Monday, March 23, 2015

দুঃখী মানুষ... :Natun Barta

দুঃখের কোনো শব্দ হয় না৷ দুঃখ আসলে এক অনন্ত নৈঃশব্দ্য৷ মন খারাপ করো না, খারাপ সময় কেটে যাবে৷ এক একটা সময় দুঃখ নিয়ে আসে৷ সময় পার হয়ে গেলে দুঃখের ইতি হয়৷ নজরুলের সেই গান শোনোনি, চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়...৷ বুঝলাম, কিন্তু আমার গ্রাম যদি নদীর ধারে হয়? প্রবাদই তো আছে, নদীর ধারে বাস, দুঃখ বারোমাস৷ নদী ভাঙে, ঘর-গেরস্হালি নদীর ভিতরে চলে যায়৷ আবার নতুন করে ঘর বাঁধো৷ ঝড় আসে, আয়লা কিংবা অমনি কিছু, তছনছ হয়
ে যায় খেতখামার, ফসলের জমি, ভিটেবাড়ি৷ মন্দির- মসজিদের ঈশ্বরের চেয়ে প্রকৃতির অনেক বেশি শক্তি৷ কেউ বাঁচাতে পারে না৷ শুরু হয় অনন্ত দুঃখের দিন৷ সেই দিনের আর শেষ নেই৷ চলতেই থাকে, চলতেই থাকে৷ মানুষের জীবন যায় দুঃখে দুঃখে৷ মানুষ যেন দুঃখ পেতেই জন্মায়৷ সকলেই কি, কেউ কেউ৷ কেউ কেউ কি? সকলেই হয়তো৷ উদ্বেগ আর দুঃখ কি সব সময় টের পাওয়া যায় মুখ দেখে? কার ভিতরে কোন অন্ধকার বাসা বেঁধে আছে কে জানে? কে বয়ে নিয়ে চলেছে কোন রাত্রি, অনন্ত রাত্রি? [X] আমার মায়ের ছিল অনেক সন্তান৷ আমরা রয়েছি তিনজন৷ ছেলেবেলায় বহুদিন পর্যন্ত মাকে কাঁদতে দেখেছি ডিলডিলের জন্য৷ ডিলডিল ছিল আমার ওপরে কোনো বোন৷ আমার দিদি৷ মেজদা, বড়দা বলেন, সে ছিল নাকি খুব সুন্দর৷ সে মারা গিয়েছিল বছর তিন বয়সে ওপার থেকে এপারে আসার পর ভয়ানক জ্বরে৷ মা তাকে সমস্ত জীবন ভুলতে পারেনি৷ আরও সন্তান ছিল৷ তাদের একজনের নাম ছিল সায়েব৷ সেও নাকি ছিল সায়েবের মতো রঙ টুকটুকে৷ বাঁচেনি বেশিদিন৷ কোনো কোনো দিন, সেই গ্রীষ্মের দুপুরে, যখন কলকাতার এই উত্তরাঞ্চল, আমাদের বেলগাছিয়া-পাইকপাড়া নিঃঝুম, কখনও ফেরিওয়ালার ডাক৷...৷ শিল কাটাও, চাই ঘুঁটে, মাটিইইই....৷ কাঁসারির ঢং ঢং নিয়ে দুপুর পার হয়ে যেত মৃদু পায়ে, একাকী মায়ের চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়াতে দেখতাম৷ দুঃখের কোনো শব্দ হয় না৷ দুঃখ আসলে এক অনন্ত নৈঃশব্দ্য৷ সেই নৈঃশব্দ্যের রূপ তখন দেখতাম মায়ের ভিতরে৷ আমি দুঃখকে ছুঁয়ে দেখতে পেরেছি প্রথমে মায়ের কাছে৷ মা ছিলেন কপোতাক্ষ পাড়ের মেয়ে৷ বাঁকা ভবানীপুর মায়ের বাপের বাড়ি, খুলনা জেলা৷ কাছেই রাঢুলি-কাটিপাড়ায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আদি নিবাস৷ মায়ের শ্বশুরবাড়ি ধূলিহর গ্রাম৷ সেখানেও অতি নিকটে সেই কপোতাক্ষ৷ মা দেশ বিভাজনে সেই নদীকে হারিয়েছিলেন৷ অনেক রাতে মায়ের মুখে মায়ের বাপেরবাড়ির কথা আমি শুনতাম৷ আমিই একমাত্র শ্রোতা৷ ঘর অন্ধকার৷ মা বলছেন, বাপেরবাড়ির ঘরে শুয়ে শোনা ভোরবেলায় কপোতাক্ষ থেকে ভেসে আসা স্টিমারের ভোঁ-এর কথা৷ প্রথম স্টিমার ছাড়ল৷ মা বলছেন, তাদের বাড়ির কথা৷ আমি তো দেখিনি, তাই আমাকে শোনানো৷ তারপর আরম্ভ হতো আর এক কথা৷ বৃটিশ আমলে উত্তরবঙ্গের বেঙ্গল-ডুয়ার্স রেলপথ চলে আসে তার নিবিড় বিবরণে৷ মেটেলি, কিংবা ডামডিম, এমনি কোনো রেলস্টেশনে কিছুদিন কেটেছিল তার ছোটবেলা৷ ভুটানি মেয়ে, চা-বাগান, কমলালেবু সঙ্গে আর এক হৃদয়বিদারক কথা৷ ওই দিকের এক রেলস্টেশনে, মায়ের বাবা, স্টেশন মাস্টার ধীরেন্দ্রনাথ বসু, তিনদিনের জ্বরে একা একা মারা গিয়েছিলেন৷ পরিবার ছিল নিজ গ্রামে৷ সেই টেলিগ্রামে সেই মৃত্যুসংবাদ এলো গ্রামে৷ মা আমাকে সেই কথা বলতেন একা অন্ধকারে৷ সেই কথা ছিল অনিঃশেষ৷ আমার মনে হয় সেই দুঃখের ইতিবৃত্ত এখনও শেষ হয়নি৷ আমি মায়ের কাছে শুনতাম লালমনিরহাট, তিস্তা জংশন, কাউনিয়া এমনি সব স্টেশনের কথা৷ গত ডিসেম্বরে আমি কোচবিহারের চ্যাংড়াবাঁধা সীমান্ত দিয়ে পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি সন্ধ্যার একটু আগে৷ যাচ্ছিলাম ছিটমহল দেখতে৷ বাংলাদেশের ভিতরে ভারতীয় ভূখণ্ড দেখতে৷ সন্ধ্যায় বুড়িমারি স্টেশনে৷ করতোয়া এক্সপ্রেসে করে যাব লালমনিরহাট পেরিয়ে তিস্তা জংশন৷ হা হা শীতের রাতে প্রায় অন্ধকার একশো বছরের এক পুরনো রেলগাড়িতে মা এসে বসলেন আমার পাশে৷ মনে পড়তে লাগল, মনে পড়তে লাগল৷ আমার মনে হতে লাগল সেই স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে৷ ১৯৪১-এর অঘ্রানে বোধহয় তার প্রয়াণ হয়েছিল৷ দেশভাগ ও পিতৃগৃহ হারানো মাকে সমস্ত জীবন দুঃখী করে রেখেছিল৷ দূরে একা একা এক শীতের রাতে যে তার বাবা, আমাদের না দেখা অচেনা সেই মাতামহ মারা গিয়েছিলেন, সেই কথা নিচুস্বরে আমাকে বলতেন৷ মায়ের মা, আমার মাতামহীও দেশভাগের আগেই চলে গিয়েছিলেন, ১৯৪৩-৪৪-এ বোধহয়৷ তাকেও দেখিনি৷ মা তাকে চিঠি লিখতেন একটি ডায়েরিতে৷ সেই ডায়েরি আমি আচমকা পেয়ে যেতে, কী লজ্জা! অথচ, নিজের বাবার কাছে, মায়ের কাছে আমার মা রাধারানী চিঠি লিখে দেশভাগ, পিতৃগৃহ হারানো, সব কথা জানিয়েছিলেন৷ কপোতাক্ষ আর বাঁকা, ধূলিহর গ্রাম পাকিস্তান হয়ে গেছে, আমরা এখন ভারতের বাসিন্দা, আমাদের কোনো গ্রাম নেই, নদী নেই এখন৷ তোমরা ভাগ্যবান তোমাদের তা দেখতে