িহার। বাঁচবার প্রেরণা। সারাক্ষণ বুকে আগলে রাখে। মায়ের কোলই ডেভিডের দিনের দোলনা, রাতের বিছানা। চোখের আড়াল করতে চায় না এক পলক । মা-তো নয়- যেন অতন্ত্র প্রহরী। কিন্তু সংসারের কাজকম্ম বলেইও তো একটা বস্তু আছে, নাকি? কেবল আদরেই কি অন্নদানা জোটে? মা সেদিন ছেলেকে দোলনায় রেখে ঘুম পাড়ানি গান গায়। ‘আয়রে ঘুম আয় নেমে, খোকার চোখে যা থেমে।’ গানের ছন্দ-দোলায় দোলনা দুলতে থাকে। খোকাও আচ্ছন্ন হয় গভীর ঘুমে। মা চট্-জলদি বেরিয়ে পড়ে সামনের বাগানে। গৃহস্থালি কাজকম্ম তাড়াতাড়ি সারতে হবে। ফিরতে হবে ছেলের কাছে। নইলে ঘুম থেকে উঠে মা-কে না দেখতে পেয়ে জুড়ে দেবে তুলকালাম কাণ্ড। ঘর মাথায় তুলবে আহ্লাদি-আদুরে কান্নায়। একি! হঠাৎ ঘরে দাউ দাউ আগুন। বোঝা গেল না, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট নাকি ফায়ার প্লেস থেকে ছড়ালো আগুনটা। ঘরের ভেতরে ঘুমন্ত ডেভিড। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। তীব্র তাপে এগুনোর জো নেই। প্রতিবেশীরাও ভিড় করেছে বাড়ির আঙ্গিনায়। প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আগুন নেভানোর। তখন অব্দি ফায়ার সার্ভিসও এসে পৌঁছায়নি। এদিকে আগুনের তীব্রতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য মা জ্বলন্ত ঘরের দিকে ছুটে যায়। প্রতিবেশীরা চেঁচিয়ে ওঠে- ‘শোনো, ডেভিডের মা! ঘরে ঢুকবার চেষ্টা করো না। আগুনে পুড়ে খাক্ হয়ে যাবে।’ ডেভিডের মা কোনো বারণই মানে না। তার আর্তি-আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। আকাশ কেঁপে ওঠে রোদনে-বিলাপে। কয়েকজন তাকে জোর করে ধরে রাখতে চায়। না। সব চেষ্টাই বৃথা। নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। সন্তানের সোহাগের টানে ভেঙে যায় সব বাধার পাঁচিল। ঝাঁপ দেয় দাউ দাউ আগুনের কুণ্ডে। ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে। ছেলে তখনো অঘোর ঘুমে। চারপাশ থেকে দোলনার দিকে ধেয়ে আসছে লেলিহান শিখা। ডেভিডের মা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে ছেলেকে বুকে তুলে নেয়। দোলনার পাশে রাখা কম্বলে ডেভিডকে জড়িয়ে নেয় ক্ষিপ্র হস্তে। আগুনের কুণ্ড থেকে বের করে আনে ডেভিডকে। আহ্! মায়ের কী পরম সুখ। তার বুকের মানিক অক্ষত, নিরাপদ। ফায়ার সার্ভিসের সাইরেনে ঘুমঘোর কেটে যায় ডেভিডের। চোখ খুলে মায়ের মুখের দিকে ছড়িয়ে দেয় অবাক দৃষ্টি। ডাগর ডাগর চোখের ক্যামেরায় যেন মায়ের ছবি তুলছে। গাল কাঁপিয়ে ফিক্ করে হেসে ওঠে। মা ডেভিডকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে পরম মমতায়। চোখে বইতে থাকে ছেলেকে ফিরে পাবার আনন্দ-অশ্রু। হ্যাঁ। মায়ের মমতার কাছে পরাস্তই হয়েছে সর্বগ্রাসী আগুন। কিন্তু বিনিময়ে মাকে দিতে হয়েছে চড়া মূল্য। আগুন কেড়ে নিয়েছে তার শরীরের সকল সৌন্দর্য। মাথার সব চুল আগুনে পুড়ে একাকার। চামড়া পুড়ে কুঁচকে গেছে। চেহারা ঝলছে গেছে। হায়! সেই পোড়া দাগ নিয়েই মাকে বাঁচতে হয় সারাটা জীবন। এভাবেই দিন কেটে যায়। পিতৃহীন ডেভিডকে পরম যত্নে লালন পালন করে তার অগ্নিদগ্ধ মা। ভুলিয়ে রাখে বাবার অভাব। মা তার সকল সৌন্দর্য হারাবার সেই করুণ কাহিনীর কিছুই কোনোদিন মুখ ফুঠে বলেনি ছেলেকে - পাছে ছেলে কষ্ট পায়। মনের কষ্ট মনেই পুষে রাখে দরদী মা। দিনে দিনে ডেভিড বড় হতে থাকে। প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে ওঠে। মায়ের এমন বিচ্ছিরি চেহারাটা তাকে ভাবাতে শুরু করে। মনে মনে কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে ঘেন্নাও করে। ছি! এমন বিচ্ছিরি চেহারা মানুষের হয়! আবার ভাবে, থাক! চেহারায় পোড়া দাগ থাকে তো থাকুক। তাতে কী যায় আসে? তার তো আদরে কোনো কমতি নেই। কিন্তু সহপাঠীদের মাদের দেখলে মনটা আবার বিচলিত হয়। কতো সুন্দর ওদের মা! আর আমার মা? ইস্ ...ভাবা যায় না। এ দ্বন্দ্বের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে ডেভিডের ভাবনা। সেদিন শিক্ষিকা ক্লাসে এসেই বললেন, জানো তো, আজ মাদার্স ডে। স্পেশালি আজ আমাদের টপিক- ‘মা’। দেরি না করেই সুসান বলে ওঠে, মিস্, আমার মা এমন একটা ব্যাংক যেখানে আমি আমার সব কষ্টের কথা জমা রাখি। রবিন চাপা গলায় বলে, দুষ্টুমীর জন্য আমাকে শাস্তি দিলে আমি কাঁদতে শুরু করলে যে নিজেও কাঁদে- সে আমার মা। ওদিক থেকে গিবসনের মন্তব্য, যার সকল গল্পে আমিই রাজকুমার - সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে দৈত্যদানু বধ করে বীরের বেশে আমি যার কোলে ফিরে আসি, সেই আমার মা। পাশ থেকে জেসিকা বলে, আমি কিচ্ছুটি না বললেও আমার মুখের দিকে তাকিয়েই যে আমার মনের সব কথা ঠিকঠাক বুঝে যায়- আমার মা সে-ই। পেছন থেকে টম এন্টনি বলে ওঠে, মিস্, অপারেশনের পর যাকে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে আমি কান্না জুড়ে দিলে যে বলে, খোকা, কেঁদো না! আমার একটুও ব্যথা নেই- সেই আমার মা। এন্টনির এ কথা শেষ হতে না হতেই সামনের বেঞ্চির কোনায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা পুঁচকে জনি গলা ফাটিয়ে বলে ওঠে, দাঁত ব্রাশ করার সময় পেস্ট খেয়ে ফেললে যে ভীষণ বকে, সে-ই মা। ক্লাসশুদ্ধ সবাই হুহু করে হেসে ওঠে। ডেভিডের ঘোর কাটে। হকচকিয়ে যায়। তবুও চুপচাপ বসে থাকে। এবার হ্যারির মন্তব্য- মিস্, যে নিজের গায়ে ঠান্ডা লাগলে আমার গায়ে কম্বল ছড়িয়ে দেয়, সে-ই আমার মা। এভাবে ক্লাসের নির্ধারিত সময়ও ফুরিয়ে