Wednesday, March 18, 2015

নীললোহিত :Natun Barta

দুটো উপন্যাসের গোড়ার প্যারা তুলে দিচ্ছি। বাঙালি কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীর আর বিশেষ কোনও ক্লু-এর প্রয়োজন হবে না কথক-লেখকটিকে ঠাউর করার জন্য। ঠিক উত্তরের জন্য কোনও পুরস্কার নেই। এই নিন... “মানিব্যাগ রাখার অভ্যেস আমার নেই কখনো। যখন যা দু’চার টাকা থাকে, বুকপকেটেই রাখি। আর প্যান্টের পকেটে রাখলে চেপ্টে যায় বলে সিগারেট-দেশলাইও ঐ বুকপকেটেই রাখতে হয়। হাওয়াই সার্টের ঐ একটাই পকেট। চক্রধরপুর থেকে ট্রাকে চেপে
যাচ্ছিলাম টেবো-হেমাডির দিকে।” [X] বেশ টের পাচ্ছি উত্তর উচ্চারণ করার জন্য ঠোঁট কাঁপছে বহু পাঠক-পাঠিকার। তবু সবুর করুন দ্বিতীয় কোট-এর জন্য, একটুখানি... “যারা জীবনে কখনো দিকশূন্যপুরে যায়নি, কিংবা সে-জায়গাটার নামও শোনেনি, তারা বুঝতে পারবে না তারা কী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার অস্তিত্বই জানা নেই, তাকে না-পাওয়ার তো কোনো দুঃখ থাকে না। কিন্তু যারা দিকশূন্যপুরে একবার গেছে, কিন্তু বারবার ফিরে যেতে পারেনি, তাদের অতৃপ্তির শেষ নেই। আমি মাঝে মাঝে সেই জায়গাটার কথা ভাবি, কিন্তু আমারও যাওয়া হয়ে ওঠে না। কেউ আমাকে ডেকে নিয়ে যায় দক্ষিণে, কেউ উত্তরে।” একটাই বুকপকেটঅলা হাওয়াই শার্ট আর উত্তর-দক্ষিণের টানাপড়েনে থাকা বাহাদুর কথকটি যে নীলু, মানে নীললোহিত তা কিন্তু আর বলার অপেক্ষায় রইল না। দিকশূন্যপুর তো ওরই আবিষ্কার, সেখানে না পৌঁছেই। এ ভাবে বছর তিরিশেক চালানোর পর সত্যি সত্যি একবার দিকশূন্যপুরে পৌঁছেও গেল নীললোহিত ‘চলো দিকশূন্যপুর’ উপন্যাসে। সেখানকার ট্রেনে চাপার আগে নিজেকে বোঝালও, “মন চলো নিজ নিকেতনে। চলো দিকশূন্যপুর।” বেশ উপন্যাস গজাল সেখানে। রোহিলা বলে একটা মেয়েকে নিয়ে নানা বৃত্তান্ত। কিন্তু সেই দিকশূন্যপুরের ভূগোল-ইতিহাস শনাক্ত করে কোন ব্যোমকেশ! দিকশূন্যপুর রয়ে গেল দিকশূন্যপুরে। দমদম, শ্যামবাজারের অলিগলিতে বেড়ে ওঠা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তিন নির্মাণের কোনটি যে বাঙালির বেশি আদরের অ্যাদ্দিনেও নিশ্চিত করা গেল না। নীরা? নীলু? না, সুনীল? নীরার কথা ছেড়েই দিন, সে আরেক দিকশূন্যপুর। সুনীলের আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে বুঝেছি নীললোহিতের অন্তরালে থেকে উনি নিজেকে অনেক স্পষ্ট করে স্পর্শ করতেন, ভালবেসে চেনাতে পারতেন। একেক সময় ধন্ধে পড়ি সুনীলের ছদ্মনাম নীললোহিত না ভাইসি ভার্সা! অর্থাৎ উল্টোটা। কারণ কী, গোটা চল্লিশ বছর ধরে কখনও কাছে থেকে, কখনও অদূর থেকে দেখে আর পড়ে এটাই বুঝলাম যে সারাটা লেখকজীবন ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একাদিক্রমে