হয়নি, আমরা দেখেছি৷ মনু (তার পরের বোন) বেঁচে নেই৷ অনেক রোগ ভোগের পর শান্তি পেয়েছে গেল আশ্বিন মাসে৷ তার সঙ্গে কি তোমাদের দেখা হয়েছে? এপারে আসার পর তার জীবনে আর সুখ ছিল না৷ আসলে সেই ডায়েরির ভিতরে মায়ের দুঃখ ছবি হয়ে ছিল৷ এমনি কত দুঃখের যে সাক্ষী হতে হয়েছে জীবনে৷ আর নিজের কত দুঃখকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে৷ মানুষের জীবনই যে যায় তার নিজস্ব দুঃখকে লুকোতে৷ কেউ যদি বলেন, তার নিজস্ব কোনো দুঃখ নেই, তিনি কি সত্য বলেন? বাল্যকালে আলেকজান্ডার ডুমার একটি উপন্যাস পড়েছিলাম অনুবাদে, দি ম্যান, হু লাফস৷ মানুষটির মুখে অস্ত্রোপচার করে এমন করে দেওয়া হয়েছিল, সে কাঁদলেও মনে হতো হাসছে৷ চোখ দিয়ে অবিরল অশ্রুপাত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মুখখানি হাস্যোজ্জ্বল৷ আসলে এখন মনে হয় এমনিই তো হয়৷ হাসতে হয় দুঃখ চেপে৷ আর অপেক্ষা করতে সুসময়ের জন্য৷ সুসময় এলে আমার দুঃখের দিন শেষ হবে৷ সহকর্মী অখিলেশ বলে, সুসময় যা ছিল, তা চলে গেছে৷ আর আসবে না৷ স্মৃতি সততই সুখের৷ যে সময়ের ভিতর দিয়ে যায় মানুষ, তা দুঃখবাহী৷ পরে তা সুখের হয়ে যায়৷ কারও কারও স্মৃতি সুখের মনে হয়, সব স্মৃতি কি সুখের হয়? ডিলডিল বা সায়েবের মৃত্যু যে তাদের জননীকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত পুড়িয়েছিল৷ আর নাজিদের গ্যাসচেম্বার, আউসভিৎস যদি কারও স্মৃতিতে থেকে থাকে, তা কি সুখের হয়? যাক আমি অখিলেশের কথা বলি৷ অখিলেশের বাল্যকাল কেটেছে উদ্বাস্তু কলোনিতে৷ সেই রানাঘাটের দিকে৷ খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে অখিল৷ শেষ পর্যন্ত একটা সরকারি চাকরি পেয়ে বাঁচিয়েছিল মা বাবা ভাই বোনের পরিবারকে৷ তারপরও খুব কষ্ট করেছে৷ বিয়ে করেছে৷ চাকরিতে বারবার বদলি হয়েছে৷ তার ছেলেটি ছিল মেধাবী৷ তার জন্য অখিলেশ তার বাকি জীবনটা ব্যয় করেছে৷ নিজেরা মাছ খেত না, তার জন্য আনত৷ নিজেরা সিনেমা-থিয়েটার দেখে পয়সা ব্যয় করত না, ভালো শার্ট, প্যান্ট কিনত না, ভালো শাড়ি কিনত না৷ খেয়ে না-খেয়ে পয়সা জমাত, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার করবে৷ অখিলেশ যা হতে চেয়েছিল, তা হতে পারেনি৷ তার ছেলে তেমন হোক৷ মেধাবী পুত্র তার সাধ পূরণ করেছিল৷ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট, তারপর দামি প্রযুক্তিবিদ৷ ছেলে চাকরি পেল৷ ফ্ল্যাট কিনল অখিলেশ তার অবসরের টাকা