ঘরবাড়ির নক্সা করিয়ে নিতে আসিবে, কত লোকের বাড়ি-ঘর বাঁধিয়া দিব। আমি একটা “দশজনের একজন” হইব। বলিস্ কি; আমার নামে একটা স্ট্রীট যদি না হয়, তখন দেখিস্।’ তৃতীয় ভ্রাতা-‘বিল্ডার, কন্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার সব বাজে লোক, তোরা হ’বি চিনির বলদ। আমি কি করিব জানিস্। আমি অন্যের কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করিতে যাইব কেন। সব কাজে আমার নিজের বুদ্ধি খাটিবে। সব নূতন ফ্যাসানে বাড়ি-ঘর করিব। আমার সব এমন হইবে, যাহা কেহ কখন দেখে নাই।’ শেষ ব্যক্তি উঠিয়া বলল-‘তোরা যাহাই করিস্ ভাই এমন কিছু করিতে পারিবি না, যাহার উপর আমার বক্তৃতা না চলিবে। উত্তম হইল; দেখ্ দেখি। তোরা যাহা করিবি, আমি তাহার দোষ ধরিব। আমার কাজের আর অভাব কি? চারি ভায়ের পরামর্শ ঠিক হইল। একজন ইঁটের কাজ করিয়া কিছু টাকা করিল। ইঁট দিয়া তাহার একটি বাড়ি হইল। তাছাড়া এক দুঃখিনী বুড়িকে ঐ ইঁট দিয়া আর একটি ঘর করিয়া দিল। কন্ট্রাক্টর ইত্যাদি মহাশয়ও কথামত কাজ করিলেন। মিউনিসিপ্যালটিকে খোঁচাইয়া নিজের নামে একটি স্ট্রীট পর্যন্ত কেমন করিয়া লইয়াছেন। তিনিও একটা কিছু হইয়াছেন। তৃতীয় বেচারা নূতন ধরনে বাড়ি করিতে দিয়া চাপা পড়িয়া মরিল। খুঁতধরা মহাশয়ের ত কথাই নাই। তাহার কাজ ফুরায়ই না। মরিবার সময় পর্যন্ত সে সন্তোষজনক রূপে, প্রশংসার সহিত কর্তব্য-কাজ করিয়া গেল। একদিন স্বর্গের দরজায় দারোয়ান-দেবতা বসিয়া রহিয়াছেন। সে প্রকাণ্ড দরজা। বিশ্বকর্মার হাতের তৈরি। বুঝিতেই ত পার, স্বয়ং বিশ্বকর্মা ঠাকুর যাহা করিয়াছেন সে কেমন সুন্দর। এত সুন্দর যে আর কি বলিব! দরজায় প্রকাণ্ড দুখানা কাচ লাগান। তাহার ভিতর দিয়া দরোয়ান-ঠাকুর কে আসিল দেখিতে পান। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তাহা করিতেছিলে না। অনেক কাল হইল স্বর্গে লোক আসে না,। তাই আজ-কালের ব্যস্ততা কিছু কম।দেবতা দরজা খুলিবার হীরার হ্যান্ডেলে হাত ঝুলাইয়া সোনার টুলে বসিয়া ঝিমাইতেছেন। এমন সময় কড়াৎ কড়াৎ করিয়া দরজার ঘা মারিবার শব্দ হইল। বাহির হইতে একজন লোক বলিতেছেন- ‘অনুগ্রহ করুন মহাশয়, আমি ভিতরে আসিতে প্রার্থনা করিতে পারি? দরজাগুলি ত মন্দ নয়। কিন্তু স্বর্গের দ্বার বন্ধ থাকিবে কেন? দরজাগুলি আরো বড় হওয়া উচিত।’ ‘তুই কেরে, পৃথিবীর লোক, ক্যাচ্ ক্যাচ্ করিয়া কথা কহিতেছিস্?’ ‘অত মোটা সুরে বলিতেছেন কেন?- আমি স্বর্গে যাইতে চাই।’ ‘বটে? তুই করিয়াছিস কে?’ ‘আমি খুঁত-ধরা কাজ করিয়াছি। আমার তিন ভাই যে কাজ করিয়াছে, তাহার সমস্ত দোষ আমার নোট বহিতে লিখিয়া আনিয়াছি। যে ইঁট পোড়াইয়াছিল, সে আর দুই মণ কয়লা কম খরচ করিলে সুরকিওয়ালা সহজেই খোয়া করিতে পারিতে। যার নামে স্ট্রীট হইয়াছে, সে এত রোগা যে অত বড় স্ট্রীট তাহার দরকার নাই। যে চাপা পড়িয়া মরিয়াছে- ’ ‘আরে থাম্ থাম। ও-সব কি কাজ? তুই নিজের হাতে কি করিয়াছিস্? ‘এই-সব নোট লিখিয়াছি।’ ‘দূর হ ব্যাটা, তুই কি আর কোন কাজই করিস্ নাই? কেবল দোষ ধরা কাজই করিয়াছিস্?’ ‘আর স্মৃতি পুস্তিকায় তাহা লিখিয়াছি।’ ‘যা, যা! তোর এখানে আসিবার হুকুম নাই।’ ‘আউ পচারিব কাঙ্কু, জগনাথঙ্কু,-‘ বলিয়া দারোয়ান দেবতা গান ধরিলেন। আমাদের সমালোচক দেখিলেন যে এত পথ খরচ, রেলভাড়া, গাড়িভাড়া করিয়া আসিয়াও কোন ফল পাইলেন না। বিরক্ত হইয়া মনে করিলেন যে, কাগজে লেখা উচিত ‘স্বর্গে ভালো অভ্যর্থনার বন্দোবস্ত নাই।’ গাড়ি পাইতে অনেক দেরি, সুতরাং ইত্যবসরে দরজার দোষগুলি টুকিয়া রাখিতে লাগিলেন। দরজার কথা শেষ হইলে, সাহেব দ্বারী-ঠাকুরের গানের এক মজার বর্ণনা লিখিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন যে, যে বুড়িকে তাহার ভাই ঘর করিয়া দিয়াছিল, সে আসিতেছে। তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘ও বুড়ি! তুই কেমন করিয়া আসিলি?’ ‘তাই ত বাপু, আমি ত কিছু জানি না। আমি দুঃখিনী বুড়ি, এমন ত কিছু করি নাই, যাহাতে এখানে আসিতে পারি।’ ‘তুই কি কোন কাজ করিস্ নাই? আমি ত সমালোচনা করিয়াছি।’ ‘আমার আর ত কিছুই মনে হয় না। তবে একদিন আমার বাড়ির কাছে পুকুরে জমা বরফের উপরে পাড়ার সকলে খেলা করিতে গিয়াছিল। যাইবার সময় আমাকে সকলেই দেখিয়া মিষ্টি কথা কহিয়া গেল। আমি ভয়ানক কাতর ছিলাম। কিছুকাল পরে দেখি, আকাশে একরকম মেঘ দেখা দিয়াছে। ওরূপ মেঘ আমার জন্মে আমি আর একবার দেখিছিয়ালাম। তখন দুই মিনিটে মধ্যে সমুদয় বরফ ফাটিয়া গিয়াছিল। আমার মনে বড় ভয় হইল। এখনই এতগুলি লোক ডুবিয়া মরিবে ভাবিয়া আমার চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। আমি কি করি? রোগে মরি, উঠিবার শক্তি নাই, ডাকিলেও কেউ আমার কথা শুনিবে না। তখন আমি আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাহিরে আসিয়া আপনার(নিজের) ঘরে আগুণ লাগাইয়া দিলাম। সকল লোক বুড়ি পুড়িয়া মরিল মনে করিয়া দৌড়িয়া আসিল। আমি তারপর কি হইল বিশেষ জানি না। কেবলমাত্র একবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কার কিছু হয় নি ত?’একজন লোক বলিল, ‘না, আমরাও আসিয়াছি আর বরফও ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।’ তারপর আর কিছু জানি না। কে যেন আমাকে এখানে আনিয়াছে।’ বুড়ির কথা শুনিয়া দরোয়ান-দেবতা স্বর্গে খবর দিলেন। আর দলে দলে দেবতারা আসিয়া ‘এসো এসো’ বলিয়া আদর করিয়া বুড়িকে স্বর্গের ভিতরে লইয়া চলিলেন। কিন্তু বুড়ি সমালোচকের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল। বলিল-‘ওর ভাই আমাকে বাড়ি করিয়া দিয়াছিল, আমার থাকিবার জায়গা ছিল না। ও মুখ কাল করিয়া ফিরিয়া যাইবে, আর আমি কোন প্রাণে তোমাদের সঙ্গে যাইব? আমার মনে বড় লাগে। আমাকে তোমরা স্বর্গে নিও না। এ বেচারা তাহা হইলে বড় কষ্ট পাইবে।’ তখন দেবতারা সমালোচককে-‘অলস! অপদার্থ! যা! বুড়ির জন্য তোকে স্বর্গে নিয়া যাওয়া হইল। তুই জীবনটা কেবল সমালোচনা করিয়াই কাটাইলি, ভাল কাজ কিছুই করিলি না। তোর মতন লোক আর এর পূর্বে স্বর্গে যায় নাই। দেবতারা তারপর বুড়ির সঙ্গে সমালোচককেও টানিয়া স্বর্গে নিয়া চলিলেন। সমালোচক হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। একবার মাত্র বলিল,‘টানিয়া লওয়া বুঝি তোমাদের অভ্যাস নাই? ভাল করিয়া টানা হইতেছে না। এমনি বুঝি টানে।’ ঢেঁকি যেখানে থাক্, তার ধান ভানা কাজ ঘোচে না। আমাদের সমালোচক ভায়া স্বর্গে গিয়াও খুঁত ধরিতে ব্যস্ত, আর কিইবা করে, একটা কাজ ত চাই? কতকগুলি ছেলে আছে, তাহারা কেবলই খুঁত ধরে; পরের দোষ দেখিয়া তাহার নিন্দা করার চেয়ে নিজের শোধরাইয়া পরের গুণ দেখা ভাল। ( উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১০ মে, ১৮৬৩ - ২০ ডিসেম্বর, ১৯১৫) বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। সন্দেশ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন যা পরে তার পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি তারই অমর সৃষ্টি। উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ (১৮৬৩ সালের ১০ মে) কিশোরগঞ্জ জেলার মসূয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত। তার পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন ও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। তার ডাকনাম ছিল শ্যামসুন্দর মুন্সী। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান। তার পৈত্রিক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তার পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভালো ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। একুশ বছর বয়সে বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ায় তার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময়কার সখা, সাথী, মুকুল ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তার লেখা প্রকাশ হতে সুরু হয়। প্রথমদিকের (যেমন সখা, ১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ।[১] তার পরে চিত্র অলঙ্করণযুক্ত গল্প প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়। ১৮৮৬ সালে ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়, এবং তখনকার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোরেরর সংসার জীবন শুরু হয়। উপেন্দ্রকিশোরের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল, এবং মেয়েরা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে তার প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হলেও মুদ্রণ সম্বন্ধে অতৃপ্ত উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন, এবং ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। এখানের একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। ১৯১১ সালে তিনি বড় ছেলে সুকুমারকে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্যে। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।)
Sunday, December 21, 2014
খুঁত ধরা ছেলে :Natun Barta
বিলাতে চারিটি ভাই একদিন এক জায়গায় বসিয়া কথাবার্তা কহিতেছিলেন। তাহাদের আলাপের বিষয়, কে কি করিবে। সকলেরই মনে ইচ্ছা, একটা কিছু হওয়া চাই। সকলের ‘একটা কিছু’ত আর একরকম হয় না। তাই চার ভাই চাররকম কথা বলিল। একজন বলিল-‘আমি ইঁটের কারবার করিব। তাহাতে টাকা হইবে, আর ইঁট দিয়া আমার একখানা বাড়ি করিব।’ আর-একজন বলিল-‘দূর হ, তোর নেহাত ছোট নজর। আমি তোর চাইতে বেশি একটা কিছু হ’ব-আমি ইঞ্জিনিয়ার হ’ব। কত লোক আমার কাছে
ঘরবাড়ির নক্সা করিয়ে নিতে আসিবে, কত লোকের বাড়ি-ঘর বাঁধিয়া দিব। আমি একটা “দশজনের একজন” হইব। বলিস্ কি; আমার নামে একটা স্ট্রীট যদি না হয়, তখন দেখিস্।’ তৃতীয় ভ্রাতা-‘বিল্ডার, কন্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার সব বাজে লোক, তোরা হ’বি চিনির বলদ। আমি কি করিব জানিস্। আমি অন্যের কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করিতে যাইব কেন। সব কাজে আমার নিজের বুদ্ধি খাটিবে। সব নূতন ফ্যাসানে বাড়ি-ঘর করিব। আমার সব এমন হইবে, যাহা কেহ কখন দেখে নাই।’ শেষ ব্যক্তি উঠিয়া বলল-‘তোরা যাহাই করিস্ ভাই এমন কিছু করিতে পারিবি না, যাহার উপর আমার বক্তৃতা না চলিবে। উত্তম হইল; দেখ্ দেখি। তোরা যাহা করিবি, আমি তাহার দোষ ধরিব। আমার কাজের আর অভাব কি? চারি ভায়ের পরামর্শ ঠিক হইল। একজন ইঁটের কাজ করিয়া কিছু টাকা করিল। ইঁট দিয়া তাহার একটি বাড়ি হইল। তাছাড়া এক দুঃখিনী বুড়িকে ঐ ইঁট দিয়া আর একটি ঘর করিয়া দিল। কন্ট্রাক্টর ইত্যাদি মহাশয়ও কথামত কাজ করিলেন। মিউনিসিপ্যালটিকে খোঁচাইয়া নিজের নামে একটি স্ট্রীট পর্যন্ত কেমন করিয়া লইয়াছেন। তিনিও একটা কিছু হইয়াছেন। তৃতীয় বেচারা নূতন ধরনে বাড়ি করিতে দিয়া চাপা পড়িয়া মরিল। খুঁতধরা মহাশয়ের ত কথাই নাই। তাহার কাজ ফুরায়ই না। মরিবার সময় পর্যন্ত সে সন্তোষজনক রূপে, প্রশংসার সহিত কর্তব্য-কাজ করিয়া গেল। একদিন স্বর্গের দরজায় দারোয়ান-দেবতা বসিয়া রহিয়াছেন। সে প্রকাণ্ড দরজা। বিশ্বকর্মার হাতের তৈরি। বুঝিতেই ত পার, স্বয়ং বিশ্বকর্মা ঠাকুর যাহা করিয়াছেন সে কেমন সুন্দর। এত সুন্দর যে আর কি বলিব! দরজায় প্রকাণ্ড দুখানা কাচ লাগান। তাহার ভিতর দিয়া দরোয়ান-ঠাকুর কে আসিল দেখিতে পান। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তাহা করিতেছিলে না। অনেক কাল হইল স্বর্গে লোক আসে না,। তাই আজ-কালের ব্যস্ততা কিছু কম।দেবতা দরজা খুলিবার হীরার হ্যান্ডেলে হাত ঝুলাইয়া সোনার টুলে বসিয়া ঝিমাইতেছেন। এমন সময় কড়াৎ কড়াৎ করিয়া দরজার ঘা মারিবার শব্দ হইল। বাহির হইতে একজন লোক বলিতেছেন- ‘অনুগ্রহ করুন মহাশয়, আমি ভিতরে আসিতে প্রার্থনা করিতে পারি? দরজাগুলি ত মন্দ নয়। কিন্তু স্বর্গের দ্বার বন্ধ থাকিবে কেন? দরজাগুলি আরো বড় হওয়া উচিত।’ ‘তুই কেরে, পৃথিবীর লোক, ক্যাচ্ ক্যাচ্ করিয়া কথা কহিতেছিস্?’ ‘অত মোটা সুরে বলিতেছেন কেন?- আমি স্বর্গে যাইতে চাই।’ ‘বটে? তুই করিয়াছিস কে?’ ‘আমি খুঁত-ধরা কাজ করিয়াছি। আমার তিন ভাই যে কাজ করিয়াছে, তাহার সমস্ত দোষ আমার নোট বহিতে লিখিয়া আনিয়াছি। যে ইঁট পোড়াইয়াছিল, সে আর দুই মণ কয়লা কম খরচ করিলে সুরকিওয়ালা সহজেই খোয়া করিতে পারিতে। যার নামে স্ট্রীট হইয়াছে, সে এত রোগা যে অত বড় স্ট্রীট তাহার দরকার নাই। যে চাপা পড়িয়া মরিয়াছে- ’ ‘আরে থাম্ থাম। ও-সব কি কাজ? তুই নিজের হাতে কি করিয়াছিস্? ‘এই-সব নোট লিখিয়াছি।’ ‘দূর হ ব্যাটা, তুই কি আর কোন কাজই করিস্ নাই? কেবল দোষ ধরা কাজই করিয়াছিস্?’ ‘আর স্মৃতি পুস্তিকায় তাহা লিখিয়াছি।’ ‘যা, যা! তোর এখানে আসিবার হুকুম নাই।’ ‘আউ পচারিব কাঙ্কু, জগনাথঙ্কু,-‘ বলিয়া দারোয়ান দেবতা গান ধরিলেন। আমাদের সমালোচক দেখিলেন যে এত পথ খরচ, রেলভাড়া, গাড়িভাড়া করিয়া আসিয়াও কোন ফল পাইলেন না। বিরক্ত হইয়া মনে করিলেন যে, কাগজে লেখা উচিত ‘স্বর্গে ভালো অভ্যর্থনার বন্দোবস্ত নাই।’ গাড়ি পাইতে অনেক দেরি, সুতরাং ইত্যবসরে দরজার দোষগুলি টুকিয়া রাখিতে লাগিলেন। দরজার কথা শেষ হইলে, সাহেব দ্বারী-ঠাকুরের গানের এক মজার বর্ণনা লিখিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন যে, যে বুড়িকে তাহার ভাই ঘর করিয়া দিয়াছিল, সে আসিতেছে। তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘ও বুড়ি! তুই কেমন করিয়া আসিলি?’ ‘তাই ত বাপু, আমি ত কিছু জানি না। আমি দুঃখিনী বুড়ি, এমন ত কিছু করি নাই, যাহাতে এখানে আসিতে পারি।’ ‘তুই কি কোন কাজ করিস্ নাই? আমি ত সমালোচনা করিয়াছি।’ ‘আমার আর ত কিছুই মনে হয় না। তবে একদিন আমার বাড়ির কাছে পুকুরে জমা বরফের উপরে পাড়ার সকলে খেলা করিতে গিয়াছিল। যাইবার সময় আমাকে সকলেই দেখিয়া মিষ্টি কথা কহিয়া গেল। আমি ভয়ানক কাতর ছিলাম। কিছুকাল পরে দেখি, আকাশে একরকম মেঘ দেখা দিয়াছে। ওরূপ মেঘ আমার জন্মে আমি আর একবার দেখিছিয়ালাম। তখন দুই মিনিটে মধ্যে সমুদয় বরফ ফাটিয়া গিয়াছিল। আমার মনে বড় ভয় হইল। এখনই এতগুলি লোক ডুবিয়া মরিবে ভাবিয়া আমার চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। আমি কি করি? রোগে মরি, উঠিবার শক্তি নাই, ডাকিলেও কেউ আমার কথা শুনিবে না। তখন আমি আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাহিরে আসিয়া আপনার(নিজের) ঘরে আগুণ লাগাইয়া দিলাম। সকল লোক বুড়ি পুড়িয়া মরিল মনে করিয়া দৌড়িয়া আসিল। আমি তারপর কি হইল বিশেষ জানি না। কেবলমাত্র একবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কার কিছু হয় নি ত?’একজন লোক বলিল, ‘না, আমরাও আসিয়াছি আর বরফও ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।’ তারপর আর কিছু জানি না। কে যেন আমাকে এখানে আনিয়াছে।’ বুড়ির কথা শুনিয়া দরোয়ান-দেবতা স্বর্গে খবর দিলেন। আর দলে দলে দেবতারা আসিয়া ‘এসো এসো’ বলিয়া আদর করিয়া বুড়িকে স্বর্গের ভিতরে লইয়া চলিলেন। কিন্তু বুড়ি সমালোচকের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল। বলিল-‘ওর ভাই আমাকে বাড়ি করিয়া দিয়াছিল, আমার থাকিবার জায়গা ছিল না। ও মুখ কাল করিয়া ফিরিয়া যাইবে, আর আমি কোন প্রাণে তোমাদের সঙ্গে যাইব? আমার মনে বড় লাগে। আমাকে তোমরা স্বর্গে নিও না। এ বেচারা তাহা হইলে বড় কষ্ট পাইবে।’ তখন দেবতারা সমালোচককে-‘অলস! অপদার্থ! যা! বুড়ির জন্য তোকে স্বর্গে নিয়া যাওয়া হইল। তুই জীবনটা কেবল সমালোচনা করিয়াই কাটাইলি, ভাল কাজ কিছুই করিলি না। তোর মতন লোক আর এর পূর্বে স্বর্গে যায় নাই। দেবতারা তারপর বুড়ির সঙ্গে সমালোচককেও টানিয়া স্বর্গে নিয়া চলিলেন। সমালোচক হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। একবার মাত্র বলিল,‘টানিয়া লওয়া বুঝি তোমাদের অভ্যাস নাই? ভাল করিয়া টানা হইতেছে না। এমনি বুঝি টানে।’ ঢেঁকি যেখানে থাক্, তার ধান ভানা কাজ ঘোচে না। আমাদের সমালোচক ভায়া স্বর্গে গিয়াও খুঁত ধরিতে ব্যস্ত, আর কিইবা করে, একটা কাজ ত চাই? কতকগুলি ছেলে আছে, তাহারা কেবলই খুঁত ধরে; পরের দোষ দেখিয়া তাহার নিন্দা করার চেয়ে নিজের শোধরাইয়া পরের গুণ দেখা ভাল। ( উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১০ মে, ১৮৬৩ - ২০ ডিসেম্বর, ১৯১৫) বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। সন্দেশ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন যা পরে তার পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি তারই অমর সৃষ্টি। উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ (১৮৬৩ সালের ১০ মে) কিশোরগঞ্জ জেলার মসূয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত। তার পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন ও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। তার ডাকনাম ছিল শ্যামসুন্দর মুন্সী। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান। তার পৈত্রিক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তার পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভালো ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। একুশ বছর বয়সে বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ায় তার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময়কার সখা, সাথী, মুকুল ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তার লেখা প্রকাশ হতে সুরু হয়। প্রথমদিকের (যেমন সখা, ১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ।[১] তার পরে চিত্র অলঙ্করণযুক্ত গল্প প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়। ১৮৮৬ সালে ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়, এবং তখনকার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোরেরর সংসার জীবন শুরু হয়। উপেন্দ্রকিশোরের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল, এবং মেয়েরা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে তার প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হলেও মুদ্রণ সম্বন্ধে অতৃপ্ত উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন, এবং ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। এখানের একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। ১৯১১ সালে তিনি বড় ছেলে সুকুমারকে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্যে। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।)
ঘরবাড়ির নক্সা করিয়ে নিতে আসিবে, কত লোকের বাড়ি-ঘর বাঁধিয়া দিব। আমি একটা “দশজনের একজন” হইব। বলিস্ কি; আমার নামে একটা স্ট্রীট যদি না হয়, তখন দেখিস্।’ তৃতীয় ভ্রাতা-‘বিল্ডার, কন্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার সব বাজে লোক, তোরা হ’বি চিনির বলদ। আমি কি করিব জানিস্। আমি অন্যের কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করিতে যাইব কেন। সব কাজে আমার নিজের বুদ্ধি খাটিবে। সব নূতন ফ্যাসানে বাড়ি-ঘর করিব। আমার সব এমন হইবে, যাহা কেহ কখন দেখে নাই।’ শেষ ব্যক্তি উঠিয়া বলল-‘তোরা যাহাই করিস্ ভাই এমন কিছু করিতে পারিবি না, যাহার উপর আমার বক্তৃতা না চলিবে। উত্তম হইল; দেখ্ দেখি। তোরা যাহা করিবি, আমি তাহার দোষ ধরিব। আমার কাজের আর অভাব কি? চারি ভায়ের পরামর্শ ঠিক হইল। একজন ইঁটের কাজ করিয়া কিছু টাকা করিল। ইঁট দিয়া তাহার একটি বাড়ি হইল। তাছাড়া এক দুঃখিনী বুড়িকে ঐ ইঁট দিয়া আর একটি ঘর করিয়া দিল। কন্ট্রাক্টর ইত্যাদি মহাশয়ও কথামত কাজ করিলেন। মিউনিসিপ্যালটিকে খোঁচাইয়া নিজের নামে একটি স্ট্রীট পর্যন্ত কেমন করিয়া লইয়াছেন। তিনিও একটা কিছু হইয়াছেন। তৃতীয় বেচারা নূতন ধরনে বাড়ি করিতে দিয়া চাপা পড়িয়া মরিল। খুঁতধরা মহাশয়ের ত কথাই নাই। তাহার কাজ ফুরায়ই না। মরিবার সময় পর্যন্ত সে সন্তোষজনক রূপে, প্রশংসার সহিত কর্তব্য-কাজ করিয়া গেল। একদিন স্বর্গের দরজায় দারোয়ান-দেবতা বসিয়া রহিয়াছেন। সে প্রকাণ্ড দরজা। বিশ্বকর্মার হাতের তৈরি। বুঝিতেই ত পার, স্বয়ং বিশ্বকর্মা ঠাকুর যাহা করিয়াছেন সে কেমন সুন্দর। এত সুন্দর যে আর কি বলিব! দরজায় প্রকাণ্ড দুখানা কাচ লাগান। তাহার ভিতর দিয়া দরোয়ান-ঠাকুর কে আসিল দেখিতে পান। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তাহা করিতেছিলে না। অনেক কাল হইল স্বর্গে লোক আসে না,। তাই আজ-কালের ব্যস্ততা কিছু কম।