চেষ্টাই ছিল যথাসম্ভব নীললোহিত হয়ে ওঠা। সুনীল অনেক পুরস্কার-টুরস্কার পেয়েছেন, মান্যিগণ্যি হয়েছেন, ঢালাও নাম হয়েছে, হেভি কনাকড়ি, গাড়ি। নীলের এসব কিছুই নেই, এতশত দূরের কথা, একটা চাকরিও সে জোটাতে পারে না। আমার গাঢ় বিশ্বাস সুনীলের স্ত্রী স্বাতীর আসল প্রেম নীলের সঙ্গে। যাকে শুধু আরেক জন এভাবে চিনে ভালবেসেছিল— মার্গারিট। যাকে নিয়ে অনেকটাই লেখা ও উৎসর্গ করা নীললোহিতের ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’। সে-কথায় পরে আসছি। আগে নীললোহিত নিয়ে যা লক্ষবার ঘ্যানঘ্যান করা হয়েছে সেই তালিকাটা ছোট্ট করে শুনিয়ে দিই। বলতে নেই, নীললোহিত নিজেও এই নিয়ে বহুত গেয়েছে, শেষ দিকে ছাড়ান দিয়েওছিল বটে। যখন নীললোহিতের রচনায় আত্মকথা, রম্যরচনাংশ কমে উপন্যাসের ভারবৃদ্ধি হয়। কিন্তু সে অন্য কথা। নীললোহিতের বয়েস, দুনিয়া জানে, সাতাশ পেরোয় না। ঠিক যে-বয়েসে বহু দিন আটকে থেকে শেষের দিকে পঁয়তিরিশে উঠেছিল আরেক দুর্দান্ত বাঙালি ছোকরা ফেলুদা, মানে ফেলু মিত্তির। নীলু অবশ্য সাতাশেই লটকে রইল চিরদিন। ফেলুকে চাকরি করতে হয় না, কারণ সে শখের গোয়েন্দা। নীলুর একটা চাকরি খূব দরকার, কিন্তু সেটা খুঁজে, জুটিয়ে, করলে তবেই না! সে বান্দা নীলু নয়। ফেলুও বেড়ায় খুব, আর বেড়াতে গিয়ে নতুন নতুন গোয়েন্দাগিরিতে পড়ে। আর নীলুর তো পায়ের তলায় সর্ষে, সে যে কখন কোথায় কী ভাবে পৌঁছয় সে-ও বড় কম রহস্য নয়। কলকাতার কাছেই অধুনা আমেরিকানিবাসী ঝর্ণামাসি আর রবীন মেসোর সাতমহলা গ্রামের বাড়িতে গিয়েও ভূতের সন্ধান পায়। ঝর্ণা নীলুর একটু দূরসম্পর্কের মাসি, বছর বছর ধরে সান ফ্রান্সিস্কোয় থেকে আরও সুন্দরী হয়ে ফিরেছে। ভেতরে ভেতরে ওর প্রতি বেশ নিষিদ্ধ টান নীলুর। তাই ভূতে অ্যাত্তোটুকু বিশ্বাস না থাকলেও সে দিব্যি উৎকর্ণ হয়ে বসল ঝর্ণামাসির গপ্পে। “ঝর্ণামাসি প্রথমেই বললেন, এ বাড়িতে ভূত আছে।...ওপরের বাথরুমের জানলা দিয়ে পুকুরঘাটটা পরিষ্কার দেখা যায়। একটি ঘোমটা দেওয়া মেয়ে ঘাটের সিঁড়িতে খানিকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। একটু পরে সে জলে নেমে গেল একটু একটু করে, তারপর ডুব দিল, আর উঠল না। আমি তাকিয়ে রইলুম, উঠলই না! রবীনমেসো বললেন, হোয়াট ননসেন্স! গ্রামের মেয়েরা এই পুকুরে চান করতে আসে। ঝর্ণামাসি বললেন, কালকেও ঠিক এটাই দেখেছিলুম, ঠিক এই সময়ে। তখন আমিও ভেবেছিলুম, কেউ চান করতে এসেছে।... পরপর দু’দিন একই ব্যাপার, ডুব দিয়ে আর উঠল না। রবীনমেসো বললেন, হোয়াট ডু ইউ মিন, আর উঠল না? ঝর্ণামাসি বললেন, কোনও মানুষ ও ভাবে জলে ডুব দেয় না। ভূত তো আছেই এ বাড়িতে। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালুম। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। অন্তত পঁচাত্তর বছর বয়েস হবে, ছোটখাট চেহারা, টুকটুকে ফর্সা রং, মাথার চুলও একেবারে সাদা। রবীনমেসোর কাকিমা।... তিনি আমার গালে একটি হাত ছোঁয়ালেন। কী ঠান্ডা সেই হাত!” ‘গভীর রাতে দিঘির ধারে’ উপন্যাসের এই অংশ ঈষৎ চওড়া করে তুলে দেবার একটিই উদ্দেশ্য। জীবন থেকে গল্পে, আর গল্প থেকে জীবনে আসার যে সরল, মধুর সত্যিমিথ্যের মিশেল নীললোহিত গড়ে তুলেছিলেন তার কিঞ্চিৎ নমুনা দেওয়া। যে-নীললোহিতের জন্মই হল রম্যরচনায়-রম্যরচনায় আশপাশের চালচলন শব্দচিত্রে ফুটিয়ে তোলার জন্য, তার এক বেহদ্দ সুযোগ হল ওই ফিচারে ফিচারে নিজের জীবনটাকে ফিরে দেখার, মেলে ধরার, গেয়ে যাবার। কালকূট ছদ্মনামের আড়ালে সমরেশ বসু কিছু কিছু উপন্যাসে অপরূপ স্মৃতি ও যৌবনযাত্রা করেছিলেন। বীণের মুখে সাপের মতো আমরা যখন সেই সব রচনাসুরে দুলছি, অমন এক সাহিত্যরসঘন সময়ে নীলাকাশ থেকে বিনা কারণে বঁধুয়ার চোখের জলের মতো ঝরে পড়েছে নীললোহিত। কালকূটেরও এক অনর্গল খোঁজার জীবন, সে স্বভাববাউল। স্বভাবফকির। স্বভাবদার্শনিক। এই ফকিরের বহু গল্প শুনেছি সমরেশদা’র মুখে। এমন ভাবে বলতেন যেন নিজের থেকে উপড়ে ফেলে তাকে সামনে রেখে দেখছেন। সুনীল সে ভাবে নীলুর থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। নিজের যে সব খেয়ালখুশি, মান-অভিমান, সুখ-দুঃখ কবিতাতেও গেল না, তাদের চালান করে দিতেন নীলুর নির্ভার ফিলোজফিতে। সেদিক দিয়ে দেখলে নীললোহিত ততটা লেখক-সুনীলের নয়, যতটা কবি-সুনীলের অল্টার ইগো, দ্বিতীয় সত্তা। সুনীলের কবিচরিত্রের কত কিছুই যে পেয়েছে নীললোহিত, সব চেয়ে বেশি করে তাঁর ভালবাসার কাঙালপনা, আর তাঁর সেরা দুই প্রেমিকা, স্বাতী ও মার্গারিট। আসুন সেই গল্পে, সে জন্য চলুন ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’... নীললোহিতের এই উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে লেখা ‘মার্গারিট, তোমার জন্য’। এ-কাহিনির শুরু নীলুর প্রথম বার আমেরিকা যাত্রা দিয়ে। জার্মানি গিয়ে কুলিগিরি করতেও সে রাজি, কিন্তু আর্টস পড়ে সেখানে কুলিগিরি জোটানো যায় না। রাশিয়াতে বাংলাভাষার অনুবাদকের কাজের জন্য দরখাস্ত করেছে সে। কিন্তু সেখানে বাঘা বাঘা দিগ্গজেরা লাইনে দাঁড়িয়ে। শেষে ভাগ্যের শিকে ছিড়ল আমেরিকার আইওয়ায় এক কবিতার কর্মশালায় ডাক পেয়ে। নীলু বলছে,... “তবু ঠিক যেন বিশ্বাস হয় না। মনে হয় স্বপ্ন। প্যান্ট-কোট পরে আমি বিশাল বিমানের জানলার ধারে বসে আছি, ঠিক যেন মানাচ্ছে না। অন্য সব যাত্রী বেশ স্বাভাবিক, আমিই একমাত্র আড়ষ্ট। যেন ঝকঝকে পিন কুশানের মধ্যে একটা বাবলা কাঁটা। পকেটে মাত্র আট ডলার। যেখানে যাচ্ছি সেখানে কারুকে চিনি না। শুধু ভরসা এই, বিদেশে কোথাও আমি মারা গেলে, ভারতের রাষ্ট্রপতি আমার মৃতদেহটাকে ফিরিয়ে আনবার ব্যবস্থা করবেন। পাশপোর্ট ফর্মে এই রকম লেখা ছিল।” আশ্চর্যের আশ্চর্য, এত আশা-আকাঙ্ক্ষা যে-নীলুর, বিদেশ পাড়ি দেবার ক’দিন যেতেই তাঁর মন কাঁদে দেশে ফেরার জন্য। রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিতার ধারা নিয়ে প্রবন্ধ লেখার বায়না এল ওর কাছে। ও জানাল, এ ওর কম্মো নয়। রাতে বাড়ি ফিরে বালিশে মাথা রাখতে ওর মন খারাপ হয়। এরই মধ্যে এক নতুন আলোর ঝলকানি। হয়তো প্রথম আলো। দরজার কড়া নেড়ে এসে হাজির সদ্য পরিচয় হওয়া ফরাসি মেয়েটা। মার্গারিট। এক দেবীমূর্তি যেন দাঁড়ানো। মাথার চুল সেরকম অগোছালো। একটা হাল্কা নীল রঙের স্কার্ট পরা, গাঢ় নীল রঙের চোখ এবং অদ্ভুত সরল দৃষ্টি। সে ঘোষণা করল আমি চলে এলাম। নীলুর তখন রান্না শেষ, আর মার্গারিট সঙ্গে করে এনেছিল দু’কৌটো বিয়র। আগের দিন নীলু ওকে বই উপহারের প্রতি-উপহার। ওরা একসঙ্গে খেল। তারপর? “খাওয়ার শেষের দিকে ঝড় উঠল। হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ। তারপর পাগলা হাওয়া। মার্গারিট জানলার কাছে দৌড়ে গিয়ে শিশুর মতন কলকণ্ঠে বলল, ‘উঃ! কী সুন্দর, কী চমৎকার, এ বছরের প্রথম ঝড়নীল, তুমি দেখবে এসো...’ আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, পর্দাগুলো উড়ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন। উড়ছে মার্গারিটের মাথার চুল, গায়ের জামা, উড়ে যাচ্ছে ওর কথা। বাইরে উইলো গাছগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে। ঝাঁক ঝাঁক পাখির মতন আকাশে উড়ছে অসংখ্য শুকনো পাতা। মার্গারিট বললো, ‘তুমি একটা কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছো? বৃষ্টি আসবার আগে উইলো গাছগুলো এরকম কাঁদে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাইরের প্রকৃতির চেয়েও এই নারীটিকে আমার আরও বেশি অপরূপ মনে হয়। প্রকৃতি উদ্দাম হয়েছে বলেই এই মুহূর্তে ওর রূপ আরও বেড়ে গেছে। ওর সর্বাঙ্গ ভরা অজস্র খুশি। যেন তার ঝাপটা এসে লাগছে আমার গায়ে। খানিক পরেই বৃষ্টি নামলো।” ঝড় বইছিল নীলুর বুকের মধ্যেও। বিশেষ করে মার্গারিট যখন আবৃত্তি শুরু করল আপোলিনেয়ারের কবিতা থেকে আর মানে করে গেল সেই অনির্বচনীয় প্রণয় কাব্যের। এত সুন্দর করে কবিতা পড়া ও শোনেনি আগে। ও যেন শব্দগুলোকে দেখছে, আর ওই বালিকার মতো যুবতীর রূপ যেন গানের মতো ওর ভেতরে চলে আসছে। নীলু মার্গারিটের ঊরুর ওপর মাথাটা হেলিয়ে দিল। মেয়েটা সেদিকে স্থির ভাবে তাকাল। কবিতাটাকে আরও বেশি উপভোগ করার জন্যই যেন মার্গারিটকে স্পর্শ করার ইচ্ছে হল ওর। “আমি বললাম, ‘এটা আবার একদিন শুনব। মার্গারিট, মে আই কিস ইউ?’ ওর মুখে একটা পাতলা দুঃখের ছায়া গড়িয়ে পড়লো। আমার মাথাটা সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। ম্লান গলায় বললো, ‘আমি দুঃখিত। আমেরিকান মেয়েরা এতে কিছু মনে করে না বটে, কিন্তু আমি পারবো না। আমি মাঝে মাঝে এখানে আসতে পারি, আমরা একসঙ্গে কবিতা পড়ব, কিন্তু আমার কাছে অন্য কিছু পাবে না।” আমি তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত গলায় বললাম, ‘না, না, তুমি আসবে। আমি আর অন্য কিছু চাই না।’ তুমি পারবে না। নিশ্চয়ই পারবো। সিঁড়ির নীচ পর্যন্ত ওকে পৌঁছে দিয়ে এসে আমি দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। শরীরে অসম্ভব ছটফটানি! জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম। এই জানলাটা পুব দিকে। এদিকেই তো কলকাতা। কত হাজার মাইল দূরে। তবু আমি জানলা দিয়ে যেন সোজা কলকাতা দেখতে পাচ্ছি।...ওখানে আমি জলের মাছ, এখানে কেউ না। চলে যাবো। দু’একদিনের মধ্যেই ফিরে যাবো!” ঠিক দু’এক দিনের মধ্যেই না হলেও থাকার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কলকাতা ফিরে এসেছিল নীলু। তার পর ওর ফের পাশ্চাত্য যাত্রা বিশ বছর পর। আর তা-ই নিয়ে লেখার শুরু হল ‘তিন সমুদ্র সাতাশ নদী’ দেশ পত্রিকায়। খুব রম্য ভ্রমণকাহিনি হিসেবে ছড়ানো লেখাটায় নীললোহিতকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে পঞ্চাশ বছর পার করা বিখ্যাত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে রেখে ঢেকে রাখা। মাঝে মাঝেই গাইতে হয়েছে, বিশেষ করে প্যারিস নিয়ে লিখতে গিয়ে, “আমি বেশ ছেলেবেলায় একবার এই সব বিলেতটিলেত দেশ ঘুরে গিয়েছিলুম।” আইওয়া থেকে ফেরার পথে ওখানে জমানো গাঁটের কড়ি খরচ করে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড, মিশর ঢুঁ মেরে গিয়েছিল নীললোহিত। যে-নীললোহিত নেই কথার অচিন গাঁ-গঞ্জ-শহরে বেমালুম ভিড়ে যায় বা নিরালায় হারায়, সে এবার আমস্টারডাম শহরে এসে কী বলছে? না “আর্ট গ্যালারি কিংবা মিউজিয়াম খুব ভালো জিনিস, কত দেখার জিনিস থাকে, দেখলে কত জ্ঞান বাড়ে, কিন্তু বড্ড পা ব্যথা করে।” ‘তিন সমুদ্র সাতাশ নদী’ আগমার্কা নীললোহিত রসবোধে মোড়া। যার কিছুটা ব্যয় হয়েছে নীলের, থুড়ি, সুনীলের বাড়ন্ত বয়স চাপা দিতে। আর সুনীলের রে রে করে বাড়া খ্যাতির সামাল দিতে। আর তা নিয়ে সুনীলদা’কে বললে উনি স্রেফ হুঁ হুঁ করে হাসতেন আর বলতেন, “ভুলে যাও, আগে কী লিখেছি ভুলে যাও।” আমি বলতাম, তা কি যায়? পায়ের তলায় সর্ষে নীলুর, সে পা বাঁচাতে জাদুঘরে ঢুকতে চাইছে না....” তাতে সুনীলদা যা বলেছিলেন তা আজও মনে আসে : “দেশ-দুনিয়া নতুন করে ঘুরতেই হবে। তবে বড় বড় প্রাসাদের ভেতরে অত সময় আর দেওয়া যাবে না। মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। শেষ অব্দি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ওপরেই তো লেখা দাঁড়ায়।” সুনীল, থুড়ি, নীললোহিত সে-কথা রেখেছিল। কত মানুষের আনাগোনা ওর ভ্রমণকথায়। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালি। এক সময় তো ওর একটা বদনামই হতে শুরু করল যে বিদেশে যাদের আতিথ্য, সমাদর পান সুনীল, তাদের নিয়ে ফলাও করে লেখে নীললোহিত। সূত্র কিংবা রহস্য একটাই। যা ধরানো আছে ওর শেষ দিকের এক উপন্যাসের শিরোনামে‘সত্যি মিথ্যের মাঝখানে’। এক সোনালি মধ্যবর্তিতায় নীললোহিত পূর্ব ও পশ্চিমের বাঙালিকে এক আলিঙ্গনে বেঁধেছেন। জীবনের সত্য ও সাহিত্যের সত্যকে একাকার করেছে কী এক রসালো মিথ্যের পুলটিসে। অবশেষে উল্লেখ করতেই হয় ‘নীললোহিতের চোখের সামনে’ বা ‘নীললোহিতের মনের আয়না’ সিরিজের রচনাগুলোর। এ রকম এক রচনায় প্রিয় গায়িকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সতর্ক করেছে নীলুফের ওই সুন্দর মুখের সামনে বই ধরে গাইলে কেতাবটা ও ছিনিয়ে নিয়ে পালাবে। কণিকাদি সে-লেখা পড়ে বিস্তর হেসেছিলেন। ওঁর নিজের মুখে শোনা। নীললোহিত তারপর এক সময় সবাইকে মাত করে দিল অমর উস্তাদ আমির খান সাহেবকে নিয়ে এক অপূর্ব উপন্যাস লিখে। আনন্দবাজারের করিডরে আমাকে বলেছিলেন, “তোমার প্রিয় লোককে নিয়ে লিখে দিলাম।” কেন যে সেদিন বলতে ভুলে গিয়েছিলাম “আর টাইটেল করলেন বাঙালির এক প্রিয়তম মানুষের প্রিয়তম গানের কথায়!” নিধুবাবুর গান ‘তোমার তুলনা তুমি’!   নীলুর পূর্বপুরুষ সুনীলদা’র একটা মহাদোষ এখন চোখে পড়ছে। এত অসংখ্য সাক্ষাৎকার দিলেন ভদ্রলোক, কিন্তু তার সবই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়ানে। কেন কতিপয় নীললোহিতের বয়ানে নয়? কারণ নীললোহিত কেউকেটা নয় বলেই? নাকি সাক্ষাৎকার দেবার মতো কিছু করে উঠতে পারেনি বলে? তা হলে নিজেকে নিয়ে জীবনের ওই সাতাশ বছরে দাঁড়িয়ে এই এত-এত, এত-এত লিখল কেন সে? যাতে কি না একটা বড়সড় নীললোহিত জীবনীই দাঁড়িয়ে গেল। আমার মাঝে-সাঝে মনে হয় সুনীলের ‘অর্ধেক জীবন’ স্মৃতিকথা আরও জমত ( কে জানে হয়তো আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্যও হত!) নীললোহিতের বয়ানে। ভাবুন তো, সুনীল বা শক্তিকে কি আলাদা করা যায় তাঁদের রচনা থেকে? ‘অবনী বাড়ি আছো’ বলে মধ্যরাতে ডাক পাড়ে কে, এ প্রশ্ন আর ইস্কুলের ক্যুইজেও ওঠার নয়। তেমনি ধারা নীলে সুনীলে। ওঁদের লেখালেখির ইউএসপি-ই ওঁদের উড়নচণ্ডী, বারমুখো ব্যক্তিত্ব। দল বেঁধে রাত শাসন করব, কিন্তু জীবনের শাসন