আসে। শিক্ষক বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি মা একেকজন স্বর্গদেবী। মা বিধাতার স্পেশাল গিফ্ট। একটি গল্প বলি, মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। একদিন স্বর্গোদ্যানে শিশুরা মেতে আছে মজার খেলায়। বিধাতাকে দেখে এক শিশু বলে ওঠে, আচ্ছা, আমার খেলার সাথীরা বলছে, আমাকে নাকি আজ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমি তো খুউব ছোট। আমি কেমন করে সেখানে থাকবো। এখানে তো অ্যাঞ্জেলরা আমার দেখভাল করে। বিধাতা বললেন, ভয় পেয়ো না। তোমার জন্যে সেখানেও একজন অ্যাঞ্জেল তোমার অপেক্ষায় আছেন। তোমার যত্ম-আত্মির এত্তটুকুন কমতি হবে না। শিশুটি বলে, এখানে তো আমি কিচ্ছুটি করি না। কেবল হেসে-খেলে, গান গেয়ে বেড়াই। বিধাতা বললেন, সেখানেও তোমার সকল কাজ ওই অ্যাঞ্জেলই করে দেবে। মজার মজার গল্প বলবে। সুরেলা গান শোনাবে। আমি তো পৃথিবীর ভাষা জানি না। অন্যদের কথা কেমন করে বুঝবো? শিশুর এ প্রশ্নের উত্তরে বিধাতা বললেন, তোমার ওই অ্যাঞ্জেল তোমাকে অনেক যত্ম করে, মধুর মধুর কথা শেখাবে। প্রাণের ভাষা শেখাবে পরম মমতায়। শিশুটি বলে, আমি তো তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইব। তখন আমি কেমন করে তা করব, বলো দেখি! বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেলই তোমাকে শিখিয়ে দেবে, কেমন করে হাত জোড় করে প্রার্থণা করতে হবে। আর, সেভাবেই তুমি আমার সঙ্গে প্রাণ ভরে কথা বলতে পারবে। আমিতো খুউব ছোট। আমাকে কে রক্ষা করবে? বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেলই তোমাকে রক্ষা করবে। তোমাকে রক্ষা করতে দরকার হলে সেই অ্যাঞ্জেল এমন কি তার জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিবে। শিশুটি বলল, তবুও তোমাকে দেখতে না পেলে আমার কিন্তু খুউব খারাপ লাগবে। আমি তোমাকে খুব মিস করব। বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেল সব সময় তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেবে। আমার কাছে আবার ফিরে আসার সঠিক পথ তোমাকে বাতলে দেবে। তুমি কখখনো পথ হারাবে না। তাছাড়া, আমি তো তোমার কাছে কাছেই থাকব। তোমাকে আমার চোখে চোখে রাখব। এমন সময় স্বর্গের প্রশান্ত ভাব ছাপিয়ে পৃথিবী থেকে ডাক আসে- এসো, হে সোনা মানিক, এসো। পৃথিবী তোমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাতে প্রস্তুত। শিশুটি উচ্চস্বরে বলে, হে বিধাতা! আমার মর্ত্য-যাত্রার সময় হলো। আমি যাচ্ছি। তুমি তো বলে গেলেনা- আমি আমার সেই অ্যাঞ্জেলকে কেমন করে চিনব? দয়া করে অন্তত তার নামটা তো বলে যাও! বিধাতা বললেন, তোমার সেই অ্যাঞ্জেলের নাম- ‘মা’। শিক্ষিকার গল্প বলা শেষ হয়। ক্লাসে বিরাজ করে আবেগময় অনুভূতি।কিন্তু ডেভিড ভাবলেষহীন। কটমট করে তাকায় শিক্ষকের দিকে। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে, অ্যাঁ, অ্যাঞ্জেল! আমার মা’র চেহারাটা দেখলে বুঝতে- অ্যাঞ্জেল নাকি ভূত! অসহ্য! অসহ্য! ঘুরে ফিরে তার মায়ের অগ্নিদগ্ধ চেহারাটাই ভেসে ওঠে ডেভিডের মনের আয়নায়। শিক্ষকের এতক্ষণের শিক্ষা বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না ক্ষ্যাপা ডেভিডের মনে। মায়ের প্রতি তার অবোধ ঘৃণা যেন মিশে আছে অস্থিমজ্জায়। একে দূর করে সাধ্যি কার। বুকে চাপা ক্ষোভ নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যায় ডেভিড। স্কুলের গন্ডি পার হয়। মায়ের প্রাণান্তকর চেষ্টা- ছেলে আরো পড়ুক। বিদ্বান হোক। বড় ডিগ্রি নিক্। শেষতক মায়ের স্বপ্ন পূরণ হয়। লেখাপড়া শেষে ডেভিড ভালো চাকরি পায়। টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, বিত্ত-বৈভব, যশ-খ্যাতি- কিছুরই কমতি নেই। টরেন্টো শহরে গিয়ে সংসার পাতে। আয়েশ আর সুখের সংসার। কিন্তু ডেভিড তার মাকে কোরোদিনও ভালো বাসতে পারেনি। কারণ এমন বিচ্ছিরি চেহারার একটা মহিলা তার মা- এটা ভাবতেই সে লজ্জা পায়। মায়ের অগোচরে অন্যদের কাছেও মন্তব্য করে- ন্যাড়ামাথাঅলা কেউ, যার কিনা গালে-মুখে এমন আগুনের স্যাঁকা দাগ- এমন একটা মানুষ কেমন করে আমার মা হয় -তাতো আমি ভাবতেই পারি না। উহ্ ! কী ভয়ানক! কী বিব্রতকর অবস্থা! ছেলের এ ধরনের অপ্রিয় মন্তব্য নিয়ে প্রতিবেশীরা প্রায়ই বলাবলি করে। একদিন মার কানেও কথাটা আসে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়। ছেলের এমন নিষ্ঠুর মন্তব্য মার বুকে শেলের মতো বিঁধে। ভাবে, আমার ব্যাপারে আমার ছেলের এমন হীন মানসিকতা? এ-ই কি আমার প্রতিদান! নিজের প্রতি নিজেরই করুণা হয়। শেষে ভাবে, থাক! ছেলেমানুষ। মন খারাপ করে আর কী হবে? একদিন শহরে যাবো। ছেলেকে সব খুলে বলব। আসল ঘটনাটা জানতে পারলে নিশ্চয়ই তার ভুল ভাঙবে। আমার এমন বিচ্ছিরি চেহারাটা-যে তাকে আগুন থেকে বাঁচানোরই ফল-তা জানতে পারলে খোকা আমার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীলই হবে। মুছে যাবে তার সব ক্ষোভ। মায়ের ত্যাগের কথা ভেবে খোকা তার মায়ের জন্য বরং গর্ববোধ করবে। ভাববে- আমার মা-ই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মা। আমার মায়ের তুল্য কোনো মা-ই নেই এ বিশ্ব সংসারে। এ ভেবে একদিন যাত্রা করে টরেন্টোর উদ্দেশে। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনা। বাসটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে। মাথায় ভীষণ চোট পেয়ে মা ঘটনাস্থলেই মারা যান। মায়ের এ আকস্মিক মৃত্যুর খবর ডেভিডের কাছে পৌঁছে। এতে মর্মাহত না হয়ে বরং ডেভিডকে খানিকটা খুশিই মনে হলো। এ যেন তার জন্যে এক স্বস্তিদায়ক খবর। সারাজীবন বয়ে বেড়ানো একটা চরম বিব্রতকর অবস্থার অবসান হলো। ভাবে, মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেও যদি বাড়ি না আসে- সমাজের কাছে মুখ রক্ষা হয় না। সংস্কার বলেও তো একটা বস্তু আছে। তাই দেরি না করে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করে ডেভিড। বাড়ি পৌঁছে দেখে ওঠোনে পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড়। সকলেই বিষন্ন। বিরাজ করছে শোকের ছায়া। মরদেহ সৎকারের প্রস্তুতি চলছে। ডেভিডের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হন্ হন্ করে ঢুকে যায় ঘরের ভেতর। সোনা-দানা, টাকা-কড়ি, দলিলপত্র কিংবা মূল্যবান অন্য কিছু যদি ঘরে পড়ে থাকে তাহলে তা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ঘরের এটা-সেটা উল্টে পাল্টে দেখে ডেভিড। অনেক দিন তো এ ঘরে আসা হয় না। কোথায় কী পড়ে আছে কে জানে! ও-দিকটায় পুরনো মলাটের বইয়ের মতো কিছু একটা চোখে পড়ে ডেভিডের। খানিকটা যত্মেই রাখা। ডেভিডের কৌতুহল বাড়ে। বইটা টেনে নেয়। অলস হাতে আনমনা হয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। দেখে মায়ের ডায়েরি। চোখ স্থির হয়ে যায় এক জায়গায়। মায়ের স্বহস্তে লেখা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০: আমি এতোটাই সুদর্শনা ছিলাম যে, আমাকে ‘মিস টরেন্টো সুন্দরী প্রতিযোগিতা’য় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ১৪ জানুয়ারি ১৯৮২: আমার স্বামী টনি গ্যাটসন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন আমার গর্ভে ছয় মাসের সন্তান ডেভিড। ২ জুলাই ১৯৮৩: আমাদের ঘরে হঠাৎ আগুন লাগে। আমি ঘুমন্ত শিশু ডেভিডকে সেই আগুনের মাঝখান থেকে নিরাপদে উদ্ধার করি। আমার সব চুল পুড়ে যায়। মাথার চামড়া ঝলছে যায়। চেহারা অগ্নিদগ্ধ হয়। ডায়েরিতে চোখ বুলাতে বুলাতে ডেভিডের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। বিষন্ন ডেভিড দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়। অনুতাপ করে। সে কতটা স্বার্থপর, তা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেয়। বিলাপে-আর্তনাদে আকাশ কাঁপিয়ে তোলে। কপাল চাপড়ায়। শিক্ষিত হলাম, মানুষ হলাম না। আমার মতো নির্বোধ আর কে আছে দুনিয়ায়! মনের পর্দায় ভেসে ওঠে স্কুলের মাদারর্স ডে’র সেই ক্লাশরুমটা। মা সম্পর্কে সহপাঠীদের আদুরে মন্তব্য আর শিক্ষকের গল্পটা কানে বাজে। মায়ের নিথর বুকে লুটিয়ে পড়ে ডেভিড। গলায় জড়িয়ে ধরে। মাকে বাহুর বাঁধনে বাঁধে। কিন্তু মায়ের সাড়া নেই। কোলের মাঝে নেই আর সেই আদরের উষ্ণতা। নেই মাতৃত্বের সেই মমতা-মহিমা। অবোধ ডেভিডকে প্রবোধ দেয়, কার সাধ্যি। ডেভিড কাঁদে, কাঁদে, আর কাঁদে। ফিরে পেতে চায় মাকে । কিন্তু হায়! এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক, অনেক দেরি। ডেভিডের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আজও ধ্বনিত হতে শুনি, হায়রে মা-- আমার মমতাময়ী মা! ...আমি তোর অপদার্থ সন্তান মা! ক্ষমার অযোগ্য আমার অপরাধ! হায়রে মা! হায়রে আমার জনম দুঃখিনী মা। (সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত কানাডার একটি গল্পের ভাবান্তর ‘জনম দুঃখিনী মা’, অ-সাম স্টরিজ, হার্ট-টাচিং মাদার্স ডে এসএমএস থেকে সংকলিত)
Saturday, December 13, 2014
জনম দুঃখিনী মা :Natun Barta
ডেভিডের জন্মের পর গ্যাটসন পরিবার যেন আনন্দ-জোয়ারে ভাসছে। অনেক দিন পর এ পরিবার একটা বাচ্চার মুখ দেখল। ঘর আলো করে রেখেছে নবজাত এ ফুটফুটে শিশুটি। আকুল হয়ে কেউ তুলে নেয় কোলে। কেউ আবার ব্যাকুল হয়ে থাকে একটু আদর করবার সুযোগের আশায়। শিশুতো নয় যেন সোহাগ-সোনার খনি। আর ডেভিডের মা? তার তো আনন্দের সীমা পরিসীমাই নেই। বাবাহারা এ ছেলেই তার জীবনের একমাত্র সম্বল। চোখের তারা। হৃদয়ের স্পন্দন। সাত রাজার ধন। মমতার মণ
িহার। বাঁচবার প্রেরণা। সারাক্ষণ বুকে আগলে রাখে। মায়ের কোলই ডেভিডের দিনের দোলনা, রাতের বিছানা। চোখের আড়াল করতে চায় না এক পলক । মা-তো নয়- যেন অতন্ত্র প্রহরী। কিন্তু সংসারের কাজকম্ম বলেইও তো একটা বস্তু আছে, নাকি? কেবল আদরেই কি অন্নদানা জোটে? মা সেদিন ছেলেকে দোলনায় রেখে ঘুম পাড়ানি গান গায়। ‘আয়রে ঘুম আয় নেমে, খোকার চোখে যা থেমে।’ গানের ছন্দ-দোলায় দোলনা দুলতে থাকে। খোকাও আচ্ছন্ন হয় গভীর ঘুমে। মা চট্-জলদি বেরিয়ে পড়ে সামনের বাগানে। গৃহস্থালি কাজকম্ম তাড়াতাড়ি সারতে হবে। ফিরতে হবে ছেলের কাছে। নইলে ঘুম থেকে উঠে মা-কে না দেখতে পেয়ে জুড়ে দেবে তুলকালাম কাণ্ড। ঘর মাথায় তুলবে আহ্লাদি-আদুরে কান্নায়। একি! হঠাৎ ঘরে দাউ দাউ আগুন। বোঝা গেল না, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট নাকি ফায়ার প্লেস থেকে ছড়ালো আগুনটা। ঘরের ভেতরে ঘুমন্ত ডেভিড। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। তীব্র তাপে এগুনোর জো নেই। প্রতিবেশীরাও ভিড় করেছে বাড়ির আঙ্গিনায়। প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আগুন নেভানোর। তখন অব্দি ফায়ার সার্ভিসও এসে পৌঁছায়নি। এদিকে আগুনের তীব্রতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য মা জ্বলন্ত ঘরের দিকে ছুটে যায়। প্রতিবেশীরা চেঁচিয়ে ওঠে- ‘শোনো, ডেভিডের মা! ঘরে ঢুকবার চেষ্টা করো না। আগুনে পুড়ে খাক্ হয়ে যাবে।’ ডেভিডের মা কোনো বারণই মানে না। তার আর্তি-আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। আকাশ কেঁপে ওঠে রোদনে-বিলাপে। কয়েকজন তাকে জোর করে ধরে রাখতে চায়। না। সব চেষ্টাই বৃথা। নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। সন্তানের সোহাগের টানে ভেঙে যায় সব বাধার পাঁচিল। ঝাঁপ দেয় দাউ দাউ আগুনের কুণ্ডে। ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে। ছেলে তখনো অঘোর ঘুমে। চারপাশ থেকে দোলনার দিকে ধেয়ে আসছে লেলিহান শিখা। ডেভিডের মা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে ছেলেকে বুকে তুলে নেয়। দোলনার পাশে রাখা কম্বলে ডেভিডকে জড়িয়ে নেয় ক্ষিপ্র হস্তে। আগুনের কুণ্ড থেকে বের করে আনে ডেভিডকে। আহ্! মায়ের কী পরম সুখ। তার বুকের মানিক অক্ষত, নিরাপদ। ফায়ার সার্ভিসের সাইরেনে ঘুমঘোর কেটে যায় ডেভিডের। চোখ খুলে মায়ের মুখের দিকে ছড়িয়ে দেয় অবাক দৃষ্টি। ডাগর ডাগর চোখের ক্যামেরায় যেন মায়ের ছবি তুলছে। গাল কাঁপিয়ে ফিক্ করে হেসে ওঠে। মা ডেভিডকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে পরম মমতায়। চোখে বইতে থাকে ছেলেকে ফিরে পাবার আনন্দ-অশ্রু। হ্যাঁ। মায়ের মমতার কাছে পরাস্তই হয়েছে সর্বগ্রাসী আগুন। কিন্তু বিনিময়ে মাকে দিতে হয়েছে চড়া মূল্য। আগুন কেড়ে নিয়েছে তার শরীরের সকল সৌন্দর্য। মাথার সব চুল আগুনে পুড়ে একাকার। চামড়া পুড়ে কুঁচকে গেছে। চেহারা ঝলছে গেছে। হায়! সেই পোড়া দাগ নিয়েই মাকে বাঁচতে হয় সারাটা জীবন। এভাবেই দিন কেটে যায়। পিতৃহীন ডেভিডকে পরম যত্নে লালন পালন করে তার অগ্নিদগ্ধ মা। ভুলিয়ে রাখে বাবার অভাব। মা তার সকল সৌন্দর্য হারাবার সেই করুণ কাহিনীর কিছুই কোনোদিন মুখ ফুঠে বলেনি ছেলেকে - পাছে ছেলে কষ্ট পায়। মনের কষ্ট মনেই পুষে রাখে দরদী মা। দিনে দিনে ডেভিড বড় হতে থাকে। প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে ওঠে। মায়ের এমন বিচ্ছিরি চেহারাটা তাকে ভাবাতে শুরু করে। মনে মনে কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে ঘেন্নাও করে। ছি! এমন বিচ্ছিরি চেহারা মানুষের হয়! আবার ভাবে, থাক! চেহারায় পোড়া দাগ থাকে তো থাকুক। তাতে কী যায় আসে? তার তো আদরে কোনো কমতি নেই। কিন্তু সহপাঠীদের মাদের দেখলে মনটা আবার বিচলিত হয়। কতো সুন্দর ওদের মা! আর আমার মা? ইস্ ...ভাবা যায় না। এ দ্বন্দ্বের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে ডেভিডের ভাবনা। সেদিন শিক্ষিকা ক্লাসে এসেই বললেন, জানো তো, আজ মাদার্স ডে। স্পেশালি আজ আমাদের টপিক- ‘মা’। দেরি না করেই সুসান বলে ওঠে, মিস্, আমার মা এমন একটা ব্যাংক যেখানে আমি আমার সব কষ্টের কথা জমা রাখি। রবিন চাপা গলায় বলে, দুষ্টুমীর জন্য আমাকে শাস্তি দিলে আমি কাঁদতে শুরু করলে যে নিজেও কাঁদে- সে আমার মা। ওদিক থেকে গিবসনের মন্তব্য, যার সকল গল্পে আমিই রাজকুমার - সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে দৈত্যদানু বধ করে বীরের বেশে আমি যার কোলে ফিরে আসি, সেই আমার মা। পাশ থেকে জেসিকা বলে, আমি কিচ্ছুটি না বললেও আমার মুখের দিকে তাকিয়েই যে আমার মনের সব কথা ঠিকঠাক বুঝে যায়- আমার মা সে-ই। পেছন থেকে টম এন্টনি বলে ওঠে, মিস্, অপারেশনের পর যাকে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে আমি কান্না জুড়ে দিলে যে বলে, খোকা, কেঁদো না! আমার একটুও ব্যথা নেই- সেই আমার মা। এন্টনির এ কথা শেষ হতে না হতেই সামনের বেঞ্চির কোনায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা পুঁচকে জনি গলা ফাটিয়ে বলে ওঠে, দাঁত ব্রাশ করার সময় পেস্ট খেয়ে ফেললে যে ভীষণ বকে, সে-ই মা। ক্লাসশুদ্ধ সবাই হুহু করে হেসে ওঠে। ডেভিডের ঘোর কাটে। হকচকিয়ে যায়। তবুও চুপচাপ বসে থাকে। এবার হ্যারির মন্তব্য- মিস্, যে নিজের গায়ে ঠান্ডা লাগলে আমার গায়ে কম্বল ছড়িয়ে দেয়, সে-ই আমার মা। এভাবে ক্লাসের নির্ধারিত সময়ও ফুরিয়ে আসে। শিক্ষক বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি মা একেকজন স্বর্গদেবী। মা বিধাতার স্পেশাল গিফ্ট। একটি গল্প বলি, মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। একদিন স্বর্গোদ্যানে শিশুরা মেতে আছে মজার খেলায়। বিধাতাকে দেখে এক শিশু বলে ওঠে, আচ্ছা, আমার খেলার সাথীরা বলছে, আমাকে নাকি আজ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমি তো খুউব ছোট। আমি কেমন করে সেখানে থাকবো। এখানে তো অ্যাঞ্জেলরা আমার দেখভাল করে। বিধাতা বললেন, ভয় পেয়ো না। তোমার জন্যে সেখানেও একজন অ্যাঞ্জেল তোমার অপেক্ষায় আছেন। তোমার যত্ম-আত্মির এত্তটুকুন কমতি হবে না। শিশুটি বলে, এখানে তো আমি কিচ্ছুটি করি না। কেবল হেসে-খেলে, গান গেয়ে বেড়াই। বিধাতা বললেন, সেখানেও তোমার সকল কাজ ওই অ্যাঞ্জেলই করে দেবে। মজার মজার গল্প বলবে। সুরেলা গান শোনাবে। আমি তো পৃথিবীর ভাষা জানি না। অন্যদের কথা কেমন করে বুঝবো? শিশুর এ প্রশ্নের উত্তরে বিধাতা বললেন, তোমার ওই অ্যাঞ্জেল তোমাকে অনেক যত্ম করে, মধুর মধুর কথা শেখাবে। প্রাণের ভাষা শেখাবে পরম মমতায়। শিশুটি বলে, আমি তো তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইব। তখন আমি কেমন করে তা করব, বলো দেখি! বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেলই তোমাকে শিখিয়ে দেবে, কেমন করে হাত জোড় করে প্রার্থণা করতে হবে। আর, সেভাবেই তুমি আমার সঙ্গে প্রাণ ভরে কথা বলতে পারবে। আমিতো খুউব ছোট। আমাকে কে রক্ষা করবে? বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেলই তোমাকে রক্ষা করবে। তোমাকে রক্ষা করতে দরকার হলে সেই অ্যাঞ্জেল এমন কি তার জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিবে। শিশুটি বলল, তবুও তোমাকে দেখতে না পেলে আমার কিন্তু খুউব খারাপ লাগবে। আমি তোমাকে খুব মিস করব। বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেল সব সময় তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেবে। আমার কাছে আবার ফিরে আসার সঠিক পথ তোমাকে বাতলে দেবে। তুমি কখখনো পথ হারাবে না। তাছাড়া, আমি তো তোমার কাছে কাছেই থাকব। তোমাকে আমার চোখে চোখে রাখব। এমন সময় স্বর্গের প্রশান্ত ভাব ছাপিয়ে পৃথিবী থেকে ডাক আসে- এসো, হে সোনা মানিক, এসো। পৃথিবী তোমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাতে প্রস্তুত। শিশুটি উচ্চস্বরে বলে, হে বিধাতা! আমার মর্ত্য-যাত্রার সময় হলো। আমি যাচ্ছি। তুমি তো বলে গেলেনা- আমি আমার সেই অ্যাঞ্জেলকে কেমন করে চিনব? দয়া করে অন্তত তার নামটা তো বলে যাও! বিধাতা বললেন, তোমার সেই অ্যাঞ্জেলের নাম- ‘মা’। শিক্ষিকার গল্প বলা শেষ হয়। ক্লাসে বিরাজ করে আবেগময় অনুভূতি।কিন্তু ডেভিড ভাবলেষহীন। কটমট করে তাকায় শিক্ষকের দিকে। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে, অ্যাঁ, অ্যাঞ্জেল! আমার মা’র চেহারাটা দেখলে বুঝতে- অ্যাঞ্জেল নাকি ভূত! অসহ্য! অসহ্য! ঘুরে ফিরে তার মায়ের অগ্নিদগ্ধ চেহারাটাই ভেসে ওঠে ডেভিডের মনের আয়নায়। শিক্ষকের এতক্ষণের শিক্ষা বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না ক্ষ্যাপা ডেভিডের মনে। মায়ের প্রতি তার অবোধ ঘৃণা যেন মিশে আছে অস্থিমজ্জায়। একে দূর করে সাধ্যি কার। বুকে চাপা ক্ষোভ নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যায় ডেভিড। স্কুলের গন্ডি পার হয়। মায়ের প্রাণান্তকর চেষ্টা- ছেলে আরো পড়ুক। বিদ্বান হোক। বড় ডিগ্রি নিক্। শেষতক মায়ের স্বপ্ন পূরণ হয়। লেখাপড়া শেষে ডেভিড ভালো চাকরি পায়। টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, বিত্ত-বৈভব, যশ-খ্যাতি- কিছুরই কমতি নেই। টরেন্টো শহরে গিয়ে সংসার পাতে। আয়েশ আর সুখের সংসার। কিন্তু ডেভিড তার মাকে কোরোদিনও ভালো বাসতে পারেনি। কারণ এমন বিচ্ছিরি চেহারার একটা মহিলা তার মা- এটা ভাবতেই সে লজ্জা পায়। মায়ের অগোচরে অন্যদের কাছেও মন্তব্য করে- ন্যাড়ামাথাঅলা কেউ, যার কিনা গালে-মুখে এমন আগুনের স্যাঁকা দাগ- এমন একটা মানুষ কেমন করে আমার মা হয় -তাতো আমি ভাবতেই পারি না। উহ্ ! কী ভয়ানক! কী বিব্রতকর অবস্থা! ছেলের এ ধরনের অপ্রিয় মন্তব্য নিয়ে প্রতিবেশীরা প্রায়ই বলাবলি করে। একদিন মার কানেও কথাটা আসে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়। ছেলের এমন নিষ্ঠুর মন্তব্য মার বুকে শেলের মতো বিঁধে। ভাবে, আমার ব্যাপারে আমার ছেলের এমন হীন মানসিকতা? এ-ই কি আমার প্রতিদান! নিজের প্রতি নিজেরই করুণা হয়। শেষে ভাবে, থাক! ছেলেমানুষ। মন খারাপ করে আর কী হবে? একদিন শহরে যাবো। ছেলেকে সব খুলে বলব। আসল ঘটনাটা জানতে পারলে নিশ্চয়ই তার ভুল ভাঙবে। আমার এমন বিচ্ছিরি চেহারাটা-যে তাকে আগুন থেকে বাঁচানোরই ফল-তা জানতে পারলে খোকা আমার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীলই হবে। মুছে যাবে তার সব ক্ষোভ। মায়ের ত্যাগের কথা ভেবে খোকা তার মায়ের জন্য বরং গর্ববোধ করবে। ভাববে- আমার মা-ই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মা। আমার মায়ের তুল্য কোনো মা-ই নেই এ বিশ্ব সংসারে। এ ভেবে একদিন যাত্রা করে টরেন্টোর উদ্দেশে। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনা। বাসটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে। মাথায় ভীষণ চোট পেয়ে মা ঘটনাস্থলেই মারা যান। মায়ের এ আকস্মিক মৃত্যুর খবর ডেভিডের কাছে পৌঁছে। এতে মর্মাহত না হয়ে বরং ডেভিডকে খানিকটা খুশিই মনে হলো। এ যেন তার জন্যে এক স্বস্তিদায়ক খবর। সারাজীবন বয়ে বেড়ানো একটা চরম বিব্রতকর অবস্থার অবসান হলো। ভাবে, মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেও যদি বাড়ি না আসে- সমাজের কাছে মুখ রক্ষা হয় না। সংস্কার বলেও তো একটা বস্তু আছে। তাই দেরি না করে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করে ডেভিড। বাড়ি পৌঁছে দেখে ওঠোনে পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড়। সকলেই বিষন্ন। বিরাজ করছে শোকের ছায়া। মরদেহ সৎকারের প্রস্তুতি চলছে। ডেভিডের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হন্ হন্ করে ঢুকে যায় ঘরের ভেতর। সোনা-দানা, টাকা-কড়ি, দলিলপত্র কিংবা মূল্যবান অন্য কিছু যদি ঘরে পড়ে থাকে তাহলে তা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ঘরের এটা-সেটা উল্টে পাল্টে দেখে ডেভিড। অনেক দিন তো এ ঘরে আসা হয় না। কোথায় কী পড়ে আছে কে জানে! ও-দিকটায় পুরনো মলাটের বইয়ের মতো কিছু একটা চোখে পড়ে ডেভিডের। খানিকটা যত্মেই রাখা। ডেভিডের কৌতুহল বাড়ে। বইটা টেনে নেয়। অলস হাতে আনমনা হয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। দেখে মায়ের ডায়েরি। চোখ স্থির হয়ে যায় এক জায়গায়। মায়ের স্বহস্তে লেখা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০: আমি এতোটাই সুদর্শনা ছিলাম যে, আমাকে ‘মিস টরেন্টো সুন্দরী প্রতিযোগিতা’য় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ১৪ জানুয়ারি ১৯৮২: আমার স্বামী টনি গ্যাটসন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন আমার গর্ভে ছয় মাসের সন্তান ডেভিড। ২ জুলাই ১৯৮৩: আমাদের ঘরে হঠাৎ আগুন লাগে। আমি ঘুমন্ত শিশু ডেভিডকে সেই আগুনের মাঝখান থেকে নিরাপদে উদ্ধার করি। আমার সব চুল পুড়ে যায়। মাথার চামড়া ঝলছে যায়। চেহারা অগ্নিদগ্ধ হয়। ডায়েরিতে চোখ বুলাতে বুলাতে ডেভিডের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। বিষন্ন ডেভিড দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়। অনুতাপ করে। সে কতটা স্বার্থপর, তা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেয়। বিলাপে-আর্তনাদে আকাশ কাঁপিয়ে তোলে। কপাল চাপড়ায়। শিক্ষিত হলাম, মানুষ হলাম না। আমার মতো নির্বোধ আর কে আছে দুনিয়ায়! মনের পর্দায় ভেসে ওঠে স্কুলের মাদারর্স ডে’র সেই ক্লাশরুমটা। মা সম্পর্কে সহপাঠীদের আদুরে মন্তব্য আর শিক্ষকের গল্পটা কানে বাজে। মায়ের নিথর বুকে লুটিয়ে পড়ে ডেভিড। গলায় জড়িয়ে ধরে। মাকে বাহুর বাঁধনে বাঁধে। কিন্তু মায়ের সাড়া নেই। কোলের মাঝে নেই আর সেই আদরের উষ্ণতা। নেই মাতৃত্বের সেই মমতা-মহিমা। অবোধ ডেভিডকে প্রবোধ দেয়, কার সাধ্যি। ডেভিড কাঁদে, কাঁদে, আর কাঁদে। ফিরে পেতে চায় মাকে । কিন্তু হায়! এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক, অনেক দেরি। ডেভিডের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আজও ধ্বনিত হতে শুনি, হায়রে মা-- আমার মমতাময়ী মা! ...আমি তোর অপদার্থ সন্তান মা! ক্ষমার অযোগ্য আমার অপরাধ! হায়রে মা! হায়রে আমার জনম দুঃখিনী মা। (সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত কানাডার একটি গল্পের ভাবান্তর ‘জনম দুঃখিনী মা’, অ-সাম স্টরিজ, হার্ট-টাচিং মাদার্স ডে এসএমএস থেকে সংকলিত)
িহার। বাঁচবার প্রেরণা। সারাক্ষণ বুকে আগলে রাখে। মায়ের কোলই ডেভিডের দিনের দোলনা, রাতের বিছানা। চোখের আড়াল করতে চায় না এক পলক । মা-তো নয়- যেন অতন্ত্র প্রহরী। কিন্তু সংসারের কাজকম্ম বলেইও তো একটা বস্তু আছে, নাকি? কেবল আদরেই কি অন্নদানা জোটে? মা সেদিন ছেলেকে দোলনায় রেখে ঘুম পাড়ানি গান গায়। ‘আয়রে ঘুম আয় নেমে, খোকার চোখে যা থেমে।’ গানের ছন্দ-দোলায় দোলনা দুলতে থাকে। খোকাও আচ্ছন্ন হয় গভীর ঘুমে। মা চট্-জলদি বেরিয়ে পড়ে সামনের বাগানে। গৃহস্থালি কাজকম্ম তাড়াতাড়ি সারতে হবে। ফিরতে হবে ছেলের কাছে। নইলে ঘুম থেকে উঠে মা-কে না দেখতে পেয়ে জুড়ে দেবে তুলকালাম কাণ্ড। ঘর মাথায় তুলবে আহ্লাদি-আদুরে কান্নায়। একি! হঠাৎ ঘরে দাউ দাউ আগুন। বোঝা গেল না, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট নাকি ফায়ার প্লেস থেকে ছড়ালো আগুনটা। ঘরের ভেতরে ঘুমন্ত ডেভিড। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। তীব্র তাপে এগুনোর জো নেই। প্রতিবেশীরাও ভিড় করেছে বাড়ির আঙ্গিনায়। প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আগুন নেভানোর। তখন অব্দি ফায়ার সার্ভিসও এসে পৌঁছায়নি। এদিকে আগুনের তীব্রতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য মা জ্বলন্ত ঘরের দিকে ছুটে যায়। প্রতিবেশীরা চেঁচিয়ে ওঠে- ‘শোনো, ডেভিডের মা! ঘরে ঢুকবার চেষ্টা করো না। আগুনে পুড়ে খাক্ হয়ে যাবে।’ ডেভিডের মা কোনো বারণই মানে না। তার আর্তি-আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। আকাশ কেঁপে ওঠে রোদনে-বিলাপে। কয়েকজন তাকে জোর করে ধরে রাখতে চায়। না। সব চেষ্টাই বৃথা। নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। সন্তানের সোহাগের টানে ভেঙে যায় সব বাধার পাঁচিল। ঝাঁপ দেয় দাউ দাউ আগুনের কুণ্ডে। ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে। ছেলে তখনো অঘোর ঘুমে। চারপাশ থেকে দোলনার দিকে ধেয়ে আসছে লেলিহান শিখা। ডেভিডের মা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে ছেলেকে বুকে তুলে নেয়। দোলনার পাশে রাখা কম্বলে ডেভিডকে জড়িয়ে নেয় ক্ষিপ্র হস্তে। আগুনের কুণ্ড থেকে বের করে আনে ডেভিডকে। আহ্! মায়ের কী পরম সুখ। তার বুকের মানিক অক্ষত, নিরাপদ। ফায়ার সার্ভিসের সাইরেনে ঘুমঘোর কেটে যায় ডেভিডের। চোখ খুলে মায়ের মুখের দিকে ছড়িয়ে দেয় অবাক দৃষ্টি। ডাগর ডাগর চোখের ক্যামেরায় যেন মায়ের ছবি তুলছে। গাল কাঁপিয়ে ফিক্ করে হেসে ওঠে। মা ডেভিডকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে পরম মমতায়। চোখে বইতে থাকে ছেলেকে ফিরে পাবার আনন্দ-অশ্রু। হ্যাঁ। মায়ের মমতার কাছে পরাস্তই হয়েছে সর্বগ্রাসী আগুন। কিন্তু বিনিময়ে মাকে দিতে হয়েছে চড়া মূল্য। আগুন কেড়ে নিয়েছে তার শরীরের সকল সৌন্দর্য। মাথার সব চুল আগুনে পুড়ে একাকার। চামড়া পুড়ে কুঁচকে গেছে। চেহারা ঝলছে গেছে। হায়! সেই পোড়া দাগ নিয়েই মাকে বাঁচতে হয় সারাটা জীবন। এভাবেই দিন কেটে যায়। পিতৃহীন ডেভিডকে পরম যত্নে লালন পালন করে তার অগ্নিদগ্ধ মা। ভুলিয়ে রাখে বাবার অভাব। মা তার সকল সৌন্দর্য হারাবার সেই করুণ কাহিনীর কিছুই কোনোদিন মুখ ফুঠে বলেনি ছেলেকে - পাছে ছেলে কষ্ট পায়। মনের কষ্ট মনেই পুষে রাখে দরদী মা। দিনে দিনে ডেভিড বড় হতে থাকে। প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে ওঠে। মায়ের এমন বিচ্ছিরি চেহারাটা তাকে ভাবাতে শুরু করে। মনে মনে কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে ঘেন্নাও করে। ছি! এমন বিচ্ছিরি চেহারা মানুষের হয়! আবার ভাবে, থাক! চেহারায় পোড়া দাগ থাকে তো থাকুক। তাতে কী যায় আসে? তার তো আদরে কোনো কমতি নেই। কিন্তু সহপাঠীদের মাদের দেখলে মনটা আবার বিচলিত হয়। কতো সুন্দর ওদের মা! আর আমার মা? ইস্ ...ভাবা যায় না। এ দ্বন্দ্বের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে ডেভিডের ভাবনা। সেদিন শিক্ষিকা ক্লাসে এসেই বললেন, জানো তো, আজ মাদার্স ডে। স্পেশালি আজ আমাদের টপিক- ‘মা’। দেরি না করেই সুসান বলে ওঠে, মিস্, আমার মা এমন একটা ব্যাংক যেখানে আমি আমার সব কষ্টের কথা জমা রাখি। রবিন চাপা গলায় বলে, দুষ্টুমীর জন্য আমাকে শাস্তি দিলে আমি কাঁদতে শুরু করলে যে নিজেও কাঁদে- সে আমার মা। ওদিক থেকে গিবসনের মন্তব্য, যার সকল গল্পে আমিই রাজকুমার - সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে দৈত্যদানু বধ করে বীরের বেশে আমি যার কোলে ফিরে আসি, সেই আমার মা। পাশ থেকে জেসিকা বলে, আমি কিচ্ছুটি না বললেও আমার মুখের দিকে তাকিয়েই যে আমার মনের সব কথা ঠিকঠাক বুঝে যায়- আমার মা সে-ই। পেছন থেকে টম এন্টনি বলে ওঠে, মিস্, অপারেশনের পর যাকে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে আমি কান্না জুড়ে দিলে যে বলে, খোকা, কেঁদো না! আমার একটুও ব্যথা নেই- সেই আমার মা। এন্টনির এ কথা শেষ হতে না হতেই সামনের বেঞ্চির কোনায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা পুঁচকে জনি গলা ফাটিয়ে বলে ওঠে, দাঁত ব্রাশ করার সময় পেস্ট খেয়ে ফেললে যে ভীষণ বকে, সে-ই মা। ক্লাসশুদ্ধ সবাই হুহু করে হেসে ওঠে। ডেভিডের ঘোর কাটে। হকচকিয়ে যায়। তবুও চুপচাপ বসে থাকে। এবার হ্যারির মন্তব্য- মিস্, যে নিজের গায়ে ঠান্ডা লাগলে আমার গায়ে কম্বল ছড়িয়ে দেয়, সে-ই আমার মা। এভাবে ক্লাসের নির্ধারিত সময়ও ফুরিয়ে আসে। শিক্ষক বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি মা একেকজন স্বর্গদেবী। মা বিধাতার স্পেশাল গিফ্ট। একটি গল্প বলি, মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। একদিন স্বর্গোদ্যানে শিশুরা মেতে আছে মজার খেলায়। বিধাতাকে দেখে এক শিশু বলে ওঠে, আচ্ছা, আমার খেলার সাথীরা বলছে, আমাকে নাকি আজ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমি তো খুউব ছোট। আমি কেমন করে সেখানে থাকবো। এখানে তো অ্যাঞ্জেলরা আমার দেখভাল করে। বিধাতা বললেন, ভয় পেয়ো না। তোমার জন্যে সেখানেও একজন অ্যাঞ্জেল তোমার অপেক্ষায় আছেন। তোমার যত্ম-আত্মির এত্তটুকুন কমতি হবে না। শিশুটি বলে, এখানে তো আমি কিচ্ছুটি করি না। কেবল হেসে-খেলে, গান গেয়ে বেড়াই। বিধাতা বললেন, সেখানেও তোমার সকল কাজ ওই অ্যাঞ্জেলই করে দেবে। মজার মজার গল্প বলবে। সুরেলা গান শোনাবে। আমি তো পৃথিবীর ভাষা জানি না। অন্যদের কথা কেমন করে বুঝবো? শিশুর এ প্রশ্নের উত্তরে বিধাতা বললেন, তোমার ওই অ্যাঞ্জেল তোমাকে অনেক যত্ম করে, মধুর মধুর কথা শেখাবে। প্রাণের ভাষা শেখাবে পরম মমতায়। শিশুটি বলে, আমি তো তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইব। তখন আমি কেমন করে তা করব, বলো দেখি! বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেলই তোমাকে শিখিয়ে দেবে, কেমন করে হাত জোড় করে প্রার্থণা করতে হবে। আর, সেভাবেই তুমি আমার সঙ্গে প্রাণ ভরে কথা বলতে পারবে। আমিতো খুউব ছোট। আমাকে কে রক্ষা করবে? বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেলই তোমাকে রক্ষা করবে। তোমাকে রক্ষা করতে দরকার হলে সেই অ্যাঞ্জেল এমন কি তার জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিবে। শিশুটি বলল, তবুও তোমাকে দেখতে না পেলে আমার কিন্তু খুউব খারাপ লাগবে। আমি তোমাকে খুব মিস করব। বিধাতা বললেন, সেই অ্যাঞ্জেল সব সময় তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেবে। আমার কাছে আবার ফিরে আসার সঠিক পথ তোমাকে বাতলে দেবে। তুমি কখখনো পথ হারাবে না। তাছাড়া, আমি তো তোমার কাছে কাছেই থাকব। তোমাকে আমার চোখে চোখে রাখব। এমন সময় স্বর্গের প্রশান্ত ভাব ছাপিয়ে পৃথিবী থেকে ডাক আসে- এসো, হে সোনা মানিক, এসো। পৃথিবী তোমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাতে প্রস্তুত। শিশুটি উচ্চস্বরে বলে, হে বিধাতা! আমার মর্ত্য-যাত্রার সময় হলো। আমি যাচ্ছি। তুমি তো বলে গেলেনা- আমি আমার সেই অ্যাঞ্জেলকে কেমন করে চিনব? দয়া করে অন্তত তার নামটা তো বলে যাও! বিধাতা বললেন, তোমার সেই অ্যাঞ্জেলের নাম- ‘মা’। শিক্ষিকার গল্প বলা শেষ হয়। ক্লাসে বিরাজ করে আবেগময় অনুভূতি।কিন্তু ডেভিড ভাবলেষহীন। কটমট করে তাকায় শিক্ষকের দিকে। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে, অ্যাঁ, অ্যাঞ্জেল! আমার মা’র চেহারাটা দেখলে বুঝতে- অ্যাঞ্জেল নাকি ভূত! অসহ্য! অসহ্য! ঘুরে ফিরে তার মায়ের অগ্নিদগ্ধ চেহারাটাই ভেসে ওঠে ডেভিডের মনের আয়নায়। শিক্ষকের এতক্ষণের শিক্ষা বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না ক্ষ্যাপা ডেভিডের মনে। মায়ের প্রতি তার অবোধ ঘৃণা যেন মিশে আছে অস্থিমজ্জায়। একে দূর করে সাধ্যি কার। বুকে চাপা ক্ষোভ নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যায় ডেভিড। স্কুলের গন্ডি পার হয়। মায়ের প্রাণান্তকর চেষ্টা- ছেলে আরো পড়ুক। বিদ্বান হোক। বড় ডিগ্রি নিক্। শেষতক মায়ের স্বপ্ন পূরণ হয়। লেখাপড়া শেষে ডেভিড ভালো চাকরি পায়। টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, বিত্ত-বৈভব, যশ-খ্যাতি- কিছুরই কমতি নেই। টরেন্টো শহরে গিয়ে সংসার পাতে। আয়েশ আর সুখের সংসার। কিন্তু ডেভিড তার মাকে কোরোদিনও ভালো বাসতে পারেনি। কারণ এমন বিচ্ছিরি চেহারার একটা মহিলা তার মা- এটা ভাবতেই সে লজ্জা পায়। মায়ের অগোচরে অন্যদের কাছেও মন্তব্য করে- ন্যাড়ামাথাঅলা কেউ, যার কিনা গালে-মুখে এমন আগুনের স্যাঁকা দাগ- এমন একটা মানুষ কেমন করে আমার মা হয় -তাতো আমি ভাবতেই পারি না। উহ্ ! কী ভয়ানক! কী বিব্রতকর অবস্থা! ছেলের এ ধরনের অপ্রিয় মন্তব্য নিয়ে প্রতিবেশীরা প্রায়ই বলাবলি করে। একদিন মার কানেও কথাটা আসে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়। ছেলের এমন নিষ্ঠুর মন্তব্য মার বুকে শেলের মতো বিঁধে। ভাবে, আমার ব্যাপারে আমার ছেলের এমন হীন মানসিকতা? এ-ই কি আমার প্রতিদান! নিজের প্রতি নিজেরই করুণা হয়। শেষে ভাবে, থাক! ছেলেমানুষ। মন খারাপ করে আর কী হবে? একদিন শহরে যাবো। ছেলেকে সব খুলে বলব। আসল ঘটনাটা জানতে পারলে নিশ্চয়ই তার ভুল ভাঙবে। আমার এমন বিচ্ছিরি চেহারাটা-যে তাকে আগুন থেকে বাঁচানোরই ফল-তা জানতে পারলে খোকা আমার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীলই হবে। মুছে যাবে তার সব ক্ষোভ। মায়ের ত্যাগের কথা ভেবে খোকা তার মায়ের জন্য বরং গর্ববোধ করবে। ভাববে- আমার মা-ই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মা। আমার মায়ের তুল্য কোনো মা-ই নেই এ বিশ্ব সংসারে। এ ভেবে একদিন যাত্রা করে টরেন্টোর উদ্দেশে। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনা। বাসটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে। মাথায় ভীষণ চোট পেয়ে মা ঘটনাস্থলেই মারা যান। মায়ের এ আকস্মিক মৃত্যুর খবর ডেভিডের কাছে পৌঁছে। এতে মর্মাহত না হয়ে বরং ডেভিডকে খানিকটা খুশিই মনে হলো। এ যেন তার জন্যে এক স্বস্তিদায়ক খবর। সারাজীবন বয়ে বেড়ানো একটা চরম বিব্রতকর অবস্থার অবসান হলো। ভাবে, মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেও যদি বাড়ি না আসে- সমাজের কাছে মুখ রক্ষা হয় না। সংস্কার বলেও তো একটা বস্তু আছে। তাই দেরি না করে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করে ডেভিড। বাড়ি পৌঁছে দেখে ওঠোনে পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড়। সকলেই বিষন্ন। বিরাজ করছে শোকের ছায়া। মরদেহ সৎকারের প্রস্তুতি চলছে। ডেভিডের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হন্ হন্ করে ঢুকে যায় ঘরের ভেতর। সোনা-দানা, টাকা-কড়ি, দলিলপত্র কিংবা মূল্যবান অন্য কিছু যদি ঘরে পড়ে থাকে তাহলে তা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ঘরের এটা-সেটা উল্টে পাল্টে দেখে ডেভিড। অনেক দিন তো এ ঘরে আসা হয় না। কোথায় কী পড়ে আছে কে জানে! ও-দিকটায় পুরনো মলাটের বইয়ের মতো কিছু একটা চোখে পড়ে ডেভিডের। খানিকটা যত্মেই রাখা। ডেভিডের কৌতুহল বাড়ে। বইটা টেনে নেয়। অলস হাতে আনমনা হয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। দেখে মায়ের ডায়েরি। চোখ স্থির হয়ে যায় এক জায়গায়। মায়ের স্বহস্তে লেখা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০: আমি এতোটাই সুদর্শনা ছিলাম যে, আমাকে ‘মিস টরেন্টো সুন্দরী প্রতিযোগিতা’য় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ১৪ জানুয়ারি ১৯৮২: আমার স্বামী টনি গ্যাটসন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন আমার গর্ভে ছয় মাসের সন্তান ডেভিড। ২ জুলাই ১৯৮৩: আমাদের ঘরে হঠাৎ আগুন লাগে। আমি ঘুমন্ত শিশু ডেভিডকে সেই আগুনের মাঝখান থেকে নিরাপদে উদ্ধার করি। আমার সব চুল পুড়ে যায়। মাথার চামড়া ঝলছে যায়। চেহারা অগ্নিদগ্ধ হয়। ডায়েরিতে চোখ বুলাতে বুলাতে ডেভিডের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। বিষন্ন ডেভিড দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়। অনুতাপ করে। সে কতটা স্বার্থপর, তা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেয়। বিলাপে-আর্তনাদে আকাশ কাঁপিয়ে তোলে। কপাল চাপড়ায়। শিক্ষিত হলাম, মানুষ হলাম না। আমার মতো নির্বোধ আর কে আছে দুনিয়ায়! মনের পর্দায় ভেসে ওঠে স্কুলের মাদারর্স ডে’র সেই ক্লাশরুমটা। মা সম্পর্কে সহপাঠীদের আদুরে মন্তব্য আর শিক্ষকের গল্পটা কানে বাজে। মায়ের নিথর বুকে লুটিয়ে পড়ে ডেভিড। গলায় জড়িয়ে ধরে। মাকে বাহুর বাঁধনে বাঁধে। কিন্তু মায়ের সাড়া নেই। কোলের মাঝে নেই আর সেই আদরের উষ্ণতা। নেই মাতৃত্বের সেই মমতা-মহিমা। অবোধ ডেভিডকে প্রবোধ দেয়, কার সাধ্যি। ডেভিড কাঁদে, কাঁদে, আর কাঁদে। ফিরে পেতে চায় মাকে । কিন্তু হায়! এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক, অনেক দেরি। ডেভিডের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আজও ধ্বনিত হতে শুনি, হায়রে মা-- আমার মমতাময়ী মা! ...আমি তোর অপদার্থ সন্তান মা! ক্ষমার অযোগ্য আমার অপরাধ! হায়রে মা! হায়রে আমার জনম দুঃখিনী মা। (সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত কানাডার একটি গল্পের ভাবান্তর ‘জনম দুঃখিনী মা’, অ-সাম স্টরিজ, হার্ট-টাচিং মাদার্স ডে এসএমএস থেকে সংকলিত)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment