মাগুরছড়া বিস্ফোরণ, দেড় যুগেও হয়নি ক্ষতিপূরণ নিজস্ব প্রতিনিধি আরটিএনএন মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে রবিবার (১৪ জুন)। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি এখনো। এমনকি ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আজো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। দেশের ভয়াবহ এ গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনার দেড় যুগ পার হয়েছে। এখনো পরিবেশ ও গ্যাস বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়
নি মার্কিন বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা আংশিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। ১৯৯৭ সালের এই দিনে মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে অক্সিডেন্টাল কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনের জন্য কূপ খননকালে মধ্যরাতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ওই বিস্ফোরণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সংরক্ষিত বনাঞ্চল, আখাউড়া-সিলেট রুটের রেলপথ, ফুলবাড়ি চা বাগান, কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক জনপথের প্রধান সড়ক. মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জির বসতঘর, পান জুম এলাকা ও পিডিবির ৩৩ হাজার কেভি প্রধান বিদ্যুৎ লাইনের। ওই ঘটনায় দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এক মাস পর ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় কমিটি। পরবর্তীতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ, ক্ষতিপূরণ আদায় ও বিতরণের বিষয়ে তদন্ত কমিটির ৩ সদস্যের একটি সাব কমিটি গঠন করে। দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের ব্যর্থতাকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তদন্ত কমিটি। তাদের অনুসন্ধানে অক্সিডেন্টালের ১৫/১৬টি ত্রুটি ধরা পড়ে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির মতে ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় পরিবেশ, বিদ্যুৎ, সড়ক, রেলপথ ও গ্যাসের মোট ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা ছিল। অন্যদিকে, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ওই ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০৯ কোটি টাকা নিরূপণ করে তা আদায়ে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের কাছে দাবি জানায়। বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ১৮ বছরেও ক্ষতিগ্রস্তদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে দেড় যুগ ধরে কমলগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের মনে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের আগুন সন্দেহের দাবানল হয়ে জ্বলছে। তৎকালীন সরকার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। ফলে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ১৮তম বার্ষিকী পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা নীরবে চোখের জল ফেলছে। এ নিয়ে মৌলভীবাজার তথা সিলেটের জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন করা হয়েছে। মূল কূপটি এখনো পুকুরের আকার ধারণ করে টিকে আছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝে মধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনায় সাক্ষী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মার্কিন অক্সিডেন্টাল কোম্পানী ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ তাদের অনুসারী কোম্পানী শেভরনের কাছে বিক্রি করেছে। বিগত ২০০৮ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়ার বুক চিরে শেভরনের ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করেছে। এতে একাধিক বাড়ির দেয়াল ও মসজিদে ফাটল দেখা দেয়ায় স্থানীয়ভাবে অনেক ব্যক্তিবর্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ধ্বংস হয় পরিবেশের স্বাভাবিকতা। সিলেট বিভাগের আদিবাসী ফোরাম নেতা খাসিয়া হেডম্যান জিডিসন সুচিয়াং প্রধান এ প্রসঙ্গে বলেন, মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ১৮ বছর পার হলেও এর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। সরকারের উচিত ওই ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্যসহ প্রতিবেদনটি দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করা। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলার কারণে মার্কিন বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করাও সরকারের দায়িত্ব। সেদিনের ভয়াবহ মাগুরছড়া মাগুরছড়ার গ্যাসকুপে বিস্ফোরণের ভয়াল স্মৃতি আজো তাড়িত করে মৌলভীবাজার জেলাবাসীকে। বিশেষ করে কমলগঞ্জের মানুষ সেদিন কতটা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল। আগুনের লেলিহান শিখা কখন কাকে গ্রাস করে ফেলে—এই আতঙ্কে প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল কমলগঞ্জবাসীর। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে ১টা ৪৫ মিনিটে মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা কমলগঞ্জ। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল মৌলভীবাজার জেলার সুনীল আকাশ। ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণভয়ে ছুটছিল দিগবিদিক। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে উঠা আগুনের লেলিহান শিখা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। জীববৈচিত্র্যের বিপুল ক্ষতি হয়। পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্য মতে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয়। দেড় যুগেও মাগুরছড়া ট্রাজেডির ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণও। ওই দুর্ঘটনার জেরে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। মন্তব্য
No comments:
Post a Comment