মানব না। কবিতার জন্য অমরত্বও প্রত্যাখ্যান করব, কিন্তু ভালবাসার জন্য কাঙালপনা ছাড়ব না এ জীবনে। যে-ভালবাসা শুধু নারী ও নীরায় বাঁধা থাকবে না, ছাড়িয়ে যাবে হিল্লিদিল্লি, কুমিল্লা, কেরল, তিন সমুদ্র সাতাশ নদী। যেমন গিয়েছিল শ্রীকান্তর, নীললোহিতের বিখ্যাত পূর্বপুরুষ। যে জীবনকথা শুরুই করেছিল এই বলে: ‘‘আমার এই ‘ভবঘুরে’ জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে! ছেলেবেলা হইতে এমনি করিয়াই তো বুড়ো হইলাম। আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের মুখে শুধু একটা একটানা ‘ছি-ছি’ শুনিয়া শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত ‘ছি-ছি-ছি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবিতে পারি নাই। কিন্তু কি করিয়া যে জীবনের প্রভাতেই এই সুদীর্ঘ ‘ছি-ছি’র ভূমিকা চিহ্নিত হইয়া গিয়াছিল, বহুকালান্তরে আজ সেই সব স্মৃত ও বিস্মৃত কাহিনীর মালা গাঁথিতে বসিয়া যেন হঠাৎ সন্দেহ হইতেছে, এই ‘ছি-ছি’টা যত বড় করিয়া সবাই দেখাইয়াছে, হয়ত তত বড়ই ছিল না।’’ শ্রীকান্ত বাংলা সাহিত্যের প্রিয়তম নায়কচরিত্র কি না এ নিয়ে ইস্কুলজীবনে ঘোর আলোচনায় জড়াতাম। একবার তার সঙ্গে ‘শেষের কবিতা’-র অমিট রে-কে তুলনায় আনতে গিয়ে এক বন্ধু তর্কে গোহারান হেরেছিল। আজও মনে হয় শ্রীকান্ত-র কোনও রাইভ্যাল তৈরি হয়নি, কারণ নারীপুরুষ নির্বিচারে এমন প্রেমে পড়ার চরিত্র পাওয়া কঠিন, অথচ যাকে প্রেমের ফাঁদে বেঁধে ফেলাও কঠিন। অনেকটা মহাভারত-এর অর্জুনের মতো। যিনি যেখানে গেছেন প্রেমে পড়েছেন, বিয়েও করেছেন, তারপর ফের নিজের জগতে। রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদও শ্রীকান্ত ঘরানার ছোকরা। লেখকের বর্ণনায় ‘‘তারাপদ হরিণশিশুর মতো বন্ধনভীরু, আবার হরিণের মতো সংগীতমুগ্ধ। যাত্রার গানেই তাহাকে প্রথম ঘর হইতে বিবাগী করিয়া দেয়। ... কেবল সংগীত কেন, গাছের ঘন পল্লবের উপর যখন শ্রাবণের বৃষ্টিধারা পড়িত, আকাশে মেঘ ডাকিত, অরণ্যের ভিতর মাতৃহীন দৈত্যশিশুর ন্যায় বাতাস ক্রন্দন করিতে থাকিত, তখন তাহার চিত্ত যেন উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিত।’’ ফলে সব সম্পর্কবন্ধন থেকে তার ক্রমশ পালিয়ে যাওয়া। শরীরে গভীর রোগ বাসা বাঁধার পরেও যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নেই কথায় যেখানে সেখানে পাড়ি দিতেন, তা নিছকই ভ্রমণবিলাসিতা থেকে নয়, অনেকটাই ওঁর ভেতরের ওই নীলুর টানে, নীলুকে জিইয়ে রাখার জন্য। উনি বুঝতেন যে খ্যাতি, প্রতিপত্তি ওঁকে ওঁর ওপর হামলে পড়ার লোকজন জুটিয়েছে, কিন্তু ভেতরের নীলুকে দিশেহারা করেছে। যে-নীলুকে এক সময় বুকে হাত রাখলেই ছুঁতে পারতেন তাকে ক্রমশ নতুন নতুন লেখায় অনুমান ও কল্পনা করে নিতে হচ্ছিল। বাঙালি সুনীল-অনুরাগীদের মধ্যে ভোটাভুটি হলে মেয়েদের ভোটে সুনীলকে এখনও হয়তো জোর লড়াই দেবে নীলু। একটা ছোট্ট দৃশ্যের উল্লেখ করব। ২০০৮ সালের। আমেরিকা থেকে সস্ত্রীক ফিরছিলাম জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে। ট্রানজিট দিয়ে কলকাতার প্লেন ধরতে যাচ্ছি, হঠাৎ সেখানে সুনীল-স্বাতীর সঙ্গে দেখা। ওঁরা আমেরিকার প্লেন ধরার জন্য বসে। কোট-প্যান্ট  পরেও কীরকম উস্কোখুস্কো চুল আর উদাস রোম্যান্টিক চাউনিতে সুনীলকে মনেই হল না সুনীল। যেন সদ্য পরিচয় হওয়া কোনও মেয়ের সঙ্গে নীললোহিত। ওঁর সেই হাত নাড়াটা রেল স্টেশন বা জাহাজ বন্দরের হাত নাড়া, মিলিয়ে যাবার আগে। অন্য ভাবে বললে, নীললোহিতের মধ্যে একটা ক্ষণিকের অতিথি ভাব আছে। এক অমলিন, কিন্তু চাপা যৌন আকর্ষণ। খেয়ালখুশির বশে কখনও কখনও ও কবিতার মতো সত্যি কথা বলে। অথচ কথা ও কাজের দায়িত্বের মধ্যে নেই। আজকের পেজ-থ্রি, পেজ-সিক্স জমানার ছেলেমেয়েরা ওর কতটা কী ধরতে পারবে বলা কঠিন। কবি সুনীল ভক্ত ছিলেন বোদলেয়ারের। ওঁর প্রিয় মার্গারিটের টান ছিল আপোলিনেয়ারের কবিতার প্রতি। তবে নীললোহিত যদি কোনও কবিকে রোল মডেল করত তো তবে সেটা অপূর্ব প্রতিভার বাউন্ডুলে চূড়ামণি রাঁবো। আফ্রিকাতে যাঁর অকালমৃত্যুতে বন্ধু, প্রেমিক ও কবি পোল ভের্লেন লিখেছিলেন: ‘‘তুমি, আমার যাদুকরী কবিতা/ আমার সবজান্তা দর্শন,/আমার স্বদেশ ও বাউন্ডুলে বোহেমিয়া,/ সব মৃত? তা হলে আমারই জীবনটা নিয়ে বাঁচো!’’ মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠলে সুনীলদা বলতেন, মৃত্যু কেবল একটা ইতি। একটা শেষ। তার বেশি কিছু নয়। অথচ আমাকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওঁর খুব ইচ্ছে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে (যেখানে সম্রাট নেপোলিয়ান শুয়ে আছেন) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার। আরেকবার পুরীর সমুদ্রে স্নান করতে করতে বললেন, এই তো বেশ হয় যদি স্রোতের টানে অজানা কোথাও ভেসে চলে যাই। এই মৃত্যুবাসনাগুলো এখন মনে হয় শ্রীমান নীললোহিতের। শেষ অবধি নীললোহিতের যেটা দুর্মর আকর্ষণ ছিল সেটা ওর সত্যি-মিথ্যে চেলে বলে যাওয়া, কিন্তু সারাক্ষণ অদ্ভুত বেদনা ও রসবোধ মিশিয়ে। পড়তে ভাললাগার এক নতুন মাত্রা খাড়া করেছিল সে। এবং বলা বাহুল্য, সব পুরস্কার টুরস্কার হাতিয়েছেন সুনীল, নীললোহিতের ঘটে লবডঙ্ক। এবং সেটাই সমীচীন, কারণ  মঞ্চে তুলে খেতাব, পদক, চেক দেবার প্রস্তাব দিলে নীললোহিতকে নিশ্চিত করে বরাবরের মতো আফ্রিকায় হারিয়ে যেতে হত। রক্তে নীলুর রাঁরো, শ্রীকান্তর ডিএনএ না!


No comments:

Post a Comment