Saturday, April 11, 2015

বেসরকারি বিনিয়োগেও চলছে খরা:অন্যদিগন্ত

‘আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগ। যথেষ্ট বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়ার কারণেই পাচার (অর্থ) সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। সেটা দুবাই কিংবা মালয়েশিয়া যেখানেই হোক। বিনিয়োগ হয় নাÑ এর একটি কারণ সব কাগজে লেখে, রাজনৈতিক অস্থিরতাÑ যার ফলে আস্থার অভাব। কিন্তু আমি জানি না, এটা কতদূর সত্যি। ’



এই সরল ¯^ীকারোক্তিটি আর কারো না, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের। গত ১

০ মে অর্থনৈতিক বিষয়ে যারা সংবাদিকতা করেন তাদের ফোরাম ইআরএফের সাথে এক বাজেট আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা সবখানেই কিছু না কিছু থাকে এবং সে সময়েও বিনিয়োগ হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আমাদের দেশেও বিনিয়োগ হয়েছে। অতীতে এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। আর আস্থার অভাবের বিষয়টি আমি বুঝতে পারি না। কারণ এ মুহূর্তে বাংলাদেশে একটি ভালো বাজার রয়েছে। বর্তমানে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের মার্কেট রয়েছে। এতে করে এখানে বিনিয়োগ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু তারপরও কেন আস্থার অভাব সেটা আমার বোধগম্য নয়। আমার কাছে বোধগম্য না হলেও বাস্তবে তা-ই আছে। বাট হোয়াট ক্যান আই ডু ?’



হ্যাঁ, সত্যিই এ বিষয়ে তার তেমন কিছুই করার নেই। কারণ ছয় বছর ধরে তিনি চেষ্টা করছেন, সেটা বক্তৃতার মাধ্যমেই হোক বা কাগজে কলমেই হোক, কাজের কাজ কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা ব্যাখ্যা করার আগে দেখে নেয়া যাক দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিস্থিতিটা কী পর্যায়ে রয়েছে।



বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এতে চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা ছিল গত ১১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। গত বছরের একই মাসে যা ছিল ১৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর শেষে যা ছিল ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।



বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাস শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার ১৭৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা এর আগের বছরের একই মাসে ছিল চার লাখ ৩৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে হিসেবে চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। ওই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরের পর চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে নেতিবাচক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশে বর্তমানে অদ্ভুত এক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এটি ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস কি না তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করার মতো সাহস পাচ্ছে না। একই সাথে কেউ ব্যবসায় স¤প্রসারণেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারা আরো সময় নিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিনিয়োগে আসতে চান। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণও কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ফেব্রæয়ারি মাসে দেশের অভ্যš—রীণ খাতে মোট ছয় লাখ ৮ হাজার ৮০৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা ২০১৩ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ছিল পাঁচ লাখ ৪৭ হাজার ৬০১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সে হিসেবে ব্যাংকগুলোর অভ্যš—রীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ঘোষিত মুদ্রানীতিতে জানুয়ারি-জুন সময়কালের জন্য ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সা¤প্রতিক মাসগুলোতে সরকারের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে, যা অভ্যš—রীণ খাতে ঋণ বিতরণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূলত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা¯—বায়নে ধীরগতি এবং সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ব্যাংকঋণের নির্ভরতা কমেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, গত বছরের শুরু থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। দেশে বর্তমানে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করলেও অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা সাহস করে এগিয়ে আসছেন না। তাই ঋণের চাহিদা না বাড়ায় ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বাড়েনি। এখনো গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কেউ বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে না।


বিদেশী বিনিয়োগও কমছে
বিনিয়োগের বোর্ডের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর দেশী বিনিয়োগ কমে গেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দেশে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ৪২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্পের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৯৭টি।
আগের বছর ২০১২ সালে এক হাজার ৬৫৫টি শিল্প প্রকল্পের বিপরীতে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৭৮ কোটি ছয় লাখ টাকার। অর্থাৎ বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ।
বিনিয়োগ বোর্ড যে হিসাবটি দিয়েছে তার সবগুলোই প্রস্তাবিত বিনিয়োগ। এটি দিয়ে প্রকৃত বিনিয়োগের কোনো চিত্র পাওয়া যাবে না। এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। দেখা গেছে, নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখে না। অনেকে স্রেফ নিবন্ধন দেখিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন।
একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, গত ৫ জানুয়ারি দেশে ভোটারবিহীন এক নির্বাচনের পর দেশে একটি সরকার থাকলেও তা প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। এ ধরনের একটি সরকারের সময় দেশী বা বিদেশী কেউ দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে না। যেখানে বিনিয়োগই হচ্ছে না সেখানে কিভাবে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হবে।


সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু


 

No comments:

Post a Comment