দেবতা দরজা খুলিবার হীরার হ্যান্ডেলে হাত ঝুলাইয়া সোনার টুলে বসিয়া ঝিমাইতেছেন। এমন সময় কড়াৎ কড়াৎ করিয়া দরজার ঘা মারিবার শব্দ হইল। বাহির হইতে একজন লোক বলিতেছেন- ‘অনুগ্রহ করুন মহাশয়, আমি ভিতরে আসিতে প্রার্থনা করিতে পারি? দরজাগুলি ত মন্দ নয়। কিন্তু স্বর্গের দ্বার বন্ধ থাকিবে কেন? দরজাগুলি আরো বড় হওয়া উচিত।’ ‘তুই কেরে, পৃথিবীর লোক, ক্যাচ্ ক্যাচ্ করিয়া কথা কহিতেছিস্?’ ‘অত মোটা সুরে বলিতেছেন কেন?- আমি স্বর্গে যাইতে চাই।’ ‘বটে? তুই করিয়াছিস কে?’ ‘আমি খুঁত-ধরা কাজ করিয়াছি। আমার তিন ভাই যে কাজ করিয়াছে, তাহার সমস্ত দোষ আমার নোট বহিতে লিখিয়া আনিয়াছি। যে ইঁট পোড়াইয়াছিল, সে আর দুই মণ কয়লা কম খরচ করিলে সুরকিওয়ালা সহজেই খোয়া করিতে পারিতে। যার নামে স্ট্রীট হইয়াছে, সে এত রোগা যে অত বড় স্ট্রীট তাহার দরকার নাই। যে চাপা পড়িয়া মরিয়াছে- ’ ‘আরে থাম্ থাম। ও-সব কি কাজ? তুই নিজের হাতে কি করিয়াছিস্? ‘এই-সব নোট লিখিয়াছি।’ ‘দূর হ ব্যাটা, তুই কি আর কোন কাজই করিস্ নাই? কেবল দোষ ধরা কাজই করিয়াছিস্?’ ‘আর স্মৃতি পুস্তিকায় তাহা লিখিয়াছি।’ ‘যা, যা! তোর এখানে আসিবার হুকুম নাই।’ ‘আউ পচারিব কাঙ্কু, জগনাথঙ্কু,-‘ বলিয়া দারোয়ান দেবতা গান ধরিলেন। আমাদের সমালোচক দেখিলেন যে এত পথ খরচ, রেলভাড়া, গাড়িভাড়া করিয়া আসিয়াও কোন ফল পাইলেন না। বিরক্ত হইয়া মনে করিলেন যে, কাগজে লেখা উচিত ‘স্বর্গে ভালো অভ্যর্থনার বন্দোবস্ত নাই।’ গাড়ি পাইতে অনেক দেরি, সুতরাং ইত্যবসরে দরজার দোষগুলি টুকিয়া রাখিতে লাগিলেন। দরজার কথা শেষ হইলে, সাহেব দ্বারী-ঠাকুরের গানের এক মজার বর্ণনা লিখিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন যে, যে বুড়িকে তাহার ভাই ঘর করিয়া দিয়াছিল, সে আসিতেছে। তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘ও বুড়ি! তুই কেমন করিয়া আসিলি?’ ‘তাই ত বাপু, আমি ত কিছু জানি না। আমি দুঃখিনী বুড়ি, এমন ত কিছু করি নাই, যাহাতে এখানে আসিতে পারি।’ ‘তুই কি কোন কাজ করিস্ নাই? আমি ত সমালোচনা করিয়াছি।’ ‘আমার আর ত কিছুই মনে হয় না। তবে একদিন আমার বাড়ির কাছে পুকুরে জমা বরফের উপরে পাড়ার সকলে খেলা করিতে গিয়াছিল। যাইবার সময় আমাকে সকলেই দেখিয়া মিষ্টি কথা কহিয়া গেল। আমি ভয়ানক কাতর ছিলাম। কিছুকাল পরে দেখি, আকাশে একরকম মেঘ দেখা দিয়াছে। ওরূপ মেঘ আমার জন্মে আমি আর একবার দেখিছিয়ালাম। তখন দুই মিনিটে মধ্যে সমুদয় বরফ ফাটিয়া গিয়াছিল। আমার মনে বড় ভয় হইল। এখনই এতগুলি লোক ডুবিয়া মরিবে ভাবিয়া আমার চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। আমি কি করি? রোগে মরি, উঠিবার শক্তি নাই, ডাকিলেও কেউ আমার কথা শুনিবে না। তখন আমি আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাহিরে আসিয়া আপনার(নিজের) ঘরে আগুণ লাগাইয়া দিলাম। সকল লোক বুড়ি পুড়িয়া মরিল মনে করিয়া দৌড়িয়া আসিল। আমি তারপর কি হইল বিশেষ জানি না। কেবলমাত্র একবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কার কিছু হয় নি ত?’একজন লোক বলিল, ‘না, আমরাও আসিয়াছি আর বরফও ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।’ তারপর আর কিছু জানি না। কে যেন আমাকে এখানে আনিয়াছে।’ বুড়ির কথা শুনিয়া দরোয়ান-দেবতা স্বর্গে খবর দিলেন। আর দলে দলে দেবতারা আসিয়া ‘এসো এসো’ বলিয়া আদর করিয়া বুড়িকে স্বর্গের ভিতরে লইয়া চলিলেন। কিন্তু বুড়ি সমালোচকের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল। বলিল-‘ওর ভাই আমাকে বাড়ি করিয়া দিয়াছিল, আমার থাকিবার জায়গা ছিল না। ও মুখ কাল করিয়া ফিরিয়া যাইবে, আর আমি কোন প্রাণে তোমাদের সঙ্গে যাইব? আমার মনে বড় লাগে। আমাকে তোমরা স্বর্গে নিও না। এ বেচারা তাহা হইলে বড় কষ্ট পাইবে।’ তখন দেবতারা সমালোচককে-‘অলস! অপদার্থ! যা! বুড়ির জন্য তোকে স্বর্গে নিয়া যাওয়া হইল। তুই জীবনটা কেবল সমালোচনা করিয়াই কাটাইলি, ভাল কাজ কিছুই করিলি না। তোর মতন লোক আর এর পূর্বে স্বর্গে যায় নাই। দেবতারা তারপর বুড়ির সঙ্গে সমালোচককেও টানিয়া স্বর্গে নিয়া চলিলেন। সমালোচক হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। একবার মাত্র বলিল,‘টানিয়া লওয়া বুঝি তোমাদের অভ্যাস নাই? ভাল করিয়া টানা হইতেছে না। এমনি বুঝি টানে।’ ঢেঁকি যেখানে থাক্, তার ধান ভানা কাজ ঘোচে না। আমাদের সমালোচক ভায়া স্বর্গে গিয়াও খুঁত ধরিতে ব্যস্ত, আর কিইবা করে, একটা কাজ ত চাই? কতকগুলি ছেলে আছে, তাহারা কেবলই খুঁত ধরে; পরের দোষ দেখিয়া তাহার নিন্দা করার চেয়ে নিজের শোধরাইয়া পরের গুণ দেখা ভাল। ( উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১০ মে, ১৮৬৩ - ২০ ডিসেম্বর, ১৯১৫) বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। সন্দেশ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন যা পরে তার পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি তারই অমর সৃষ্টি। উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ (১৮৬৩ সালের ১০ মে) কিশোরগঞ্জ জেলার মসূয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত। তার পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন ও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। তার ডাকনাম ছিল শ্যামসুন্দর মুন্সী। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান। তার পৈত্রিক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তার পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভালো ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। একুশ বছর বয়সে বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ায় তার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময়কার সখা, সাথী, মুকুল ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তার লেখা প্রকাশ হতে সুরু হয়। প্রথমদিকের (যেমন সখা, ১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ।[১] তার পরে চিত্র অলঙ্করণযুক্ত গল্প প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়। ১৮৮৬ সালে ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়, এবং তখনকার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোরেরর সংসার জীবন শুরু হয়। উপেন্দ্রকিশোরের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল, এবং মেয়েরা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে তার প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হলেও মুদ্রণ সম্বন্ধে অতৃপ্ত উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন, এবং ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। এখানের একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। ১৯১১ সালে তিনি বড় ছেলে সুকুমারকে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্যে। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment