
বন উৎসর্গ করেন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অসংখ্য দেশপ্রেমিক। পাকিস্তানি বুলেটও সেদিন তাদের দমাতে পারেনি। সেদিনের সেই আত্মদানই পরবর্তীকালে রূপ নিয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে। রচিত হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। এরই ধারাবাহিতায় বাঙালির গৌরবময় অর্জন স্বাধীন 'বাংলাদেশ'। ভাষার জন্য জীবন দেয়ার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। অসংখ্য মানুষের জীবন উৎসর্গের মাধ্যমেই বাংলা আজ বিশ্বের অন্যতম ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ২০০০ সালে আমাদের এ গৌরবের দিনটি পায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও সরগরম হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা ফিরে তাকাই আমাদের শিকড়ের দিকে। আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নতুন করে আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়। সঙ্গত কারণেই ভাষার মাস নিয়ে আমাদের মধ্যে একটি অন্য রকম আবেগ কাজ করে। সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ থাকে মাসজুড়েই। তবে যে ভাষার জন্য তরুণরা জীবন উৎসর্গ করেছিল সেই বাংলা ভাষাকে আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রচলন নিশ্চিত করতে পারিনি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিচ্ছি। সাইনবোর্ড, ব্যানার, বিজ্ঞাপন, সরকারি দপ্তরের নথি, সংবাদপত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই রয়েছে ভুল বানানের ছড়াছড়ি। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম করেছে, অথচ আমরা বাংলা লিখছি যে যার ইচ্ছামতো। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যে উচ্চমর্যাদা প্রাপ্য ছিল, আমরা তা আজও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। কেবল কাগজে-কলমেই বাংলা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে এখনো বাংলা ভাষার ব্যবহার খুবই কম। এখনো সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ইংরেজি ভাষা। বেসরকারি খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা ভাষার স্থান নেই বললেই চলে। ১০০ বছর আগেও একটি ভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুধু ইংরেজি নয়, ১৮টি ভাষায় দক্ষতা লাভের পরও বাংলাকে এগিয়ে নিয়েছেন। জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীরাও বাংলায় তাদের গবেষণাপত্র ও অন্যান্য রচনা উপস্থাপন করেছেন। তাই কেবল আনুষ্ঠানিকতা ও আবেগের মধ্যে থাকলেই হবে না, বাংলা ভাষায় উচ্চতর গবেষণা, উচ্চশিক্ষা এবং প্রাত্যহিক জীবনে শুদ্ধরূপে ভাষা চর্চার জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেখানে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। এটাই ভাষার মাসের ডাক। আর এটাই হওয়া উচিত আমাদের প্রত্যাশা ও লালনের কেন্দ্রবিন্দু। এআর/ এএইচ
No comments:
Post a Comment