মাহবুব উল্লাহর বিশ্লেষণ মোদির সফরের উচ্ছ্বাস ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে গেছে নিউজ ডেস্ক আরটিএনএন ঢাকা: মোদির সফরে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার মৌলিক বিষয়গুলো খুব একটা প্রাধান্য পায়নি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, শুধুমাত্র ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সংগঠিত ভূমি সীমান্ত চুক্তির অনুলিপি হস্তান্তর হয়েছে। একটি চুক্তির বাস্তব
ায়নের জন্য প্রায় ৪১ বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিশিষ্ট এ রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার যেটাকে সফল বলছেন সেটা বাংলাদেশের জনগণের সফলতা নাকি বাংলাদেশে এখন যে সরকার ক্ষমতায় আছে তার নিজস্ব স্বার্থের সফলতা এটা একটা বড় প্রশ্ন! মাহবুব উল্লাহ রেডিও তেহরানের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, মোদির ঢাকা সফরের সময় বেশ কয়েকটি চুক্তি, প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে স্পষ্ট নয় এসব সমঝোতা স্মরক, চুক্তি এবং প্রটোকলের মধ্যে কি আছে, এগুলোর কি শর্ত! তাছাড়া ভারত ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সাহায্য অর্থাৎ ঋণ দেয়ার কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন এই ঋণের কোনোরকম শর্ত নেই; তাহলে কি আছে এই ঋণে! সব মিলিয়ে মোদির সফর নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে গেছে বলে সাক্ষাৎকারে জানান অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হল। আরটি: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে দু দিনের সফর করেছেন। সফরের সময় যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে তার বেশিরভাগই বাংলাদেশের স্বার্থে যায় নি বলে অনেক বিশ্লেষণে উঠে আসছে। আপনি কি বলবেন? মাহবুব উল্লাহ: দেখুন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে আমাদের মিডিয়াতে যথেষ্ট উচ্ছ্বােসের সৃষ্টি হয়েছিল। আর মিডিয়ার ভূমিকার ফলে জনমনেও বিরাট একটা আকাঙ্ক্ষার জন্ম নিয়েছিল। তবে বাস্তবে মোদির সফরকে ঘিরে আনুষ্ঠানিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যেকার মৌলিক বিষয়গুলো খুব একটা প্রাধান্য পায়নি। শুধুমাত্র ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সংগঠিত ভূমি সীমান্ত চুক্তির অনুলিপি হস্তান্তর হয়েছে। অর্থাৎ এই চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও এর বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৪১ বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা বিরাট আশা-আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছিল এ কারণে যে সম্ভবত তিস্তার বিষয়ে কোনো আলাপ আলোচনা হবে এবং একটা সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। শুধু তিস্তা নয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন ৫৪ টি নদী আছে, দু দেশের মধ্যে এই নদীগুলোর পানি বন্টন কিভাবে হবে সে ব্যাপারেও কোনো আলোচনা হয়েছে বলে কোনো সংবাদ মাধ্যমে খবর দেখিনি। এরইমধ্যে এসব নদীতে উজানে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এমনকি জলবিদ্যুতের জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এরফলে ওইসব নদী ক্রমান্বয়ে প্রবাহ হারিয়ে ফেলছে এবং বাংলাদেশে বিরাট পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। দুদেশের মধ্যে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হলে আমরা যতই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলি না কেন আসলে বিপুল ক্ষতির সন্মুখীন হব আমরা। এছাড়া সীমান্ত হত্যাসহ অন্যান্য নানা প্রশ্ন রয়েছে। মোদির ঢাকা সফরের সময় বেশ কয়েকটি চুক্তি, প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে স্পষ্ট নয় এসব সমঝোতা স্মরক, চুক্তি এবং প্রটোকলের মধ্যে কি আছে, এগুলোর কি শর্ত! তাছাড়া ভারত ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সাহায্য অর্থাৎ ঋণ দেয়ার কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন এই ঋণের কোনোরকম শর্ত নেই; তাহলে কি আছে এই ঋণে! ঋণ বললে আমরা যতটুকু বুঝি তার একটা সুদের হার থাকবে, ঋণ ব্যবহারের খাত কি হবে, সামগ্রী সংগ্রহ করা হবে কিভাবে- সাধারণ এ ধরণের ঋণের মধ্যে এ বিষয়গুলো থাকে। সে ব্যাপারটাও স্পষ্ট নয়। তো সব মিলিয়ে মোদির সফর নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে গেছে। আরটি: নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে আওয়ামী লীগ ‘সফল ও ঐতিহাসিক’ বলে মনে করছে। আসলে বাংলাদেশের দিক থেকে কতটা সফল ছিল মোদির সফর? মাহবুব উল্লাহ: বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক বিশেষ করে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছেন আমরা যতটুকু দিয়েছি তার সমতূল্য তেমন কিছুই পাইনি। উত্তর-পূর্ব ভারতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়ার তার সবই দিয়েছে ভারতকে। বিনিময়ে এর প্রাপ্য মাশুল পাওয়া যাবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। কাজেই এ ধরণের প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। রেডিও তেহরান: ব্রিটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘দ্যা ইকোনমিস্ট’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নরেন্দ্র মোদির সফরের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে- বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশের নেতার কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কতটা সত্য ইকনোমিস্টের এ বক্তব্য? অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: দেখুন, এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়; বিশ্বের যেসব দেশ সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে দূর্বল সেসব দেশের সরকারগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর সমর্থন সহযোগিতা কিম্বা আরো অন্যরকমের সুবিধা আশা করে। এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ভারতের বড় রকমের প্রভাব আছে। তো স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সরকার আশা করবে ভারত এই সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করবে এবং বাংলাদেশের সরকারকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করবে না। বিশেষ করে আমরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় দেখেছিলাম-ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশ সফরে এসে একেবারেই খোলামেলাভাবে সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তখন অবশ্য নরেন্দ্র মোদির সরকার ছিল না; তখন মনমোহন সিংয়ের সরকার ক্ষমতায় ছিল। আর তখন ভারতের ওই সমর্থনে বাংলাদেশের জনমনে যথেষ্ট উষ্মার সৃষ্টি হয়েছিল। তো এখন তারা যেটাকে সফল বলছেন সেটা বাংলাদেশের জনগণের সফলতা নাকি বাংলাদেশে এখন যে সরকার ক্ষমতায় আছে তার নিজস্ব স্বার্থের সফলতা এটা একটা বড় প্রশ্ন! আরটি: নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল- বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের আপত্তি বা বাধা ছিল তাও বেশ স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত খালেদার সঙ্গে মোদির বৈঠক হয়েছে। কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন বিষয়টিকে? মাহবুব উল্লাহ: দেখুন আমি একটি সংবাদপত্রে পড়েছি যে বিষয়টি নিয়ে ভারতের মন্ত্রিসভাতেও আলোচনা হয়েছে। যখন টানাপড়েন চলছিল তখন ভারত সরকার বিশেষ বিবেচনার দিক থেকে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারা বৈঠকে মিলিত হবেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছিলেন যে খালেদা-মোদি বৈঠক হবে না তখন দিল্লি থেকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন যে বৈঠক হবে। শেষপর্যন্ত মোদি-খালেদা বৈঠকটি হয়েছে; বলা চলে দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে এটা একটা রেওয়াজ হয়েছে। এটা ষাটের দশক নয় বা এটা ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ও নয়; এখন বিশ্বের সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান যখন অন্য একটি দেশ সফর করেন তখন শুধু সরকারের সাথেই কথা বলেন না; সরকারবিরোধী অন্যান্য দল এবং তাদের নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন। তারা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক হিসেবে দেখেন। কূটনৈতিক এবং স্বার্থ বিবেচনায় ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার এটাকেই যথার্থ মনে করেছে যে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপির সাথে আলোচনা হওয়া দরকার। যদিও এই দলটি বর্তমানে সংসদে নেই। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে ঠিক এই মুহূর্তে ভারত সবগুলো ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে চায়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি রয়েছে তা কিছুটা হ্রাস করতে চেয়েছে। ভারত তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সবমহলের কাছ থেকেই একটা সমর্থন চাইছে। এরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নরেন্দ্র মোদি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে আমার ধারণা। মন্তব্য
No comments:
Post a Comment