দিয়ে৷ এই কাহিনী খুব পরিচিত৷ এর পরের কাহিনীও খুব পরিচিত৷ অখিলেশের পুত্রের বিবাহ হল৷ বউ নিয়ে সে গেল পশ্চিমে৷ সাতপুরুষে কেউ আমেরিকা যায়নি৷ আনন্দ আর অহঙ্কারে বুক ভরে গেল অখিলেশ আর তার বউয়ের৷ অখিলেশ এখন বিপত্নীক৷ বউযের অসুখে সে একা জেরবার হয়ে গিয়েছিল নার্সিংহোমে দৌড়ে দৌড়ে৷ ছেলে আসতে পারেনি মায়ের অসুখের সময়৷ টাকার অভাব অখিলেশের ছিল না৷ সে চেষ্টা করেছিল খুব, কিন্তু বউ থাকেনি৷ নাতির মুখ দেখতে চেয়েছিল৷ আমেরিকায় নাতি জন্মেছে৷ ছবিতে যা দেখেছিল সেই শিশুর ঠাকুমা, তাতে মন ভরেনি তো৷ অভিমানে চলেই গেল৷ অখিলেশ আমেরিকায় যায়নি ছেলের কাছে৷ একা থাকে৷ ঘুরে ঘুরে বেড়ায়৷ রানাঘাট নবদ্বীপ থেকে কেরল, গুজরাট, বিন্ধ্যাচল ঘুরে বেড়ায়৷ আর যখন কলকাতায় থাকে, ভোরবেলা আমার সঙ্গে তার দেখা হয়৷ হাতে বাজারের থলে৷ একা মানুষের কীই বা বাজার! ধুস! অভ্যেসে নিয়ে বেরুই৷ ধুস, কী হবে বলো দেখি, এখন কত পেনশন পাই, করব কী? যাও ঘুরে এসো আমেরিকা, তীর্থদর্শন হবে৷ না৷ দুঃখী অখিলেশ বলে, যাব, যেতেই পারি, কিন্তু চেনা নেই কেউ যে৷ তারা তো ভুলেই গেছে৷ বলো, রংপুর শহরটা কেমন? গিয়েছিলে না বাংলাদেশ? আচ্ছা, আমি যদি আমার আত্মজীবনী লিখি, কেউ পড়বে? আর শুভেন্দু? শুভেন্দুর ছেলে মেধাবী ছিল৷ কিন্তু তার মাথায় যে কবিতা আর গল্পের ভূত৷ সঙ্গে পশ্চিমা ক্লাসিক মিউজিক৷ তার কি কিছু হবে? কী করবে সে? বেশি বয়সের সন্তান৷ শুভেন্দুর বন্ধুর সন্তানেরা সবাই দাঁড়িয়ে গেছে, এ কবে দাঁড়াবে ঈশ্বর জানেন৷ শুভেন্দুর খুব মন খারাপ হয় চারদিক দেখে৷ কিন্তু কী করবে সে? এ সব কারও হাতে নেই৷ জীবন খুব হিসাব করে চালাতে হয়৷ তাহলে হয়তো দুঃখ এড়ানো যায় কমবেশি৷ তবু শুভেন্দুর একসময় মন ভালো হয়, যখন ছেলে এসে বলে, এইটা শোনো, আমরা কম্পোজ করেছি৷ তখন রাত অনেক৷ সেই মিউজিক শুনতে শুনতে শুভেন্দুর চোখে জল এসে যায়৷ আবার পরের দিন, এক বন্ধু যখন বলে, তার ছেলে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড, শুভেন্দু চোখের সামনে দেখতে পায় তার সদ্য যুবকপুত্রের বিষন্ন মুখ৷ তার কবিতা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে একটি ম্যাগাজিন থেকে৷ তাকে বারবার বদলাতে বলছে যারা মিউজিক চেয়েছিল তারা৷ সে বলছে, আমি আমার থিম বদলাব কেন? আপনারা তাহলে নিজেরা বানিয়ে নিন মিউজিক৷ সে খুব অহঙ্কারী যুবক৷ এই সব নিয়ে শুভেন্দুর দুঃখী মুখ৷ অরুণেশের মেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে৷ অরুণেশের ঘুম আসে না৷ কী যে হবে? অনেক খোঁজ নিয়ে বিয়ে দিয়েছিল৷ কিন্তু সমস্তটাই জলে গেল৷ মেয়ে অপমানিত হয়ে হয়ে না পেরে চলে এসেছে৷ ম্লানমুখে সামনে ঘোরে, জানালার ধারে একা বসে থাকে৷ স্কুল সার্ভিস কমিশনের জন্য তৈরি হচ্ছে৷ অথচ অরুণেশের দাদার মেয়ের বিয়েটা কত ভালো হয়েছে৷ অরুণেশ নিজের মেয়ের দিকে তাকাতে পারে না৷ মেয়ে দোষ দেয় মা-বাবাকে৷ এখন কেস লড়ে ডিভোর্স নিতে হবে৷ সীতাদি আমাদের বাড়িতে আসতেন৷ কমবয়সে একটি ছেলে নিয়ে বিধবা৷ স্বামী সামান্য চাকরি করতেন৷ কিছুই প্রায় রেখে যাননি৷ সীতাদি সেলাই মেশিন চালিয়ে, ঠোঙা তৈরি করে সন্তান নিয়ে বেঁচ্ছেন৷ খুব স্নিগ্ধ ছিল তার মুখখানি৷ মনে পড়ে৷ ছেলের চাকরির জন্য সীতাদি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরতেন৷ আমাদের বাড়িতেও হয়তো আসতেন ওই কারণেই৷ মায়ের মন ছিল দয়া আর মায়ায় পূর্ণ৷ সীতাদিকে খুব যত্ন করতেন৷ গল্প করতেন সাতক্ষীরার৷ সীতাদি ওই সাতক্ষীরার সস্পর্কেই অনেক দূরের আত্মীয়া ছিলেন৷ সন্ধ্যার পর তিনি চলে গেলে মা বলতেন, মেয়ের নাম সীতা রাখতে নেই৷ রামায়ণের সীতার দুঃখ এই সীতার ভাগ্যে এসে মিলেছে৷ সীতার মতো দুঃখী কেউ ছিল? দুই মহাকাব্যের দুই প্রধান নারী সীতা আর দ্রৌপদী ছিল দুখিনী নারী৷ দুজনেই পুরুষের অবহেলায় কাটিয়েছে জীবন৷ দ্রৌপদী নামও রাখতে নেই৷ বেহুলা দেবতার মনোরঞ্জন করে তবে না লখিন্দরকে ফেরাতে পেরেছিল৷ বেহুলা নামও ক’জনের হয়? কে সাহস করে রাখতে পারে? দুঃখী মানুষের জীবনের মেঘ কি সরে না? কোনো কোনো জনকে ভাগ্য বলি, অদৃষ্ট বলি, কিছু না বলি, সবদিক থেকে মারেন অলীক ঈশ্বর৷ ঈশ্বর যদি করুণাময় হবেন, তবে এইভাবে মারেন কেন? এই প্রশ্ন নীলার৷ নীলা বন্ধুপত্নী৷ তাদের সন্তানটি মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী৷ আর সন্তান নিতে সাহস হয়নি নীলার৷ এখন এই শেষ বয়সে এসে তার নিজের অসুখ৷ সে অসুখ কালান্তক৷ ছেলের বয়স তিরিশ পার৷ হিসাব করতে পারে না৷ বন্ধু মুখ অন্ধকার করেই থাকে৷ সমস্ত জীবন কত চেষ্টা করেছে ছেলেটাকে ভালো করে তুলতে৷ হয়নি৷ বয়স বেড়ে গেছে৷ কী হবে ওর ভবিষ্যৎ? বলতে বলতে চোখে জল এসে যায় সুজনের বউ অনিতার৷ অনিতা বলে, ভগবানের ওপর বিশ্বাস রেখে কী হবে? ভগবান অন্ধ এবং বধির৷ মানুষ কি শুধু দুঃখ নিতেই জন্মায়! এই সব দুঃখ আসলে ঈশ্বরের নিজের ঝুলির৷ তিনি তা চালান করে দেন মানুষের ভিতর৷ মানুষ তবুও তাকে ছাড়া বাঁচে