কুষ্টিয়ার পাঁচ বীরাঙ্গনার খোঁজ রাখেনা কেউ কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া টাইম নিউজ বিডি, ১০ মে, ২০১৫ ১৮:২৬:৪২ কুষ্টিয়ার পাঁচ বীরাঙ্গনা জননীর খোঁজ রাখেনা কেউ। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় বীভৎসতার নির্মম সাক্ষী হয়ে এখনও বেঁচে আছেন কুষ্টিয়ার পাঁচ বীরাঙ্গনা জননী। সদর উপজেলার রাবেয়া, কুমারখালীর দয়রামপুরের দুলজান নেছা, ও মাসুদা বেগম এবং পার্শ্ববর্তী মঠমালিয়াট গ্রামের মোমেনা খাতুন স্বাধীনতার
৪৪ বছরে না পেয়েছেন মর্যাদা, না মিলেছে তাদের শান্তিপূর্ণ আশ্রয় ও পুনর্বাসন। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের যাপিত জীবন যেমন মানবেতর, তেমনি সামাজিকভাবে নিগৃহীতও বটে। কি এনজিও, কি সরকারি সংস্থা সবাই তাদের ব্যবহার করছে পণ্য হিসেবে। ফলে লোকলজ্জার চেয়েও জীবন সায়াহ্নে এসে তাদের মনে দানা বেঁধেছে বিশ্বাসহীনতা। বীরাঙ্গনারা জানান, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার-আলবদরদের বিচারের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি আন্দোলন শুরু করলে ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ সেখানকার বীরাঙ্গনারা গণআদালতে সাক্ষ্য দিতে ঢাকায় আসেন। কুষ্টিয়া জেলার তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহমেদ তাদের ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। গণআদালতে সাক্ষ্য দিয়ে গ্রামে ফিরে বীরাঙ্গনারা বিরোধীদের রোষাণলে পড়েন। আর তাদের স্বামীরা হাট-বাজারে ঠাট্টা-মস্করার শিকার হন। নানা উপহাস সইতে হয় তাদের ছেলেমেয়েদের। এখন এ সমস্যা না থাকলেও অভাব-অনটনে জর্জরিত জীবন তাদের। বীরাঙ্গনাদের একজন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার জিয়ারুখী ইউনিয়নের বংশীতলার রাবেয়া খাতুনের বয়স এখন ৬৬ বছর। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করতেন তিনি। সে খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায় তার বাড়িতে। নির্যাতন চলে তার ওপর। এরপর শুরু হয় সামাজিক অবহেলা আর অপমান। এসব কষ্ট বুকে নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি। বীরাঙ্গনা রাবেয়ার তিন ছেলে আর দুই মেয়ে। স্বামী গোলাম রহমান শেখ প্রায় ছয় বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে থাকেন ছোট ছেলে আফাজ উদ্দিনের সঙ্গে। যুদ্ধের স্মৃতিস্মরণ করে রাবেয়া বলেন, ‘ঘটনার দিন ছিল ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। আচমকা এর কিছুদিন আগে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে আইছিল। তারা কয় কিছুদিন থাকব। স্বামী ভালা মানুষ আছিল। কইল থাকুক, যুদ্ধ করবিনে; দেশ স্বাধীন অইব। আমি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না কইরি খাওয়াইছি। কিন্তু মেলেটারিরা খবর পাইয়ি গেছিল। বাড়িতে হামলা চালায়ি আমাক নির্যাতন করছিল। সেই কষ্ট বুকে নিই আজও বাইচি আছি। ছাওয়ালের সংসারি থাকি। কোনোরকম চইলি যায়। স্বামীর চিকিৎসার জন্যই পিরায় এক লাখ ট্যাকা দিনা হয়েছিল। সেই ট্যাকা এখনও শোধ করতে পারছিনে।’ তিনি জানান, মাঝে মাঝে এনজিও এবং স্থানীয় সরকারের প্রশাসনের লোকজন আসে, সাহায্য দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু চলে যাওয়ার পর আর কেউ খবর রাখে না। সেই দুঃখ-দুর্দশা নিয়েই তাকে জীবন কাটাতে হয়। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার সিরাজুল হক বলেন, রাবেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সহযোগী। যুদ্ধের সময় রাবেয়া ও তার স্বামী আমাদের রান্না করে খাইয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে রাবেয়ার নাম মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় অজ্ঞাত কারণে রাবেয়াকে নারী মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেয়নি। এ নিয়ে রাবেয়ার স্বামী আমাকে ভুল বুঝে মারা গেল। কারণ তার স্বামী বলত আমি বীরাঙ্গনা মেনে সংসার করছি, সরকার কেন তার স্বীকৃতি দেবে না? এলেজান : এলেজানের সংসারে দারুণ টানাপড়েন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। মাত্র তিন মাস আগে তার বিয়ে হয় আকবর আলীর সঙ্গে। ভালোই চলছিল নতুন সংসার। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মাঝামাঝি সময়ে এসে পাল্টে যায় জীবনের সবকিছু। এলেজান বলেন, 'একাত্তরের সে সব ঘটনা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। নতুন করে বলে-কয়ে কী হবে? আমার বুকির ব্যারাম। ধড়ফড় করে সব সময়। ওষুধ নাই তাই বুকি ত্যাল ঘষি।' তিনি জানান, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় এখন আর কাজকর্ম তেমন করতে পারেন না। মেয়েদের একজন পরের বাড়িতে কাজ করে। আর দু'জন শ্বশুরবাড়িতে কোনো রকমে টিকে আছে। দুলজান: মৃত তেজের আলী মল ছিলেন নদীভাঙন কবলিত মানুষ। পদ্মা সব কিছু গ্রাস করলে চর থেকে তিনি এসে ঘর তোলেন পার্শ্ববর্তী দয়রামপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের তিন বছর আগে দুলজানকে বিয়ে করেন তেজের মল। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে অন্য দুই নারীর মতো দুলজানও হন নির্যাতিত। দুলজানের বয়স এখন ৭৬। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করেছিল তার বুকে-পিঠে। সেই থেকে চিরস্থায়ী বুকের ব্যথা নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় বেঁচে আছেন তিনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক উপসর্গও দিন দিন বড় আকার ধারণ করছে। দুলজানের নাতজামাই সাবু জানান, তার নানিশাশুড়ি এখন আর কথা বলতে চান না। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও সংগঠনের কেউ কেউ তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে শুধু ছবি তুলে নিয়ে যায়। তারা অপেক্ষায় থাকেন কিন্তু কোনোদিনই কেউ আর ফিরে আসেনি তার চিকিৎসা খরচ নিয়ে। মাসুদা: হাশিমপুরের আরেক বীরাঙ্গনা মাসুদা খাতুন সঠিক জানেন না তার কী হয়েছে। স্বামী মফিজ উদ্দিন শেখের ধারণা, তার ক্যান্সার হয়েছে। কিছু খেতে পারেন না। মাসুদার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে তার স্বামী বিক্রি করেছেন সংসারের অনেক কিছু। এরপরও মাসুদার বেঁচে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন মফিজ। তাদের চার ছেলে দুই মেয়ে। ছোট ছেলে পড়াশোনা করে এবং অন্যরা কাজ করে। একটি মাত্র ঘরেই সবার বসবাস। মাসুদা খাতুন বলেন, ৯ বছরে আমার বিয়ে হয়। যুদ্ধের সময় আমার তিন সন্তান ছিল। বাংলা আশ্বিন মাসে একদিন পাক বাহিনী স্থানীয় রাজাকার (মৃত) চাঁদ আলী, রশিদ কারিকরের সহায়তায় বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং আমাকে নির্যাতন করে। তিনি বলেন, ১৯৬১ সালে বিয়ে হয়েছিল। আমি তখন খুব ছোট। আমার স্বামী ভালা লোক। তাই যুদ্ধের পরেও আমারে ছেড়ে দেয়নি। মাসুদা আরও বলেন, শেখের বেটি (বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা) একবার আমাগো (এলেজান, দুলাজান, মাসুদা) ঢাকায় নিয়ে ৫০ হাজার টাকা দিছিল (১৯৯৬)। কিন্তু এখন আর কেউই খোঁজ রাখে না। মোমেনা: ৬০ বছরের বৃদ্ধ মোমেনা খাতুন। দুই ছেলেমেয়ের সংসারে থাকেন। তার স্বামী আবদুল কাদের মালিথাও অসুস্থ। কাজকর্মও তেমন একটি করেন না। আগে লোকজনের কথোপকথনে লজ্জা পেতেন, নিজেদের হীন ভাবতেন। এখন তিনি ভাবেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেপথ্যে তাদেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মোমেনা খাতুন বলেন, 'যুদ্ধের সময় মানুষের কত ক্ষতি হইছে। প্রাণ গেছে, বাড়িঘর গেছে। এগুলো মনে রাইখা কী হইব। কিন্তু যখন মানুষ নিন্দে করে তখন খুব খারাপ লাগে। যুদ্ধের সময় তখন আমার ১৭-১৮ বছর। বাংলা আশ্বিন মাসে একদিন মেলেটারি বাড়িঘর ঘেরাও দেয়। নির্যাতন কইরে আগুন দেয়। আমার কী দোষ। প্রায়ই মানুষজন আসে, খবর নিয়ে চলে যায়। পরে কেউ খোঁজ নেয় না।' এমকে
No comments:
Post a Comment