাঁদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অন্য দেশে এ ধরনের গবেষণার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আমাদের তরুণেরা কাজ করতে করতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন। এখানে অব্যাহত বিদ্যুৎ থাকত না। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো তাঁরা ভালো বেতনও পাননি। তবু আন্তরিকভাবে তাঁরা কাজ করে গেছেন। পাটের জিন-নকশা আমরা এ দেশে বসে উন্মোচন করেছি। এই আনন্দের কোনো শেষ নেই। এরপর আমরা লাগলাম ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের কাজে। শুরুতে ভেবেছিলাম, এ গবেষণায় পাঁচ বছর সময় লাগবে। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীরা দিন-রাত পরিশ্রমের বিনিময়ে এক বছরের মধ্যে ছত্রাকের রহস্য ভেদ করলেন। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনে গবেষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। এই গবেষণার মাধ্যমে জৈব তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতের তরুণ বিজ্ঞানীদের যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা হলো, তার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বজুড়ে জৈব তথ্যপ্রযুক্তি খাত দ্রুত বড় ও শক্তিশালী হচ্ছে। জৈব তথ্যপ্রযুক্তিসেবা দিয়ে কেবল ভারতই প্রতিবছর দুই বিলিয়ন ডলার অর্থ আয় করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই খাতে আয় আরও বেশি। বাংলাদেশেরও এই খাতে প্রবেশ করার সুযোগ এখন অপার। আমাদের বিজ্ঞানীদের গবেষণা যদি বাংলাদেশকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তার চেয়ে বড় আনন্দ তো আর হতে পারে না। এএইচ


No comments:

Post a Comment