গে তো বটেই- বক্তৃতা প্রদানের সম্পর্কটা তেমন স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। স্কুলের লেখাপড়ায় মৌখিক ও লিখিত- এ দু’ধরনের পাঠ থাকে। একজন ঔপন্যাসিকের জন্যে শেষোক্তটাই শ্রেয়। ঔপন্যাসিক বলার পটুতার চেয়ে লেখার প্রতিভায় বেশি পারদর্শী। তাই তিনি চুপচাপ থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনো বাহ্যিক আবহকে অন্তর্গত সৃজনশীলতার রসে সিক্ত করার তাগিদ অনুভূত হলে তাকে মিশে যেতে হয় মানুষের ভিড়ে। তাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকেও তিনি চারপাশের মানুষের কথাবার্তা শুনে থাকেন। আর তাদের আলাপচারিতায় যোগ দিয়ে তাদের সম্পর্কে তার যে ধারনা- সেটাকে বিচক্ষণতাপূর্ণ প্রশ্নের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করেন । দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে বলেই তিনি লেখালেখির সময় বেশ কাটাকুটি করেন। অবশ্য বার বার কাটাকুটির ফলে শেষতক তার শৈলীর ফটিক স্বচ্ছতা ফুটে ওঠে। কিন্তু সমাবেশে সরাসরি বক্তব্য দেয়ার সময়ে হোঁচট খেলে তা আর সংশোধন করবার সুযোগ থাকে না। ছেলেবেলায় আমি এমন এক প্রজন্মে বড় হয়েছি যেখানে বড়দের সামনে ঘোরাফেরা করা কিংবা তাদের আলাপচারিতা শোনা অল্পবয়েসীদের জন্য বারণ ছিল। দু’চারটা বিশেষ ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটতো অথবা বড়দের অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে হতো। সে কারণেই আমাদের কারো কারো স্বচ্ছন্দে কথা বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। ভুগতে হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে। আমাদের বলার মাঝখানে কেউ আমাদের অনায়াসেই থামিয়ে দিতে পারে- সে ভয়ে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো করে কথা শেষ করতে চাই। সম্ভবত সে কারণেই অন্য অনেকের মতো বালকবেলা থেকেই লেখালেখির ব্যাপারটা আমাকেও পেয়ে বসে। সে বয়েসে মনে প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা জাগে, বড়রা আমাদের লেখাগুলো পড়ে আমাদের মনের কথা বুঝবেন। লেখার মাঝখানে বড়রা আমাদের থামিয়ে দিতে পারবেন না বলেই এ মাধ্যমটা বেছে নেই। ভাবি, এ পন্থায়ই তারা আমাদের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আসল কথাগুলো শুনতে পাবেন। আমাকে এ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাটা আমার কাছে নিতান্ত অবাস্তবই ঠেকেছে। তাই আমাকে বেছে নেবার কারণটা জানবার জন্যে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। কোনো ঔপন্যাসিক নিজের লেখা বই সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ থাকতে পারেন; তিনি যা লিখেছেন, সে সম্পর্কে লেখকের চেয়ে তার পাঠকেরা কতটা বেশি ওয়াকিবহাল থাকতে পারেন- সেদিনই তা টের পেলাম। মনে হয় সে ব্যাপারটা এত গভীরভাবে আগে কখনো বুঝতে পারিনি। কোনো ঔপন্যাসিকই কখনো নিজে তার বইয়ের পাঠক হতে পারেন না। তবে যখন তিনি পান্ডুলিপি থেকে বাক্যপ্রকরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনাবশ্যক পুনরাবৃত্তি ও বাহুল্য অনুচ্ছেদ দূর করার জন্য ঘঁষামাজা করেন- কেবল তখনই তিনি নিজের বইয়ের পাঠকের ভূমিকা নিতে পারেন। নিজের উপন্যাস সম্পর্কে তার ধারণা খণ্ডিত, বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট। খুব কাছ থেকে রূপায়ণ করবার কারণে শিল্পী তার রূপায়িত চিত্রের সামগ্রিক রূপ ধরতে পারে না। লেখালেখি এক অদ্ভূত, অপরূপ ও নিঃসঙ্গ শিল্পকর্ম। উপন্যাসের প্রথম কয়েক পাতা লিখবার পর্যায়ে ভর করে হতোদ্দম। প্রতিদিনই মনে হয়- এই বুঝি ভুল পথে চলে এলাম। এ দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি হয় পেছনে ফিরে গিয়ে ভিন্ন কোনো নতুন পথে চলাবার তাড়না। তবে এ রকম অনুভূতিকে উপেক্ষা করেই সামনে এগোনোর কাজটা করতে হয়। লেখালেখির সঙ্গে শীতের রাতে বরফাচ্ছন্ন রাস্তার শূন্যমাত্রার দৃশ্যমানতার তুলনা করা যায়। বিপরীতে ফিরবার পথ নেই; নেই কোনো বিকল্প। সামনেই এগোতেই হবে। যেতে যেতে নিজকে বুঝ মানাতে হবে- কুয়াশা সরে গেলে সামনে চলার পথ নির্বিঘ্ন হবে- তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো বই লিখে প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে মনে হতে পারে যে, বইটা বুঝি লেখকের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং শেষ হবার আগেই যেন বইটা মুক্তির শ্বাস নিতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মের ছুটি হবার আগের দিন ক্লাসের বাচ্চাদের হাবভাব যেমনটা হয়, বইয়ের আচরণও যেন সেরকমটাই হয়ে যায়। সেদিন স্কুলছাত্রদের মনোযোগে ছেদ পড়ে। আর আচরণে দেখা দেয় চঞ্চলতা। আরো খানিকটা এগিয়ে বলতে পারি- শেষ অনুচ্ছেদগুলো লেখার সময়ে লেখকের কবল থেকে অতি দ্রুত মুক্তি পাবার জন্যে বইটা যেন কিছুটা বৈরী ভাব দেখাতে শুরু করে। তখন ও এমনতরো ব্যস্ততা দেখায় যে, শান্তি মতো শেষ কথাগুলো লিখবার ফরসুত পর্যন্ত দিতে চায় না। বই লেখা শেষ- এবার লেখককে ওর আর কোনো দরকার নেই। ও লেখককে বেমালুম ভুলে যায়। এবার সে ওকে আবিষ্কার করে পাঠকদের ভিড়ের মাঝে। এ ঘটনা লেখকের মধ্যে সঞ্চার করে গভীর শূন্যতা এবং পরিত্যক্ত ভাব। একে এক হতাশাজনক অবস্থাও বলতে পারেন। কারণ লেখক ও বইয়ের মধ্যের এদ্দিনের নাড়ির বন্ধন নিদারুণভাবে এতো চটজলদি ছিন্ন হয়ে যাওয়া বড়ই বেদনাদায়ক। এ অতৃপ্তি ও অসম্পূর্ণ উদ্যমের অনুভূতি পরবর্তী বই লেখার স্পৃহা জাগায়-যাতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়- যদিও তা কখনো সম্ভব হয় না। বছরের পর বছর ধরে একটার পর একটা বই বের হতে থাকে, আর পাঠকদের মাঝে লেখকের সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকে। তো যা বলছিলাম। হ্যাঁ, লেখকের নিজের চেয়ে পাঠকরাই একটা বই সম্পর্কে বেশি জানেন ও বোঝেন। কোনো উপন্যাস এবং এর পাঠকদের মধ্যে যা ঘটে তা ডিজিটাল যুগের আলোকচিত্র প্রসেসের সঙ্গে তুল্য। অন্ধকার কক্ষে আলোকচিত্র প্রিন্ট করার সময় একটু একটু করে আসল ছবিটা ভেসে উঠতে উঠতে শেষতক পরিপূর্ণভাবে মূর্তমান হয়। আপনি যখন কোনো উপন্যাস পড়তে শুরু করেন; তখন সেই একই রাসায়নিক প্রক্রিয়া সঞ্চালিত হয়। কিন্তু লেখক ও পাঠকের মধ্যে এ রকম সঙ্গতি বজায় রাখবার জন্যে পাঠকের অতিমাত্রায় চাপ নেয়ার কোনো ব্যাপার নেই- যেমন আমরা গলা চড়িয়ে গায়কদের খোশামুদি করে থাকি। কিন্তু বইয়ের বেলায় লেখকের অগোচরেই একটু একটু করে এর গভীরে ঢুকে যাবার অনেক অবকাশ পাঠকের থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আঁকুপাংচার-এর কথাই ধরুন। স্নায়ুতন্ত্রের ঠিক ওই নির্দিষ্ট জায়গায়ই সূঁচটাকে ফোটানো হয় যাতে এর প্রবাহকে অবাধ ও নির্বিঘ্ন করা যায়। ঔপন্যাসিক এবং তার পাঠকদের মধ্যে এই যে অন্তরঙ্গ, ঘনিষ্ঠ ও পরিপূরক সম্পর্ক রয়েছে এর সঙ্গে সঙ্গীত ভূবনের একটা সাযুজ্য রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি সব সময়েই ভেবে এসেছি যে, লেখালেখির সাথে সঙ্গীতের একটা নিবিড় ঘনিষ্ঠতা আছে- যদিও সঙ্গীতের তুলনায় লেখালেখিটার পরিশুদ্ধতা খানিকটা কম। সঙ্গীতশিল্পীরা এমন একটা শিল্পকলার চর্চা করে থাকেন- যার শিল্পমান উপন্যাসের চেয়ে অনেক উন্নত। সে জন্যে আমি তাদের প্রতি খুবই ঈর্ষাপরায়ণ। কবিদের ক্ষেত্রেও তাই। তারাও ঔপন্যাসিকদের তুলনায় সঙ্গীতশিল্পীদের ঢের কাছাকাছি। বালকবেলায় আমি কবিতা লেখা শুরু করি। কোথাও এরকম একটা মন্তব্য শুনেছিলাম যে ‘ব্যর্থ কবিদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসে গদ্য লেখক।’ আর আমি নিশ্চিত,এ মন্তব্যটা আমার বেলায় সর্বাংশে সত্য। সঙ্গীতের চেয়ে বরং একজন ঔপন্যাসিক তার লেখার মাধ্যমে সব্বাইকে তুষ্ট করতে চায়। যে দৃশ্যপট, পথপ্রান্তর, ভূচিত্রে তিনি সঙ্গীতের স্বরগ্রামের সুরেলা টুকরোগুলোকে দেখতে পান সেগুলোই তার এক বইয়ের পর আরেক বইয়ে ছড়িয়ে দিয়েও তিনি বোধ করেন যে, যথাযথ পূর্ণতা না পেয়ে বরং এদের অঙ্গহানীই ঘটেছে।তখন সেই ঔপন্যাসিক একদিকে যেমন যথার্থ সঙ্গীতকার না হতে পেরে অনুতাপ করেন, অন্যদিকে, চপিন-এর মতো সুরযোজনা করতে না পেরে অনুশোচনা করেন। আমি আমার নিজের এবং অন্যান্যদের বেলায়ও লক্ষ্য করেছি যে, একটা কারণে ঔপন্যাসিকের সঙ্গে তার সাহিত্যকর্মের নিদারুণ দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং সচেতনতার অভাব দেখা দেয়। যখনই একটা নতুন বই লেখা হয় তখন সেটা আগের বইটাকে মুছে ফেলে। আর সেটা এমনভাবে বিলুপ্ত হতে থাকে, যেন আমি সেটার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। আমি ভাবতাম, একের পর এক আমি যে সব বই লিখে যাচ্ছি সেগুলোর একটা অন্যটা থেকে বিযুক্ত। এগুলো একের পর এক পালা বদলের ধারায় স্মৃতির অতলান্তিকে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু সচরাচর এদের মধ্যে রূপায়িত সেই একই মুখাবয়ব, একই নাম, একই স্থান, একই বুলি এক বইয়ের পর আরেক বইয়েবার বার ফিরে আসে। এ যেন আধো ঘুম, আধো জাগরণে দিবাস্বপ্নের মাঝে অভিন্ন ছাঁচে কাপড় বোনার মতো। ঔপন্যাসিক সচরাচর একজন নিদ্রাচারী এবং যা-ই তিনি লেখেন তাতে এতোটাই নিমগ্ন থাকেন যে, রাস্তা পার হতে গিয়ে তিনি গাড়ি চাপা পড়েন কিনা সে আশঙ্কায় সত্যি সত্যিই উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। তবে একথা ভুললে চলবে না যে, মেপে মেপে পা ফেলা অতি সাবধানী নিদ্রাচারীও কিন্তু ছাদের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পা পিছলে পড়তে পারেন। আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাপত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছে যে, ‘তিনি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিশ্বে জীবনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।’ ১৯৪৫ সালে আমার মতো আরো যারা প্যারিসে জন্ম নিয়েছে- তারা সবাই জার্মান অধিকৃত প্যারিসের সন্তান। তখনকার প্যারিসে যারা বসবাস করতো তারা যতো শিগগির সম্ভব সেসব দিনের কথা এবং নিদেনপক্ষে নিত্যদিনের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ ভুলে যেতে চাইতো।এমন একটা ঘোরের মধ্যে তাদের জীবন কেটেছে যে, তারা স্বাভাবিক জীবন যাপনের সঙ্গে এর কোনো ফারাক করতে পারতো না। দারুণ অনিশ্চয়তা আর সন্তাপের মধ্যে কোনো রকমে বেঁচে থাকার সে-দিনগুলো ছিল এক দুঃস্বপ্ন। পরবর্তীতে যখন তাদের ছেলে মেয়েরা সেই আমলটা সম্পর্কে জানতে চাইতো- তখন তারা চাতুর্যের সঙ্গে সে-প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতেন। অথবা এমনভাবে নীরব থাকতেন যেন তারা তাদের স্মৃতি থেকে সেই অন্ধকার সময়টাকে মুছে ফেলতে চান, কিংবা আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকোতে চান। মা-বাবাদের এমন নীরবতার মুখোমুখি হয়ে আমরা সবকিছু এমনভাবে বুঝে নিতাম যে, যেন আমরা নিজেরাই তাদের সেই সময়টাতে জীবনযাপন করেছি। অধিকৃত সেই প্যারিস ছিল এক অদ্ভুত জনপদ। বাহ্যত জীবন যেন ‘আগের মতোই’ চলতো- নাট্যশালা, প্রেক্ষাগৃহ, সঙ্গীত নিকেতন, হোটেল-রেস্তোরাঁ স্বাভাবিকভাবেই খোলা থাকতো। বেতারে গান বাজতো। যুদ্ধের আগের সময়ের চেয়েও নাট্যশালা ও সিনেমাহলে দর্শক সমাগম হতো অনেক বেশি। পরিস্থিতিটা এমন যে, পরস্পরের ওপর ভরসা করার কোনো উপায় না থাকায় আশ্রয়স্থল বিবেচনা করে লোকজন সেগুলোতে জড়ো হয়ে গাদাগাদি করে বসতো। এ উদ্ভট অবস্থার বর্ণনা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, প্যারিসের অবস্থা মোটেই আগের মতো স্বাভাবিক ছিল না। গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ না থাকায় চারদিক ছিল নীরব-নিঝুম। সেই নিস্তব্দতার মধ্যে বেজে উঠতো শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি, ঘোড়ার খুড়ের শব্দ, জনসমাগমের পদধ্বনি, কণ্ঠের গুনগুনানি। রাস্তাঘাটের ভূতুড়ে নিস্তব্দতার মাঝে শীতকালে বিকেল ৫ টায় বন্ধ করে দেয়া হতো বিদ্যুৎ সরাবরাহ। জানলাপথের ক্ষীণ আলোর রেখার ওপরও ছিল নিষেধাজ্ঞা। সমস্ত শহর যেন নিজের মধ্যে নিজেই হারিয়ে যেত। নাৎসি দখলদাররা মজা করে বলতো- ‘নেত্রহীন নগর’। বয়স্ক এবং বাচ্চাকাচ্চারা মূহুর্তের মধ্যে এমনভাবে গুম হয়ে যেতো যে তাদের আর কোনো হদিসই মিলতো না। বন্ধুবান্ধবরা নিজেদের মাঝে মন খুলে কোনো কথাবার্তা বলতো না। কারণ সবখানে বিরাজ করতো এক ভীতিকর আবহ। এ দুঃস্বপ্নের প্যারিসের মেট্রো-স্টেশন থেকে কখন-যে কাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, কার ওপর দোষারোপের খড়গ নেবে আসবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। শান্তির সময়ে ভুলেও কেউ যে পথ মাড়াতো না সেরকম ঘুপচি পথে কখনো-সখনো কারো-কারো সঙ্গে দৈবাৎ দেখা সাক্ষাত হয়ে যেত। প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের বীজ সান্ধ্যআইন জারি থাকা অবস্থায়ও অংকুরিত, পল্লবিত, বিকশিত হতো। কিন্তু ভবিষ্যতে জীবনে কখনো আবার দু’জনের দেখা মিলবে কিনা- সে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এর অনিবার্য ফলাফল হলো প্রেমের অকালমৃত্যু এবং কখনো কখনো এমন বিচ্ছিরি মেলামেশার ফলে জন্ম নিতো কোনো অনাকাংখিত শিশু। সে কারণেই নাৎসি দখলদারিত্বের প্যারিসকে আমি সব সময় আদিম অসভ্যতার অন্ধকার যুগ বলে বিবেচনা করে আসছি। অবশ্য এমনটা না হলে আমার লেখক মানসেরও জন্ম হতো না। সেই প্যারিস কখনো আমার পিছু ছাড়তো না। আর আমার বইগুলো অবগুণ্ঠিত আলোর অন্তরালেই হারিয়ে যেত। এভাবেই একজন লেখক জীবনের বাস্তবতা থেকে পালিয়ে সন্নাসজীবন গ্রহণ করে কিংবা নিভৃতচারী হয়ে অথবা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না জড়িয়েও-যে তার জন্ম তারিখ ও তার কাল দ্বারা অমোছনীয়ভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন- সেটা তারই প্রমাণ। তিনি যদি কবিতা লেখেন তাহলে তিনি যে কালের কবি, সেই কবিতাগুলোতে ওই কালেরই প্রতিফলন ঘটান এবং অন্য কোনো যুগে এ ধরনের কবিতা কোনো দিনই লেখা হবে না। আইরিশ কবি ইয়েটস-এর কবিতার বেলায় এ কথাটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার ‘দি ওয়াইল্ড সোয়ান্স এ্যাট কুলি’ আমাকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করে। পার্কের একটা লেকে ইয়েটস দেখতে পান যে, ক’টা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে- যা তিনি শৈল্পিক মুন্সিয়ানায় কাব্যরূপ দিয়েছেন...। ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিতায় মরালের প্রতীকী উপস্থিতি ছিল হরহামেশা। বোঁদলেয়ার বা মালার্মের কবিতায় এর ভুরি ভুরি প্রমাণ মিলবে। কিন্তু ইয়েটস-এর এ কবিতাটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা যেতো না। এ কবিতার একটা স্বকীয় ও নির্দিষ্ট যুৎসই ছন্দমাত্রা রয়েছে; রয়েছে একটা বিষন্নতা বা বিষাদগ্রস্ততার ভাব- যা কবিতাটিকে বিংশ শতাব্দীর সঙ্গে- এমনকি যে বছরে তিনি সেটা লিখেছেন- সে নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতাকে এঁটে দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে বিংশ শতাব্দীর কোনো লেখকও নিজেকে তার সময়ের বন্ধনে আবন্ধ বলে ভাবতে পারেন। আর ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিক বলজাক, ডিকেন্স, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কিও খানিকটা স্মৃতিবিধুরতার আবহ দিতে পারেন। সেকালে সময় চলতো একালের চেয়ে ধীরগতিতে এবং এ মন্থর গতি ঔপন্যাসিকের লেখার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যেতো এ কারণে যে, এটা তাকে তার শক্তি-সামর্থ এবং মনন-মতিকে শাণিত করার সুযোগ করে দিতো। এর পর থেকে সময় আরো গতিশীলতা পেয়েছে এবং ক্ষীপ্র গতিতে সামনের দিকে ছুটে চলেছে উদ্দীপ্ত বেগে। আর অতীতের আকাশচুম্বী সাহিত্য ইমারতের সঙ্গে গির্জার মতো স্থাপত্যশিল্প এবং একালের অসন্ধিত, বিযুক্ত, অসংলগ্ন, ভগ্ন ও খণ্ডিত শিল্পকর্মের প্রভেদটা কেমন- সেটাই বিবৃত করছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, এখন আমার প্রজন্মের ক্রান্তিকাল চলছে। আর আমার জানবার কৌতূহল এটাই যে, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, এবং টুইট-এসব সুবিধাদির মাঝে আমার যে পরবর্তী প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে, কেমন করে সাহিত্যে সে জগৎটাকে নিরন্তর রূপায়িত করছে- যে জগতের সঙ্গে প্রত্যেকেই যুক্ত রয়েছে এবং যেখানে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম আমাদের সেই অন্তরঙ্গতা ও গোপনীয়তাকে গ্রাস করছে। কদিন আগেও আমাদের আপন ভূবনে অবলীলায় বিরাজ করতো। সেই একান্ত গোপনীয়তা ব্যক্তিবিশেষকে যে গভীরতা দেয় তা যেকোনো উপন্যাসের মূল উপজীব্য হতে পারে। তবে আমি সাহিত্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী এবং নিশ্চিত যে, মহাকবি হোমার থেকে শুরু করে সকল প্রজন্মের লেখকরা যেমনি রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন, আমাদের উত্তরসূরী লেখকরাও সাহিত্যের তেমনি সুরক্ষা করবেন। অন্যান্য শিল্পীর মতোই প্রত্যেক লেখক তার যুগের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংলগ্ন থাকেন- যা তিনি এড়াতে পারেন না। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার যুগভাবনা। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক লেখক তার সাহিত্যকর্মে কালোত্তীর্ণ কিছুর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। রেসিন বা শেক্সপিয়র-এর নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে সেটা তেমন জরুরি নয় যে, চরিত্রাভিনেতাদের ওই যুগেরই পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে হবে অথবা পরিচালক তাদেরকে জিন্স ও চামড়ার জ্যাকেটই পরিয়ে দিবেন। এগুলো নিতান্তই তুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয়। তলস্তয় পড়ার সময় অ্যানা কারেনিনাকে আমাদের এতো কাছের বলে মনে হয়; দেড় শতাব্দী পরও আমরা বেমালুম ভুলে যাই-যে তিনি ১৮৭০ সনের সাজপোশাক পরে আছেন। আবার এ্যাডগার এলেন পো, মেলভিল বা স্তদল-এর মতো এমন অনেক লেখকও আছেন- যাদের লেখার সাহিত্যমূল্য তাদের সমকালীন পাঠকদের চেয়ে তাদের মৃত্যুর দু’শতাব্দীর পরের পাঠকরা আরো গভীরভাবে উপলব্দি করেছেন। শেষ বিচারে কতকাল অব্দি কোনো ঔপন্যাসিক বেঁচে থাকেন? বাস্তব জগতের যেসব মানুষ লেখককে বিভিন্ন চরিত্র চিত্রণে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে লেখকের যে খানিকটা দূরত্ব থাকে সে ব্যবধান লেখকের ক্ষমতাকে সীমার বাঁধনে বাঁধতে পারে না। ফ্লাবার্ট বলেন, ‘মাদাম বোভারি আমিই’ এবং তলস্তয় তাৎক্ষণিক সেই মহিলাকে শনাক্ত করে ফেলেন যাকে রাশিয়ার একটা রেলস্টেশনে এক রাতে তিনি ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছেন। এমন শনাক্তকরণের সওগাতের বিস্তার এতোটাই প্রসারিত হয়েছে যে, তলস্তয় আকাশ আর মাটির চিত্রকল্পকে এমনি একাকার করে বর্ণনা করেছেন, যেন তিনি এর মধ্যে পুরো নিবিষ্ট হয়ে আছেন। এতে অবশ্য এক ধরনের নিঃসঙ্গতারও ইঙ্গিত আছে। তবে এর অর্থ কিন্তু এ নয় যে, এটা অন্তর্মুখিতা। বরং বাইরের জগৎটাকে নিরিক্ষণকালে তা টান টান চিত্তবৈভব ও অতি সহজবোধ্যতার সুযোগ সৃষ্টি করে। আর তখন সেটা পক্ষান্তরে উপন্যাসেই ঠাঁই করে নেয়। আমি সবসময়েই ভাবি যে, কবি এবং ঔপন্যাসিকরা সে সব মানুষের মধ্যে একটা রহস্যময়তা ছড়িয়ে দিতে পারেন যারা বাহ্যত প্রাত্যহিকতায় এবং মামুলি বিষয়ে সমাচ্ছন্ন থাকেন। এর কারণ হলো এরা তাদের সম্মোহিতের মতো গভীর মননে বারংবার পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এদের এ অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মাঝেই ঘটে তাদের নিত্যদিনের যাপিত জীবনের যবনিকাপাত। আর এভাবেই রহস্য উম্মোচিত হতে হতে এক সময় অন্ধাকারে ফুটে উঠে দীপ্তির ছটা- যা তাদের অনেক গভীর গহ্বরে লুকোনো থাকে বলে প্রথম দর্শনে দৃষ্টিগোচর হয় না। কবি, ঔপন্যাসিক এবং চিত্রশিল্পীর ভূমিকা হলো সেই রহস্য ভেদ করা এবং আঁধার কুঠরিতে উজ্জ্বল আলোর বিকাশ ঘটানো- যা প্রতিটি মানুষের গহন গভীরে লুক্কায়িত। আমার দূরবর্তী আত্মীয় চিত্রশিল্পী এমেডিও মদিগলিয়ানির কথা মনে পড়ে। তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী চিত্রকর্মের মডেল হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন নামপরিচয়হীন লোকদের, রাস্তার ছেলেমেয়ে, উদ্বাস্তু, গৃহকর্মী, ক্ষুদ্র কৃষক আর তরুণ শিক্ষানবিসদের। তুলির মমতার আঁচড়ে তিনি তাদের মূর্তমান করেছেন গভীর ঐকান্তিকতায়। তাদের দিয়েছেন না বলে বরং বলা যায় রূপায়িত করেছেন- তাদের গোবেচারা চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লাবন্য ও মহত্ত্বকে। ঔপন্যাসিক তার সাহিত্যকর্মের অভিযাত্রায় ওই বাস্তবতার কোনো বিকৃতি না ঘটিয়েই এর গভীর তলদেশ থেকে মূলত তুলে আনেন সেই প্রকৃতবাস্তবকেই । অবলোহিত ও অতিবেগুনী শক্তিবলে তিনি তাদের বাহ্যিক চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লালিত্যকে বের করে আনেন। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, ঔপন্যাসিক অন্তর্দৃষ্টিমান কিংবা দৃকশক্তিমান স্বপ্নদর্শীর মতো সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে তা করে থাকেন। তিনি যেন কেবলমাত্র বোধগম্য কম্পন অনুভব করবার জন্যে ভূকম্পবিদের মতো গিরিশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকেন। গুনমুগ্ধ পাঠক হিসেবে আমি কোনো লেখকের জীবনী পড়বার আগে অন্তত দু’বার ভাবি। জীবনীকাররা কখনো কখনো তুচ্ছ খুঁটিনাটি নিয়ে মাতামাতি করেন। নির্ভর করেন অসমর্থিত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের ওপর । তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো সৃষ্টি করে গোলক ধাঁধাঁ কিংবা চরম হতাশা। সম্প্রচারের সময় রেডিওতে গ্যাড় গ্যাড় আওয়াজ হলে সঙ্গীত শোনা যেমন অসম্ভব হয়ে পড়ে, এ ব্যাপারটাও তেমনি। তাই একজন লেখককে প্রকৃতই জানবার উপায় হলো তার লেখা বই পড়া । এভাবেই তার সঙ্গে আমাদের সখ্য গড়ে ওঠে। আর সেটা তখনই ঘটে যখন তিনি তার সবটাই উজাড় করে দেন এবং তিনি আমাদের সঙ্গে সংলাপ করেন অত্যন্ত নিম্নস্বরে। তবুও আপনি যখন কোনো লেখকের জীবনী পড়েন তখন আপনি কদাপি বাল্যকালের এমন এক লক্ষণীয় ঘটনাকে আবিষ্কার করেন যা ভবিষ্যতের কোনো সাহিত্যকর্মের সেই বীজ বপন করে- যে সম্পর্কে তিনি আগ থেকেই স্পষ্টরূপে সচেতন থাকেন না। সে লক্ষণীয় ঘটনা সাহিত্যকর্মে হানা দেয়ার জন্যে নানা ছদ্মাবরণে বার বার ফিরে ফিরে আসে। আলফ্রেড হিচকক-এর কথাই ধরা যাক। তিনি লেখক নন, তথাপিও তার চলচ্চিত্রে উপন্যাসের ন্যায় শক্তিমত্তা, সঙ্গতি ও সংসক্তি রয়েছে। যখন তার ছেলের বয়স পাঁচ বছর, তখন হিচককের বাবা তার এক পুলিশ অফিসার বন্ধুর কাছে একটা চিঠি পৌঁছে দিতে বলেন। ছেলে যথারীতি চিঠিটা প্রাপককে পৌঁছে দেয়। কিন্তু ওই পুলিশ অফিসার ছেলেটাকে থানার সেই লক-আপে আটক করে রাখেন- যে সেলটা রাতভর অপরাধীদের বন্দী করে রাখার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আতঙ্কিত ছেলেটা ঘণ্টা খানেক হাজতবাসের পর ছাড়া পায়। এবার পুলিশ অফিসার ব্যাপারটাকে খোলাসা করে- ‘বুঝলে খোকা! জীবনে কোনো অপকর্ম বা মন্দ আচরণ করলে কী দশা হয় তা তোমার জানা হয়ে গেল।’ এ পুলিশ অফিসারটি শিশু-পালনের বিষয়ে তার সেই উদ্ভট ধ্যান-ধারনাসহ অবশ্যই পরবর্তীতে হিচককের সকল চলচ্চিত্রে চিত্রিত উদ্বেগ-উৎকণ্টার বাতাবরণের নেপথ্যে মদদ যুগিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনীর অবতারণা করে আমি আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, আমার শৈশবের নির্দিষ্ট কয়েকটি টুকরো টুকরো উপখ্যান যে বীজ রোপন করেছে তা পরবর্তীতে আমার উপন্যাস হয়ে উঠেছে। সচরাচর মা-বাবার সঙ্গে আমার থাকা হতো না। এমন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে থাকতাম যাদের সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানতাম না। একের পর এক বদল করতে হয়েছে এলাকা-বাড়ি-ঠিকানা। সে সময় একজন কিশোরের কাছে কোনো কিছুই বেখাপ্পা মনে হয়নি। এমনকি উদ্ভট ও আজগুবি পরিস্থিতিকেও অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হতো। এর অনেক দিন পর আমার শৈশব আমাকে হেঁয়ালিপনায় তাড়িত করেছে এবং আমার বাবা-মা যে সকল মানুষজন ও এলাকা ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন- তাদের আমি নিরন্তর খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু এরা এমনভাবে বদলে যেতে থাকলো- যে আমি তাদের অনেকেরই হদিস করতে পারিনি। পারিনি সে সব পুরনো এলাকা বা বাড়ি-ঘরগুলোকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে। এ বিভ্রান্তি দূর করবার চেষ্টায় ব্যর্থতা এবং রহস্যের জট খুলবার প্রয়াস আমার মধ্যে লেখালেখির স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। তখন এমন মনে হয়েছে যে, যেন এ লেখালেখি আর ভাব-কল্পনা আমাকে পরিশেষে ওই শিথিল সম্পর্ক- সূতোর প্রান্তগুলোকে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছে। আমরা যখন ‘রহস্য’ প্রসঙ্গে বলতে চাই- সে ভাবনার অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের মনে ভেসে ওঠে ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘লা মিস্টারেস দা প্যারিস’ নামের ফরাসি উপন্যাসটির কথা। এ শহর- দৈবক্রমে প্যারিস- যে শহরে আমার জন্ম-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার আশৈশব সম্পর্ক। এ পরিচয়ের বন্ধন এতোটাই নিবিড় আর গভীর যে, অদ্যাবধি আমি প্যারিসের রহস্যের সন্ধান করে যাচ্ছি নিরন্তর। আমার যখন নয় কি দশ বছর বয়েস- তখন এমন ঘটলো যে, আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে একাকি হাঁটতে শুরু করি- যদিও আমার হারিয়ে যাবার ভয় ছিল, তবুও আমি হেঁটেই চলেছি অবিরাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি আশপাশের এলাকা পার হয়ে অদ্দুর চলে গেলাম যে, আমি ঠিক সেইন নদীর তীরের অপরিচিত এলাকায় পৌঁছে গেলাম। আমার শুধুমাত্র ভরসা এটুকুই যে, তখন দিনের বেলা। বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর পর্যায়ে আমি ভয় কাটিয়ে দুঃসাহসী অভিযানে বেরিয়ে পড়তে- এমনকি মেট্টোতে চড়ে দূর-দূরান্তে চলে যেতেও কুণ্ঠিত হতাম না। ঠিক এভাবেই আপনি কোনো শহর সম্পর্কে জানতে পারেন। আমি যে ঔপন্যাসিকদের গুনমুগ্ধ তাদের অনেকেরই এ দৃষ্টান্ত আমি অনুসরণ করি এবং সেজন্যে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে প্যারিস, লন্ডন, সেন্ট পিটার্সবার্গ বা স্টকহোমের মতো শহর তাদের উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ও অন্যতম মূল উপজীব্য ছিল। যাদের লেখায় মানবিকতা আহুত, জাগ্রত ও আদৃত হয়েছে তাদের অন্যতম পথিকৃৎ এডগার এ্যালেন পো তার ‘দি ম্যান অব দি ক্রাউড’ ছোটগল্পে একটি রেস্তোরাঁর জানলা দিয়ে ফুটপাত ধরে লোকজনকে অন্তহীন যাত্রায় অবিরাম চলতে দেখেছেন। বেদস্তুর চেহারার একজনকে নির্দিষ্ট করে তার সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানবার আগ্রহে রাতভর তাকে লন্ডনের আনাচে কানাচে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু সেই অজানা-অচেনা লোকটি হলো জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো সাধারণ মানুষ। এমন লোকের পিছু নেয়া নিরর্থক। কারণ সে চিরদিনই নাম-পরিচয়হীন থেকে যায় এবং তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার কোনো আত্মপরিচয় থাকে না, থাকে না কোনো স্বকীয় অস্তিত্ব। সে সাধারণ লোকের ভিড়ের অন্যতম পথিকের মতো ঠেলাঠেলি, ঘেঁষাঘেঁষি, ধাক্কাধাক্কি করে জনস্রোতে চলতে চলতে যথারীতি পথের মাঝেই হারিয়ে যায়। আমি প্রসঙ্গত কবি টমাস ডি কুইন্সি’র বেলায় যেমনটা ঘটেছিল, এর উল্লেখ করছি। তরুণ বয়েসের একটা ঘটনা তার জীবনের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। লন্ডনে অক্সফোর্ডের রাস্তার ভিড়ের মধ্যে এক তরুণীর সঙ্গে দৈবক্রমে তার সাক্ষাৎ ও পরে বন্ধুত্ব হয়। তিনি দিন কতেক সে তরুণীর সাহচর্য পান এবং ক’দিনের জন্যে লন্ডন শহরের বাইরে যান। দুজন সম্মত হয় যে, হপ্তান্তে তারা আবার একই সময়ে, একই স্থানে, প্রতিদিন বিকেলে আগের মতো মিলিত হবে। কিন্তু আর কোনোদিন তাদের পরস্পরের দেখা হয়নি। নিঃসন্দেহে একই সময়ে তারা একে অন্যকে খুঁজে বেড়িয়েছে দিনের পর দিন। মহাব্যস্ত এই জটলা-জটিল লন্ডনে হয়তো তারা একে অন্যের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুটের দূরত্বে ছিল কিংবা এমন দূরত্বে ছিল যে-ব্যবধান লন্ডনের সুপরিসর রাস্তার চেয়ে অধিক ছিলনা। কিন্তু তাদের সেই স্বল্প দূরত্ব একদিন চিরবিচ্ছেদেই পর্যবসিত হলো। যে প্রতিবেশ ও পরিবেশে মানুষ জন্ম নেয় এবং বসবাস করে সেই চিরচেনা জনপদ, রাস্তাঘাট, খানিক দেখা, কোনো খেদ বা ক্ষণিকের সুখবোধ সময়ের আবর্তে সেই মানুষদের স্মৃতিকাতর করে। তরুণ বয়েস থেকেই আমি পুরনো ফরাসি টেলিফোন নির্দেশিকা ঘাটতাম। বিশেষত সড়কের নামের আদ্যাক্ষর ও বাড়ির নম্বরের ক্রমানুসারে গ্রাহকদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর যে নির্দেশিকায় ছাপানো হতো সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখতাম- যাতে সেগুলোকে আমার লেখালেখির কাজে লাগানো যায়। কারো কারো নাম পরের বছরের নির্দেশিকা থেকে বেমালুম উধাও হয়ে যেতো। এসব পুরনো নির্দেশিকা মাঝে মধ্যে নিজকে বোকা বানিয়ে ফেলে। কারণ, এতে লিখিত তথ্যানুযায়ী নম্বরগুলোতে ফোন করে কোনোই সাড়া পাওয়া যেতো না। আমার প্রথম বই লেখার স্পৃহা ও প্রেরণা আমি ওই পুরনো ফরাসি টেলিফোন নির্দেশিকা থেকেই পাই। আমি কিছু কিছু অপরিচিত লোকের নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর পেন্সিলে আন্ডারলাইন করে রাখতাম এবং হাজার হাজার লোকের ভিড়ে তাদের জীবন কেমন ছিল- এ বিষয়ে কল্পনা করতাম। বড় শহরে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। পারেন নিজেকে গোপন বা অদৃশ্য করে ফেলতে। আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় বদলে ফেলতে পারেন এবং নতুন এক জীবন শুরু করতে পারেন। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, ব্যক্তিপরিচয় বদল করা এবং সময় পরিক্রমার বিষয়গুলো বাস্তবে সেই শহরটার পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সে কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই শহরগুলোই হয়ে উঠেছে উপন্যাসের উপজীব্য-ক্ষেত্র। কোনো কোনো নামকরা শহর তো লেখকদের নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়েই আছে, যেমন- বলজাক ও প্যারিস, ডিকেন্স ও লন্ডন, দস্তয়ভস্কি ও সেন্ট পিটার্সবার্গ, টোকিও এবং নাগাই কাফু, স্টকহোম ও জালমার সডেরবার্গ। আমি সেই প্রজন্মের মানুষ- যা এ সকল ঔপন্যাসিকদের দ্বারা প্রভাবিত এবং যে প্রজন্ম যথাযোগ্য ও বিধেয় উপায়ে সে বিষয়টির অনুসন্ধান চালাতে চায়- যাকে বোঁদলেয়ার বলতেন ‘প্রাচীন শহরের সর্পিল ভাঁজ’। একথা সত্য যে, ৫০ বছর আগে, অন্য কথায়, আমার বয়ঃসন্ধিক্ষণে যে শহরকে আবিষ্কার করার জন্যে আমি তীব্র উত্তেজনা অনুভবের অভিজ্ঞতা অর্জন শুরু করেছি, সেই শহরে তখন চলছে নিরন্তর পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এদের কোনো কোনোটা- মার্কিন মুলুক এবং যে এলাকাকে লোকেরা তৃতীয় বিশ্ব বলে থাকে- সেগুলো জঞ্জালের নতুন মাত্রাযুক্ত করে মেগাসিটিতে পরিণত হয়। এর বাসিন্দারা অর্থনৈতিক বৈষম্যে শ্রেণীবিভক্ত হয়ে উপেক্ষা কিংবা অবজ্ঞার পাত্র হতে শুরু করে। সমাজকল্যাণমূলক সেবার আওতায় শুরু হয় এদের জীবন-যাপন। দিনকে দিন বাড়তে থাকে বস্তির সংখ্যা। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ঔপন্যাসিকরা নগরজীবন সম্পর্কে এক ধরনের রোমান্টিক ভাবধারা পোষণ করতো- যা ডিকেন্স বা বোঁদলেয়ার-এর ভাবদর্শন থেকে আলাদা কিছু নয়। সে কারণেই আমি জানতে আগ্রহী হই যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথাসাহিত্যিকরা কেমন করে কোলাহলপূর্ণ একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর বেসামাল নগরকে তাদের উপন্যাসের উপজীব্য করতে আহ্বান করবেন। আমার বই সম্পর্কে আপনারা দয়াপরবশ হয়ে উল্লেখ করেছেন যে, আমার সাহিত্যকর্ম ‘শৈল্পিক স্মৃতিগ্রন্থনা- যার মধ্য দিয়ে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের দুর্বোধ্য এবং অনায়ত্ত ভাগ্যের কথা।’ কিন্তু আমি আসলে যা- এ প্রশংসা তার চেয়ে অনেকখানিই বেশি। হারিয়ে যাওয়া হৈমশিলা আবার যেমন সমুদ্র-পৃষ্ঠে ভেসে উঠে- তেমনি বিস্মরণের সাদা কাগজটার প্রলেপ ভেদ করে বিবর্ণ ভাবনাগুলোকে বর্ণিল ও দৃশ্যমান করে ফুটিয়ে তোলাই একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পবৃত্তি। (সংক্ষেপিত)
Tuesday, January 13, 2015
প্যাত্রিক মোদিয়ানো’র নোবেল ভাষণ- ২০১৪ :Natun Barta
আজ আমি এখানে আপনাদের মাঝে আসতে পেরে খুবই আনন্দিত। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে আপনারা আমাকে যে সম্মান দেখিয়েছেন তাতে আমি অভিভূত এবং আবেগাপ্লুত। এ প্রথমবার আমি এত বড় দর্শক সমাবেশে বক্তব্য রাখছি। তাই আমি খানিকটা শঙ্কিতও বটে। অবশ্য বক্তব্য রাখা কোনো লেখকের জন্যে স্বাভাবিক ও সহজাত ব্যাপার বলেই অনেকই ভেবে থাকেন। কিন্তু বিষয়টা আদৌ তেমন নয়। অনেক ক্ষেত্রে একজন লেখকের- নিদেনপক্ষে একজন ঔপন্যাসিকের সঙ্
গে তো বটেই- বক্তৃতা প্রদানের সম্পর্কটা তেমন স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। স্কুলের লেখাপড়ায় মৌখিক ও লিখিত- এ দু’ধরনের পাঠ থাকে। একজন ঔপন্যাসিকের জন্যে শেষোক্তটাই শ্রেয়। ঔপন্যাসিক বলার পটুতার চেয়ে লেখার প্রতিভায় বেশি পারদর্শী। তাই তিনি চুপচাপ থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনো বাহ্যিক আবহকে অন্তর্গত সৃজনশীলতার রসে সিক্ত করার তাগিদ অনুভূত হলে তাকে মিশে যেতে হয় মানুষের ভিড়ে। তাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকেও তিনি চারপাশের মানুষের কথাবার্তা শুনে থাকেন। আর তাদের আলাপচারিতায় যোগ দিয়ে তাদের সম্পর্কে তার যে ধারনা- সেটাকে বিচক্ষণতাপূর্ণ প্রশ্নের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করেন । দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে বলেই তিনি লেখালেখির সময় বেশ কাটাকুটি করেন। অবশ্য বার বার কাটাকুটির ফলে শেষতক তার শৈলীর ফটিক স্বচ্ছতা ফুটে ওঠে। কিন্তু সমাবেশে সরাসরি বক্তব্য দেয়ার সময়ে হোঁচট খেলে তা আর সংশোধন করবার সুযোগ থাকে না। ছেলেবেলায় আমি এমন এক প্রজন্মে বড় হয়েছি যেখানে বড়দের সামনে ঘোরাফেরা করা কিংবা তাদের আলাপচারিতা শোনা অল্পবয়েসীদের জন্য বারণ ছিল। দু’চারটা বিশেষ ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটতো অথবা বড়দের অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে হতো। সে কারণেই আমাদের কারো কারো স্বচ্ছন্দে কথা বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। ভুগতে হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে। আমাদের বলার মাঝখানে কেউ আমাদের অনায়াসেই থামিয়ে দিতে পারে- সে ভয়ে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো করে কথা শেষ করতে চাই। সম্ভবত সে কারণেই অন্য অনেকের মতো বালকবেলা থেকেই লেখালেখির ব্যাপারটা আমাকেও পেয়ে বসে। সে বয়েসে মনে প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা জাগে, বড়রা আমাদের লেখাগুলো পড়ে আমাদের মনের কথা বুঝবেন। লেখার মাঝখানে বড়রা আমাদের থামিয়ে দিতে পারবেন না বলেই এ মাধ্যমটা বেছে নেই। ভাবি, এ পন্থায়ই তারা আমাদের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আসল কথাগুলো শুনতে পাবেন। আমাকে এ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাটা আমার কাছে নিতান্ত অবাস্তবই ঠেকেছে। তাই আমাকে বেছে নেবার কারণটা জানবার জন্যে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। কোনো ঔপন্যাসিক নিজের লেখা বই সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ থাকতে পারেন; তিনি যা লিখেছেন, সে সম্পর্কে লেখকের চেয়ে তার পাঠকেরা কতটা বেশি ওয়াকিবহাল থাকতে পারেন- সেদিনই তা টের পেলাম। মনে হয় সে ব্যাপারটা এত গভীরভাবে আগে কখনো বুঝতে পারিনি। কোনো ঔপন্যাসিকই কখনো নিজে তার বইয়ের পাঠক হতে পারেন না। তবে যখন তিনি পান্ডুলিপি থেকে বাক্যপ্রকরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনাবশ্যক পুনরাবৃত্তি ও বাহুল্য অনুচ্ছেদ দূর করার জন্য ঘঁষামাজা করেন- কেবল তখনই তিনি নিজের বইয়ের পাঠকের ভূমিকা নিতে পারেন। নিজের উপন্যাস সম্পর্কে তার ধারণা খণ্ডিত, বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট। খুব কাছ থেকে রূপায়ণ করবার কারণে শিল্পী তার রূপায়িত চিত্রের সামগ্রিক রূপ ধরতে পারে না। লেখালেখি এক অদ্ভূত, অপরূপ ও নিঃসঙ্গ শিল্পকর্ম। উপন্যাসের প্রথম কয়েক পাতা লিখবার পর্যায়ে ভর করে হতোদ্দম। প্রতিদিনই মনে হয়- এই বুঝি ভুল পথে চলে এলাম। এ দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি হয় পেছনে ফিরে গিয়ে ভিন্ন কোনো নতুন পথে চলাবার তাড়না। তবে এ রকম অনুভূতিকে উপেক্ষা করেই সামনে এগোনোর কাজটা করতে হয়। লেখালেখির সঙ্গে শীতের রাতে বরফাচ্ছন্ন রাস্তার শূন্যমাত্রার দৃশ্যমানতার তুলনা করা যায়। বিপরীতে ফিরবার পথ নেই; নেই কোনো বিকল্প। সামনেই এগোতেই হবে। যেতে যেতে নিজকে বুঝ মানাতে হবে- কুয়াশা সরে গেলে সামনে চলার পথ নির্বিঘ্ন হবে- তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো বই লিখে প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে মনে হতে পারে যে, বইটা বুঝি লেখকের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং শেষ হবার আগেই যেন বইটা মুক্তির