‘‘মন্ত্রীর জন্য স্তুতিকাব্য লেখা আমার কাজ নয়। বরং তোমাদের মন্ত্রীকে বোলো, তিনি যেন আমাকে দেখলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। তবেই তার দরবারে যাব আমি।’’ কথাটা যিনি বলছেন, তার বয়স মাঝদুপুর পার করেছে, দাড়িতে পাক ধরছে অল্প, আর শরীরটাও ভেঙে যাচ্ছে নানা কারণে। তিনি আসাউল্লাহ খান বেগ ওরফে মির্জ়া গালিব। ভারতবর্ষের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। ১৮৪৫-এর আশেপাশে কোনো একটা সময়, মির্জ়া তখন লৌখনোতে বাড়ি ভাড়া নিয়
ে আছেন, দিল্লি ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন বেশ কিছু দিন। ধারদেনায় ডুবে রয়েছেন মাথা পর্যন্ত। মুদিখানা থেকে ফলওয়ালা, তেজারতির কারবারি থেকে মদের দোকান, সর্বত্র দেনা হয়ে আছে তার। দিল্লিতে কবিতার চাইতে ধারের জন্য তখন মির্জ়াকে বেশি মানুষ চেনেন। রোজগার বলতে পারিবারিক পেনশনের ওপর নির্ভর করা, কিন্তু নবাবি আমল চুকে যাওয়ামাত্র বৃটিশ সরকার তাতেও হস্তক্ষেপ করেছে। নতুন করে পিটিশন করতে হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। শেষমেশ মির্জ়ার উকিল হীরালাল বললেন, কলকাতায় গিয়ে লর্ড মেটক্যাফের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারলে কাজটা হলেও হতে পারে। অগত্যা দিল্লির ভাড়ার হাভেলি ছেড়ে দীর্ঘ সফরে বেরোতে হলো মির্জ়াকে। সেই সফরে যাবার সঙ্গতিটুকুও ছিল না উর্দু ভাষার সেরা এই শায়রের। এমনকী নিজের দিওয়ান (গজলের পাণ্ডুলিপি) বন্ধক রেখে টাকা ধার নেবার চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু কেউ রাজি হননি সে-প্রস্তাবে। শেষে সহৃদয় এক সুদের কারবারি তাকে লৌখনো অবধি যাবার রসদটুকু জুগিয়েছেন। এবার লৌখনোর নবাব যদি আর কিছু অর্থ বরাদ্দ করেন তো কলকাতা অবধি যাবার একটা ব্যবস্থা হয়। লৌখনোতে তখন তার খ্যাতি ছড়িয়েছে অল্পস্বল্প, সেখানে জুটে গেল কয়েকজন শারগিদ। তাদের মুখেই খবর পেলেন, লৌখনো-র নবাব হায়দারের হাতে আর কোনো ক্ষমতাই নেই। উল্টো নবাবের কর্মচারী আগা মীর বৃটিশ সরকারের নির্লজ্জ চাটুকারিতা করে ডেপুটির পদ বাগিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে। তাকে খুশি করতে পারলেই কাজ হাসিল হতে পারে। সে সময়ে মির্জ়াকে একজন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আগা মীরের স্তুতিসূচক দু লাইন-এর একটি শের রচনা করে তার দরবারে গিয়ে শোনাতে। তার উত্তরেই ওই কথাটি বলেছিলেন মির্জ়া। দেনায় ডুবে যাওয়া, পদে পদে অপমানিত, হেরে যাওয়া একজন মানুষ। চার সন্তানের মৃত্যু পার করে আসা, দারিদ্রের সঙ্গে যুঝতে থাকা একজন মানুষ। সামান্য ক’টা টাকার জন্য