না৷ কষ্ট পেলে মন্দির মসজিদ গির্জায় মাথা ঠোকে৷ পৃথিবী এখন মানুষের ভারে নুয়ে পড়েছে৷ কোটি কোটি মানুষ হাজার সমস্যায় জর্জরিত৷ চারদিকে শুধু ম্লানমুখ৷ কবে ওই চোখে ছিল দীপ্তি, তার কথা সেই ঈশ্বরও জানেন না৷ হ্যাঁ, ‘তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে মানুষের মন জানে জীবনের মানে: সকলের ভালো করে জীবনযাপন৷’ (এই সব দিন রাত্রি, জীবনানন্দ দাশ)৷ সকলের ভালো করে জীবন যাপন তো হয়ে ওঠে না৷ ওঠে না বলেই না মানুষ দুঃখের ভারে নুয়ে পড়ে৷ গড়পড়তা মানুষ, অমল, বিমল, কমল এবং ইন্দ্রজিৎ সমস্তদিন একে অন্যের দিকে তাকিয়ে দেখে কে ভালো আছে তার চেয়ে বেশি৷ আর তা আন্দাজ করলে তার ভিতরে গোপন দুঃখ নেমে আসে৷ যতই মহামানবেরা বলে যান– সকলে সমান পাবে, সমান খাবে, সমান হবে, কিন্তু তা কখনও কি হয়? হয়েছে কোনো দেশে? চীন, রুশ, কিংবা মার্কিন মুলুকে? হয়নি যখন দুঃখী মানুষের অভাব কোথাও একটুও কম নেই৷ বরং বেশিই বলা যায়৷ কেন না আকাঙ্খার আয়োজন বেশি৷ আমাদের দেশে সাধারণ, অতিসাধারণ মানুষের আকাঙ্খা কম৷ বেশি চায় না সে৷ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে৷ ‘আমোদ’৷ সেই গল্পে একেবারে ভূমিহীন চাষা যাত্রা দেখতে গেল৷ কত ভিড় সেখানে, সে আর বসবে কী করে, সমুখে গিয়ে দেখবে কী করে? প্যান্ডেলের বাইরে একেবারে পিছনে দাঁড়িয়ে, ডিঙি মেরে মেরে সমস্ত রাত সে দেখল যেটুকু দেখা যায়৷ আসলে অতদূর থেকে সে কিছুই শোনেনি, কিছুই দেখেনি, কিন্তু যা দেখেছে যা শুনেছে তাইই অনেক৷ সকাল হয়ে গেল যাত্রা শেষ হতে৷ চলল সে তার কাজে৷ যাই হোক আমোদটা তো হয়েছে৷ সামান্য পেলেই খুশি মানুষ কম নেই৷ যারা তেমন কিছু পায়নি, তারা তেমন কিছু আশাও করে না৷ তাদের দুঃখবোধও তাই কম৷ চলে গেলেই হলো৷ আসলে জীবনটাকে মেনে নেওয়া, না নেওয়ার ভিতরেই আছে দুঃখ আর সুখের ইতিবৃত্ত৷ কিন্তু যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের তার সাথে হয়নাকো দেখা৷ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কল্পনাও করতে পারে না ফড়িঙের, দোয়েলের জীবনের কথা৷ তাই ধারণ করতে হয় দুঃখকে৷ প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে দুঃখ নিয়ে একাকী হয় মানুষ৷ আধুনিক জীবন ও প্রতিযোগিতা প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বাল্যকাল থেকে প্রতিযোগিতা শিখেছে নতুন প্রজন্ম৷ বাবা-মা তাকে ক্রমাগত ঠেলে দিয়েছে প্রতিযোগিতায়৷ ক্লাসে, ছবি