শ্বাস নিতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মের ছুটি হবার আগের দিন ক্লাসের বাচ্চাদের হাবভাব যেমনটা হয়, বইয়ের আচরণও যেন সেরকমটাই হয়ে যায়। সেদিন স্কুলছাত্রদের মনোযোগে ছেদ পড়ে। আর আচরণে দেখা দেয় চঞ্চলতা। আরো খানিকটা এগিয়ে বলতে পারি- শেষ অনুচ্ছেদগুলো লেখার সময়ে লেখকের কবল থেকে অতি দ্রুত মুক্তি পাবার জন্যে বইটা যেন কিছুটা বৈরী ভাব দেখাতে শুরু করে। তখন ও এমনতরো ব্যস্ততা দেখায় যে, শান্তি মতো শেষ কথাগুলো লিখবার ফরসুত পর্যন্ত দিতে চায় না। বই লেখা শেষ- এবার লেখককে ওর আর কোনো দরকার নেই। ও লেখককে বেমালুম ভুলে যায়। এবার সে ওকে আবিষ্কার করে পাঠকদের ভিড়ের মাঝে। এ ঘটনা লেখকের মধ্যে সঞ্চার করে গভীর শূন্যতা এবং পরিত্যক্ত ভাব। একে এক হতাশাজনক অবস্থাও বলতে পারেন। কারণ লেখক ও বইয়ের মধ্যের এদ্দিনের নাড়ির বন্ধন নিদারুণভাবে এতো চটজলদি ছিন্ন হয়ে যাওয়া বড়ই বেদনাদায়ক। এ অতৃপ্তি ও অসম্পূর্ণ উদ্যমের অনুভূতি পরবর্তী বই লেখার স্পৃহা জাগায়-যাতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়- যদিও তা কখনো সম্ভব হয় না। বছরের পর বছর ধরে একটার পর একটা বই বের হতে থাকে, আর পাঠকদের মাঝে লেখকের সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকে। তো যা বলছিলাম। হ্যাঁ, লেখকের নিজের চেয়ে পাঠকরাই একটা বই সম্পর্কে বেশি জানেন ও বোঝেন। কোনো উপন্যাস এবং এর পাঠকদের মধ্যে যা ঘটে তা ডিজিটাল যুগের আলোকচিত্র প্রসেসের সঙ্গে তুল্য। অন্ধকার কক্ষে আলোকচিত্র প্রিন্ট করার সময় একটু একটু করে আসল ছবিটা ভেসে উঠতে উঠতে শেষতক পরিপূর্ণভাবে মূর্তমান হয়। আপনি যখন কোনো উপন্যাস পড়তে শুরু করেন; তখন সেই একই রাসায়নিক প্রক্রিয়া সঞ্চালিত হয়। কিন্তু লেখক ও পাঠকের মধ্যে এ রকম সঙ্গতি বজায় রাখবার জন্যে পাঠকের অতিমাত্রায় চাপ নেয়ার কোনো ব্যাপার নেই- যেমন আমরা গলা চড়িয়ে গায়কদের খোশামুদি করে থাকি। কিন্তু বইয়ের বেলায় লেখকের অগোচরেই একটু একটু করে এর গভীরে ঢুকে যাবার অনেক অবকাশ পাঠকের থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আঁকুপাংচার-এর কথাই ধরুন। স্নায়ুতন্ত্রের ঠিক ওই নির্দিষ্ট জায়গায়ই সূঁচটাকে ফোটানো হয় যাতে এর প্রবাহকে অবাধ ও নির্বিঘ্ন করা যায়। ঔপন্যাসিক এবং তার পাঠকদের মধ্যে এই যে অন্তরঙ্গ, ঘনিষ্ঠ ও পরিপূরক সম্পর্ক রয়েছে এর সঙ্গে সঙ্গীত ভূবনের একটা সাযুজ্য রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি সব সময়েই ভেবে এসেছি যে, লেখালেখির সাথে সঙ্গীতের একটা নিবিড় ঘনিষ্ঠতা আছে- যদিও সঙ্গীতের তুলনায় লেখালেখিটার পরিশুদ্ধতা খানিকটা কম। সঙ্গীতশিল্পীরা এমন একটা শিল্পকলার চর্চা করে থাকেন- যার শিল্পমান উপন্যাসের চেয়ে অনেক উন্নত। সে জন্যে আমি তাদের প্রতি খুবই ঈর্ষাপরায়ণ। কবিদের ক্ষেত্রেও তাই। তারাও ঔপন্যাসিকদের তুলনায় সঙ্গীতশিল্পীদের ঢের কাছাকাছি। বালকবেলায় আমি কবিতা লেখা শুরু করি। কোথাও এরকম একটা মন্তব্য শুনেছিলাম যে ‘ব্যর্থ কবিদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসে গদ্য লেখক।’ আর আমি নিশ্চিত,এ মন্তব্যটা আমার বেলায় সর্বাংশে সত্য। সঙ্গীতের চেয়ে বরং একজন ঔপন্যাসিক তার লেখার মাধ্যমে সব্বাইকে তুষ্ট করতে চায়। যে দৃশ্যপট, পথপ্রান্তর, ভূচিত্রে তিনি সঙ্গীতের স্বরগ্রামের সুরেলা টুকরোগুলোকে দেখতে পান সেগুলোই তার এক বইয়ের পর আরেক বইয়ে ছড়িয়ে দিয়েও তিনি বোধ করেন যে, যথাযথ পূর্ণতা না পেয়ে বরং এদের অঙ্গহানীই ঘটেছে।তখন সেই ঔপন্যাসিক একদিকে যেমন যথার্থ সঙ্গীতকার না হতে পেরে অনুতাপ করেন, অন্যদিকে, চপিন-এর মতো সুরযোজনা করতে না পেরে অনুশোচনা করেন। আমি আমার নিজের এবং অন্যান্যদের বেলায়ও লক্ষ্য করেছি যে, একটা কারণে ঔপন্যাসিকের সঙ্গে তার সাহিত্যকর্মের নিদারুণ দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং সচেতনতার অভাব দেখা দেয়। যখনই একটা নতুন বই লেখা হয় তখন সেটা আগের বইটাকে মুছে ফেলে। আর সেটা এমনভাবে বিলুপ্ত হতে থাকে, যেন আমি সেটার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। আমি ভাবতাম, একের পর এক আমি যে সব বই লিখে যাচ্ছি সেগুলোর একটা অন্যটা থেকে বিযুক্ত। এগুলো একের পর এক পালা বদলের ধারায় স্মৃতির অতলান্তিকে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু সচরাচর এদের মধ্যে রূপায়িত সেই একই মুখাবয়ব, একই নাম, একই স্থান, একই বুলি এক বইয়ের পর আরেক বইয়েবার বার ফিরে আসে। এ যেন আধো ঘুম, আধো জাগরণে দিবাস্বপ্নের মাঝে অভিন্ন ছাঁচে কাপড় বোনার মতো। ঔপন্যাসিক সচরাচর একজন নিদ্রাচারী এবং যা-ই তিনি লেখেন তাতে এতোটাই নিমগ্ন থাকেন যে, রাস্তা পার হতে গিয়ে তিনি গাড়ি চাপা পড়েন কিনা সে আশঙ্কায় সত্যি সত্যিই উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। তবে একথা ভুললে চলবে না যে, মেপে মেপে পা ফেলা অতি সাবধানী নিদ্রাচারীও কিন্তু ছাদের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পা পিছলে পড়তে পারেন। আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাপত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছে যে, ‘তিনি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিশ্বে জীবনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।’ ১৯৪৫ সালে আমার মতো আরো যারা প্যারিসে জন্ম নিয়েছে- তারা সবাই জার্মান অধিকৃত প্যারিসের সন্তান। তখনকার প্যারিসে যারা বসবাস করতো তারা যতো শিগগির সম্ভব সেসব দিনের কথা এবং নিদেনপক্ষে নিত্যদিনের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ ভুলে যেতে চাইতো।এমন একটা ঘোরের মধ্যে তাদের জীবন কেটেছে যে, তারা স্বাভাবিক জীবন যাপনের সঙ্গে এর কোনো ফারাক করতে পারতো না। দারুণ অনিশ্চয়তা আর সন্তাপের মধ্যে কোনো রকমে বেঁচে থাকার সে-দিনগুলো ছিল এক দুঃস্বপ্ন। পরবর্তীতে যখন তাদের ছেলে মেয়েরা সেই আমলটা সম্পর্কে জানতে চাইতো- তখন তারা চাতুর্যের সঙ্গে সে-প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতেন। অথবা এমনভাবে নীরব থাকতেন যেন তারা তাদের স্মৃতি থেকে সেই অন্ধকার সময়টাকে মুছে ফেলতে চান, কিংবা আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকোতে চান। মা-বাবাদের এমন নীরবতার মুখোমুখি হয়ে আমরা সবকিছু এমনভাবে বুঝে নিতাম যে, যেন আমরা নিজেরাই তাদের সেই সময়টাতে জীবনযাপন করেছি। অধিকৃত সেই প্যারিস ছিল এক অদ্ভুত জনপদ। বাহ্যত জীবন যেন ‘আগের মতোই’ চলতো- নাট্যশালা, প্রেক্ষাগৃহ, সঙ্গীত নিকেতন, হোটেল-রেস্তোরাঁ স্বাভাবিকভাবেই খোলা থাকতো। বেতারে গান বাজতো। যুদ্ধের আগের সময়ের চেয়েও নাট্যশালা ও সিনেমাহলে দর্শক সমাগম হতো অনেক বেশি। পরিস্থিতিটা এমন যে, পরস্পরের ওপর ভরসা করার কোনো উপায় না থাকায় আশ্রয়স্থল বিবেচনা করে লোকজন সেগুলোতে জড়ো হয়ে গাদাগাদি করে বসতো। এ উদ্ভট অবস্থার বর্ণনা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, প্যারিসের অবস্থা মোটেই আগের মতো স্বাভাবিক ছিল না। গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ না থাকায় চারদিক ছিল নীরব-নিঝুম। সেই নিস্তব্দতার মধ্যে বেজে উঠতো শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি, ঘোড়ার খুড়ের শব্দ, জনসমাগমের পদধ্বনি, কণ্ঠের গুনগুনানি। রাস্তাঘাটের ভূতুড়ে নিস্তব্দতার মাঝে শীতকালে বিকেল ৫ টায় বন্ধ করে দেয়া হতো বিদ্যুৎ সরাবরাহ। জানলাপথের ক্ষীণ আলোর রেখার ওপরও ছিল নিষেধাজ্ঞা। সমস্ত শহর যেন নিজের মধ্যে নিজেই হারিয়ে যেত। নাৎসি দখলদাররা মজা করে বলতো- ‘নেত্রহীন নগর’। বয়স্ক এবং বাচ্চাকাচ্চারা মূহুর্তের মধ্যে এমনভাবে গুম হয়ে যেতো যে তাদের আর কোনো হদিসই মিলতো না। বন্ধুবান্ধবরা নিজেদের মাঝে মন খুলে কোনো কথাবার্তা বলতো না। কারণ সবখানে বিরাজ করতো এক ভীতিকর আবহ। এ দুঃস্বপ্নের প্যারিসের মেট্রো-স্টেশন থেকে কখন-যে কাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, কার ওপর দোষারোপের খড়গ নেবে আসবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। শান্তির সময়ে ভুলেও কেউ যে পথ মাড়াতো না সেরকম ঘুপচি পথে কখনো-সখনো কারো-কারো সঙ্গে দৈবাৎ দেখা সাক্ষাত হয়ে যেত। প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের বীজ সান্ধ্যআইন জারি থাকা অবস্থায়ও অংকুরিত, পল্লবিত, বিকশিত হতো। কিন্তু ভবিষ্যতে জীবনে কখনো আবার দু’জনের দেখা মিলবে কিনা- সে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এর অনিবার্য ফলাফল হলো প্রেমের অকালমৃত্যু এবং কখনো কখনো এমন বিচ্ছিরি মেলামেশার ফলে জন্ম নিতো কোনো অনাকাংখিত শিশু। সে কারণেই নাৎসি দখলদারিত্বের প্যারিসকে আমি সব সময় আদিম অসভ্যতার অন্ধকার যুগ বলে বিবেচনা করে আসছি। অবশ্য এমনটা না হলে আমার লেখক মানসেরও জন্ম হতো না। সেই প্যারিস কখনো আমার পিছু ছাড়তো না। আর আমার বইগুলো অবগুণ্ঠিত আলোর অন্তরালেই হারিয়ে যেত। এভাবেই একজন লেখক জীবনের বাস্তবতা থেকে পালিয়ে সন্নাসজীবন গ্রহণ করে কিংবা নিভৃতচারী হয়ে অথবা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না জড়িয়েও-যে তার জন্ম তারিখ ও তার কাল দ্বারা অমোছনীয়ভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন- সেটা তারই প্রমাণ। তিনি যদি কবিতা লেখেন তাহলে তিনি যে কালের কবি, সেই কবিতাগুলোতে ওই কালেরই প্রতিফলন ঘটান এবং অন্য কোনো যুগে এ ধরনের কবিতা কোনো দিনই লেখা হবে না। আইরিশ কবি ইয়েটস-এর কবিতার বেলায় এ কথাটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার ‘দি ওয়াইল্ড সোয়ান্স এ্যাট কুলি’ আমাকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করে। পার্কের একটা লেকে ইয়েটস দেখতে পান যে, ক’টা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে- যা তিনি শৈল্পিক মুন্সিয়ানায় কাব্যরূপ দিয়েছেন...। ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিতায় মরালের প্রতীকী উপস্থিতি ছিল হরহামেশা। বোঁদলেয়ার বা মালার্মের কবিতায় এর ভুরি ভুরি প্রমাণ মিলবে। কিন্তু ইয়েটস-এর এ কবিতাটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা যেতো না। এ কবিতার একটা স্বকীয় ও নির্দিষ্ট যুৎসই ছন্দমাত্রা রয়েছে; রয়েছে একটা বিষন্নতা বা বিষাদগ্রস্ততার ভাব- যা কবিতাটিকে বিংশ শতাব্দীর সঙ্গে- এমনকি যে বছরে তিনি সেটা লিখেছেন- সে নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতাকে এঁটে দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে বিংশ শতাব্দীর কোনো লেখকও নিজেকে তার সময়ের বন্ধনে আবন্ধ বলে ভাবতে পারেন। আর ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিক বলজাক, ডিকেন্স, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কিও খানিকটা স্মৃতিবিধুরতার আবহ দিতে পারেন। সেকালে সময় চলতো একালের চেয়ে ধীরগতিতে এবং এ মন্থর গতি ঔপন্যাসিকের লেখার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যেতো এ কারণে যে, এটা তাকে তার শক্তি-সামর্থ এবং মনন-মতিকে শাণিত করার সুযোগ করে দিতো। এর পর থেকে সময় আরো গতিশীলতা পেয়েছে এবং ক্ষীপ্র গতিতে সামনের দিকে ছুটে চলেছে উদ্দীপ্ত বেগে। আর অতীতের আকাশচুম্বী সাহিত্য ইমারতের সঙ্গে গির্জার মতো স্থাপত্যশিল্প এবং একালের অসন্ধিত, বিযুক্ত, অসংলগ্ন, ভগ্ন ও খণ্ডিত শিল্পকর্মের প্রভেদটা কেমন- সেটাই বিবৃত করছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, এখন আমার প্রজন্মের ক্রান্তিকাল চলছে। আর আমার জানবার কৌতূহল এটাই যে, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, এবং টুইট-এসব সুবিধাদির মাঝে আমার যে পরবর্তী প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে, কেমন করে সাহিত্যে সে জগৎটাকে নিরন্তর রূপায়িত করছে- যে জগতের সঙ্গে প্রত্যেকেই যুক্ত রয়েছে এবং যেখানে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম আমাদের সেই অন্তরঙ্গতা ও গোপনীয়তাকে গ্রাস করছে। কদিন আগেও আমাদের আপন ভূবনে অবলীলায় বিরাজ করতো। সেই একান্ত গোপনীয়তা ব্যক্তিবিশেষকে যে গভীরতা দেয় তা যেকোনো উপন্যাসের মূল উপজীব্য হতে পারে। তবে আমি সাহিত্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী এবং নিশ্চিত যে, মহাকবি হোমার থেকে শুরু করে সকল প্রজন্মের লেখকরা যেমনি রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন, আমাদের উত্তরসূরী লেখকরাও সাহিত্যের তেমনি সুরক্ষা করবেন। অন্যান্য শিল্পীর মতোই প্রত্যেক লেখক তার যুগের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংলগ্ন থাকেন- যা তিনি এড়াতে পারেন না। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার যুগভাবনা। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক লেখক তার সাহিত্যকর্মে কালোত্তীর্ণ কিছুর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। রেসিন বা শেক্সপিয়র-এর নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে সেটা তেমন জরুরি নয় যে, চরিত্রাভিনেতাদের ওই যুগেরই পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে হবে অথবা পরিচালক তাদেরকে জিন্স ও চামড়ার জ্যাকেটই পরিয়ে দিবেন। এগুলো নিতান্তই তুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয়। তলস্তয় পড়ার সময় অ্যানা কারেনিনাকে আমাদের এতো কাছের বলে মনে হয়; দেড় শতাব্দী পরও আমরা বেমালুম ভুলে যাই-যে তিনি ১৮৭০ সনের সাজপোশাক পরে আছেন। আবার এ্যাডগার এলেন পো, মেলভিল বা স্তদল-এর মতো এমন অনেক লেখকও আছেন- যাদের লেখার সাহিত্যমূল্য তাদের সমকালীন পাঠকদের চেয়ে তাদের মৃত্যুর দু’শতাব্দীর পরের পাঠকরা আরো গভীরভাবে উপলব্দি করেছেন। শেষ বিচারে কতকাল অব্দি কোনো ঔপন্যাসিক বেঁচে থাকেন? বাস্তব জগতের যেসব মানুষ লেখককে বিভিন্ন চরিত্র চিত্রণে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে লেখকের যে খানিকটা দূরত্ব থাকে সে ব্যবধান লেখকের ক্ষমতাকে সীমার বাঁধনে বাঁধতে পারে না। ফ্লাবার্ট বলেন, ‘মাদাম বোভারি আমিই’ এবং তলস্তয় তাৎক্ষণিক সেই মহিলাকে শনাক্ত করে ফেলেন যাকে রাশিয়ার একটা রেলস্টেশনে এক রাতে তিনি ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছেন। এমন শনাক্তকরণের সওগাতের বিস্তার এতোটাই প্রসারিত হয়েছে যে, তলস্তয় আকাশ আর মাটির চিত্রকল্পকে এমনি একাকার করে বর্ণনা করেছেন, যেন তিনি এর মধ্যে পুরো নিবিষ্ট হয়ে আছেন। এতে অবশ্য এক ধরনের নিঃসঙ্গতারও ইঙ্গিত আছে। তবে এর অর্থ কিন্তু এ নয় যে, এটা অন্তর্মুখিতা। বরং বাইরের জগৎটাকে নিরিক্ষণকালে তা টান টান চিত্তবৈভব ও অতি সহজবোধ্যতার সুযোগ সৃষ্টি করে। আর তখন সেটা পক্ষান্তরে উপন্যাসেই ঠাঁই করে নেয়। আমি সবসময়েই ভাবি যে, কবি এবং ঔপন্যাসিকরা সে সব মানুষের মধ্যে একটা রহস্যময়তা ছড়িয়ে দিতে পারেন যারা বাহ্যত প্রাত্যহিকতায় এবং মামুলি বিষয়ে সমাচ্ছন্ন থাকেন। এর কারণ হলো এরা তাদের সম্মোহিতের মতো গভীর মননে বারংবার পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এদের এ অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মাঝেই ঘটে তাদের নিত্যদিনের যাপিত জীবনের যবনিকাপাত। আর এভাবেই রহস্য উম্মোচিত হতে হতে এক সময় অন্ধাকারে ফুটে উঠে দীপ্তির ছটা- যা তাদের অনেক গভীর গহ্বরে লুকোনো থাকে বলে প্রথম দর্শনে দৃষ্টিগোচর হয় না। কবি, ঔপন্যাসিক এবং চিত্রশিল্পীর ভূমিকা হলো সেই রহস্য ভেদ করা এবং আঁধার কুঠরিতে উজ্জ্বল আলোর বিকাশ ঘটানো- যা প্রতিটি মানুষের গহন গভীরে লুক্কায়িত। আমার দূরবর্তী আত্মীয় চিত্রশিল্পী এমেডিও মদিগলিয়ানির কথা মনে পড়ে। তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী চিত্রকর্মের মডেল হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন নামপরিচয়হীন লোকদের, রাস্তার ছেলেমেয়ে, উদ্বাস্তু, গৃহকর্মী, ক্ষুদ্র কৃষক আর তরুণ শিক্ষানবিসদের। তুলির মমতার আঁচড়ে তিনি তাদের মূর্তমান করেছেন গভীর ঐকান্তিকতায়। তাদের দিয়েছেন না বলে বরং বলা যায় রূপায়িত করেছেন- তাদের গোবেচারা চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লাবন্য ও মহত্ত্বকে। ঔপন্যাসিক তার সাহিত্যকর্মের অভিযাত্রায় ওই বাস্তবতার কোনো বিকৃতি না ঘটিয়েই এর গভীর তলদেশ থেকে মূলত তুলে আনেন সেই প্রকৃতবাস্তবকেই । অবলোহিত ও অতিবেগুনী শক্তিবলে তিনি তাদের বাহ্যিক চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লালিত্যকে বের করে আনেন। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, ঔপন্যাসিক অন্তর্দৃষ্টিমান কিংবা দৃকশক্তিমান স্বপ্নদর্শীর মতো সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে তা করে থাকেন। তিনি যেন কেবলমাত্র বোধগম্য কম্পন অনুভব করবার জন্যে ভূকম্পবিদের মতো গিরিশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকেন। গুনমুগ্ধ পাঠক হিসেবে আমি কোনো লেখকের জীবনী পড়বার আগে অন্তত দু’বার ভাবি। জীবনীকাররা কখনো কখনো তুচ্ছ খুঁটিনাটি নিয়ে মাতামাতি করেন। নির্ভর করেন অসমর্থিত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের ওপর । তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো সৃষ্টি করে গোলক ধাঁধাঁ কিংবা চরম হতাশা। সম্প্রচারের সময় রেডিওতে গ্যাড় গ্যাড় আওয়াজ হলে সঙ্গীত শোনা যেমন অসম্ভব হয়ে পড়ে, এ ব্যাপারটাও তেমনি। তাই একজন লেখককে প্রকৃতই জানবার উপায় হলো তার লেখা বই পড়া । এভাবেই তার সঙ্গে আমাদের সখ্য গড়ে ওঠে। আর সেটা তখনই ঘটে যখন তিনি তার সবটাই উজাড় করে দেন এবং তিনি আমাদের সঙ্গে সংলাপ করেন অত্যন্ত নিম্নস্বরে। তবুও আপনি যখন কোনো লেখকের জীবনী পড়েন তখন আপনি কদাপি বাল্যকালের এমন এক লক্ষণীয় ঘটনাকে আবিষ্কার করেন যা ভবিষ্যতের কোনো সাহিত্যকর্মের সেই বীজ বপন করে- যে সম্পর্কে তিনি আগ থেকেই স্পষ্টরূপে সচেতন থাকেন না। সে লক্ষণীয় ঘটনা সাহিত্যকর্মে হানা দেয়ার জন্যে নানা ছদ্মাবরণে বার বার ফিরে ফিরে আসে। আলফ্রেড হিচকক-এর কথাই ধরা যাক। তিনি লেখক নন, তথাপিও তার চলচ্চিত্রে উপন্যাসের ন্যায় শক্তিমত্তা, সঙ্গতি ও সংসক্তি রয়েছে। যখন তার ছেলের বয়স পাঁচ বছর, তখন হিচককের বাবা তার এক পুলিশ অফিসার বন্ধুর কাছে একটা চিঠি পৌঁছে দিতে বলেন। ছেলে যথারীতি চিঠিটা প্রাপককে পৌঁছে দেয়। কিন্তু ওই পুলিশ অফিসার ছেলেটাকে থানার সেই লক-আপে আটক করে রাখেন- যে সেলটা রাতভর অপরাধীদের বন্দী করে রাখার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আতঙ্কিত ছেলেটা ঘণ্টা খানেক হাজতবাসের পর ছাড়া পায়। এবার পুলিশ অফিসার ব্যাপারটাকে খোলাসা করে- ‘বুঝলে খোকা! জীবনে কোনো অপকর্ম বা মন্দ আচরণ করলে কী দশা হয় তা তোমার জানা হয়ে গেল।’ এ পুলিশ অফিসারটি শিশু-পালনের বিষয়ে তার সেই উদ্ভট ধ্যান-ধারনাসহ অবশ্যই পরবর্তীতে হিচককের সকল চলচ্চিত্রে চিত্রিত উদ্বেগ-উৎকণ্টার বাতাবরণের নেপথ্যে মদদ যুগিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনীর অবতারণা করে আমি আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, আমার শৈশবের নির্দিষ্ট কয়েকটি টুকরো টুকরো উপখ্যান যে বীজ রোপন করেছে তা পরবর্তীতে আমার উপন্যাস হয়ে উঠেছে। সচরাচর মা-বাবার সঙ্গে আমার থাকা হতো না। এমন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে থাকতাম যাদের সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানতাম না। একের পর এক বদল করতে হয়েছে এলাকা-বাড়ি-ঠিকানা। সে সময় একজন কিশোরের কাছে কোনো কিছুই বেখাপ্পা মনে হয়নি। এমনকি উদ্ভট ও আজগুবি পরিস্থিতিকেও অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হতো। এর অনেক দিন পর আমার শৈশব আমাকে হেঁয়ালিপনায় তাড়িত করেছে এবং আমার বাবা-মা যে সকল মানুষজন ও এলাকা ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন- তাদের আমি নিরন্তর খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু এরা এমনভাবে বদলে যেতে থাকলো- যে আমি তাদের অনেকেরই হদিস করতে পারিনি। পারিনি সে সব পুরনো এলাকা বা বাড়ি-ঘরগুলোকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে। এ বিভ্রান্তি দূর করবার চেষ্টায় ব্যর্থতা এবং রহস্যের জট খুলবার প্রয়াস আমার মধ্যে লেখালেখির স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। তখন এমন মনে হয়েছে যে, যেন এ লেখালেখি আর ভাব-কল্পনা আমাকে পরিশেষে ওই শিথিল সম্পর্ক- সূতোর প্রান্তগুলোকে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছে। আমরা যখন ‘রহস্য’ প্রসঙ্গে বলতে চাই- সে ভাবনার অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের মনে ভেসে ওঠে ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘লা মিস্টারেস দা প্যারিস’ নামের ফরাসি উপন্যাসটির কথা। এ শহর- দৈবক্রমে প্যারিস- যে শহরে আমার জন্ম-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার আশৈশব সম্পর্ক। এ পরিচয়ের বন্ধন এতোটাই নিবিড় আর গভীর যে, অদ্যাবধি আমি প্যারিসের রহস্যের সন্ধান করে যাচ্ছি নিরন্তর। আমার যখন নয় কি দশ বছর বয়েস- তখন এমন ঘটলো যে, আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে একাকি হাঁটতে শুরু করি- যদিও আমার হারিয়ে যাবার ভয় ছিল, তবুও আমি হেঁটেই চলেছি অবিরাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি আশপাশের এলাকা পার হয়ে অদ্দুর চলে গেলাম যে, আমি ঠিক সেইন নদীর তীরের অপরিচিত এলাকায় পৌঁছে গেলাম। আমার শুধুমাত্র ভরসা এটুকুই যে, তখন দিনের বেলা। বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর পর্যায়ে আমি ভয় কাটিয়ে দুঃসাহসী অভিযানে বেরিয়ে পড়তে- এমনকি মেট্টোতে চড়ে দূর-দূরান্তে চলে যেতেও কুণ্ঠিত হতাম না। ঠিক এভাবেই আপনি কোনো শহর সম্পর্কে জানতে পারেন। আমি যে ঔপন্যাসিকদের গুনমুগ্ধ তাদের অনেকেরই এ দৃষ্টান্ত আমি অনুসরণ করি এবং সেজন্যে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে প্যারিস, লন্ডন, সেন্ট পিটার্সবার্গ বা স্টকহোমের মতো শহর তাদের উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ও অন্যতম মূল উপজীব্য ছিল। যাদের লেখায় মানবিকতা আহুত, জাগ্রত ও আদৃত হয়েছে তাদের অন্যতম পথিকৃৎ এডগার এ্যালেন পো তার ‘দি ম্যান অব দি ক্রাউড’ ছোটগল্পে একটি রেস্তোরাঁর জানলা দিয়ে ফুটপাত ধরে লোকজনকে অন্তহীন যাত্রায় অবিরাম চলতে দেখেছেন। বেদস্তুর চেহারার একজনকে নির্দিষ্ট করে তার সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানবার আগ্রহে রাতভর তাকে লন্ডনের আনাচে কানাচে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু সেই অজানা-অচেনা লোকটি হলো জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো সাধারণ মানুষ। এমন লোকের পিছু নেয়া নিরর্থক। কারণ সে চিরদিনই নাম-পরিচয়হীন থেকে যায় এবং তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার কোনো আত্মপরিচয় থাকে না, থাকে না কোনো স্বকীয় অস্তিত্ব। সে সাধারণ লোকের ভিড়ের অন্যতম পথিকের মতো ঠেলাঠেলি, ঘেঁষাঘেঁষি, ধাক্কাধাক্কি করে জনস্রোতে চলতে চলতে যথারীতি পথের মাঝেই হারিয়ে যায়। আমি প্রসঙ্গত কবি টমাস ডি কুইন্সি’র বেলায় যেমনটা ঘটেছিল, এর উল্লেখ করছি। তরুণ বয়েসের একটা ঘটনা তার জীবনের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। লন্ডনে অক্সফোর্ডের রাস্তার ভিড়ের মধ্যে এক তরুণীর সঙ্গে দৈবক্রমে তার সাক্ষাৎ ও পরে বন্ধুত্ব হয়। তিনি দিন কতেক সে তরুণীর সাহচর্য পান এবং ক’দিনের জন্যে লন্ডন শহরের বাইরে যান। দুজন সম্মত হয় যে, হপ্তান্তে তারা আবার একই সময়ে, একই স্থানে, প্রতিদিন বিকেলে আগের মতো মিলিত হবে। কিন্তু আর কোনোদিন তাদের পরস্পরের দেখা হয়নি। নিঃসন্দেহে একই সময়ে তারা একে অন্যকে খুঁজে বেড়িয়েছে দিনের পর দিন। মহাব্যস্ত এই জটলা-জটিল লন্ডনে হয়তো তারা একে অন্যের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুটের দূরত্বে ছিল কিংবা এমন দূরত্বে ছিল যে-ব্যবধান লন্ডনের সুপরিসর রাস্তার চেয়ে অধিক ছিলনা। কিন্তু তাদের সেই স্বল্প দূরত্ব একদিন চিরবিচ্ছেদেই পর্যবসিত হলো। যে প্রতিবেশ ও পরিবেশে মানুষ জন্ম নেয় এবং বসবাস করে সেই চিরচেনা জনপদ, রাস্তাঘাট, খানিক দেখা, কোনো খেদ বা ক্ষণিকের সুখবোধ সময়ের আবর্তে সেই মানুষদের স্মৃতিকাতর করে। তরুণ বয়েস থেকেই আমি পুরনো ফরাসি টেলিফোন নির্দেশিকা ঘাটতাম। বিশেষত সড়কের নামের আদ্যাক্ষর ও বাড়ির নম্বরের ক্রমানুসারে গ্রাহকদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর যে নির্দেশিকায় ছাপানো হতো সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখতাম- যাতে সেগুলোকে আমার লেখালেখির কাজে লাগানো যায়। কারো কারো নাম পরের বছরের নির্দেশিকা থেকে বেমালুম উধাও হয়ে যেতো। এসব পুরনো নির্দেশিকা মাঝে মধ্যে নিজকে বোকা বানিয়ে ফেলে। কারণ, এতে লিখিত তথ্যানুযায়ী নম্বরগুলোতে ফোন করে কোনোই সাড়া পাওয়া যেতো না। আমার প্রথম বই লেখার স্পৃহা ও প্রেরণা আমি ওই পুরনো ফরাসি টেলিফোন নির্দেশিকা থেকেই পাই। আমি কিছু কিছু অপরিচিত লোকের নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর পেন্সিলে আন্ডারলাইন করে রাখতাম এবং হাজার হাজার লোকের ভিড়ে তাদের জীবন কেমন ছিল- এ বিষয়ে কল্পনা করতাম। বড় শহরে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। পারেন নিজেকে গোপন বা অদৃশ্য করে ফেলতে। আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় বদলে ফেলতে পারেন এবং নতুন এক জীবন শুরু করতে পারেন। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, ব্যক্তিপরিচয় বদল করা এবং সময় পরিক্রমার বিষয়গুলো বাস্তবে সেই শহরটার পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সে কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই শহরগুলোই হয়ে উঠেছে উপন্যাসের উপজীব্য-ক্ষেত্র। কোনো কোনো নামকরা শহর তো লেখকদের নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়েই আছে, যেমন- বলজাক ও প্যারিস, ডিকেন্স ও লন্ডন, দস্তয়ভস্কি ও সেন্ট পিটার্সবার্গ, টোকিও এবং নাগাই কাফু, স্টকহোম ও জালমার সডেরবার্গ। আমি সেই প্রজন্মের মানুষ- যা এ সকল ঔপন্যাসিকদের দ্বারা প্রভাবিত এবং যে প্রজন্ম যথাযোগ্য ও বিধেয় উপায়ে সে বিষয়টির অনুসন্ধান চালাতে চায়- যাকে বোঁদলেয়ার বলতেন ‘প্রাচীন শহরের সর্পিল ভাঁজ’। একথা সত্য যে, ৫০ বছর আগে, অন্য কথায়, আমার বয়ঃসন্ধিক্ষণে যে শহরকে আবিষ্কার করার জন্যে আমি তীব্র উত্তেজনা অনুভবের অভিজ্ঞতা অর্জন শুরু করেছি, সেই শহরে তখন চলছে নিরন্তর পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এদের কোনো কোনোটা- মার্কিন মুলুক এবং যে এলাকাকে লোকেরা তৃতীয় বিশ্ব বলে থাকে- সেগুলো জঞ্জালের নতুন মাত্রাযুক্ত করে মেগাসিটিতে পরিণত হয়। এর বাসিন্দারা অর্থনৈতিক বৈষম্যে শ্রেণীবিভক্ত হয়ে উপেক্ষা কিংবা অবজ্ঞার পাত্র হতে শুরু করে। সমাজকল্যাণমূলক সেবার আওতায় শুরু হয় এদের জীবন-যাপন। দিনকে দিন বাড়তে থাকে বস্তির সংখ্যা। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ঔপন্যাসিকরা নগরজীবন সম্পর্কে এক ধরনের রোমান্টিক ভাবধারা পোষণ করতো- যা ডিকেন্স বা বোঁদলেয়ার-এর ভাবদর্শন থেকে আলাদা কিছু নয়। সে কারণেই আমি জানতে আগ্রহী হই যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথাসাহিত্যিকরা কেমন করে কোলাহলপূর্ণ একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর বেসামাল নগরকে তাদের উপন্যাসের উপজীব্য করতে আহ্বান করবেন। আমার বই সম্পর্কে আপনারা দয়াপরবশ হয়ে উল্লেখ করেছেন যে, আমার সাহিত্যকর্ম ‘শৈল্পিক স্মৃতিগ্রন্থনা- যার মধ্য দিয়ে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের দুর্বোধ্য এবং অনায়ত্ত ভাগ্যের কথা।’ কিন্তু আমি আসলে যা- এ প্রশংসা তার চেয়ে অনেকখানিই বেশি। হারিয়ে যাওয়া হৈমশিলা আবার যেমন সমুদ্র-পৃষ্ঠে ভেসে উঠে- তেমনি বিস্মরণের সাদা কাগজটার প্রলেপ ভেদ করে বিবর্ণ ভাবনাগুলোকে বর্ণিল ও দৃশ্যমান করে ফুটিয়ে তোলাই একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পবৃত্তি। (সংক্ষেপিত)
গে তো বটেই- বক্তৃতা প্রদানের সম্পর্কটা তেমন স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। স্কুলের লেখাপড়ায় মৌখিক ও লিখিত- এ দু’ধরনের পাঠ থাকে। একজন ঔপন্যাসিকের জন্যে শেষোক্তটাই শ্রেয়। ঔপন্যাসিক বলার পটুতার চেয়ে লেখার প্রতিভায় বেশি পারদর্শী। তাই তিনি চুপচাপ থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনো বাহ্যিক আবহকে অন্তর্গত সৃজনশীলতার রসে সিক্ত করার তাগিদ অনুভূত হলে তাকে মিশে যেতে হয় মানুষের ভিড়ে। তাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকেও তিনি চারপাশের মানুষের কথাবার্তা শুনে থাকেন। আর তাদের আলাপচারিতায় যোগ দিয়ে তাদের সম্পর্কে তার যে ধারনা- সেটাকে বিচক্ষণতাপূর্ণ প্রশ্নের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করেন । দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে বলেই তিনি লেখালেখির সময় বেশ কাটাকুটি করেন। অবশ্য বার বার কাটাকুটির ফলে শেষতক তার শৈলীর ফটিক স্বচ্ছতা ফুটে ওঠে। কিন্তু সমাবেশে সরাসরি বক্তব্য দেয়ার সময়ে হোঁচট খেলে তা আর সংশোধন করবার সুযোগ থাকে না। ছেলেবেলায় আমি এমন এক প্রজন্মে বড় হয়েছি যেখানে বড়দের সামনে ঘোরাফেরা করা কিংবা তাদের আলাপচারিতা শোনা অল্পবয়েসীদের জন্য বারণ ছিল। দু’চারটা বিশেষ ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটতো অথবা বড়দের অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে হতো। সে কারণেই আমাদের কারো কারো স্বচ্ছন্দে কথা বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। ভুগতে হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে। আমাদের বলার মাঝখানে কেউ আমাদের অনায়াসেই থামিয়ে দিতে পারে- সে ভয়ে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো করে কথা শেষ করতে চাই। সম্ভবত সে কারণেই অন্য অনেকের মতো বালকবেলা থেকেই লেখালেখির ব্যাপারটা আমাকেও পেয়ে বসে। সে বয়েসে মনে প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা জাগে, বড়রা আমাদের লেখাগুলো পড়ে আমাদের মনের কথা বুঝবেন। লেখার মাঝখানে বড়রা আমাদের থামিয়ে দিতে পারবেন না বলেই এ মাধ্যমটা বেছে নেই। ভাবি, এ পন্থায়ই তারা আমাদের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আসল কথাগুলো শুনতে পাবেন। আমাকে এ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাটা আমার কাছে নিতান্ত অবাস্তবই ঠেকেছে। তাই আমাকে বেছে নেবার কারণটা জানবার জন্যে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। কোনো ঔপন্যাসিক নিজের লেখা বই সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ থাকতে পারেন; তিনি যা লিখেছেন, সে সম্পর্কে লেখকের চেয়ে তার পাঠকেরা কতটা বেশি ওয়াকিবহাল থাকতে পারেন- সেদিনই তা টের পেলাম। মনে হয় সে ব্যাপারটা এত গভীরভাবে আগে কখনো বুঝতে পারিনি। কোনো ঔপন্যাসিকই কখনো নিজে তার বইয়ের পাঠক হতে পারেন না। তবে যখন তিনি পান্ডুলিপি থেকে বাক্যপ্রকরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনাবশ্যক পুনরাবৃত্তি ও বাহুল্য অনুচ্ছেদ দূর করার জন্য ঘঁষামাজা করেন- কেবল তখনই তিনি নিজের বইয়ের পাঠকের ভূমিকা নিতে পারেন। নিজের উপন্যাস সম্পর্কে তার ধারণা খণ্ডিত, বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট। খুব কাছ থেকে রূপায়ণ করবার কারণে শিল্পী তার রূপায়িত চিত্রের সামগ্রিক রূপ ধরতে পারে না। লেখালেখি এক অদ্ভূত, অপরূপ ও নিঃসঙ্গ শিল্পকর্ম। উপন্যাসের প্রথম কয়েক পাতা লিখবার পর্যায়ে ভর করে হতোদ্দম। প্রতিদিনই মনে হয়- এই বুঝি ভুল পথে চলে এলাম। এ দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি হয় পেছনে ফিরে গিয়ে ভিন্ন কোনো নতুন পথে চলাবার তাড়না। তবে এ রকম অনুভূতিকে উপেক্ষা করেই সামনে এগোনোর কাজটা করতে হয়। লেখালেখির সঙ্গে শীতের রাতে বরফাচ্ছন্ন রাস্তার শূন্যমাত্রার দৃশ্যমানতার তুলনা করা যায়। বিপরীতে ফিরবার পথ নেই; নেই কোনো বিকল্প। সামনেই এগোতেই হবে। যেতে যেতে নিজকে বুঝ মানাতে হবে- কুয়াশা সরে গেলে সামনে চলার পথ নির্বিঘ্ন হবে- তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো বই লিখে প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে মনে হতে পারে যে, বইটা বুঝি লেখকের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং শেষ হবার আগেই যেন বইটা মুক্তির শ্বাস নিতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মের ছুটি হবার আগের দিন ক্লাসের বাচ্চাদের হাবভাব যেমনটা হয়, বইয়ের আচরণও যেন সেরকমটাই হয়ে যায়। সেদিন স্কুলছাত্রদের মনোযোগে ছেদ পড়ে। আর আচরণে দেখা দেয় চঞ্চলতা। আরো খানিকটা এগিয়ে বলতে পারি- শেষ অনুচ্ছেদগুলো লেখার সময়ে লেখকের কবল থেকে অতি দ্রুত মুক্তি পাবার জন্যে বইটা যেন কিছুটা বৈরী ভাব দেখাতে শুরু করে। তখন ও এমনতরো ব্যস্ততা দেখায় যে, শান্তি মতো শেষ কথাগুলো লিখবার ফরসুত পর্যন্ত দিতে চায় না। বই লেখা শেষ- এবার লেখককে ওর আর কোনো দরকার নেই। ও লেখককে বেমালুম ভুলে যায়। এবার সে ওকে আবিষ্কার করে পাঠকদের ভিড়ের মাঝে। এ ঘটনা লেখকের মধ্যে সঞ্চার করে গভীর শূন্যতা এবং পরিত্যক্ত ভাব। একে এক হতাশাজনক অবস্থাও বলতে পারেন। কারণ লেখক ও বইয়ের মধ্যের এদ্দিনের নাড়ির বন্ধন নিদারুণভাবে এতো চটজলদি ছিন্ন হয়ে যাওয়া বড়ই বেদনাদায়ক। এ অতৃপ্তি ও অসম্পূর্ণ উদ্যমের অনুভূতি পরবর্তী বই লেখার স্পৃহা জাগায়-যাতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়- যদিও তা কখনো সম্ভব হয় না। বছরের পর বছর ধরে একটার পর একটা বই বের হতে থাকে, আর পাঠকদের মাঝে লেখকের সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকে। তো যা বলছিলাম। হ্যাঁ, লেখকের নিজের চেয়ে পাঠকরাই একটা বই সম্পর্কে বেশি জানেন ও বোঝেন। কোনো উপন্যাস এবং এর পাঠকদের মধ্যে যা ঘটে তা ডিজিটাল যুগের আলোকচিত্র প্রসেসের সঙ্গে তুল্য। অন্ধকার কক্ষে আলোকচিত্র প্রিন্ট করার সময় একটু একটু করে আসল ছবিটা ভেসে উঠতে উঠতে শেষতক পরিপূর্ণভাবে মূর্তমান হয়। আপনি যখন কোনো উপন্যাস পড়তে শুরু করেন; তখন সেই একই রাসায়নিক প্রক্রিয়া সঞ্চালিত হয়। কিন্তু লেখক ও পাঠকের মধ্যে এ রকম সঙ্গতি বজায় রাখবার জন্যে পাঠকের অতিমাত্রায় চাপ নেয়ার কোনো ব্যাপার নেই- যেমন আমরা গলা চড়িয়ে গায়কদের খোশামুদি করে থাকি। কিন্তু বইয়ের বেলায় লেখকের অগোচরেই একটু একটু করে এর গভীরে ঢুকে যাবার অনেক অবকাশ পাঠকের থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আঁকুপাংচার-এর কথাই ধরুন। স্নায়ুতন্ত্রের ঠিক ওই নির্দিষ্ট জায়গায়ই সূঁচটাকে ফোটানো হয় যাতে এর প্রবাহকে অবাধ ও নির্বিঘ্ন করা যায়। ঔপন্যাসিক এবং তার পাঠকদের মধ্যে এই যে অন্তরঙ্গ, ঘনিষ্ঠ ও পরিপূরক সম্পর্ক রয়েছে এর সঙ্গে সঙ্গীত ভূবনের একটা সাযুজ্য রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি সব সময়েই ভেবে এসেছি যে, লেখালেখির সাথে সঙ্গীতের একটা নিবিড় ঘনিষ্ঠতা আছে- যদিও সঙ্গীতের তুলনায় লেখালেখিটার পরিশুদ্ধতা খানিকটা কম। সঙ্গীতশিল্পীরা এমন একটা শিল্পকলার চর্চা করে থাকেন- যার শিল্পমান উপন্যাসের চেয়ে অনেক উন্নত। সে জন্যে আমি তাদের প্রতি খুবই ঈর্ষাপরায়ণ। কবিদের ক্ষেত্রেও তাই। তারাও ঔপন্যাসিকদের তুলনায় সঙ্গীতশিল্পীদের ঢের কাছাকাছি। বালকবেলায় আমি কবিতা লেখা শুরু করি। কোথাও এরকম একটা মন্তব্য শুনেছিলাম যে ‘ব্যর্থ কবিদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসে গদ্য লেখক।’ আর আমি নিশ্চিত,এ মন্তব্যটা আমার বেলায় সর্বাংশে সত্য। সঙ্গীতের চেয়ে বরং একজন ঔপন্যাসিক তার লেখার মাধ্যমে সব্বাইকে তুষ্ট করতে চায়। যে দৃশ্যপট, পথপ্রান্তর, ভূচিত্রে তিনি সঙ্গীতের স্বরগ্রামের সুরেলা টুকরোগুলোকে দেখতে পান সেগুলোই তার এক বইয়ের পর আরেক বইয়ে ছড়িয়ে দিয়েও তিনি বোধ করেন যে, যথাযথ পূর্ণতা না পেয়ে বরং এদের অঙ্গহানীই ঘটেছে।তখন সেই ঔপন্যাসিক একদিকে যেমন যথার্থ সঙ্গীতকার না হতে পেরে অনুতাপ করেন, অন্যদিকে, চপিন-এর মতো সুরযোজনা করতে না পেরে অনুশোচনা করেন। আমি আমার নিজের এবং অন্যান্যদের বেলায়ও লক্ষ্য করেছি যে, একটা কারণে ঔপন্যাসিকের সঙ্গে তার সাহিত্যকর্মের নিদারুণ দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং সচেতনতার অভাব দেখা দেয়। যখনই একটা নতুন বই লেখা হয় তখন সেটা আগের বইটাকে মুছে ফেলে। আর সেটা এমনভাবে বিলুপ্ত হতে থাকে, যেন আমি সেটার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। আমি ভাবতাম, একের পর এক আমি যে সব বই লিখে যাচ্ছি সেগুলোর একটা অন্যটা থেকে বিযুক্ত। এগুলো একের পর এক পালা বদলের ধারায় স্মৃতির অতলান্তিকে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু সচরাচর এদের মধ্যে রূপায়িত সেই একই মুখাবয়ব, একই নাম, একই স্থান, একই বুলি এক বইয়ের পর আরেক বইয়েবার বার ফিরে আসে। এ যেন আধো ঘুম, আধো জাগরণে দিবাস্বপ্নের মাঝে অভিন্ন ছাঁচে কাপড় বোনার মতো। ঔপন্যাসিক সচরাচর একজন নিদ্রাচারী এবং যা-ই তিনি লেখেন তাতে এতোটাই নিমগ্ন থাকেন যে, রাস্তা পার হতে গিয়ে তিনি গাড়ি চাপা পড়েন কিনা সে আশঙ্কায় সত্যি সত্যিই উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। তবে একথা ভুললে চলবে না যে, মেপে মেপে পা ফেলা অতি সাবধানী নিদ্রাচারীও কিন্তু ছাদের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পা পিছলে পড়তে পারেন। আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাপত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছে যে, ‘তিনি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিশ্বে জীবনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।’ ১৯৪৫ সালে আমার মতো আরো যারা প্যারিসে জন্ম নিয়েছে- তারা সবাই জার্মান অধিকৃত প্যারিসের সন্তান। তখনকার প্যারিসে যারা বসবাস করতো তারা যতো শিগগির সম্ভব সেসব দিনের কথা এবং নিদেনপক্ষে নিত্যদিনের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ ভুলে যেতে চাইতো।এমন একটা ঘোরের মধ্যে তাদের জীবন কেটেছে যে, তারা স্বাভাবিক জীবন যাপনের সঙ্গে এর কোনো ফারাক করতে পারতো না। দারুণ অনিশ্চয়তা আর সন্তাপের মধ্যে কোনো রকমে বেঁচে থাকার সে-দিনগুলো ছিল এক দুঃস্বপ্ন। পরবর্তীতে যখন তাদের ছেলে মেয়েরা সেই আমলটা সম্পর্কে জানতে চাইতো- তখন তারা চাতুর্যের সঙ্গে সে-প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতেন। অথবা এমনভাবে নীরব থাকতেন যেন তারা তাদের স্মৃতি থেকে সেই অন্ধকার সময়টাকে মুছে ফেলতে চান, কিংবা আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকোতে চান। মা-বাবাদের এমন নীরবতার মুখোমুখি হয়ে আমরা সবকিছু এমনভাবে বুঝে নিতাম যে, যেন আমরা নিজেরাই তাদের সেই সময়টাতে জীবনযাপন করেছি। অধিকৃত সেই প্যারিস ছিল এক অদ্ভুত জনপদ। বাহ্যত জীবন যেন ‘আগের মতোই’ চলতো- নাট্যশালা, প্রেক্ষাগৃহ, সঙ্গীত নিকেতন, হোটেল-রেস্তোরাঁ স্বাভাবিকভাবেই খোলা থাকতো। বেতারে গান বাজতো। যুদ্ধের আগের সময়ের চেয়েও নাট্যশালা ও সিনেমাহলে দর্শক সমাগম হতো অনেক বেশি। পরিস্থিতিটা এমন যে, পরস্পরের ওপর ভরসা করার কোনো উপায় না থাকায় আশ্রয়স্থল বিবেচনা করে লোকজন সেগুলোতে জড়ো হয়ে গাদাগাদি করে বসতো। এ উদ্ভট অবস্থার বর্ণনা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, প্যারিসের অবস্থা মোটেই আগের মতো স্বাভাবিক ছিল না। গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ না থাকায় চারদিক ছিল নীরব-নিঝুম। সেই নিস্তব্দতার মধ্যে বেজে উঠতো শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি, ঘোড়ার খুড়ের শব্দ, জনসমাগমের পদধ্বনি, কণ্ঠের গুনগুনানি। রাস্তাঘাটের ভূতুড়ে নিস্তব্দতার মাঝে শীতকালে বিকেল ৫ টায় বন্ধ করে দেয়া হতো বিদ্যুৎ সরাবরাহ। জানলাপথের ক্ষীণ আলোর রেখার ওপরও ছিল নিষেধাজ্ঞা। সমস্ত শহর যেন নিজের মধ্যে নিজেই হারিয়ে যেত। নাৎসি দখলদাররা মজা করে বলতো- ‘নেত্রহীন নগর’। বয়স্ক এবং বাচ্চাকাচ্চারা মূহুর্তের মধ্যে এমনভাবে গুম হয়ে যেতো যে তাদের আর কোনো হদিসই মিলতো না। বন্ধুবান্ধবরা নিজেদের মাঝে মন খুলে কোনো কথাবার্তা বলতো না। কারণ সবখানে বিরাজ করতো এক ভীতিকর আবহ। এ দুঃস্বপ্নের প্যারিসের মেট্রো-স্টেশন থেকে কখন-যে কাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, কার ওপর দোষারোপের খড়গ নেবে আসবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। শান্তির সময়ে ভুলেও কেউ যে পথ মাড়াতো না সেরকম ঘুপচি পথে কখনো-সখনো কারো-কারো সঙ্গে দৈবাৎ দেখা সাক্ষাত হয়ে যেত। প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের বীজ সান্ধ্যআইন জারি থাকা অবস্থায়ও অংকুরিত, পল্লবিত, বিকশিত হতো। কিন্তু ভবিষ্যতে জীবনে কখনো আবার দু’জনের দেখা মিলবে কিনা- সে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এর অনিবার্য ফলাফল হলো প্রেমের অকালমৃত্যু এবং কখনো কখনো এমন বিচ্ছিরি মেলামেশার ফলে জন্ম নিতো কোনো অনাকাংখিত শিশু। সে কারণেই নাৎসি দখলদারিত্বের প্যারিসকে আমি সব সময় আদিম অসভ্যতার অন্ধকার যুগ বলে বিবেচনা করে আসছি। অবশ্য এমনটা না হলে আমার লেখক মানসেরও জন্ম হতো না। সেই প্যারিস কখনো আমার পিছু ছাড়তো না। আর আমার বইগুলো অবগুণ্ঠিত আলোর অন্তরালেই হারিয়ে যেত। এভাবেই একজন লেখক জীবনের বাস্তবতা থেকে পালিয়ে সন্নাসজীবন গ্রহণ করে কিংবা নিভৃতচারী হয়ে অথবা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না জড়িয়েও-যে তার জন্ম তারিখ ও তার কাল দ্বারা অমোছনীয়ভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন- সেটা তারই প্রমাণ। তিনি যদি কবিতা লেখেন তাহলে তিনি যে কালের কবি, সেই কবিতাগুলোতে ওই কালেরই প্রতিফলন ঘটান এবং অন্য কোনো যুগে এ ধরনের কবিতা কোনো দিনই লেখা হবে না। আইরিশ কবি ইয়েটস-এর কবিতার বেলায় এ কথাটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার ‘দি ওয়াইল্ড সোয়ান্স এ্যাট কুলি’ আমাকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করে। পার্কের একটা লেকে ইয়েটস দেখতে পান যে, ক’টা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে- যা তিনি শৈল্পিক মুন্সিয়ানায় কাব্যরূপ দিয়েছেন...। ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিতায় মরালের প্রতীকী উপস্থিতি ছিল হরহামেশা। বোঁদলেয়ার বা মালার্মের কবিতায় এর ভুরি ভুরি প্রমাণ মিলবে। কিন্তু ইয়েটস-এর এ কবিতাটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা যেতো না। এ কবিতার একটা স্বকীয় ও নির্দিষ্ট যুৎসই ছন্দমাত্রা রয়েছে; রয়েছে একটা বিষন্নতা বা বিষাদগ্রস্ততার ভাব- যা কবিতাটিকে বিংশ শতাব্দীর সঙ্গে- এমনকি যে বছরে তিনি সেটা লিখেছেন- সে নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতাকে এঁটে দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে বিংশ শতাব্দীর কোনো লেখকও নিজেকে তার সময়ের বন্ধনে আবন্ধ বলে ভাবতে পারেন। আর ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিক বলজাক, ডিকেন্স, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কিও খানিকটা স্মৃতিবিধুরতার আবহ দিতে পারেন। সেকালে সময় চলতো একালের চেয়ে ধীরগতিতে এবং এ মন্থর গতি ঔপন্যাসিকের লেখার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যেতো এ কারণে যে, এটা তাকে তার শক্তি-সামর্থ এবং মনন-মতিকে শাণিত করার সুযোগ করে দিতো। এর পর থেকে সময় আরো গতিশীলতা পেয়েছে এবং ক্ষীপ্র গতিতে সামনের দিকে ছুটে চলেছে উদ্দীপ্ত বেগে। আর অতীতের আকাশচুম্বী সাহিত্য ইমারতের সঙ্গে গির্জার মতো স্থাপত্যশিল্প এবং একালের অসন্ধিত, বিযুক্ত, অসংলগ্ন, ভগ্ন ও খণ্ডিত শিল্পকর্মের প্রভেদটা কেমন- সেটাই বিবৃত করছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, এখন আমার প্রজন্মের ক্রান্তিকাল চলছে। আর আমার জানবার কৌতূহল এটাই যে, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, এবং টুইট-এসব সুবিধাদির মাঝে আমার যে পরবর্তী প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে, কেমন করে সাহিত্যে সে জগৎটাকে নিরন্তর রূপায়িত করছে- যে জগতের সঙ্গে প্রত্যেকেই যুক্ত রয়েছে এবং যেখানে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম আমাদের সেই অন্তরঙ্গতা ও গোপনীয়তাকে গ্রাস করছে। কদিন আগেও আমাদের আপন ভূবনে অবলীলায় বিরাজ করতো। সেই একান্ত গোপনীয়তা ব্যক্তিবিশেষকে যে গভীরতা দেয় তা যেকোনো উপন্যাসের মূল উপজীব্য হতে পারে। তবে আমি সাহিত্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী এবং নিশ্চিত যে, মহাকবি হোমার থেকে শুরু করে সকল প্রজন্মের লেখকরা যেমনি রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন, আমাদের উত্তরসূরী লেখকরাও সাহিত্যের তেমনি সুরক্ষা করবেন। অন্যান্য শিল্পীর মতোই প্রত্যেক লেখক তার যুগের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংলগ্ন থাকেন- যা তিনি এড়াতে পারেন না। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার যুগভাবনা। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক লেখক তার সাহিত্যকর্মে কালোত্তীর্ণ কিছুর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। রেসিন বা শেক্সপিয়র-এর নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে সেটা তেমন জরুরি নয় যে, চরিত্রাভিনেতাদের ওই যুগেরই পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে হবে অথবা পরিচালক তাদেরকে জিন্স ও চামড়ার জ্যাকেটই পরিয়ে দিবেন। এগুলো নিতান্তই তুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয়। তলস্তয় পড়ার সময় অ্যানা কারেনিনাকে আমাদের এতো কাছের বলে মনে হয়; দেড় শতাব্দী পরও আমরা বেমালুম ভুলে যাই-যে তিনি ১৮৭০ সনের সাজপোশাক পরে আছেন। আবার এ্যাডগার এলেন পো, মেলভিল বা স্তদল-এর মতো এমন অনেক লেখকও আছেন- যাদের লেখার সাহিত্যমূল্য তাদের সমকালীন পাঠকদের চেয়ে তাদের মৃত্যুর দু’শতাব্দীর পরের পাঠকরা আরো গভীরভাবে উপলব্দি করেছেন। শেষ বিচারে কতকাল অব্দি কোনো ঔপন্যাসিক বেঁচে থাকেন? বাস্তব জগতের যেসব মানুষ লেখককে বিভিন্ন চরিত্র চিত্রণে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে লেখকের যে খানিকটা দূরত্ব থাকে সে ব্যবধান লেখকের ক্ষমতাকে সীমার বাঁধনে বাঁধতে পারে না। ফ্লাবার্ট বলেন, ‘মাদাম বোভারি আমিই’ এবং তলস্তয় তাৎক্ষণিক সেই মহিলাকে শনাক্ত করে ফেলেন যাকে রাশিয়ার একটা রেলস্টেশনে এক রাতে তিনি ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছেন। এমন শনাক্তকরণের সওগাতের বিস্তার এতোটাই প্রসারিত হয়েছে যে, তলস্তয় আকাশ আর মাটির চিত্রকল্পকে এমনি একাকার করে বর্ণনা করেছেন, যেন তিনি এর মধ্যে পুরো নিবিষ্ট হয়ে আছেন। এতে অবশ্য এক ধরনের নিঃসঙ্গতারও ইঙ্গিত আছে। তবে এর অর্থ কিন্তু এ নয় যে, এটা অন্তর্মুখিতা। বরং বাইরের জগৎটাকে নিরিক্ষণকালে তা টান টান চিত্তবৈভব ও অতি সহজবোধ্যতার সুযোগ সৃষ্টি করে। আর তখন সেটা পক্ষান্তরে উপন্যাসেই ঠাঁই করে নেয়। আমি সবসময়েই ভাবি যে, কবি এবং ঔপন্যাসিকরা সে সব মানুষের মধ্যে একটা রহস্যময়তা ছড়িয়ে দিতে পারেন যারা বাহ্যত প্রাত্যহিকতায় এবং মামুলি বিষয়ে সমাচ্ছন্ন থাকেন। এর কারণ হলো এরা তাদের সম্মোহিতের মতো গভীর মননে বারংবার পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এদের এ অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মাঝেই ঘটে তাদের নিত্যদিনের যাপিত জীবনের যবনিকাপাত। আর এভাবেই রহস্য উম্মোচিত হতে হতে এক সময় অন্ধাকারে ফুটে উঠে দীপ্তির ছটা- যা তাদের অনেক গভীর গহ্বরে লুকোনো থাকে বলে প্রথম দর্শনে দৃষ্টিগোচর হয় না। কবি, ঔপন্যাসিক এবং চিত্রশিল্পীর ভূমিকা হলো সেই রহস্য ভেদ করা এবং আঁধার কুঠরিতে উজ্জ্বল আলোর বিকাশ ঘটানো- যা প্রতিটি মানুষের গহন গভীরে লুক্কায়িত। আমার দূরবর্তী আত্মীয় চিত্রশিল্পী এমেডিও মদিগলিয়ানির কথা মনে পড়ে। তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী চিত্রকর্মের মডেল হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন নামপরিচয়হীন লোকদের, রাস্তার ছেলেমেয়ে, উদ্বাস্তু, গৃহকর্মী, ক্ষুদ্র কৃষক আর তরুণ শিক্ষানবিসদের। তুলির মমতার আঁচড়ে তিনি তাদের মূর্তমান করেছেন গভীর ঐকান্তিকতায়। তাদের দিয়েছেন না বলে বরং বলা যায় রূপায়িত করেছেন- তাদের গোবেচারা চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লাবন্য ও মহত্ত্বকে। ঔপন্যাসিক তার সাহিত্যকর্মের অভিযাত্রায় ওই বাস্তবতার কোনো বিকৃতি না ঘটিয়েই এর গভীর তলদেশ থেকে মূলত তুলে আনেন সেই প্রকৃতবাস্তবকেই । অবলোহিত ও অতিবেগুনী শক্তিবলে তিনি তাদের বাহ্যিক চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা লালিত্যকে বের করে আনেন। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, ঔপন্যাসিক অন্তর্দৃষ্টিমান কিংবা দৃকশক্তিমান স্বপ্নদর্শীর মতো সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে তা করে থাকেন। তিনি যেন কেবলমাত্র বোধগম্য কম্পন অনুভব করবার জন্যে ভূকম্পবিদের মতো গিরিশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকেন। গুনমুগ্ধ পাঠক হিসেবে আমি কোনো লেখকের জীবনী পড়বার আগে অন্তত দু’বার ভাবি। জীবনীকাররা কখনো কখনো তুচ্ছ খুঁটিনাটি নিয়ে মাতামাতি করেন। নির্ভর করেন অসমর্থিত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের ওপর । তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো সৃষ্টি করে গোলক ধাঁধাঁ কিংবা চরম হতাশা। সম্প্রচারের সময় রেডিওতে গ্যাড় গ্যাড় আওয়াজ হলে সঙ্গীত শোনা যেমন অসম্ভব হয়ে পড়ে, এ ব্যাপারটাও তেমনি। তাই একজন লেখককে প্রকৃতই জানবার উপায় হলো তার লেখা বই পড়া । এভাবেই তার সঙ্গে আমাদের সখ্য গড়ে ওঠে। আর সেটা তখনই ঘটে যখন তিনি তার সবটাই উজাড় করে দেন এবং তিনি আমাদের সঙ্গে সংলাপ করেন অত্যন্ত নিম্নস্বরে। তবুও আপনি যখন কোনো লেখকের জীবনী পড়েন তখন আপনি কদাপি বাল্যকালের এমন এক লক্ষণীয় ঘটনাকে আবিষ্কার করেন যা ভবিষ্যতের কোনো সাহিত্যকর্মের সেই বীজ বপন করে- যে সম্পর্কে তিনি আগ থেকেই স্পষ্টরূপে সচেতন থাকেন না। সে লক্ষণীয় ঘটনা সাহিত্যকর্মে হানা দেয়ার জন্যে নানা ছদ্মাবরণে বার বার ফিরে ফিরে আসে। আলফ্রেড হিচকক-এর কথাই ধরা যাক। তিনি লেখক নন, তথাপিও তার চলচ্চিত্রে উপন্যাসের ন্যায় শক্তিমত্তা, সঙ্গতি ও সংসক্তি রয়েছে। যখন তার ছেলের বয়স পাঁচ বছর, তখন হিচককের বাবা তার এক পুলিশ অফিসার বন্ধুর কাছে একটা চিঠি পৌঁছে দিতে বলেন। ছেলে যথারীতি চিঠিটা প্রাপককে পৌঁছে দেয়। কিন্তু ওই পুলিশ অফিসার ছেলেটাকে থানার সেই লক-আপে আটক করে রাখেন- যে সেলটা রাতভর অপরাধীদের বন্দী করে রাখার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আতঙ্কিত ছেলেটা ঘণ্টা খানেক হাজতবাসের পর ছাড়া পায়। এবার পুলিশ অফিসার ব্যাপারটাকে খোলাসা করে- ‘বুঝলে খোকা! জীবনে কোনো অপকর্ম বা মন্দ আচরণ করলে কী দশা হয় তা তোমার জানা হয়ে গেল।’ এ পুলিশ অফিসারটি শিশু-পালনের বিষয়ে তার সেই উদ্ভট ধ্যান-ধারনাসহ অবশ্যই পরবর্তীতে হিচককের সকল চলচ্চিত্রে চিত্রিত উদ্বেগ-উৎকণ্টার বাতাবরণের নেপথ্যে মদদ যুগিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনীর অবতারণা করে আমি আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, আমার শৈশবের নির্দিষ্ট কয়েকটি টুকরো টুকরো উপখ্যান যে বীজ রোপন করেছে তা পরবর্তীতে আমার উপন্যাস হয়ে উঠেছে। সচরাচর মা-বাবার সঙ্গে আমার থাকা হতো না। এমন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে থাকতাম যাদের সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানতাম না। একের পর এক বদল করতে হয়েছে এলাকা-বাড়ি-ঠিকানা। সে সময় একজন কিশোরের কাছে কোনো কিছুই বেখাপ্পা মনে হয়নি। এমনকি উদ্ভট ও আজগুবি পরিস্থিতিকেও অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হতো। এর অনেক দিন পর আমার শৈশব আমাকে হেঁয়ালিপনায় তাড়িত করেছে এবং আমার বাবা-মা যে সকল মানুষজন ও এলাকা ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন- তাদের আমি নিরন্তর খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু এরা এমনভাবে বদলে যেতে থাকলো- যে আমি তাদের অনেকেরই হদিস করতে পারিনি। পারিনি সে সব পুরনো এলাকা বা বাড়ি-ঘরগুলোকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে। এ বিভ্রান্তি দূর করবার চেষ্টায় ব্যর্থতা এবং রহস্যের জট খুলবার প্রয়াস আমার মধ্যে লেখালেখির স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। তখন এমন মনে হয়েছে যে, যেন এ লেখালেখি আর ভাব-কল্পনা আমাকে পরিশেষে ওই শিথিল সম্পর্ক- সূতোর প্রান্তগুলোকে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছে। আমরা যখন ‘রহস্য’ প্রসঙ্গে বলতে চাই- সে ভাবনার অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের মনে ভেসে ওঠে ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘লা মিস্টারেস দা প্যারিস’ নামের ফরাসি উপন্যাসটির কথা। এ শহর- দৈবক্রমে প্যারিস- যে শহরে আমার জন্ম-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার আশৈশব সম্পর্ক। এ পরিচয়ের বন্ধন এতোটাই নিবিড় আর গভীর যে, অদ্যাবধি আমি প্যারিসের রহস্যের সন্ধান করে যাচ্ছি নিরন্তর। আমার যখন নয় কি দশ বছর বয়েস- তখন এমন ঘটলো যে, আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে একাকি হাঁটতে শুরু করি- যদিও আমার হারিয়ে যাবার ভয় ছিল, তবুও আমি হেঁটেই চলেছি অবিরাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি আশপাশের এলাকা পার হয়ে অদ্দুর চলে গেলাম যে, আমি ঠিক সেইন নদীর তীরের অপরিচিত এলাকায় পৌঁছে গেলাম। আমার শুধুমাত্র ভরসা এটুকুই যে, তখন দিনের বেলা। বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর পর্যায়ে আমি ভয় কাটিয়ে দুঃসাহসী অভিযানে বেরিয়ে পড়তে- এমনকি মেট্টোতে চড়ে দূর-দূরান্তে চলে যেতেও কুণ্ঠিত হতাম না। ঠিক এভাবেই আপনি কোনো শহর সম্পর্কে জানতে পারেন। আমি যে ঔপন্যাসিকদের গুনমুগ্ধ তাদের অনেকেরই এ দৃষ্টান্ত আমি অনুসরণ করি এবং সেজন্যে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে প্যারিস, লন্ডন, সেন্ট পিটার্সবার্গ বা স্টকহোমের মতো শহর তাদের উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ও অন্যতম মূল উপজীব্য ছিল। যাদের লেখায় মানবিকতা আহুত, জাগ্রত ও আদৃত হয়েছে তাদের অন্যতম পথিকৃৎ এডগার এ্যালেন পো তার ‘দি ম্যান অব দি ক্রাউড’ ছোটগল্পে একটি রেস্তোরাঁর জানলা দিয়ে ফুটপাত ধরে লোকজনকে অন্তহীন যাত্রায় অবিরাম চলতে দেখেছেন। বেদস্তুর চেহারার একজনকে নির্দিষ্ট করে তার সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানবার আগ্রহে রাতভর তাকে লন্ডনের আনাচে কানাচে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু সেই অজানা-অচেনা লোকটি হলো জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো সাধারণ মানুষ। এমন লোকের পিছু নেয়া নিরর্থক। কারণ সে চিরদিনই নাম-পরিচয়হীন থেকে যায় এবং তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার কোনো আত্মপরিচয় থাকে না, থাকে না কোনো স্বকীয় অস্তিত্ব। সে সাধারণ লোকের ভিড়ের অন্যতম পথিকের মতো ঠেলাঠেলি, ঘেঁষাঘেঁষি, ধাক্কাধাক্কি করে জনস্রোতে চলতে চলতে যথারীতি পথের মাঝেই হারিয়ে যায়। আমি প্রসঙ্গত কবি টমাস ডি কুইন্সি’র বেলায় যেমনটা ঘটেছিল, এর উল্লেখ করছি। তরুণ বয়েসের একটা ঘটনা তার জীবনের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। লন্ডনে অক্সফোর্ডের রাস্তার ভিড়ের মধ্যে এক তরুণীর সঙ্গে দৈবক্রমে তার সাক্ষাৎ ও পরে বন্ধুত্ব হয়। তিনি দিন কতেক সে তরুণীর সাহচর্য পান এবং ক’দিনের জন্যে লন্ডন শহরের বাইরে যান। দুজন সম্মত হয় যে, হপ্তান্তে তারা আবার একই সময়ে, একই স্থানে, প্রতিদিন বিকেলে আগের মতো মিলিত হবে। কিন্তু আর কোনোদিন তাদের পরস্পরের দেখা হয়নি। নিঃসন্দেহে একই সময়ে তারা একে অন্যকে খুঁজে বেড়িয়েছে দিনের পর দিন। মহাব্যস্ত এই জটলা-জটিল লন্ডনে হয়তো তারা একে অন্যের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুটের দূরত্বে ছিল কিংবা এমন দূরত্বে ছিল যে-ব্যবধান লন্ডনের সুপরিসর রাস্তার চেয়ে অধিক ছিলনা। কিন্তু তাদের সেই স্বল্প দূরত্ব একদিন চিরবিচ্ছেদেই পর্যবসিত হলো। যে প্রতিবেশ ও পরিবেশে মানুষ জন্ম নেয় এবং বসবাস করে সেই চিরচেনা জনপদ, রাস্তাঘাট, খানিক দেখা, কোনো খেদ বা ক্ষণিকের সুখবোধ সময়ের আবর্তে সেই মানুষদের স্মৃতিকাতর করে। তরুণ বয়েস থেকেই আমি পুরনো ফরাসি টেলিফোন নির্দেশিকা ঘাটতাম। বিশেষত সড়কের নামের আদ্যাক্ষর ও বাড়ির নম্বরের ক্রমানুসারে গ্রাহকদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর যে নির্দেশিকায় ছাপানো হতো সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখতাম- যাতে সেগুলোকে আমার লেখালেখির কাজে লাগানো যায়। কারো কারো নাম পরের বছরের নির্দেশিকা থেকে বেমালুম উধাও হয়ে যেতো। এসব পুরনো নির্দেশিকা মাঝে মধ্যে নিজকে বোকা বানিয়ে ফেলে। কারণ, এতে লিখিত তথ্যানুযায়ী নম্বরগুলোতে ফোন করে কোনোই সাড়া পাওয়া যেতো না। আমার প্রথম বই লেখার স্পৃহা ও প্রেরণা আমি ওই পুরনো ফরাসি টেলিফোন নির্দেশিকা থেকেই পাই। আমি কিছু কিছু অপরিচিত লোকের নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর পেন্সিলে আন্ডারলাইন করে রাখতাম এবং হাজার হাজার লোকের ভিড়ে তাদের জীবন কেমন ছিল- এ বিষয়ে কল্পনা করতাম। বড় শহরে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। পারেন নিজেকে গোপন বা অদৃশ্য করে ফেলতে। আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় বদলে ফেলতে পারেন এবং নতুন এক জীবন শুরু করতে পারেন। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, ব্যক্তিপরিচয় বদল করা এবং সময় পরিক্রমার বিষয়গুলো বাস্তবে সেই শহরটার পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সে কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই শহরগুলোই হয়ে উঠেছে উপন্যাসের উপজীব্য-ক্ষেত্র। কোনো কোনো নামকরা শহর তো লেখকদের নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়েই আছে, যেমন- বলজাক ও প্যারিস, ডিকেন্স ও লন্ডন, দস্তয়ভস্কি ও সেন্ট পিটার্সবার্গ, টোকিও এবং নাগাই কাফু, স্টকহোম ও জালমার সডেরবার্গ। আমি সেই প্রজন্মের মানুষ- যা এ সকল ঔপন্যাসিকদের দ্বারা প্রভাবিত এবং যে প্রজন্ম যথাযোগ্য ও বিধেয় উপায়ে সে বিষয়টির অনুসন্ধান চালাতে চায়- যাকে বোঁদলেয়ার বলতেন ‘প্রাচীন শহরের সর্পিল ভাঁজ’। একথা সত্য যে, ৫০ বছর আগে, অন্য কথায়, আমার বয়ঃসন্ধিক্ষণে যে শহরকে আবিষ্কার করার জন্যে আমি তীব্র উত্তেজনা অনুভবের অভিজ্ঞতা অর্জন শুরু করেছি, সেই শহরে তখন চলছে নিরন্তর পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এদের কোনো কোনোটা- মার্কিন মুলুক এবং যে এলাকাকে লোকেরা তৃতীয় বিশ্ব বলে থাকে- সেগুলো জঞ্জালের নতুন মাত্রাযুক্ত করে মেগাসিটিতে পরিণত হয়। এর বাসিন্দারা অর্থনৈতিক বৈষম্যে শ্রেণীবিভক্ত হয়ে উপেক্ষা কিংবা অবজ্ঞার পাত্র হতে শুরু করে। সমাজকল্যাণমূলক সেবার আওতায় শুরু হয় এদের জীবন-যাপন। দিনকে দিন বাড়তে থাকে বস্তির সংখ্যা। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ঔপন্যাসিকরা নগরজীবন সম্পর্কে এক ধরনের রোমান্টিক ভাবধারা পোষণ করতো- যা ডিকেন্স বা বোঁদলেয়ার-এর ভাবদর্শন থেকে আলাদা কিছু নয়। সে কারণেই আমি জানতে আগ্রহী হই যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথাসাহিত্যিকরা কেমন করে কোলাহলপূর্ণ একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর বেসামাল নগরকে তাদের উপন্যাসের উপজীব্য করতে আহ্বান করবেন। আমার বই সম্পর্কে আপনারা দয়াপরবশ হয়ে উল্লেখ করেছেন যে, আমার সাহিত্যকর্ম ‘শৈল্পিক স্মৃতিগ্রন্থনা- যার মধ্য দিয়ে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের দুর্বোধ্য এবং অনায়ত্ত ভাগ্যের কথা।’ কিন্তু আমি আসলে যা- এ প্রশংসা তার চেয়ে অনেকখানিই বেশি। হারিয়ে যাওয়া হৈমশিলা আবার যেমন সমুদ্র-পৃষ্ঠে ভেসে উঠে- তেমনি বিস্মরণের সাদা কাগজটার প্রলেপ ভেদ করে বিবর্ণ ভাবনাগুলোকে বর্ণিল ও দৃশ্যমান করে ফুটিয়ে তোলাই একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পবৃত্তি। (সংক্ষেপিত)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete'প্যাত্রিক মোদিয়ানো’র নোবেল ভাষণ-২০১৪ ' টি অনুবাদ করেছেন ড. নেয়ামত উল্যা ভুঁইয়া-- যা বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্যান্য কিছু পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদকের নাম যথাযথভাবে লেখাটিতে অবিলম্বে সন্নিবেশ করার জন্য 'সংবাদ পরিক্রমা' ও 'Natun Barta' কে বিনীত অনুরোধ করা হল।
ReplyDeleteউপর্যুক্ত 'প্যাত্রিক মোদিয়ানো’র নোবেল ভাষণ-২০১৪ ' টি অনুবাদ করেছেন ড. নেয়ামত উল্যা ভুঁইয়া-- যা বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্যান্য কিছু পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদকের নাম যথাযথভাবে লেখাটিতে অবিলম্বে সন্নিবেশ করার জন্য 'সংবাদ পরিক্রমা' ও 'Natun Barta' কে অনুরোধ করা হল। আর বিধিমতে সেটা প্রকাশকের অবশ্য পালণীয় বিষয় বটে।
ReplyDeleteভাষান্তর : ড.নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া
ReplyDeleteপ্যাত্রিক মোদিয়ানোর নোবেল ভাষণ
বাংলাদেশ প্রতিদিন
প্রকাশ : শুক্রবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা
আপলোড : ২ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০
https://www.bd-pratidin.com/rokomari-sahitto/2015/01/02/53630
ReplyDeletehttps://www.bd-pratidin.com/amp/rokomari-sahitto/2015/01/02/53630
#poetryofdrneyamatbhuiyan
#ড_নেয়ামতউল্যাভূঁইয়া #Neyamat
#poetrybyneyamat #বাংলাকবিতা
#নেয়ামতভূঁইয়ারকবিতা #নেয়ামত #কবিতা
#poetryofneyamat #neyamat_poetry
#bengalipoetry #বাংলাকবিতা #poems
#bengalipoetrycommunity #সাহিত্য #poems #englishliterature #গীত #bengalikobita #গীতিকবিতা #lyrics
#englishpoetry #englishpoems #lyricist #lyricalpoems #twitterpoets #lovepoems #twitterwriters #poetry_community #writingcommunity #Dr_NeyamatUllahBhuiyan