হেনস্থা হওয়া একজন মানুষ। কিন্তু দিনের শেষে তিনি শিল্পী। তিনি কবি। অনাপ়সী, নির্ভয়, আত্মসম্মানে টইটম্বুর। শেষ হয়ে যাবেন, কিন্তু মাথা নোয়াবেন না। আশ্চর্য এই যে, আজ থেকে অত বছর আগেও এমন মানুষ সংখ্যায় কমই ছিলেন। তবে চাটুকারদের সংখ্যাটা বোধহয় ক্রমশ বেড়েছে। যাই হোক, স্তুতি না-করায় নবাবি খাজানার কানাকড়িও জুটল না মির্জ়ার। লৌখনোতে কয়েক মাস শিক্ষানবিশি করে কিছু টাকা জমিয়ে বুন্দেলখণ্ড অবধি পৌঁছলেন। সেখানে বন্ধুবর জুলফিকার আলি বাহাদুরের আতিথেয়তায় কাটল কিছু দিন। তারই তদবিরে, আমিন চন্দ নামের এক কারবারির কাছ থেকে হাজার দুয়েক মুদ্রা ধার নিয়ে কলকাতার উদ্দেশে ফের বেরোলেন মাথা উঁচু করা একজন মানুষ, কবিদের কবি, মির্জ়া গালিব। তার মন তখন অন্য কারণে একটু খুশি। দিল্লি ছাড়ার কয়েক দিন আগেই তার বেগম উমরাও জন্ম দিয়েছেন পঞ্চম সন্তানটিকে। মির্জ়া সেই ছেলের মুখের আধো বুলি কানে নিয়েই পাড়ি দিলেন কলকাতায়। *** ২০১২-র পুরানি দিল্লি। কী একটা কাজে আমাকে যেতে হয়েছে সেখানে, কবিতা পড়াই বোধহয়। হাতে আছে একদিন সময়, মন চলল তার তীর্থে। চাঁদনি চওক মেট্রো স্টেশন থেকে অলিগলি হয়ে বল্লিমারন এলাকায় পৌঁছনো। পিছনে বিকেলের রোদ আগলে রেখেছে লাল কেল্লা, সামনে দাঁড়ানো ওই যুবক তরমুজওলার পাশ দিয়ে বাঁয়ে ঢুকলেই গলি কাসিম। ঘিঞ্জি একটা আঁকাবাঁকা গলি। এদিকে জুতোর দোকান তো ওদিকে শুকনো ফলের পসরা। নানা রঙের প্লাস্টিক-এর চাঁদোয়ায় বিকেলের পুরনো আকাশটা প্রায় ঢাকাই পড়ে গিয়েছে। তারই এক ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মসজিদ-এর মিনার, একটু পরেই আজান শুরু হবে। হ্যাঁ, মসজিদ একটা থাকার কথা বটে এখানেই। আর তার কয়েক পা ডাইনে গেলেই সেই হাভেলি, যার ভারী দরজা ঠেলে ধীর পায়ে গলি কাসিম-এর সন্ধ্যা চাখতে বেরিয়ে পড়তেন সেই প্রৌঢ়, মির্জ়া গালিব। এখনও কি তেমনই আছে হাভেলিটা? কৌতূহলে এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে। একজন চুড়িওলাকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি দেখিয়ে দিলেন মির্জ়া কা মকান। ভারী দরজাটা আছে ঠিকই, সামনে একজন দ্বাররক্ষীও মোতায়েন (কারণ এখন মির্জ়ার হাভেলি হেরিটেজ বিল্ডিং বলে ঘোষিত), কিন্তু এ কী দেখছি? হাভেলির ভেতরে, যে-উঠোনে মির্জ়া পায়চারি করতেন, আড্ডা দিতেন ইয়ার দোস্তদের নিয়ে, সেই উঠোনে একখানা ফোন বুথ। আর হাভেলির মাথার ওপরকার আকাশটা ঢেকে দিয়ে অগুনতি জানালা আর বারান্দা থেকে ভিজে কাপড় ঝুলে রয়েছে। এইখানে থাকতেন আমার প্রিয়তম কবি, উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ শায়র? এত রকম বেমানান রঙের মধ্যে উঠোনের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে কাচের বাক্সে রাখা একটা লম্বা খাতা। উর্দু হস্তাক্ষরে গালিব সাহেবের একটি দিওয়ান। কোনো এক নাম-না-জানা অক্ষরশিল্পীর তুলির টানে প্রাণ-পাওয়া সেই পাণ্ডুলিপির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে, টিমটিমে কিছু বাতি আর জর্দার চনমনে খুশবুর মধ্যেই জেগে উঠছে আজান... আর একটু এগোলেই কি হাজি মীরের কিতাবের দোকান? যেখানে সারাটা দিন আড্ডা দিতেন আর বই পড়তেন মির্জ়া? হ্যাঁ, ওই তো! আর সেই দোকান থেকে কয়েক পা হাঁটলেই নওয়াবজানের কোঠা... আর কিছুক্ষণ পর তার গলাতেই শোনা যাবে মির্জ়ার দু চারটে শের... *** ‘‘মির্জ়া, তুমি দিওয়ান ছাপাচ্ছ না কেন? এমন অসামান্য লেখার হাত তোমার!’’ লালকেল্লার সামনের বিখ্যাত চা দু’ভাঁড় আনিয়ে কথাটা তুললেন হাজি মীর। ১৮৩৫-এর দিল্লি, বদলের হাওয়া কেল্লার রং পাল্টাচ্ছে তখন। গালিব যথারীতি মীর তকি মীরের সংকলনে মুখ ডুবিয়ে রেখেছেন। তার প্রিয় কবি মীর, ইসলামের প্রতি আনুগত্যের অভাবে যিনি দিল্লির শাহী দরবার থেকে বিতাড়িত। অবশ্য নামাজ পড়া, মসজিদে যাওয়া, এসব মির্জ়ার ধাতেও নেই। বিবি উমরাও আল্লাহর সঙ্গে বোঝাপড়ায় ব্যস্ত, মির্জ়া মজে থাকেন মদে, জুয়ায়, গজলে। কোনো দিন না তাকেও সাধের দিল্লি ছাড়তে হয়। ‘‘আমার দিওয়ান কে ছাপাবে হাজি সাহেব?’’ বই থেকে মুখ তুলে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন মির্জ়া, ‘‘তার চেয়ে এই যে আপনার দোকানে বসে দু চারটে শের পড়বার গুস্তাখি করি, সে-ই আমার ভালো।’’ ‘‘আর ভাগ্যিস সেসব বহুমূল্য গুস্তাখিগুলো আমি লিখে রাখি! নইলে তোমার কত গজল যে এমনই বয়ে যেত...,’’ ব’লে এক তাড়া পাতা টেনে বার করলেন হাজি মীর। তারই দ্রুত হাতের লেখায় মির্জ়ার বলে যাওয়া শেরগুলো টুকে রাখা। সব মিলিয়ে অনেকগুলো গজল। ‘ইয়ে ন থি হমারি কিসমত কে ভিসাল-এ-ইয়ার হোতা...’ কাছেই কোথাও কেউ গাইছে। এ তো গালিবেরই শের! বেশ অবাক হলেন মির্জ়া। হাজি সাহেব কৌতূহলো ভাঙ্গিয়ে বললেন, মেয়েটি নওয়াবজান। মির্জ়ার অন্ধ ভক্ত এক তওয়ায়েফ, মাঝেমধ্যেই হাজির দোকানে এসে মির্জ়ার শের টুকে নিয়ে যায় গাইবে বলে। তার বড় ইচ্ছে, একবার মির্জ়াকে দ্যাখে। শেষমেশ আলাপ হয়েছিল এই দুজনের। নওয়াবজান মির্জ়াকে খোলাখুলিই জানিয়েছিলেন তার প্রতি আসক্তির কথা। অপেক্ষা করেছিলেন বহু মেহফিল সাজিয়ে। কিন্তু সংসারে, নেশায়, জুয়ায় আর লেখায় মজে থাকা মির্জ়া সেই অপেক্ষার উত্তর দিতে একটু দেরিই করে ফেলেছিলেন। তত দিনে মির্জ়াকে না-পাওয়ার যন্ত্রণা গজলে মুড়ে নিয়ে দিল্লি ছেড়ে চলে গিয়েছে সেই রূপসী। নওয়াবজান। তবে যাবার আগে তিনি করে গিয়েছিলেন এক অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী। তার কোঠায় যাতায়াতকারী এক কোতোয়াল একবার বলেছিল, ‘‘তুমি যে গালিবের প্রেমে পাগল, সে সারা দিল্লির কাছে দেনায় ডুবে আছে, জানো?’’ সামান্য হেসে নওয়াবজান উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘জানি। আর এটাও জানি যে একদিন তামাম দেশ তার শায়রীর দেনায় ডুবে থাকবে।’’ সেই তরুণীর কথা বিফলে যায়নি। *** দিল্লির দরবারে বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি ইব্রাহিম জ়ওক। প্রতিভাবান, সন্দেহ নেই, কিন্তু আপসেও তার জুড়ি নেই। শায়রীর চেয়ে জি-হুজুরিতেই তার পারদর্শিতা বেশি। কবিতার পদের চেয়ে নিজের পদ তার বেশি প্রিয়। দরবারে মাঝেমধ্যেই মুশায়েরা বসে, সম্রাটের তোষামোদসূচক কাব্যে কে কত এগিয়ে, তার দৌড় হয়। জ়ওক গুণী মানুষ, কিন্তু পদ চলে যাওয়ার ভয় তার গুণকে আড়াল করে রাখে সারাক্ষণ। গালিবের শের তখন দিল্লির যুবকদের মুখে মুখে ফিরছে। কিন্তু প্রকাশিত সংকলন একটিও নেই। ডাকা হলো তাকে মুশায়েরায়। আদত ফারসিতে গজল পড়লেন, তারিফের বদলে জুটল পরিহাস। সম্রাটের অনুমতি না নিয়েই সে দিন দরবার ছেড়েছিলেন মির্জ়া। আবার তাকে ফিরতে হলো কয়েক বছর পর, যখন স্বয়ং জ়ওক তাকে মুশায়েরায় আমন্ত্রণ জানালেন। এমন আমন্ত্রণ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আল্লাহকে শুকরিয়া জানালেন বিবি উমরাও। যদি এই সুযোগে কিছু অর্থ জোটে, দেনা মেটানো যাবে কিছুটা। এমনিতেই তার শোহর সংসারে থেকেও উদাসীন। একবার পেনশনের ৭৫০ মুদ্রা জুটেছিল, মুদিখানায় ধার শোধ করে বাকি টাকা দিয়ে আর্মি ক্যান্টনমেন্ট থেকে হুইস্কি কিনে বাড়ি ঢুকেছিলেন। তার ওপর জুয়ার নেশা তো আছেই। সুতরাং শায়রী যদি দু চার পয়সা এনে দেয়, ক্ষতি কী? মির্জ়া যদিও জানেন জ়ওক-এর উদ্দেশ্য কী। দিল্লির অলিগলির হাওয়ায় এই যে তার নাম উড়ছে এখন, দরবারের জানলা দিয়ে সে-হাওয়া তো জ়ওক সাহেবের কানেও কথা বলছে। কী এমন লেখে এই গালিব, একবার যাচাই করে নিতে হবে না? মির্জ়ার কিছু ছিল না। না ধনদৌলত, না শিরোপা, না শাসকের বদান্যতা। বরং বদনামটাই কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু যেটা ছিল, সেটা একজন শায়র হিসেবে মাথা উঁচু করা আত্মবিশ্বাস। তাকে সম্বল করেই বাহাদুর শাহ জাফরের মুশায়েরায় আসন গ্রহণ করলেন মির্জ়া। সেই শমআ জ্বালানো সন্ধ্যার দরবারি মুশায়েরা দিল্লির কাব্য ইতিহাসে আজও লেখা হয়ে আছে। ‘হর এক বাত পে কহতে হো তুম কে তু ক্যা হ্যায়...’ এই একটি গজলেই মুশায়েরা মাত করেছিলেন মির্জ়া। স্বয়ং পোয়েট লরিয়েট বৃদ্ধ জ়ওক-এর হাতও বারবার তারিফে হাওয়া কেটেছিল। ভেট কিছু না-পেলেও, শোহর-এর শাহী স্বীকৃতিতেই আটখানা অন্ত্বঃসত্তা বিবি উমরাও। এর আগে তিনটি সন্তান খুইয়েছেন তিনি। এবার কি আল্লাহ মুখ তুলে চাইবেন? পরদিন সকালে মুখ চুন করে হাভেলিতে ঢুকলেন মির্জ়ার আগরানিবাসী বাল্যবন্ধু বংশীধর। হাজি মীরের কাছ থেকে নিজের শেরগুলো কুড়িয়ে বাড়িয়ে একটি দিওয়ান খাড়া করেছিলেন মির্জ়া, বংশীধর সেটা নিয়ে গেছিলেন। কিন্তু দিল্লি, আগরা বা লৌখনো-এর কোনো প্রকাশক এই অনামী কবির দিওয়ান ছাপতে রাজি নয়। ভাবনায় আর কাজে সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একজন মাঝবয়সি মানুষ হাতে তুলে নিলেন নিজের ব্যর্থ পাণ্ডুলিপিখানা। যে সব শের একদিন তামাম হিন্দুস্তানের মুখে মুখে ঘুরবে গজল হয়ে, তাদের কোনো প্রকাশক জুটল না। সময় বরাবর অসফল জহুরি। আসল হিরাকে সে চিরকালই বহু দেরিতে চিনেছে। দিওয়ান ফেলে রেখে গলি কাসিম-এর চেনা রাস্তায় পা রাখলেন মির্জ়া। তার কয়েক দিন পর আরও একবার মৃত সন্তান প্রসব করলেন উমরাও। দিল্লির এক কোণের এক গরিব হাভেলিতে আরও একটি চিরাগ নিভিয়ে পাশাপাশি বসল এক অসহায় দম্পতি, যাদের ভালোবাসা তখনও নেভেনি। *** শিমলা বাজার, কলকাতা, ১৮৪৬। মানিকতলা গির্জার পিছনে একটা দু কামরার বাসা ভাড়া নিয়ে মাস চারেক হলো আছেন এক নরম স্বভাবের প্রৌঢ়। সুদূর দিল্লি থেকে এসেছেন, লাট সাহেবের সঙ্গে কী সব সরকারি কাজের তাগিদে। দাড়ি আর ফেজ টুপিখানা দেখে মনে হয় ধর্মে মুসলমান, কিন্তু মানেন না কিছুই। সন্ধ্যার পর হুইস্কি চাই, মসজিদে যেতে দেখা যায় না একদিনও, হিন্দুদের সঙ্গেও দিব্যি খোশমেজাজে গল্প জোড়েন। এই ক’মাসেই কলকাতাকে ভারী ভালোবেসে ফেলেছেন, মনে ধরে গিয়েছে বাঙালিদেরও। একদিন তো বলেই ফেলেছেন, দিল্লিতে স্ত্রী আর ছেলে না থাকলে এই শহরেই আস্তানা পাততেন বাকি জীবনটা। ছেলেটা কত বড় হলো? হাজি মীর মাঝেমধ্যে চিঠি লেখে বটে, কিন্তু বাড়ির খবর কিছু দেয় না। পাওনাদাররা কি বেগমকে বড্ড জ্বালাতন করছে? রোজকার রুটি জুটছে কি? আরও একবার নিজেকে ব্যর্থ মনে হলো তার। কেবল কলম চালানো ছাড়া কিছুই তো করা হয়ে উঠল না জীবনে। তবু যদি তার কবিতা বিকোত বাজারে... শেষমেশ লর্ড মেটক্যাফে একটা তারিখ দিলেন মির্জ়াকে। মির্জ়ার এই দেড় বছরের ক্লান্তিকর সফরে এটাই একমাত্র সুখবর। এরই মধ্যে কলকাতার কয়েকজন সুহৃদ মির্জ়ার সম্মানে এক মুশায়েরার আয়োজন করলেন, তার পড়ে পাওয়া কবিখ্যাতির কিছুটা কলকাতাতেও পৌঁছেছে দেখে বেশ অবাকই হলেন মির্জ়া। রাজি হলেন মুশায়েরায় যেতে। আর সেখানেই ঘটল বিপত্তি। প্রশ্ন উঠল উর্দু ভাষার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে। বেশির