আঁকায়, ক্রিকেটে, কবিতা বলায়, কুইজ কম্পিটিশনে তাকে ঠেলে দিয়ে দিয়ে আর হারিয়ে হারিয়ে দুঃখের সাগরে ডুবিয়েছে মা-বাবা৷ তাকে স্বাভাবিক মানুষ করে তুলতে পারেনি৷ চারদিকে ম্লানমুখ বেড়েছে শুধু৷ এমন দেখেছি আমরা সবাই৷ নিজেকে নষ্ট করে ফেলা, আত্মহননের পথে যাওয়া এইভাবে হয়৷ প্রত্যাখ্যান দুঃখী করে৷ প্রয়াত লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, প্রত্যাখ্যান, অপমান ইত্যাদি একজন লেখককে গড়ে তোলে৷ অনেকটা তাইই৷ প্রত্যাখ্যান, অপমান একজন মানুষকেও জীবন চেনায়৷ দুঃখী মানুষের মতো জীবন চেনে কে? সে চেনে সাধু ও শয়তান, দুজনকেই৷ সে চেনে জীবনের আলো ও অন্ধকার দুইই৷ লেখক তা লেখেন পরাজিত মানুষের কথা৷ হেরে যাওয়া মানুষের কথা৷ তা যদি তিনি নিজে অনুভব না করবেন, কী করে সেই কথা লিখবেন? আমরা জানি না, কীভাবে এসেছিল সেই ১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪-র সন্ধ্যা৷ অন্যমনস্ক ছিলেন কবি, বিষাদে আচ্ছন্ন ছিলেন, কেমন ছিলেন তা কে-ই বা জানে? নানারকম কথা ভেসে আসে৷ জীবনানন্দ ওই সন্ধ্যায় ট্রামের ধাক্কায় আহত হন গুরুতরভাবে৷ ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪, ৫ কার্তিক, ১৩৬১, রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে তার প্রয়াণ হয়৷ কবি আর কবিতা পাঠকের সেই দুঃখ এখনও যায়নি৷ যাবে না কোনোদিন৷ জীবনানন্দের কবিতায় যা আছে নিহিত হয়ে, সেই আট বছর আগে একদিন থেকে অনেক অনেক কবিতায়, গল্প আর উপন্যাসে আছে দুঃখী মানুষের, হেরে যাওয়া মানুষের জীবন৷ জলপাইহাটি, জীবনপ্রণালী, মাল্যবান থেকে আরও সব উপন্যাসে, গল্পে৷ কিন্তু তা শুধু ওখানেই আবদ্ধ নেই, বিস্তারিত জীবনের অসম্ভব বোধে৷ দুঃখ আমাদের সঙ্গী৷ সুখপাখি চঞ্চল৷ শুধুই উড়ে যেতে চায়৷ আমি ফিরি সেই মহাদ্রষ্টা লেখক বিভূতিভূষণে৷ তিনি বলছেন, দুঃখ জীবনের বড় সম্পদ,....৷ যে জীবন অশ্রুকে জানে না, আশাহত ব্যর্থতাকে জানে না সে জীবন মরুভূমি, সে সুখসম্পদ-ধনসম্পদ-ভরা ভয়ানক জীবনকে আমরা যেন ভয় করতে শিখি৷ ঐহিক সফলতায় যে মানুষ অনেকের ওপরে, সে যখন দেখে তার চোখে অসফল একজন কেমন মাথা উঁচু করে হাঁটে, কেমন মান্য হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে, সফলতার অর্থ তখন বদলে যায় তার কাছে৷ ঈর্ষাবোধ তার কাছে নিয়ে আসে দুঃখ৷ তার চোখে যে মানুষ ব্যর্থ, সে কিন্তু জানে সে যা পেয়েছে তাই তার পাওনা ছিল এই জীবনের কাছে।


No comments:

Post a Comment