ভাগেরই মত, উর্দু আসলে মুসলমানদের ভাষা। বেশ বিরক্ত হয়েই বিরোধিতা করলেন মির্জ়া, ‘‘উর্দুর জন্ম ভারতবর্ষের সেনা ছাউনিগুলোতে। উর্দু শব্দের অর্থই তো ছাউনি। সেই ভাষা আজ কেবল মুসলমানদের সম্পত্তি হয়ে গেল কী করে? ভাষার ওপর ধর্মের মালিকানা হয় কখনও? তাহলে আর ফরিদ কেন লিখলেন পাঞ্জাবিতে? উর্দু তামাম হিন্দুস্তানের ভাষা। দয়া করে কেবল ইসলামীদের ভাষা আখ্যা দিয়ে তাকে ছোট করবেন না। হিন্দু আর মুসলমান একই মাটির সন্তান, ভাষার প্রশ্নে তাদের বিরোধ ঘটিয়ে দেশটাকে লুটে নিতে চাইছে সাহেবরা। সেটা কি আপনারা বুঝতে পারছেন না?’’ সেদিন মির্জ়া শের পড়লেন না আর। মুশায়েরায় হাজির ছিলেন কয়েকজন বৃটিশ। মির্জ়ার বক্তব্য লর্ড মেটক্যাফের কানে পৌঁছতে এক দিনও লাগল না। খারিজ হলো মির্জ়ার পেনশনের আর্জি। কলকাতার ঠিকানা হাওয়ায় উড়িয়ে ক্লান্ত মির্জ়া খালি হাতে ফিরে চললেন দিল্লি। *** কবরখানায় নেমে আসা সন্ধে কেবল দেখতে পাচ্ছে, এক প্রায়-বৃদ্ধ ভেজা চোখে মাজ়ারের সামনে বসে অস্ফুটে কী যেন বলে চলেছেন। আসলে তিনি শের পড়ছেন, মৃদু বকছেন অকালে চলে যাওয়া তার পঞ্চম সন্তানটিকে। কাজের ফিকিরে কলকাতায় থাকাকালীন কখন তাকে ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি এসে কবরে শুয়ে পড়েছে তার ফুটফুটে ছেলেটি, খবরও পাননি মির্জ়া। দিল্লি যেদিন পৌঁছলেন, সেদিন সন্ধেবেলাতেই আরও একবার সন্তানের মাজ়ারে চাদর চড়াতে যেতে হলো তাকে। ‘‘তনহা গয়ে কিউঁ, অব রহো তনহা কোই দিন অওর’’... একা একা চলে গেলে কেন? এখন থাকো আরও কিছু দিন একা! শের-এর বকুনি দিতে দিতে সময়ের কাছে পর্যুদস্ত অথচ অপরাজিত মির্জ়া ফিরে এলেন গলি কাসিম-এর হাভেলিতে। বেগমের চুলে পাক ধরেছে, চোখের নীচে কালি। সে-কালির কতখানি অভিমান আর কতখানি অভিযোগ, তা বোঝার চেষ্টা করে আর লাভ নেই। ভাবলেন মির্জ়া। চার চোখের চাউনি চালাচালি হলো একবার, তারপর ক্লান্ত পায়ে দোতলার ছোট কামরাটিতে ঢুকে গ্লাসে পানীয় ঢাললেন মির্জ়া। বোতলগুলোও বেইমান, সব কটা খালি হয়ে বসে আছে। সকলে মিলে হারিয়ে দিতে চাইছে তাকে। সময়, পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক, মানুষজন আর তার নিজের স্বভাব। নিজের মুদ্রাদোষে নিজে একা তিনি আলাদা হয়ে যাচ্ছেন প্রতি মুহূর্তে। মাথা নিচু করছেন আরও একবার, শুধু লেখার খাতাটার সামনে। লিখছেন, ‘রঞ্জ সে খুগর হুয়া ইনসান তো মিট যাতা হ্যায় রঞ্জ / মুশকিলেঁ মুঝ পর পড়ি ইতনি কে আসাঁ হো গয়ি’ (দুঃখের সঙ্গে সমঝোতা করে নিলেই দুঃখ মিটে যায় / এতরকম মুশকিলে পড়লাম যে শেষমেশ সবটাই সহজ হয়ে গেল)। দিল্লিতে সেই কোন অতীতকালে ইতিহাসের চাদর নিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে তখন... *** ১৮৫৪ বা ৫৫। দেনা। আরও দেনা। হুমকি। শাসানি। শেষে পাওনাদারদের ডিক্রি জারি। শোধ না করতে পারলে আদালতে জবাবদিহি। এদিকে কয়েক মাস হলো আগরা থেকে এসে তার বাড়িতেই সপরিবার আশ্রয় নিয়েছেন মির্জ়ার ভাই ইউসুফ খান। মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন তিনি, তারও কোনো রোজগার নেই। কীভাবে সমাধান হবে এই পরিস্থিতির? জানেন না মির্জ়া। বিকেল হলেই বেরিয়ে যান সামনের নুক্কড়ের পাকা জুয়াড়িদের আসরে। কোতোয়াল বহুবার তাদের গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছে, কিন্তু ওই জুয়াই মির্জ়ার শেষ ভরসা। যদি ভাগ্য ফেরে! এমন সময়ে এক প্রভাবশালী বন্ধুর দৌলতে অধ্যাপনার চাকরি পেলেন দিল্লি কলেজে। ফারসি পড়াতে হবে, পাকা চাকরি। বেতন যেরকম বলছে, তাতে ধার শোধ করে সংসার মন্দ চলবে না। প্রথম দিন গিয়ে আর গেলেন না তিনি। তদবিরকারী বন্ধুটি খবর পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন এই বিরাগের কারণ। মির্জ়া জানালেন, প্রথম দিন যখন তিনি টাঙ্গা থেকে কলেজের দরজায় নামেন, তাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কেউ সেখানে ছিলেন না। এই অসম্মান তিনি মেনে নিতে পারেননি। বন্ধুটি এ সব শুনেও তার অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘দোস্ত, এ বয়সে এসে চাকরি করলে সম্মান অর্জনের জন্য করব। সম্মান খোয়ানোর জন্য নয়।’’ সরীসৃপদের ভিড়ে তার শিরদাঁড়াই তাকে আলাদা করে রেখেছিল বরাবর। প্রতিভায়, নীতিবোধে, আত্মমর্যাদাজ্ঞানে সমসাময়িক শিল্পীদের চেয়ে অনেকটাই ঊর্ধ্বে ছিলেন মির্জ়া। সারাজীবন অভাব আর গঞ্জনা সহ্য করবার পর পাওনাদারের ডিক্রি আর পরিবারের উপোসের মুখে দাঁড়িয়ে পাকা চাকরিকে মর্যাদার প্রশ্নে ফিরিয়ে দিতে একটা জোর লাগে। সত্যিকারের শিল্পীর জোর। বাকিদের, শিল্পের ভণিতাময় লোকজনের সেটা থাকার কথা নয়। এর মাস ছয়েক পরের কথা। আদালতে হাজিরা দিতে হলো ডিক্রির কারণে। তার পরপরই প্রকাশ্যে জুয়া খেলার অপরাধে ছ’মাসের হাজতবাস। স্বয়ং বাহাদুর শাহ জাফরের হুকুমনামাও তাকে মুক্ত করতে পারল না। এক জীবনে যত রকমের বিপদ হতে পারে, দেখে নিলেন মির্জ়া। ভোগ করে নিলেন সব ধরনের অপমানের মুকুট। ভেঙে গেল শরীর আর মন, পরিবারে এক বেলার জন্যেও এল না সুদিনের রোদ্দুর। তবে হাজতে থাকতেই বন্ধু বংশীধর খবর এনেছিলেন, খোদ লৌখনো-এর নামজাদা প্রকাশকের ঘর থেকে বেরিয়েছে গালিবের প্রথম দিওয়ান, কয়েক দিনের মধ্যে তার দ্বিতীয় সংস্করণও ছাপাতে হয়েছে। অনেক দেখলেন মির্জ়া। কেবল বিক্রি করলেন না নিজেকে। একবারের জন্যেও মাথা নোয়ালেন না শাসকের সামনে। নোয়ালে আজ তাকে মানুষ অন্যভাবে চিনত অবশ্য। ক্ষমতার পায়ের নীচে খোলামকুচি হয়ে মিশে যাওয়া একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে থেকে যেতেন তিনি ইতিহাসে। যেমন মানুষ প্রত্যেক যুগেই বিরাট সংখ্যায় থাকে। দুঃখ এই যে, সময় একদিন হাত ঝাড়ে আর সেইসব সুযোগসন্ধানীদের নামধাম বালির মতোই খসে পড়ে যায়। থেকে যান মির্জ়ারা। হাজতবাস শেষ হবার পরেই অবশ্য তাকে আপ্যায়ন করে দরবারে ডেকে ‘দবির-উল-মুলক’ খেতাবে ভূষিত করেন বাহাদুর শাহ, সভাকবি জ়ওক-ও উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে প্রচুর উপঢৌকন ও বেশ কিছু মুদ্রা। সংসারের অভাব শেষমেশ কিছুটা হলেও মিটল, ধার শোধ করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মির্জ়া। *** ১৮৫৭। সিপাহী বিদ্রোহে গোটা দেশ উত্তাল, দিল্লিতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার আগুন ছড়িয়েছে হু হু করে। কারফিউ চলছে। নিজের উঠোনে বসে মনখারাপের প্রহর গুনছেন মির্জ়া। এ কোন দিল্লি? এ কেমন ভারতবর্ষ? যাও বা সংসারে সামান্য টাকা এলো, প্রিয় শহরটা ছারখার হয়ে গেল চোখের সামনে। সিপাহী বিদ্রোহ মির্জ়ার কাছ থেকে কেড়ে নিল অনেক কিছু। বেখেয়ালে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়া ভাই ইউসুফ নিহত হলেন বৃটিশ পেয়াদার গুলিতে। সারাজীবনের বন্ধু হাজি মীরকে হত্যা করে গাছে টাঙিয়ে দিল হিন্দুরা, জ্বালিয়ে দিল তার বইয়ের দোকান। অগুনতি বইয়ের সঙ্গে চিরকালের মতো ছাই হয়ে গেল মির্জ়ার বহু শের, যা হাজি নিজের হাতে লিখে রাখতেন রোজ। লৌখনোর নবাব, সুকবি ওয়াজিদ আলি শাহকে গৃহবন্দি করে রাখা হলো কলকাতার মেটিয়াব্রুজে। দিল্লি ছাড়তে বাধ্য হলেন বাহাদুর শাহ জাফর, শেষমেশ তার মৃত্যু হলো আন্দামানে। সেই গলি কাসিম, সেই হাভেলি, সেই নিভে আসা সন্ধ্যা, আর সেই এক দম্পতির বসে থাকা। এবার অবসানের অপেক্ষায়। ধোঁয়া-ওঠা পুড়ে-যাওয়া দিল্লির রাস্তায় তখন খুব কম পড়ত মির্জ়ার ক্লান্ত দুটো পা। ইয়ার দোস্ত-রা মৃত, গানবাজনা বন্ধ শহরে, মদেও আর তেমন নেশা নেই। ‘নেই’ দিয়ে ঘিরে থাকা ৭০ বছরের দীর্ঘ জীবনে আছে বলতে কেবল লেখা। আরও একবার কলম তুলে নিলেন মির্জ়া। লিখলেন, ‘হুই মুদ্দত কে গালিব মর গয়া পর ইয়াদ আতা হ্যায় / উও হর এক বাত পর কহেনা কে ইউঁ হোতা তো ক্যা হোতা...’ সম্ভবত তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, আর এক বছর পর গলি কাসিম-এর দীর্ঘশ্বাস সঙ্গে নিয়ে দিল্লির রাজপথে নামবে তার জানাজ়া... সূত্র: মির্জ়া গালিব, আ বায়োগ্রাফিকাল সিনারিও, লেখক - গুলজার
No comments:
Post a Comment